Ads

নিস্ফল আবেদন

।। সুমাইয়া আফরোজ ।।

 

বড় বৌ এর চিৎকার খোলা বাতাসে ওই দূরের মেঠোপথের পথিকের কানে গিয়ে ধাক্কা খায়, যদিও চিৎকারটা পথিকের উদ্দেশ্যে নয় সেটার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য পাশের ঘরের ছোট বৌ। অপরাধ, ছাগল লেলিয়ে দিয়ে বড় বৌ এর সদ্যই লকলকিয়ে ওঠা পেয়ারা গাছের ডালাসমেত পাতা ভক্ষণ।
আওয়াজ শোনা যায়,
: ঔ ফকিন্নির ঘরের মাইয়া, তুই বকরিটারে ঘরে আটকাইতে পারোস না তো বকরি পালতে যাস ক্যান?
পাল্টা জবাব থেকেও বঞ্চিত হয় না পথিক,
: আরে আমার জমিদারনি রে! তোর চৌদ্দ গোষ্ঠীর জমিদারি আমার জানা আছে। ছোটলকের মাইয়া, এক গাছের পাতার লাইগা ঝগড়া করস? তুই তোর গাছ সামলাইয়া রাখ গে।
পাল্টা চিৎকারটা আরও ভয়ানক হয়,
: চোরের মাইয়ার ডাঙ্গর গলা দেখছো গো! লাজ শরম তো তোর জাতেও নাই।

 

পথিকের আর প্রতুত্তর শোনার সময় থাকে না, গন্তব্য তাকে টেনে নিয়ে যায় দুই বৌ এর ঝগড়া থেকে বহুদূরের পথে। ক্ষীণ আওয়াজ ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে যায়।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। বাড়ি দুটিও শান্ত হয়।

 

ওদের খড়ের চালা যেভাবে গলাগলি করে দাঁড়িয়ে থাকে তাকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় তাদের মাঝে গভীর প্রণয়।
কিন্তু ভেতরের গল্পটা সচরাচরই এরকম হয়। দিনশেষে রাত আসে। বড় বৌ এর রক্তের মাঝে প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে থাকে বিছানায় শুয়ে শুয়ে। এদিকে বড় কর্তাও বিষয়টিকে গুরুতরভাবে না নেয়ায় সে আরও বেশি আহত হয়।
ন্যাড়া পেয়ারা গাছের চেহারা সামনে ভাসে তার। নীরবে চোখের জ্বল মুছে মনে সনে প্রতিজ্ঞা করে বসে ” এর আমি শেষ দেইখ্যা ছাড়ুম”
রাতের আঁধার কেটে যায়, দুই ঘরের চালার উপরে একটা সূর্যই হেসে উঠে।

 

ছোট বৌ কাঁঠাল গাছের সাথে দড়ি দিয়ে ছাগলটাকে শক্ত করেই বাঁধে। ঝগড়ার সময় যাই বলুক না কেন, ইচ্ছে করে ছাগল দিয়ে অন্যের ক্ষতি করার মানুষ সে নয়। কিন্তু বড় বৌ এর এত ছোটলোকি কথাও সহ্য করার মত ধৈর্য তার নেই। ছাগলের দড়ির একটু উপরে আরেকটা দড়িতে কিছু কাঁঠালপাতা বেঁধে দিয়ে ছোট কর্তার খাবার নিয়ে মাঠের পানে চলতে থাকে।
ভাতের সাথে ধানের গুঁড়ো মিশিয়ে হাঁসের খাবার এগিয়ে দিয়ে বাইরে উঁকি দেয় বড় বৌ। ছোট বৌ এর ছায়া ততক্ষণে ছোট হয়ে এসেছে। বড় বৌ এর চোখ যায় অদূরে বেঁধে রাখা ছাগলটার দিকে। ভয়ংকর এক প্রতিশোধস্পৃহা বিদ্যুৎ এর মত চমক দেয় তার চোখমুখে।

 

কিছুক্ষণ পর ধারালো বটি টা নিয়ে বের হয় আঁচলের তলায় করে, ইচ্ছে হয় যেন ওটা গলায় চালিয়ে দেয় একেবারে। কিন্তু এদিক ওদিক একবার দেখে নিয়ে অতখানি সাহসে কুলায় না। একটু ভেবে কাঁপা হাতে ছাগলের গোড়ালির উপরে একটা ঘা বসিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে ঘরে ফিরে।
বাড়ির মাঝে এসেই সম্বিৎ ফিরে আসে তার। এই অপরাধের দায় নিশ্চিত তার উপরেই আসবে।

 

অস্থির চিত্তে বুদ্ধি ফাঁদে, একটা মুড়ো ছুরি লুকিয়ে নিয়ে আরেকবার কাঁঠালতলায় যায়, ছাগল অনবরত পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করছে আর তাজা রক্ত ঝরে পড়ছে, সাথে আর্তচিৎকার। এখনো কেউ আসে নি এদিকটায়। মুড়ো ছুরি সেখানে ফেলে রেখে পালিয়ে আসে বড় বৌ। সন্তর্পণে কান পেতে থাকে ছোট বৌএর আর্তনাদ দেখার জন্য। দুশ্চিন্তা কেটে গেছে এতক্ষণে, তার দোষ হবার আর কোন কারণ নেই। সবাই ভাববে ওখানে পড়ে থাকা ছুরিতে আঘাত লেগেই কান্ডটা ঘটেছে।
একটু পরেই শোরগোল শোনা যায়, ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দেয় বড় বৌ। এতক্ষণে নিশ্চয় টের পেয়েছে ছোট বৌ, কিন্তু ঘটনা কি? সবাই হৈচৈ করছে কিন্তু ছোট বৌ এর গলা শোনা যায় না কেন? সে তো এমন শান্ত হয়ে থাকার কথা নয়!

 

বিষয়টা পরিষ্কার হওয়ার জন্য দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় বড় বৌ, দেখতে পায় উঠানে বড় জটলা। ভীতচোখে একবার ছাগলের দিকে তাকায়, না ওদিকটাতে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। রহস্যময় লাগে সবকিছু। সাহস করে ভীড় ঠেলে সামনে যায়, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে ছোট বৌ এর নিথর শরীর।
বাচ্চু ডাক্তার এসে নাড়ি পরীক্ষা করে বলে দিলো,
: ছোট বৌ আর নাই।

 

ছোট কর্তা কাদামাখা শরীরে মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদতে লাগলো, পাড়া সুদ্ধ লোক চোখ মুছে হায় হায় করতে লাগলো। কেবল বড় বৌ বৈদ্যুতিক শক খাওয়া মানুষের মতো সমস্ত শক্তি হারিয়ে ধপ করে বসে পড়লো ছোট বৌ এর নিথর দেহের পাশে।
কিছুক্ষণ পর কলিজাফাটা চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
: আমারে মাপ কইরা দে ছোট বৌ, আমারে মাপ কইরা দে।

 

সবাই ছোট বৌ এর মুখপানে তাকালো আরেকটিবার, সেখানে ক্ষমার কোন চিহ্ন বিশেষ খুঁজে পাওয়া গেলো না।
হয়তো ক্ষমার জগৎ থেকে সে আজ চলে গেছে বহুদূর…
লেখকঃ সাহিত্যিক ও গল্পকার 

 

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়ন মূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিন।

এবং প্রিয় লেখক ! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected]

প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন