Ads

নারীর শব্দহীন কান্না

খলিলুর রহমান

মানবজাতির মধ্যে পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠি হচ্ছে নারী। দৈহিক গঠন, মানসিকতার জগত, চিন্তা-চেতনার পার্থক্যে…….. নারী ও পুরুষ মহান রাব্ববুল আলামীনের এক অনবদ্য সৃষ্টি। নারী একাধারে এক বা একাধিক সন্তানের মমতাময়ী মা, একজন ভালবাসার মানুষের অনুগত স্ত্রী, একজন নতজানু বাবার অকৃত্রিম মহব্বতের আদুরে কন্যা।

একটি মেয়ে শিশু জন্মের পর থেকেই বাবা-মায়ের এক অপার্থিব স্নেহের ছায়ায় বড় হতে থাকে। বাবা তার স্নেহাস্পদ কন্যাশিশুটিকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করে সব সময়। হৃদয়ের সবটুকু আদর-সোহাগ আর সর্বোচ্চ সামর্থ্য অনুযায়ী মেয়েটিকে তিল তিল করে গড়ে তোলে। কন্যাশিশুটির আদব, ভদ্রতা, বিনয়, ধর্মীয় জ্ঞান, একাডেমিক শিক্ষা দানে জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে সংগ্রাম করে যান একজন দায়িত্বশীল বাবার মতো । শত কষ্টেও বাবা তার প্রানাধিক কন্যা সন্তানটির সকল আবদার, ভাল লাগাকে পূরন করে পরিপূর্নভাবে।

এই কন্যা সন্তানটি যখন বিয়ের উপযুক্ত হয় বাবা তখন সবচেয়ে বিদ্যা-বুদ্ধি, ইনকামে অগ্রগামী, বংশ মর্যাদায় শ্রেষ্ঠত্ব একটি পছন্দের ছেলের কাছে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে পাত্রস্থ করে দেয়। জন্ম থেকে বিয়ে দেয়া পর্যন্ত, পেটে ধারন থেকে ভুমিষ্টের সময় মায়ের অসহনীয় যন্ত্রনা, শিশু থেকে লালন-পালন, কিশোরী বয়স পেরিয়ে যুবতী পর্যন্ত বড় করে একদম অপরিচিত একটি ছেলের কাছে তুলে দেয়া যে, কি নিদারুন কষ্টের! তা ভুক্তভোগী বাবা-মা ছাড়া এ সমাজের অন্য কেহ অনুধাবন করতে পারবেনা।

বিয়ের পরে মেয়েটি খুব হাসি-আনন্দ আর উচ্ছলতার মধ্যেই দিনগুলো অতিবাহিত করে। অপরিপক্ক একটি মেয়ে অতি অল্প সময় একেবারে অচেনা এক প্রতিকুল পরিবেশ আর অদেখা মানুষগুলোর সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয় একজন দক্ষ নাবিকের মতো। জীবনে কোনদিন চুলোর কাছে যায়নি যেই আদুরে কন্যাটি, সেই খুকী মেয়েটিই যখন একজন অানুগত্যে টইটুম্বুর মানুষের মতো সংসারের সকল দায়িত্ব পালন করে নিরলসভাবে; তখন অবাক না হয়ে পারে না বাবা নামক প্রানীটি।

অত:পর সদ্য বিবাহিতা মেয়েটির আনন্দময়ী পদচারনা ও উদ্যমী কর্মকান্ড দেখে বাবা-মা গোপনে গোপনে খুব খুশী হয় আর মনে মনে বলে…..আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী! মেয়েটি নতুন জামাই বাড়ি খুব সুখে আছে। অস্ফুটস্বরে দোয়া করে….হে পরওয়ারদিগার! মেয়েটিরর এই সুখকে তুমি দীর্ঘায়িত করো।

কিছুদিন পরে এই ছোট্ট বধুটি একের পর এক বাচ্চা জন্ম দেয়, সংসারের সকল দায়িত্ব সামলায়, সন্তানের লালন পালন করে পরম আনন্দে, শ্রদ্ধাস্পদ স্বাামীধনের সেবা শুশ্রুষায় মনোনিবেশ করে আপন হাতে। এক পর্যায় নতুন বধু হয়ে যায় সন্তানের মা, যত্নশীল স্ত্রী, ঘরের সম্পূর্ন চাবীগুলোর মালিক।
এক সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে নব বধুটি সন্তানকে মানুষ করতে সীমাহীন বিনিদ্র রজনী কাটায়, ভাল ভাল সুষম খাদ্যের অভাবে রক্তশুন্যতায় ভোগে। অন্যদিকে স্বামীসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের অপরিমেয় কেয়ারিং এর বিশালচাপ সহ্য করতে করতে চোখের কোণায় কালি জমা পড়ে, ধীরে ধীরে শরিরের সৌন্দর্য্য- গ্লামারস নষ্ট হয়। সময়ের অভাবে সাজু গুজু করতে না পেরে শ্রী হীন হয়ে পড়ে শরির নামক কায়াটি।
চরম বাস্তব সত্য হচ্ছে…….দাম্পত্য জীবনের এমন বেলায় এসে ঘরের কর্তা তার প্রিয় মানুষটিকে আর আগের মতো ভালবাসে না। কথায় কথায় খোটা দেয়। অযাচিত বাক্যবানে স্ত্রীর জীবনকে বিষিয়ে তোলে এভাবে…..

তুমি সাজতে পারো না,
তুমি এত অসুন্দর কেন?
তোমাকে ভাল দেখায় না,
তুমি আমাকে পূর্বের মত কেয়ার কর না,
ডাকলে কাছে আস না। ইত্যাদি।

অথচ সংসার জীবন… শুরুর প্রথম প্রহরে এই স্বামীই তার স্ত্রীকে কত শত প্রেমের কথা বলে চমকে দিয়েছে। কত সময় ব্যয় করেছে দু’জনে ভালবাসার গল্প বলে। বিয়ের শুরুতে একজন আরেকজনকে না দেখে থাকতে পারত না।

আর আজ বীর বাহাদুর স্বামীর কাছে স্ত্রী অপাংক্তেয়। স্বামাী বেচারা একটু চিন্তাও করেনা তার চাঁদের মত বাচ্চগুলোকে মানুষ করা, দিনরাত সংসারের অপরিমীত খাটুনিতে বেচারীর শরীর, চেহারার সৌন্দর্য্যে ভাটা পড়েছে।

অতপর কিছু স্বামী জীবনের সবচেয়ে চরম কষ্ট আর তিক্ততায় ভরপুর বাক্যটি দিয়ে স্ত্রীর মন জমিনে সারা জীবনের লালিত স্বপ্নকে ভেঙে খান খান করে দেয়।

স্বামী বলে,আমি আর একটি বিয়ে করব। সবাই বলে কেন বিয়ে করবে? তার সরল জবাব…স্ত্রী অসুন্দর এবং সে আমাকে আগের মত ভালবাসেনা তাই আর একটি বিয়ে করব।

কেহ আবার বলে, স্ত্রীর বাচ্চা হয়না তাই বিয়ে করব। অথচ এ ধরনের দম্পতির ক্ষেত্রে দেখা যায়…..স্ত্রীর বাচ্চা ধারন করতে কোন সমস্যা নেই। কেহ আবার নতুন কোন যুবতী মেয়ের প্রেমে পড়ে নিজ সাজানো সংসারকে ত্যাগ করে দ্বিতীয় বিয়ে করে। আর প্রথম স্ত্রীকে বেবি সহ তালাক দিতেও কুন্ঠাবোধ করে না। বর্তমানে এ ধরনের তালাকের প্রবনতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

হযরত রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহতা’য়ালার কাছে হালাল কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বা রাগের উদ্রেক সৃষ্টিকারী কাজ হলো… স্ত্রীকে তালাক দেয়া ও ভিক্ষা করা।

যেই লাজুক রাঙা সারল্যে উদ্বীপ্ত মেয়েটি এক সাগর আশা নিয়ে অপরিচিত একটি ছেলেকে জীবনের সবচেয়ে আপন ভেবে সংসার নামক অধ্যায়ের শুভযাত্রা করেছিল, সংসারের মায়ায় তার অতি পরমাত্মীয়দের ছেড়ে স্বামীকে আপন করে নিয়েছিল সারা জীবন একই ছাদের নীচে থাকবে বলে; সেই প্রিয় মানুষটি যখন এক সময় দাজ্জালের মত অাচরন করে তাকে ছেড়ে চলে যায়; তখন সেই স্ত্রীর মনোজগতে কি পরিমান কষ্টের রক্তক্ষরন হয়, তা যদি কান পেতে কেহ শুনতে পারত ; তবে সে শব্দহীন কান্না দিয়ে এক একটি বড় বড় উপন্যাস রচনা করতে পারত।

স্বামীর এহেন বর্ণনাতীত নির্যাতন-অত্যাচারে অতীষ্ট হয়ে বাচ্চা সহ মেয়েটি অকুল সাগরে গন্তব্যহীন ছুটে চলে কচুরিপানার মতো। কিছু চালাক-চতুর স্ত্রীরা কোন কোন সময় আদালতের শরনাপন্ন হয় বিচারের আশায়। আবার কেহ লোক লজ্জার ভয়ে নীরবে সব সহ্য করে । বর্তমানে কোর্টগুলো এ ধরনের কেস মামলা দিয়ে ঠাসা।

একসময় কোথাও ঠাঁই না পেয়ে মেয়েটি বাবার বাড়িতে এসে চোখর জল ফেলে। বাবা তার আদুরে কন্যার অবিরাম অশ্রু ধারায় মেয়েটির অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব করে নিজেও অস্ফুট স্বরে কাঁদে।এ সমাজের চারদিকে নারীদের এ ধরনের বাক্যহীন, শব্দহীন কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে।

দাম্পত্য জীবনের এ দুরবস্থায় সঠিক ধর্মীয় জ্ঞানের প্রয়োগ, পরকালের জবাবদিহীতা, আকাশ সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রন, স্মার্ট ফোনের অপব্যবহার রোধ, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধকরন, ছোট ছোট মাসুম বাচ্চার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করা, ইসলামী স্কলারদের কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে তালাক ও বিবাহ বিচ্ছেদের মত নিষ্ঠুর কার্যক্রম বন্ধকরনে সহায়ক ভুমিকা পালন করতে পারে।

মনে রাখতে হবে…একটি বন্ধনকে ছিন্ন করা খুব সহজ কিন্ত অসহায় বাচ্চা ও বিধবা নারীর নীরব কান্না সহ্য করা অনেক কঠিন।এ সমাজ থেকে অপ্রয়োজনীয় বহুবিবাহ, তালাকের মত জঘন্য কাজ নির্মুল হয়ে নারীর শব্দহীন কান্না বন্ধ হোক চীরতরে সে কামনা আমাদের সকলের। আল্লাহ বিবাহিত পুরুষদের সঠিক জ্ঞান দিন।

লেখক; কলাম লেখক

আরও পড়ুন