Ads

এখনও রাত্রি নামে

।।  তাহনিয়া তরিক ।।

সেদিন ভিসি স্যারের সাথে এসে অক্সিজেন মাস্ক দেয়া নিথর চেহারাটা দেখে যে অনুভূতি হয়েছিল আজ আবার পরিপাটি কেবিনে দাঁড়িয়েও সেই অনুভূতিটা ফিরে আসছে ডক্টর ফৌজিয়ার। এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার মাথায় হাত রাখলেন। চুলে হাত বুলালেন। চেহারার ক্ষতগুলো এখনো স্পষ্ট। শুকায়নি ওগুলো। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। ফুলের তোড়া আর ফল-হরলিক্স এর প্যাকেট গুলো বেডসাইডে সাজিয়ে রাখল ড.তনিমা। অন্যরা কথা বলছে মেয়েটার বাবা বিশিষ্ট শিল্পপতি শফিক চৌধুরীর সাথে। আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো মোহনা নামের মেয়েটা। হাসার চেষ্টা করলেন ডক্টর ফৌজিয়া-‘ মোহনা কেমন লাগছে এখন’? তার হাতে হাত রাখলো মেয়েটা-‘ ম্যাম’! চোখের কোন গড়িয়ে পানি পড়লো বালিশে। মেরুদন্ডে আবার শিরশিরে ভাব টের পেলেন একটা। প্রচন্ড অনুভব করছেন মস্তিষ্কে ক্রমশ টান পড়ছে সুতোয়। আরো আরো গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।

হঠাৎ অন্ধকার হয়ে এলো চারপাশ। দু:সহ আওয়াজ চারপাশে। অসহ্য যন্ত্রণা। “না না”- চিৎকার করে আবার সেন্স হারালো মোহনা। মাত্রই বালিশে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলেন ওকে। মেয়ের বুকে আছড়ে পড়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন মিসেস শিলা চৌধুরী। ডিউটি ডাক্তার ছুটে এলেন দ্রুত। দু’ঘন্টা পরে ছোট বোন নিশি এসে শিলা চৌধুরীকে জোর করে বাসায় পাঠাল। ঘুমের ইনজেকশন দেওয়ার মোহনা এখন ঘুমাচ্ছে।

ড্রাইভার সুমন নামিয়ে দিয়ে গেল রোজ গার্ডেনের সুদৃশ্য ফটকে। ময়নার মা দরজা খুলে দিতেই দ্রুত পায়ে শিলা চৌধুরী  ঢুকলেন নিজের সাজানো ফ্ল্যাটে। পাঁচদিন পর নিজের জগতে ফেরা। ভেবেছিলেন একটা হট শাওয়ার নিয়ে খানিক ঘুমিয়ে নিবেন। কিন্তু মাখন কোমল শয্যাও তার পাঁচ দিনের রাত জাগা চোখে নিদ্রার রেশ টানতে পারল না। পায়ে পায়ে লিভিং এ এসে দাঁড়ালেন। বিশাল কাঁচের জানালা পথে ভেসে আসছে লেকের পানি ছোঁয়া নরম বাতাস। হালকা বাতাসে এপাশ-ওপাশ দুলছে দেওয়ালে ঝোলানো পোট্রেট গুলো। মোহনার সদ্য কেনা সুদৃশ্য শোপিস স্টান্ড আর বর্ণিল ঝাড়বাতি জানান দিচ্ছে নিজেদের জৌলুশ। তার দিকে তাকিয়ে হুহু করে উঠলো বুকটা।২৫০০ স্কয়ার ফিটের বিশাল বাসাটাকে এ মূহুর্তে পুরোই শূন্য মনে হল শিলা চৌধুরীর কাছে। মোহনার কলোধ্বনি ছাড়া পৃথিবীটাই মূল্যহীন শিলা চৌধুরির কাছে। মেয়ে কি আর কখনো আগের মত হতে পারবে? পায়ে পায়ে মেয়ের রুমের দরজায় এসে দাঁড়ান? এখানে দাড়িয়ে সেদিন সকালে বিদায় নিয়েছিল মোহনা। বলেছিল ফিরতে রাত হবে। রাত পেরিয়ে নতুন সূর্য উঠেছিল। ফেরেনি মোহনা। তারপর….! গা কেঁপে উঠলো তার। ড্রেসিং টেবিলের ওপর এ মাসের শুরু থেকেই কেনা প্রসাধনীর সারি। এ দোকান সে দোকান ঘুরে পছন্দ করা ড্রেসগুলোর প্যাকেট পড়ে আছে এলোপাতাড়ি। তার নিজের পছন্দ করা সাত হাজার টাকার লাল কমলা লং ড্রেসটা মোহনা চয়েজ করেছিল ওই দিনের জন্য।

তারপর সারা রাত ফোন বন্ধ। বিভীষিকাময় কতগুলো মূহুর্ত! অত:পর……! গত চারটাদিন কতবার আল্লাহকে ডেকেছেন??-ভাবেন শিলা চৌধুরী। আইসিইউর দরজার কাছে ঠায় বসেছিলেন তসবি হাতে। অতঃপর কাল বিকেলে চোখ মেলে তাকায় তার মোহনা। ‘থ্যাংকস গড’ – বলে খুশিতে ডক্টরদের মিষ্টি বিলি করেন মোহনার বাবা শফিক চৌধুরী। এতিমখানায় দুটো ছাগল দেবার মানত করে ফেলেন শিলা চৌধুরী নিজেই। কিন্তু থেকে থেকে চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে তার আদরের আত্মজা। ওকি পাগল হয়ে যাবে? তার বুকের মানিকের জীবন কি এখানেই থেমে যাবে?  আর কখনো কি ছন্দ ফিরবে না তার সাজানো পরিবারে? একটা ডাস্টার দিয়ে কি সবকিছু মুছে ফেলা যাবে? ভাবতে ভাবতে নিজেই যেন পাগল হয়ে যাচ্ছেন শিলা চৌধুরী।

দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভাঙছেন ডক্টর ফৌজিয়া। ম্যাডামকে দেখে সালাম দিয়ে সরে দাঁড়ালো সিঁড়িতে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েরা। প্রচন্ড গুরুগম্ভীর আর মিতভাষী হিসাবে ক্যাম্পাসে পরিচিত আছে ডক্টর ফৌজিয়ার। এখন মনটা পরে আছে গত সপ্তাহে। সেদিন ফোর্থ ইয়ারের ক্লাস শেষে আগামী দিনের করণীয় বলছিলেন। মাথা নাড়ালো কয়েকজন- ‘ম্যাডাম কালকে তো ক্লাস করবোনা।’ ‘কেন?কি সমস্যা’- ভুরু কুঁচকে স্টুডেন্টদের দিকে তাকলেন। ‘ কাল তো ফোরটিন্থ ফেব্রুয়ারী ম্যাডাম।’ – কয়েকজন বলে উঠেছিল সমস্বরে। গাড়ি হাঁকিয়ে আসা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানগুলোর কন্ঠে দুঃখের ছোঁয়াহীন হুল্লোড়। ক’মিনিট থমকে ছাত্র-ছাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন ডক্টর ফৌজিয়া। তারপর চেপে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলেছিলেন-‘ ভালোবাসা কি একদিনের জিনিস? ট্রু লাভের জন্য কি কোন দিন লাগে? প্যারাডক্স! এভরিথিং ইজ প্যারাডক্স!- ধীরে ধীরে মাথা নেড়েছিলেন। উঠে এসেছিল ক্লাস ছেড়ে। সেদিন ওটুকু কথা বলে কেন রেখে দিয়েছিলেন? কেন আরেকটু আগবাড়িয়ে বুঝাতে গেলেন না ছেলেমেয়েগুলোকে?- একটা চাপা অপরাধবোধ নাড়া দিয়ে যাচ্ছে ডক্টর ফৌজিয়াকে। বাসায় ফিরেও স্থির হতে পারলেন না ডক্টর ফৌজিয়া। বিশাল খালি ফ্ল্যাটে পায়চারি করলেন কয়েকবার। মোহনার যন্ত্রণাক্লিষ্ট চেহারাটা সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে তার চারপাশে। কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছেন না।আগামীকাল ভাষা দিবসের আলোচনা সভা আছে। লেকচার গোছানোর ঝামেলা নেই শুধু এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেয়ে শুয়ে পড়লেন। ম্যাডামের চেহারা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে রইল রহিমা। এরপর একসময় রান্নাঘর গুছিয়ে, দরজাগুলো সব চেক করে শুতে চলে গেল সেও।

‘যাক মেয়েটা তাহলে বেঁচে গেল।’-কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র প্রফেসর ডঃ শামীম। ‘হ্যাঁ স্যার আমরা তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আসলে ওর বাবা-মার ভাগ্য।’- অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড. তনিমা এসে বসলো সোফায়। টিচার্স লাউঞ্জে ঢুকলেন ডক্টর রেহেনা। তনিমার শেষের কথাটুকু শুনতে পেয়ে বললেন মেয়েটার ভাগ্য তো ভাল। কিন্তু কালপ্রিটগুলো কি ধরা পড়েছে? সালমা মাথা নাড়লো। মোহনার জন্য বিচারের দাবীতে মানববন্ধনের নেতৃত্ব দিচ্ছে ও।  সাথে জামিল আর শওকত হেল্প করছে তাকে। কোনার দিকের একটা সোফায় বসে নীরবে চায়ের কাপে মনোনিবেশ করেছেন ডক্টর ফৌজিয়া। ‘চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালেন একসময়। সবার দিকে তাকিয়ে বললেন-‘ আমার মনে হয় কি জানেন? মরে গেলেই বরং বেঁচে যেত মেয়েটা।’ উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়েছে ডক্টর ফৌজিয়ার দিকে। ‘কি বলছেন ম্যাডাম?- আকাশ থেকে পড়েছে শওকত। অন্য সবার চোখেও একই অভিব্যক্তি।‘ কি যা তা বলছ?  মরে গেলে আবার কেউ বেঁচে যায়?- রেজিস্টার ডক্টর হোসনে আরা ম্যাডাম এগিয়ে এলেন।

মরে গেলে আর কেউ বেঁচে না থাক, ফৌজিয়া তো বেঁচে যেতেন! গতকাল সুপার শপে সাদিয়ার সাথে দেখা হবার পর থেকেই কোথায় যেন একটা কাঁটা খচখচ করে চলেছে। টিচার্স লাউঞ্জ থেকে চুপচাপ বেরিয়ে আসলেও মনের ঝড় থামেনা তার । ফৌজিয়া এখন ডক্টর ফৌজিয়া হয়ে কি লাভ হয়েছে? গতকাল সাদিয়া কোলের শিশুকে থামাতে থামাতে তার হাত ধরে জিজ্ঞাসা করেছিল- ‘তুই এখন কেমন আছিস রে’? আবাল্য শৈশব কৈশোরের সহপাঠীর কেবল চোখদু’টোর দিকে তাকিয়ে মুখে মৃদু হাসি টেনেছিলেন ফৌজিয়া- ‘এইতো চলছে,।’ হ্যাঁ চলছেই তো জীবনটা। সবার কত আরাধ্য সম্মানজনক অবস্থান। এই বয়সেই সমাজ সংসারে ঈর্ষান্বিত হবার মত ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তার কাছে -শিশু পার্কের খেলনা ট্রেনের মত শুধুই চলার জন্য চলা। যার কোন গন্তব্য নেই। কলেজ ফ্রেন্ড সাদিয়ার রক্ষণশীল চলাফেরাকে বরাবরই দৃষ্টিকটু অর্থহীন মনে হতো। তবে অসম্ভব ভালো একটা মেয়ে।ওর আজ কত ভরা সংসার। স্বামী-সন্তান, ভালোবাসামাখা স্বপ্নের নীড়। অথচ? সামনের টেবিলে কফির কাপ রেখে গেল রহিমা। বারান্দার ওধারে দু’টি চড়ুই কিচিরমিচির করছে। পাশের জারুল গাছের পাতাগুলো দুলছে মৃদু বাতাসে। বড্ড একা লাগে তার। স্টুডেন্টদের সামনে বসা স্বল্পভাষী গুরুগম্ভীর শিক্ষিকাটি নিজের কাছে আজ বড়ই অসহায়। নিজের হাতে গড়া সুদৃশ্য জগতে তাকে বুঝবার কেউ নেই। ছুটির বিকেলে সাথে নিয়ে ঘুরবার, হাতের মুঠোয় হাত পুড়ে আশ্বাস দেওয়ার মতো কোন মানুষ নেই তার পাশে। পছন্দের জিনিসটি মুখে তুলে দেবার কিংবা সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবার মতো একটি সত্ত্বার অভাব মাঝেমাঝেই ছুঁয়ে যায় তাকে। আরমান এর কথা মনে পড়ে। বাবারে বাবা! কি আগুন ঝরিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল সেদিন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। সব ভুলে ঝাঁজিয়ে উঠেছিল-‘ ইজ ইট ট্রু অর ফলস? সাহস থাকলে অস্বীকার কর।’ ফৌজিয়ার আর বলার কিছু ছিল না। একদিন অবুঝের মত যে বিষবৃক্ষের বীজ বুনেছিলেন,তার বিষাক্ত নি:শ্বাস এসে লাগে সদ্য নির্মিত স্বপ্ন সৌধে। সুপ্ত কালির আঁচড়ে ভালোবাসা আর শাশ্বত বন্ধন তুচ্ছ হয়ে যায় নিমেষে। সেদিন বুঝেছিলেন বাবা অর্থের জোয়ারে সব ঢেকে রাখতে চাইলেও সব ঢেকে রাখা যায়না। মাত্র একটি দিন! কিন্তু জীবনের প্রথম অধ্যায়ে তারুণ্যের উদ্যামে ভাসা অভিশপ্ত সেই দিনটিতে, জীবনের সাদা খাতায় যে কালো পোঁচ লেগেছিল তা কখনো মুছবার নয়। ছোটবেলায় লেখায় কোন ভুল হয়ে গেলে ফৌজিয়া কেঁদে ফেলতেন। মা ইরেজার হাতে দিয়ে বলতেন-‘ মুছে ফেলো বোকা মেয়ে!’ মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন ফৌজিয়া। ঠিক যেভাবে ফিরে এসেছে মোহনা। কিন্তু সেই কালো দাগ মুছে ফেলবার সামর্থ্য নেই পৃথিবীর কোন ইরেজারের। আজও লাল গোলাপের ছড়াছড়ি দেখেন দিনটাতে। কিন্তু গোলাপের রক্তিম শোভার নিচে লুকানো বিষাক্ত কাঁটাগুলো প্রতিনিয়ত ক্ষত বিক্ষত করে ইংরেজির স্বনামধন্য তরুণ অধ্যাপিকা ড.ফৌজিয়াকে। হয়তো মোহনাকেও করবে। তবুও চমকাবেনা নতুন পথিকরা। প্রতিবছর লালের ছদ্মাবরণে রাত্রি নামতে থাকবে নতুন কোনো ফৌজিয়া-মোহনার জীবনে। জীবনের প্রভাত বেলাতেই গোধূলির শূন্যতা টের পাওয়া ডঃ ফৌজিয়াকে আজ সাদিয়ার সফেদ গতিপথ বড়ই কাছে টানছে। পাশের বারান্দায় চড়ুই দম্পতি তাদের বাসা খুঁজে পেয়ে তখন আনন্দে কিচিরমিচির রব জুড়েছে।

লেখকঃ গল্পকার ও শিক্ষক 

আরও পড়ুন