Ads

দায়িত্ব ।। নারীদের গল্প

।। হালিমা খাতুন ।।

প্রতিবেশী এক ভাবী মারিয়াম বেগমের গেটে এসে কলিংবেল টিপে ডাকছে, “ভাবি গেট খোলেন”।

গেট খুলতেই রিনা বেগম ভতরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। তারপর হাপাতে হাপাতে বললেন,

“ বেশ কিছুদিন ধরে শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে । দূর্বল লাগে,সামান্য তিন তলায় উঠতেই আমার বুক ধড় ফড় করে। অস্থির লাগে, তাই কিছু বলার আগেই বসে পড়লাম। আসসালামু আলাইকুম ভাবী কেমন আছেন?”

“ওয়ালাইকুম আছ্ছালাম,জ্বী আলহামদুলিল্লাহ। অসুস্থ শরীরে আপনি কেন আসতে গেলেন ? আমাকে ফোন দিলেই তো আমি যেতাম।“

খুব বিনয়ের সাথে বললেন মরিয়ম বেগম ।

“না থাক, নিজেই আসলাম যে। আপনার বাসায় কে কাজ করে তাকে দিয়ে আমার বাসার কাজটা করানো যায় কিনা দেখতে।” বেশ আকুতি মাখা কণ্ঠে বললেন রিনা বেগম । তারপর আবার বললেন,

“আপনি আগে যে কাজের লোকটা দিয়েছিলেন সেও দুই মাস ধরে কাজ করে না। আর এই দুই মাস ধরেই কাজের লোক খুঁজি কিন্তু পাচ্ছি না। তাই…।”

“ঠিক আছে ওলির মা আসুক। ওর সাথে কথা বলে আপনার জন্য একটা লোক ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ।” মারিয়াম বেগম বললেন । তারপর রিনা বেগমের দিকে নাস্তা এগিয়ে দিয়ে বললেন ।

“এখন একটু নাস্তা করেন।“

রিনা বেগম শুধু চায়ের কাপে কয়েক চুমুক দিয়ে বললেন,

“ভাবি দেখবেন একটা মানুষ খুঁজে দিতে পারেন কিনা? বড় উপকার হতো। এখন যাই  ঘরে অনেক কাজ পরে আছে । পুরো বাড়ী এলো মেলো হয়ে আছে।”

আরও পড়ুন-এখনো বিজয় আসেনি ।। ১ম পর্ব

পরের দিন সকালে মরিয়ম বেগমের বাসায় ওলির মা কাজে আসল। এসেই টেবিল থেকে প্লেট বাটি নিয়ে ধোয়া শুরু করলো সে। এখনকার কাজের লোকেরা বেশ কমার্শিয়াল । তারা হাই-হ্যালো বা সালাম বিনিময় করে একটুও সময় অপচয় করতে চায় না। মারিয়াম বেগম ওলির মার সাথে রান্না ঘরের কাজ শুরু করতে করতে ওলির  মাকে বললেন,

“ওলির মা! কোন কাজের মানুষের খোঁজ আছে তোমার কাছে? রিনা ভাবীর  একটা কজের লোক লাগবে।”

“অহন করোর কথা জানি না । কয় দিন আগে কইলে আমার জা কাজ করত । হে অহন গুলশানে কামে গ্যাছে।”

চট করে উত্তর দিল ওলির মা । ওলির মার উত্তরে মরিয়ম বেগমের  কিছুটা আশাভঙ্গ হলেও আবার  উৎসাহী  কণ্ঠে বললেন,

“ঠিক আছে; ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া, প্লেট ধোয়া এই তিনটা কাজই তো । আমার বাসার সময়টা একটু আগ পিস করে ওনার কাজটা করে দিও। বেচারী অনেক অসুস্থে”

“ঠিক আছে বিকালে আসুম, তখন উনার বাসায় আমারে নিয়া যাইয়েন।” ওলির মা বলল ।

আসরের পর ওলির মা এসে ছাদের গাছগুলোতে পানি দিয়ে এসে বলল,

“কাকি লন উনার বাসা দেখখা আসি।”

“তুমি নামো , আমি বোরখাটা পরে আসছি।” মরিয়ম বেগম বললেন ।

রিনা বেগমের বাসার গেটের কাছে যেতেই ওলির মা বলে উঠল,

“এইডা আপনার রিনা ভাবীর বাসা? পিছনের ঐ টিন সেটের ঘরগুলোতেই আমি আগে থাকতাম। হেরে তো আমি চিনি। হেরা বাড়ীওলা। তিন তলায় থাকে। উনার বাসায় আমি আগে দুই মাস কাজ কোইরা গেছি । অহন আর করুম না। কাকি! হের বাসায় কেউই কাজ করতে চায় না।”

“কেন? উনিতো ভাল মানুষ, বেশ সহজ সরল । তো সমস্যা কি ?” একটু আক্ষেপের সূরে বললেন মরিয়ম বেগম ।

“কামের টাকা ঠিক মত দেয় না। বেতন লইয়া গুরায়।” এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল ওলির মা । তারপর মুখটা মরিয়ম বেগমের কাছাকাছি এনে একটু নিচু কণ্ঠে বলল,

“হের জামাই সারাদিন ঘরে থাকে। একটার পর একটা কামের কতা কয়। বড় দুই পোলাপাইন দুই ঘরে বারোটা পর্যন্ত ঘুমায়। গেটও খোলে না । টাইম মত কাম করোন যায় না। উনি ভাল ওইলে কি ওইবো? উনার বাসার সবাই উনার কথা শোনে না। আর উনি করো সাথে না পাইরা চুপ কইরা সারা দিন একা একা কাজ করে। ক্যামন যেন একটা বাসা উনাদের। আঠারোশো টাকার কাজের জন্য মানুা চার পাঁচ ঘন্টা থাকবো নাকি হের বাসায়?”

“ঠিক আছে তুমি চলে যাও, আমিও যাই।” অলির মায়ের কথা শুনে হতাশ কণ্ঠে বললেন মরিয়ম বেগম ।

বেশ কিছুদিন হয়ে গেল । রিনা বেগমের আর খোঁজ নিতে পারেন না মরিয়ম বেগম। হঠাৎ একদিন বেলা এগারোটার দিকে মসজিদের মাইক থেকে রিনা বেগমের মৃত্যুর খবর শুনলেন মারিয়াম বেগম। শুনেই সাথে সাথে দৌড় দিলেন তাদের বাসায় । গেটের কাছে যেতেই অনেক মানুষের ভিড়। ভিড় ঠেলে যেতেই দেখলেন নিচ তলার একটা খালি ঘরে লাশ শোয়ানো আছে । পাশে মাদ্রাসার তিনটা ছেলে বসে কোরআন পড়ছে। দুই তিন জন প্রতিবেশী কান্না করছে, চোখ মুছছে । কেউ বলছে “দশ মিনিট আগেও মানুষটা দুনিয়ায় ছিল । এখন আর নেই, বেচারী অনেক ভাল মানুষ ছিল!”

কিন্তু ওনার কোনও আপন জন এখানে না দেখে মারিয়াম বেগম তৃতীয় তলায় উঠে গেলেন । গিয়ে দেখলেন বড় ছেলে বড় মেয়ের ঘর লাগানো।

“ছেলে অনার্সে আর মেয়ে ইন্টারমেডিয়েটে পড়ে। অল্প জায়গার উপর একটা ছোট বাড়ী। তার স্বামীকে সবাই সাংবাদিক নামে ডাকে । কিন্তু কোন পত্রিকার তাও কেউ যানে না ।  কোনও দিন  কেউ কাজেও যেতে দেখেনি।

রিনা বেগমের ননদ আর  দুই জন ভাড়টিয়া ডাইনিং এ বসে আছে। মারিয়াম বেগম তাদেরকে  জিজ্ঞেস করলেন,

“উনার স্বামী কোথায়?”

“ছোট ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে গেছে।” রিনা বেগমের ননদ উত্তর দিল ।

“উনার কি হয়েছিল?” মরিয়ম বেগম প্রশ্ন করলেন । উত্তরে একজন ভাড়াটিয়া বলে উঠলো,

“প্রেসার, ডায়বেটিকস…। কয়েকদিন ধরে বাসার সবাইকে বলেছে উনার বুকে ব্যাথা। কিছুই ভাল লাগে না। কিন্তু উনার স্বামী বলেছে, ‘ডায়বেটিস বেড়েছে হাঁটালে ঠিক হয়ে যাবে।’”

আরেক জন বলল, “বেশ কিছুদিন ধরেই উনি খুব চুপ হয়ে থাকতেন। আস্তে আস্তে ঘরের কাজ করতেন।”

মারিয়ম বেগম রান্না ঘরে ঢুকে দেখলেন কড়াইতে লতি কাটা, দুই বাটিতে চিংড়ি মাছ আর পেঁয়াজ কাটা। সেগুলোর দিকে আঙ্গুলি দেখিয়ে মরিয়ম বেগম জিজ্ঞেস করলেন,

“এগুলো কে কেটেছে?”

রিনা বেগমের ননদ বললেন, “ভাবিই কেটেছে। এগুলো কাটতে কাটতে পাশের ভাড়াটিয়াকে ডেকে বলেছে ‘আমার কাছে একটু আসো,আমার খুব খারাপ লাগছে।’ উঠে বমি করতেই ওখানে পড়ে যায়। সাথে সাথেই ডাক্তার নিয়ে আসা হয় । কিন্তু ডাক্তার এসে বলেন উনি মারা গেছে।”

“আন্টি ঘরের কাজ করতে করতে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে অসুস্থতার প্রমাণ দিলেন।” এক ভাড়াটিয়া ভারি কণ্ঠে বলে উঠলেন।

মারিয়াম বেগম নিরবে ঘরের সব কিছুর দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। চোখ মুছতে মুছতে বলে উঠলেন, “হায়রে দায়িত্ব! মৃত্যুর কষ্ট নিয়েও স্বামী, সন্তানদের খাবারের যোগান দিয়ে গেলেন রিনা ভাবী।”

লেখকঃ কবি এবং গল্পকার

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

আরও পড়ুন