Ads

পূর্ণতা

।। সুমাইয়্যা সিদ্দিকা ।।

হুইসেলের তীক্ষ্ম শব্দে নড়েচড়ে বসে শামা। শেষ রাতের ট্রেনটা স্টেশন ছেড়ে ছুটে যাচ্ছে নিজ গন্তব্যে।

মশারী ভেদ করে দেয়াল ঘড়ির পানে চোখ যায় ওর। ঘড়ির কাঁটা আড়াইটা ছুঁই ছুঁই।

বাইরে কোথাও অনবরত কেঁদে চলেছে রাত জাগা কোন বেওয়ারিশ কুকুর ছানা। কিং সাইজ খাটের হেড বোর্ডে পিঠ ঠেকিয়ে বসে ও। পায়ের ওপর শিমুল তুলোর নরম তুলতুলে ছোট্ট বালিশে চার মাসের ফারদিন। ছেলেকে ঘুম পাড়াতে ব্যর্থ হয়ে কখন যেন নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছিল শামা।

ধাতস্থ হতেই দেখে ফাহাদ ছেলের ডায়াপার চেক করছে। ওকে জাগতে দেখে মুচকি হাসে ফাহাদ। জীবনসঙ্গীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ছেলের দিকে তাকায় শামা। দেখে ছেলে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে ওর পানে। চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই।

: ইসসিরে বাবাটা! আজও না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিবে? বলতে বলতে শামার কাছ থেকে ছেলেকে কোলে তুলে নেয় ফাহাদ।

বাবার কথা শুনে হাত- পা ছুঁড়ে নিজের খুশী জানান দেয় পুঁচকেটা। শামাকে ঘুমানোর ইশারা করে ছেলেকে কোলে তুলে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় ফাহাদ।

রাতে এক ফোঁটাও ঘুমায় না ছেলে। আর সারাদিন বসিয়ে রাখলেও ঘুমিয়ে থাকে।

পুরোটা রাত ধরে ছেলেকে ঘুম পাড়াতে নানান কোষেষ চলে শামার। ফাহাদও সংগী হয় ওর।

ছেলের সাথে সাথে শামারও প্রায় রাতই নির্ঘুম কাটে । ঘরের হাজার রকম কাজ, বড় দু’জনের দেখভাল করা। সব মিলিয়ে দিনেও খুব একটা ঘুমানোর সুযোগ পায় না ও। সারাক্ষণ ক্লান্তি লেগে থাকে। সাথে মেজাজের পারদের উর্ধ্বগতি তো রয়েছেই। রাত জাগতে জাগতে চোখের নিচে কালশিটে পড়ে গিয়েছে শামার। ওর ফর্সা চেহারা কালচে হয়ে গিয়েছে।

ফাহাদ বেরিয়ে যেতেই খানিকক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করে উঠে বসে শামা। ডাইনিং রুমে গিয়ে টেবিলে রাখা জগ গ্লাস থেকে পানি ঢেলে খায়। পাশের রুমে বড় দুই জন ঘুমাচ্ছে। সেদিকে একটু উঁকি দিয়ে এসে কি মনে করে চিরুনী হাতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে। গত দু’দিন ধরে চুলে হাত দেওয়া হয়নি! জট পাকিয়ে আছে চুলগুলো।

রূপচর্চা নিয়ে কোনকালেই বাড়াবাড়ি পছন্দ না করলেও সবসময় একটু টিপটপ থাকতে পছন্দ করে সে। পরিপাটি করে চুল আঁচড়িয়ে একটা হাত খোপা বা লম্বা বেণী করা; দু’চোখে গাঢ় করে কাজল দেওয়া। এই-ই ওর সাজ। যা ফাহাদেরও খুব পছন্দ।

অথচ কত দিন হয়ে গেল আয়নাতে নিজেকে ঠিকঠাক মতো দেখা হয় না! সারাদিনেও চুলগুলো একবার ভালো করে আঁচড়ানোরও সুযোগ পায় না এখন। ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে যায় ওর।

বিয়ের প্রথম দিকের কথা মনে হতেই এক টুকরো লাজুক হাসি খেলে যায় ওর ঠোঁট জোড়াতে।

: চোখ বন্ধ করো তো!

ফাহাদের কথায় চোখ বন্ধ করলেও ঘ্রাণে ঠিকই টের পেতো বেলী বা বকুল ফুলের মালা এনেছে সে। পানজাবীর পকেট থেকে লুকানো মালা শামার খোঁপায় জড়াতে জড়াতে খুনসুঁটিতে মেতে উঠতো অফিস ফেরত ফাহাদ।

বড় ছেলেটা হওয়ার পরও বেশ কিছু দিন নিয়ম করে ফুলের মালা আনতো ফাহাদ। তারপর একসময় কবে কবে যেন মালার বদলে বাচ্চাদের চকলেট,চিপস, ডায়াপার আর নিত্য দিনের লিস্টি স্থান করে নিল ফাহাদের দু’হাতে।

ছেলের সাথে রাত জাগতে

জাগতে নীল আলোর জগতে আনাগোনাও বেড়ে গিয়েছে শামার। বান্ধবীদের কাপল পোস্টের খুনসুঁটিগুলো বেশ নাড়া দেয় ওকে। প্রায়ই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে ওসব।

আগে তো মাসে বা পনেরো দিনে একটু হলেও ঘুরতে বের হতো। নিদেনপক্ষে বাসার পাশের ফুড কোর্টগুলোতে খাওয়া-দাওয়া করা হতো।

ফেসবুকের ওয়ালে পরিচিতদের বেড়ানোর পোস্ট দেখে আর নিজের সাথে তুলনা করে করে আরো হতাশ লাগে ওর।

ইদানীং খুনসুঁটি তো দূরের থাক, দু’জনের জরুরী কথা বলারও যেন সময় করা কঠিন হয়ে গিয়েছে। তবে ফাহাদ যথেষ্ট সহযোগিতা করার চেষ্টা করে। যতক্ষণ বাসায় থাকে বড় দুই জনকে ঘুম পাড়ানো,খাওয়ানো সব একহাতে করে।

শামাকে আগের দুই বাচ্চাকে নিয়ে এত হ্যাপা পোঁহাতে হয়নি। পেট ভরে খাইয়ে দিলে সারারাত ঘুমিয়ে কাবার করে দিতো ওরা। এখনো মনে পড়লে হাসি পায় ওর। বড় ছেলে ফারহিন ঘুমালে ঘরের কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে ছেলের নাকে হাত দিয়ে দেখতো শ্বাস- প্রশ্বাস ঠিক আছে কি-না?

তারপরও ফারহিন, শালিমা পিঠে-পিঠি হওয়াতে যখন তখন ঘোরাঘুরিও শূণ্যের কোথায়। কিন্তু গত চারটা মাস যেন মনে হয় ওর রাত-দিন এক জায়গাতেই থমকে আছে।

সারাদিন তিন বাচ্চাকে সামলিয়ে শরীর চলতে চায় না। তারওপর সারা রাত জাগা।

মাঝে মধ্যে বিকালে ছাদে যেতো। কিন্তু বাচ্চাদের নিয়ে ছাদে গেলেই ফ্ল্যাটের কারো না কারো দেখা হয়। তাদের ফিসফাসও কানে আসে। সেদিন তো তিনতলার ভাবী বলেই বসলেন।

: এ যুগে তিন তিনটে বাচ্চা!

আরো কত কথা। এসব শোনার ভয়ে বাইরেও যেতে উৎসাহ পায় না ও।

ফাহাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই শামার। ব্যাংকের চাকুরী করেও বাচ্চাদের এতটুকু যে ও সাপোর্ট দিচ্ছে ও এতেই খুশী শামা। তবুও সময় অসময়ে বড্ড অস্থির হয়ে যায় ও।

প্রায়ই মায়ের কথা মনে হয়। মা বলে শামা নিজেও ছোটবেলাতে রাতে জেগে থাকতো। বাবা ছিলেন প্রবাসী। মা ছিলেন যৌথ পরিবারের বড় বৌ। বাচ্চাদের সামলিয়েও সবদিক দেখতে হতো থাকে। সে তুলনায় ও নিজে বেশ ভালোই আছে।

জট পাকানো চুল ছাড়িয়ে বেণী করতে করতে ভাবে সন্তানের জন্য মা কত কি করে সন্তান কি কখনো তা বুঝে!

ও নিজেও কখনোই বুঝতে পারেনি নিজে মা হওয়া তক! মায়ের জন্য কৃতজ্ঞ অশ্রুতে চোখ জোড়া ছলছল করে ওঠে । স্রষ্টার প্রতিও অবনত হয়ে ওঠে ওর অন্তর। হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরি আসে শামার। তবে সেটা পরিতৃপ্তির। পরিপূর্ণতার।

লেখকঃ কবি ও গল্পকার

ফেসবুকে লেখক 

 

আরও পড়ুন