Ads

ভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জ

।। শহীদ সিরাজী ।।

হাদিসটা পড়তেই রাগিব সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। দুশ্চিন্তা এসে চিন্তার জায়গাকে দখল করলো। ভাবতে লাগলেন এখন তার কি করা উচিৎ। একদিকে ছেলের ভবিষৎ অন্যদিকে একজন পিতার দায়িত্ব। যে কোন একটা বেছে নিতে হবে। কোনটা নিবে সে!

ছেলে অনার্স শেষ করেছে। এখন এমএস করবে। চাকরির যে আকাল এমএস করলে হয়তো সুযোগ তৈরি হতেও পারে। এতদিন পরিকল্পনা ছিল দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করবে। এখন সকলে বলছে দেশে নয় বরং বিদেশে যাও এক ঢিলে দুই পাখি মারো। এমএস করা হবে চাকরিও পেয়ে যাবে। শুনে ছেলে এখন একপায়ে খাঁড়া।

বাবা রাগিব সাহেব একটা বহুজাতিক কোম্পানির জিএম ছিলেন। দীর্ঘদিন চাকরি শেষে অবসর নিয়েছেন। অবসরে সকলে যা করেন তাই করছেন। মসজিদের সাথে সম্পর্ক বাড়িয়েছেন। সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত জামাতে নামায পড়ছেন। কুরআন হাদিস পড়ছেন। ইউটিউবে সব খ্যাতনামা শায়খদের নানাবিধ বয়ান শুনে শুনে সময় কাটাচ্ছেন। এছাড়াও জুমলিংকে কুরআনের স্টাডি ক্লাসে নিয়মিত অংশগ্রহন করছেন। মন্দ কাটছে না সময়।

আগে কিছুটা ব্যস্ততা থাকলেও উদাসীনতাও কম ছিলো না। এখন দুটোয় কমেছে। প্রতিদিন সকালে হাঁটাহাঁটি করে শরীরকে ঠিকঠাক রাখার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে নিয়মিত কুরআন-হাদিস অধ্যয়ন করে ও বিশ্বের সব ইসলামী স্কলারদের বই পড়ে আত্মাকে খাবারটাও দিচ্ছেন। শরীরে ও মনে যেন বার্ধক্য বাসা বাঁধতে না পারে; তার কসরত করছেন। আজকে কুরআন পড়া শেষে হাদিসগ্রন্থ হাতে নিয়েছেন। পড়বেন। গতদিনের পড়া হাদিসের পরেরটা পড়তে শুরু করলেন তিনি।

ইবনু আব্বাস (রা) বর্ণনা করেছেন, নবিজি (সা) বলেছেন, ‘যে লোক আজান শুনেও ওজর ছাড়া জামাতে নামায আদায় থেকে বিরত থাকে; সে অন্য কোথাও নামায পড়লে কবুল হবে না। সাহাবাগণ জিজ্ঞেসা করলেন-ওজর কি? নবিজি বললেন- ‘ভয়-ভীতি অথবা অসুস্থতা।’ (আবু দাউদ, বায়হাকি)

হাদিস পড়েই দুশ্চিন্তায় পড়লেন রাগিব সাহেব। দুশ্চিন্তা ছেলেকে নিয়ে। অনেকদিন থেকে একটা কষ্ট মনে তার বাসা বেঁধে আছে। আজ আরও যোগ হলো। কয়েকদিন আগের একটা ঘটনা তাকে বেশ চিন্তায় ফেলেছিল। সেদিন নামায পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে বন্ধু ড. এহসানের সঙ্গে হাঁটছিলেন। তিনি হঠাৎ প্রশ্ন করলেন,

“ভাই! আপনার ছেলেকে তো দেখছি না। বেশ ভাল ছেলে! তবে নিয়মিত নয় মসজিদে।”

বেশ লজ্জা পেয়েছিলেন রাগিব সাহেব। কি বলবেন তিনি! বলেছিলেন, উদাসীনতা

“হ্যাঁ ভাই! একটু অলসও।”

বিষয়টা মনের ভেতর কাঁটার মত খচখচ করে বিঁধছে এখনো। ছেলের কল্যাণ চায় না এমন বাবা আছে না-কি? বাবা রাগিব সাহেব চান ছেলে নিয়মিত মসজিদে যাবে নামায পড়বে। অথচ তার উদাসীনতা দেখে তিনি যেমন হতাশ হচ্ছেন তেমন  কষ্টের ক্ষরণও বেড়ে চলেছে। স্ত্রীকে বলছেন কিন্তু লাভ হয়নি। বলেছে, তোমার ছেলে তোমারই দায়িত্ব। এতে কষ্টটা আরও বেড়েছে। অনেক চেষ্টা করেছেন। যখন মসজিদে ডেকেছেন তখন সাথে গেছে। না ডাকলে যায়নি। আসলে যখন বোঝানো হয় তখন কাজ হয় কিন্তু না বললে হয় না।

এমন সময় তার বিদেশে যাওয়া নিয়ে চলছে গবেষণা। চলছে সুন্দর আগামির স্বপ্ন বোনা। স্বজনেরা স্বপ্ন দেখাচ্ছে। তারা বুঝাচ্ছে; দেশে কিছু করতে না পেরে অনেকে বিদেশে গিয়ে সেটেলড হয়েছে। বাবা রাগিব সাহেবের দুশ্চিন্তা এখানেই।

আজকের হাদিস পাঠ তার চিন্তার জগতকে একটা ধাক্কা দিয়েছে। যাকে না বললে মসজিদে যায় না, সে বিদেশে কি করবে তা বুঝতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। বিদেশে পরিবেশের কারনে নামায ছেড়ে দেবে না ; এ গ্যারান্টি কে দেবে? পৃথিবীর সামান্য সুখের জন্য তখন তো তার পরকাল ধ্বংস হয়ে যাবে। আর এ কাজে বাবা হিসাবে তাকেই ভূমিকা রাখতে হবে? এসব দুশ্চিন্তা তার মনের ভেতরে ডালপালা বিস্তার করেই চললো।

আরও পড়ুন-পরীক্ষার জীবন জীবনের পরীক্ষা

এর কয়েকদিন পর ফজর শেষে বের হয়ে রাগিব সাহেব মর্নিংওয়াক করছেন। পথে দেখা হয়ে গেল বন্ধু ড. মাহবুবের সাথে। মনে মনে তাকেই খুঁজছিলেন তিনি। কাকতালীয় ব্যাপার যেন! ড. মাহবুব বেশ ফ্রেন্ডলি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। কথা বলতে বলতে পাশাপাশি হাঁটছেন তারা।

রাগিব সাহেব ভাবলেন তাঁর সাথে শেয়ার করি না কেন বিষয়টা। তিনি সজ্জন যদি কোন ভাল পরামর্শ দেন। ভাবতে ভাবতে সব বলেই ফেললেন। শুনে ড মাহবুব বললেন,

“আপনি নিজেই একজন প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ ব্যক্তি। সিদ্ধান্ত আপনার। সবই আপনার জানা। তবে পরিবেশকে আমি গুরুত্ব দেই। যে পরিবেশে আপনার ছেলে থাকবে বা যাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তা আপনার জানা উচিৎ। সকলেরই ভালো পরিবেশে যেমন থাকা দরকার তেমন ভাল মানুষের সাথেই বন্ধুত্ব করা উচিৎ। ইরানের বিখ্যাত মনীষী শেখ সাদীর একটা কথা আছে- “সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’।

কথাটা একদম ঠিক। ভালো বন্ধু জীবনকে সুখে সাজিয়ে দেয় আর খারাপ বন্ধু জীবনকে নরকে পরিণত করে। এখন আপনার ছেলের সবকিছুই তো আপনি জানেন। এর আলোকে সিদ্ধান্ত নিন। ড. মাহবুব সাহেবের পরামর্শ পরিষ্কার। শুনে রাগিব সাহেব দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারলেন না। যে ছেলে তাদের আদর-স্নেহে বড় হয়েছে সে বিদেশে গিয়ে কেমন থাকবে সেটাই তাকে ভাবাচ্ছে। বাবা হিসাবে তিনি সান্তনা পেতেন যদি সে নামাযে আান্তরিক হতো। অভ্যস্ত হলে বিদেশে ভাল থাকতো। কারণ তিনি জানেন,

‘ইন্নাস সালাতা তানহা আনিল

ফাহশা ই ওয়াল মুনকার।’

‘নিশ্চয়ই! নামাজ মানুষকে খারাপ কাজ

থেকে বিরত রাখে।’

এসব ভাবতে ভাবতে তার মাথায় হঠাৎ একটা চিন্তা উঁকি মারলো। কাউকে কিছু না বলে তিনি সময় ও সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগলেন। দেশের বাইরে যাওয়া চিন্তা যখন মাথায় এসেছে তখন শুভাকাঙ্খীরা কতদিন মাথায় তা বয়ে বেড়াবে! সুতরাং দেরি না করে পরিবারের সদস্যরা আবার পরামর্শে বসেছে। অনেকক্ষণ আলোচনা হলো এখন বাবা হ্যাঁ বললেই যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করতে পারে। অবশেষে রাগিব সাহেব মুখ খুললেন। বললেন, “তোমরা ভালো চাও বলে সোহানকে বিদেশে পাঠাতে বলছো। কিন্তু এতে ভালো হবে তার কোন গ্যারাণ্টি আছে? না তোমরা কেউ দিতে পারবে?”

কথা বুঝতে না পেরে সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। আসলে তিনি কি বলতে চাচ্ছেন? বাড়ির কর্তা ব্যক্তির কথার উপরে কে কথা বলবে, সকলে চুপ করো আছে। শেষে রাগিব সাহেব সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কি তোমরা কেউ বুঝতে পারছো না, তাইতো?”

বাড়ির কর্তা হলেও রাগিব সাহেব কোন কিছু চাপিয়ে দেন না। সকলের কথা শোনেন। শুধু পরামর্শ দেন না, গ্রহনও করেন। সবার কথা শুনে পরে সিদ্ধান্ত দেন। একারনে কেউ কথা বলতে সংকোচ করে না।

বাড়ির গিন্নি বললেন,”যা বলতে চাও, খোলাসা করে বলো! এরা ছোট মানুষ তোমার কথা কিভাবে বুঝবে?”

তিনি বললেন, “দেখো! আমি ও’র বিদেশে যাবার ব্যাপারে না করছি না। তবে বিদেশে যাওয়া তার কল্যাণের হবে কি-না; সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান।”

মা অবাক হয়েছেন। জিজ্ঞেস করলেন, “কেন সন্দেহ হচ্ছে? কিসের সন্দেহ?”

বাবা রাগিব সাহেব বললেন,” এখানে লাভ-ক্ষতির একটা হিসাব আছে। আমরা ছোট লাভ পাওয়ার আশা করছি, কিন্তু বড় ক্ষতির কথা চিন্তা করছি না।”

এবার মা স্বামীর কথায় বিরক্ত হয়ে বললো, কি সব ধাঁধার মত কথা বলছো?

তিনি স্ত্রীকে বললেন, “দেখো! তোমার ছেলে বিদেশে গিয়ে হয়তো ডিগ্রী নিতে পারবে, চাকরী পেয়ে আয়-উপার্জনও করবে। এসব মানছি। তবে সে নিয়মিত নামায পড়বে কিনা তার গ্যারান্টি কে দেবে। অথচ মুসলমান ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্য হলো নামায। ও’ যদি নামাযের ব্যাপারে সচেতন হতো আমাদের চিন্তা হতো না। ! এ নামাযই তাকে রক্ষা করতো। এত বলার পরও যখন তাকে ঠিকমত সচেতন করতে পারছি না, তখন বিদেশে কি ঠিক থাকবে? ভিন্ন পরিবেশ ও গার্ডিয়ান না থাকলে কি সে নামায ঠিকঠিক মত পড়বে ? তখন কি বড় ক্ষতির মধ্যে পড়বে না?”

মা বললেন, “সোহান তো নামায পড়ে! তবে সন্দেহ কেন?”

বাবা বললেন, “পড়ে তবে নিয়মিত নয়, মসজিদে জামাতে নয়।”

নামায পড়ার গুরুত্ব তারা আগেও শুনেছে তবে এমন ভাবে চিন্তা করেনি। যৌক্তিক কথা! গুরুত্বও বুঝতে পারছে। তাদের বলার কিছু নেই! সকলের দিকে তাকিয়ে রাগিব সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের কারো কি কোন কথা বা পরামর্শ আছে?”

সকলে ভাবছে, তিনি যা বলেছেন ঠিক বলেছেন। তবে কেউ ভাবেনি তাদের এমন কথা শুনতে হবে। কিছুটা কিংকর্তব্যবিমুঢ। হঠাৎ কোন পরামর্শ তাদের মাথায় আসছে না। তাছাড়া বাড়ির কর্তার উচিৎ কথার সামনে তারা কি বলবে বুঝতে পারছে না। সকলেই চুপ করে আছে। তবে মা কথা বললেন, “তাহলে কি সোহানের বিদেশ যাওয়া হবে না?”

রাগিব সাহেব বিজ্ঞ ব্যক্তি। বুঝতে পারছেন গিন্নির কথা, বুঝতে পারছেন তাদের অবস্থা। একটু হেসে বললেন, “এটা সোহানের উপর নির্ভর করবে।”

আবার ধাঁধা! তবুও সকলে আশা পেলো যেন। জানতে চাইলো, “কি রকম?”

রাগিব সাহেব এবার পরিবেশ হালকা করে বললেন, “তোমাদের একটা ফর্মুলা দেবো। তোমরা সকলে সোহানকে রাজি করাও।”

সকলে উৎসুক। বললো, “কি ফর্মুলা বলুন।”

“সোহান সিদ্ধান্ত নিয়ে ৪০ দিনের একটা কোর্স করবে?”

সকলে অবাক! জিজ্ঞেস করলো,

“৪০ দিনের কোর্স!”

“হ্যাঁ! সোহান একটানা ৪০ দিন মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত জামাতে নামায পড়বে!”

সকলে ভেবেছিল নিশ্চয় IELTS এর মত কোন কোর্স করার কথা বলা হবে। শুনে সকলে আকাশ থেকে পড়লো। তবে তারা যেমন চমৎকৃত হলো তেমন খুশিও হলো। বিশেষ করে সোহানের মা বেশ খুশি হলেন। বললেন,

“ভাল বুদ্ধি বের করেছো। একটানা ৪০ দিন মসজিদে জামাতে নামায পড়লে নিশ্চয় ভাল ফল পাওয়া যাবে। সে নামাযে যেমন অভ্যস্ত হয়ে পড়বে, তেমন আল্লাহর রহমতও লাভ করতে পারবে। কেউ আল্লাহর দিকে হেঁটে গেলে আল্লাহ তার দিকে দৌড়িয়ে আসেন।”

যাকে নিয়ে এতকিছু সেই সোহানও সবকিছু শুনলো। বুঝতে পারছে বাবা তার দিকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। অবশ্য তার ভালোর জন্যই।

এতদিন তো এভাবে ভাবেনি। এখন সে বড় হয়েছে, আল্লাহর নির্দেশকে যেমন মানতে হবে তেমন বাবা-মার ইচ্ছাও পুরণ করতে হবে। দোয়া নিতে হবে। আর অলসতা নয়, এ চ্যালেঞ্জ গ্রহন করতে হবে। নিজেকে বদলে ফেলতে হবে। তবে কিভাবে তা করবে সেসব নিয়ে সে পরিকল্পনা করতে লাগলো।

 

লেখকঃ ইসলামী লেখক এবং প্রাক্তন ব্যাংকার, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

 

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়ন মূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিয়ে ফেসবুকে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন।প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন