Ads

এম্পটি নেস্টার

শেলী জামান খান

আমার দুই ছেলে সুমিত ও অমিত। এরা আমার জীবনের দুই হিরো। আমার দু’টি ডানা। এদের ভরসায় আমি আকাশ পাড়ি দেই। উড়ে বেড়াই। একসময় ছোট্ট পাখির বাসা বানিয়েছিলাম। ডিম পেড়ে, তা দিয়ে ছানা ফুটিয়েছিলাম। মুখে তুলে খাইয়েছি। তারা এখন বড় হয়ে গেছে। এখন তাদেরও ডানা গজিয়েছে। তারা উড়তে শিখেছে।গর্বে, আনন্দে আমার বুক ভরে যায়। বারবার ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু পক্ষীশাবক বাবা মা’কে ত্যাগ করলেও এই মানবশিশুদ্বয় আমাদের ত্যাগ করেনি। তবে ইতোমধ্যে তারাও নতুন বাসা বেঁধেছে। তাদেরও নিজের পায়ের নিচে শক্ত একটি ভীত তৈরি করতে হবে। শাখা প্রশাখা মেলে বড় হতে হবে। ঝড়ঝাপটা সামলানো শিখতে হবে। তাছাড়া সময় এসেছে সঙ্গিনী খুঁজে নিয়ে “নেস্ট” তৈরি করার।

সন্তান বড় হলে, প্রাপ্তবয়স্ক হলে ‘মুভআউট’ করবে এটাই পশ্চিমা রীতি। যেহেতু আমরা বাস করি পশ্চিমা জগতে। তারা বড় হয়ে উঠেছে পশ্চিমা শিক্ষা ও ঢং এ।তাই আমি ব্যাক্তিগতভাবে এতে দোষের কিছু দেখি না। বরং তাদের “গ্রো” করবার মত স্পেস দিতে চাই। বড় গাছের নীচে আরেকটি চারা গাছ সবল, শক্তপোক্তভাবে বাড়ার সুযোগ কম পায়। তার জন্য পর্যাপ্ত আলো, হাওয়া, রোদ্দুর দরকার। খরা, ঝড়, জল সামলানো এবং মোকাবেলা করার শিক্ষা দরকার। তারপর তাদের পেছনে আমরা, আমাদের পেছনে তারাতো আছেই, থাকবোই পিঠ পেতে দেয়ার জন্য। অন্তত যতদিন বেঁচেবর্তে থাকবো।

প্রথমে বড় ছেলে সুমিত ‘মুভ আউট’ করল। জীবিকার প্রয়োজনে। চোখে জল, মুখে হাসি নিয়ে তাকে গুড লাক জানালাম। নিউইয়র্ক ছেড়ে ছেলে চলে গেল লসআ্যন্জেলস এ। প্লেনে পাড়ি দিলেও পাঁচ ঘন্টার পথ। বহুদিন পরপর দেখা হয়। কথা হয় ফোনে, ভার্চূয়ালে। ছেলে নিজের হাতে ঘর, বাথরুম পরিস্কার করে, গার্বেজ বাইরে ফেলে আসে, বাজার করে, কখনো রান্নাও করে। আমরা বাবা-মা, আর তার ছোটভাই অমিত সেই সব দৃশ্য ভার্চূয়ালে দেখি। মনে মনে ভাবি, আমি কত ভাগ্যবতী মা, হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও মন চাইলে ছেলেকে দেখতে পারি। যদিও স্পর্শ করতে পারি না।কথা বলি, দেখি, তাই বা কম কিসে? আগের দিনের মায়েদেরতো সেই সুযোগটুকুও ছিল না। আহারে…!

সুমিতের পরিত্যক্ত ঘর, বিছানা আমি বেদখল করলাম। সেখানে টানটান হয়ে একা ঘুমাই। তার লেখার টেবিলে জাকিয়ে বসে লেখালেখি করি। আমার হাসবেন্ডও মহাখুশি। আমার মত রাতজাগা আপদ বিদায় হয়েছে ভেবে। কারন তাকে আর রাতবিরাতে আমার লেখালেখির হ্যাপা, লাইটের আলোর যন্ত্রনা সহ্য করতে হয় না। আমিও মহাখুশি। আমারও আর তার সাতসকালে উঠে ওজু, নামাজ পড়ার ঢুকঠাক শব্দে ঘুমের ব্যাঘাত হয় না। সুমিতকে এসব আরাম আয়েসের খবর দেই হাসিমুখে। সে কৃত্রিম দুঃখীদুঃখী চেহারা করে বলে, “বাহ্, আমাকে ভাগিয়ে দিয়ে তোমরা খুব আরামে আছ, তাই না? আমার সবকিছু জবরদখল হয়ে গেছে।”

তবে এই বিচ্ছেদে কোন কষ্ট নেই। গ্লানি নেই। এটাই জীবন। মা বাবাকে এই বিচ্ছেদ মেনে নিতেই হবে। তবে আমাদের বাঙালি ধ্যান ধারনায়, চিন্তা ও মানসিকতায় এই “মুভ আউট” তেমনভাবে ওয়েলকাম নয়। আমরা গাদাগাদি করে, জড়াজড়ি করে থাকতে ভালোবাসি। আমার পূর্বপুরুষরা সেভাবেই থেকে গেছেন। আমাদের ছোটবেলাও কেটেছে বড় একটি একান্নবর্তী সংসারে। আমি নিজেও জীবনের একটা বড় সময় এমনি একটি একান্নবর্তী সংসার করে এসেছি।তাতে ভালমন্দ, আনন্দ বেদনা, তিক্ততা সবকিছুই মাখামাখি করে ছিল। এসবে একসময় বিরক্তিও এসেছে। হতাশাও ভর করেছে। এখন আবার পিছন ফিরে তাকালে সেই আনন্দবেদনার জীবনও নস্টালজিক করে তোলে আমায়।মাঝেমধ্যে মনে হয় খুব কী মন্দ ছিল সেই দিনগুলো?

কিন্তু ইতোমধ্যেই পশ্চিমা রীতির অনেক কিছুকেই আমি, আমরা আমাদের জীবনে স্বাগত জানিয়েছি। অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বিচার বিশ্লেষণ করে, দেখেশুনে, জেনে, মনে হয়েছে, ওদের কাছেও আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে। আমাদের বাঙালি মানসিকতার আহারে, উহুরে বাদ দিয়ে সন্তানদের বড় হতে দেয়া খারাপ কিছু নয়। আবার বুড়ো বয়সে সন্তানের ঘাড়ে বসে খাওয়াও কোন আনন্দের কথা নয়।বরং একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত তাদের দেখভাল করে, বড় হলে নিজের পায়ে নিজেকে দাঁড়ানোর শিক্ষাটা দেয়াই জরুরী। একজন স্বাধীন মানুষ, স্বাধীন স্বত্তা হিসেবে বেড়ে ওঠা ওদের জন্য খুবই প্রয়োজন। ঘাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থেকে কেবল উপদেশ দিয়ে, নিজের মতামত চাপিয়ে দেয়াই আদর, ভালোবাসা, রক্ষণাবক্ষণ করা নয়। তাকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার সুযোগ করে দেয়াও জরুরী।

তেমনি নিজেকে নিঃস্ব করে সন্তানের জন্য স্বর্বস্ব খুইয়ে দেয়া মোটেই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। নিজের মাথা গোঁজার ব্যাবস্থা, দুবেলা খাওয়ার সংস্থান রাখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাহলে বুড়ো বয়সে নিজেকে সন্তানের গলগ্রহ ভাবতে হবে না। সন্তানের কাছে সন্মান ও সুসম্পর্কও বজায় থাকবে। নিজের সন্তান হলেও বুঝতে হবে সে সম্পূর্ণ আলাদা একজন মানুষ। তার নিজের সংসার হবে, সন্তান হবে, একজন জীবন সঙ্গী থাকবে। তাদের অনেক চাওয়া-পাওয়া, আকাংখা থাকবে। যেমন একসময় আমাদেরও ছিল। মাঝখানে ‘কাবাব মে হাড্ডি’ হওয়া খুব সুখকর কিছু নয়।

দূরে থাকলেই কেবল দূরত্ব বাড়ে তা নয়। একই ঘরে, একই ছাদের নিচে থেকেও স্বামী-স্ত্রী, বাবা, মা এবং সন্তানের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হতে পারে। হয়ও। তাই সম্পর্কের মধ্যেও সুবাতাস, অক্সিজেন প্রবাহিত হতে দেয়া প্রয়োজন। তাই আমার হিরোদের আমি হাসিমুখে গুডলাক বলতে পেরেছি। বড়ভাইয়ের পদচিণ্হ ধরে ছোটটিও এবার উড়াল দিল।তবে সে আছে আমাদের সাথে, একই রাজ্যে। শুধু ঘরটি আলাদা হল।

ব্রুকলীনের সুন্দর অভিজাত একটি এলাকায় ছোট ছেলেটি তার ডেরা বেঁধেছে। তার বাসার কাছেই সুবিশাল প্রসপেক্ট পার্ক। সেখানে হাঁটতে, দৌড়াতে পারবে বলে সে খুব খুশি। জীবনে কখনও ডর্মে থাকার সুযোগ হয়নি তার। সেই আফসোসটা মনে মনে ছিলই। এবার সুযোগ এসেছে। নিজের মত করে বন্ধুর সাথে থাকার।আমি বা আমার হাসবেন্ড একবারও নিষেধ করিনি। হাসিমুখে সন্মতি দিয়েছি। প্রবাসজীবনে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হবার সমস্ত ধকল একসময় তারা মাথা পেতে নিয়েছিল। স্কুল জীবন থেকেই কাজ করে, কঠোর পরিশ্রম করে তারা বড় হয়েছে। জীবন তাদের কাছে সোনার চামুচ নিয়ে আসেনি। তারা মাটি খুঁড়ে সোনা বের করেছে। তাই নিজের মত করে, মনের আনন্দ নিয়ে জীবন সাজাবার অধিকার তারা অর্জন করেছে। আমাদের আদোর, ভালোবাসা, আশির্বাদ তাদের উপর আছে এবং সবসময়ই থাকবে।

জুলাই মাসের শুরুতেই অমিতের ঘরটিও খালি হয়ে গেল। এঘরেও এখন আমার অবাধ গতিবিধি। ঘুম না এলে আমি একবার এঘর, একবার ওঘর করি। মাঝেমধ্যে একরাত এঘরে, একরাত ওঘরে ঘুমাই। তবুও ইনসমনিয়া যায় না। প্রায়ই নির্ঘুম রাত কাটাই।খেতে বসে ভাল তরকারিটা আমার গলা দিয়ে নামতে চায় না। মনে হয় সুমিত বা অমিত এটা খেতে খুব ভালোবাসে। অমিতের জন্য বক্সে খাবার তুলে রাখি। দু’ একদিন পর পরই সে চলে আসে। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। আমরা নানা গল্প করি। যাবার সময় কিছু খাবার প্যাক করে নিয়ে যায় সে। মায়ের মনে খানিকটা তৃপ্তি আসে।

বাথরুম ক্লিন করা, কিচেন ক্লিন করা সবই এখন সে নিজের হাতে করছে। ট্রেডার জো’স, হোল ফুডস থেকে গ্রোসারি কিনে এনে ফেসটাইমে কল করে অমিত। মাম, দেখ আজ কি কি কিনলাম। আজকের ডিনার কি হবে দেখ। নিজের কর্মক্ষমতায় সে নিজেই উচ্ছসিত। ভাবখানা, “দেখ, আমিও পারি!”

সন্তানরা বড় হয়ে মুভ আউট করলে, এমন পরিস্থিতিতে অনেক বাবা মাই ডিপ্রেশন, লোনলিনেসে ভোগেন। অনেকেরই ইনসমনিয়া দেখা দেয়। অনেকে বাঁচার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। জীবনে হতাশা এসে ভর করে। পশ্চিমা দেশে এটাকে বলে “এম্পটি নেস্ট সিনড্রম”। বাংলায় হয়ত বলা যায় “ শুন্য বাসার হাহাকার”। পাখিও আমাদের মতই বাসা বাঁধে। সঙ্গিনী খুঁজে নেয়। ডিম পাড়ে। ডিমে তা দেয়। একসময় ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়। বাবা পাখি খাবার খুঁজে আনে। মা পাখি মুখে তুলে সন্তানকে খাওয়ায়।তারপর পাখি ছানাদের ডানা হয়। ডানায় শক্তি সঞ্চয় হলেই ছানারা মা বাবাকে গুডবাই বলে উড়ে চলে যায়। বুক ভরা হাহাকার নিয়ে মা এবং বাবা পাখি শুন্য বাসার দিকে তাকিয়ে থাকে। কত স্মৃতি মনে পড়ে। চোখ জলে ভরে আসে। তবুও ছানারা উড়তে শিখেছে সেই আনন্দে, সেই গর্বে মা পাখি, বাবা পাখি তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।

পাখি সমাজে উড়ে যাওয়া পক্ষিশাবকেরা নিজের বাসা তৈরির পর আবার তাদের বাবা ও মা পাখির কাছে দেখাসাক্ষাৎ করতে ফিরে আসে কিনা আমার জানা নেই।তবে মনুষ্যশাবকেরা দেখা করতে বার বার ফিরে আসে। শুন্যনীড়ের সবচেয়ে বড় আনন্দ হ’ল যখন আমাদের নব্যযুবকেরা বাবা মা’র সাথে দেখা করতে ফিরে আসে। সেটা প্রতি সপ্তাহান্তেই হোক বা বছরে একবারই হোক, তাদের ফিরে আসার পদশব্দ এবং দরজা দিয়ে ঠুকতে দেখার রোমাঞ্চই আলাদা।প্রতিটি বাবা-মাই একসময় তাদের বাচ্চাদের এই গ্রো-আপ করার ব্যাপারটি প্রশংসার চোখে দেখতে শুরু করে। পরবর্তীতে সন্তানের প্রতি তাদের প্রত্যাশাও বাড়তে শুরু করে।

বাড়ন্ত সন্তানরা যখন তাদের নিজস্ব জীবন, মতামত এবং তাদের নিজস্ব আবেগ নিয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের মতই বিকশিত হয়ে উঠতে শুরু করে, তারা তাদের শিক্ষা এবং কর্মদক্ষতায় চৌকোশ হয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসে, তখন বিস্মিত, আনন্দিত বাবা মা’র মনে হতেই পারে “হু দিস গ্রোউন-আপ পিউপল আর?”তারা কি আমারই সন্তান? তখন বাবা-মা’র এই খালি বাসাই হয়ে ওঠে সাফল্য, গর্ব এবং দুর্দান্ত সব স্মৃতির স্থান।

তাইতো আমাদের বাচ্চারা বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় যে শূন্যতা তৈরি করে যায় তাতে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। এই সময়টি সেই বাবা মা’দের জন্য দুর্দান্ত এক বিবর্তনের সময়স্বরূপ। পৃথিবীর পথে নিজের সন্তানেরা তাদের নিজস্ব পথ খুঁজে নিতে পারছে, তা দেখাও “এম্পটি নেস্টার” বাবা মা’র কাছে বিরাট এক আনন্দের ব্যাপার।হয়ত সন্তানদের কাছেই হবে তাদের শেখার শুরু।কারণ ততদিনে পৃথিবীও বদলে গেছে অনেক। এই বদলে যাওয়া পৃথিবীতে সন্তানদের দেখানো পথ ধরেই নিজেদের বৃদ্ধবয়সের জীবনেও পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হতে পারে।আনতে হতে পারে নতুনধারার জীবনে অভ্যস্ততা।এভাবেই ধাপে ধাপে জীবনের পালাবদল হতে থাকে।

এভাবেই নানা পালাবদলের মধ্য দিয়ে জন্মের পর থেকে একটি লম্বা পথ আমরা পাড়ি দিয়ে এসেছি। আমার জীবনে এসেছে এখন মধ্যদুপুর বা পড়ন্ত বিকেল। আর কতদূর, কতটা পথ যেতে পারব, তাও জানা নেই।পথ চলতে গিয়ে সামান্য কিছু কষ্ট যা পেয়েছি, সেই কষ্টটুকু পথের কাঁটা মনে করে পথেই ফেলে রেখে এসেছি। পথটুকু পাড়ি দিয়েছি খুশি মনে।আনন্দ নিয়েই পথ হেঁটেছি। “এম্পটি নেস্টার” জীবনটাও মেনে নিয়েছি গৌরবের সাথেই।সেই গৌরব আর আনন্দ নিয়েই বিদায় নিতে চাই এই সুন্দর মায়াময় পৃথিবী থেকে।

লেখক পরিচিতি
শেলী জামান খান।লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম বাংলাদেশে। পুরনো ঢাকায়। ছোটবেলা কেটেছে চাকুরিজীবী বাবার সাথে বিভিন্ন মফস্বল শহরে।উচ্চতর শিক্ষাজীবন ইডেন কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দীর্ঘদিন ধরে বসবাস নিউইয়র্কে।�
সখ লেখালেখি, বেড়ানো, ফটোগ্রাফি।প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ।

 

আরও পড়ুন