Ads

বিশ্ব হিজাব দিবসঃ মুসলিম নারীদের জন্য এর তাৎপর্য ।। ২য় পর্ব

দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব

।। জামান শামস ।। 

হিজাব-নিকাবের ব্যাপারে কোরআন ও হাদিস থেকে দলিল

নির্ভরযোগ্যতা ও রাবির ভিত্তিতে নিচে কিছু সহিহ ও হাসান হাদিস তুলে ধরা হলো:

আয়েশা সিদ্দিকা রা. থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, ِরাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লাম ফজরের সালাত আদায় করতেন, তখন তাঁর সঙ্গে অনেক মুমিন মহিলা চাদর দিয়ে গা ঢেকে শরিক হতেন। তারপর তাঁরা নিজ নিজ ঘরে ফিরে যেতেন। রাতের অন্ধকারের জন্য তখন কেউ তাঁদের চিনতে পারত না। (সহীহ বুখারী ৫৭৮)

আলিমরা এ হাদিসের বিশেষ কিছু শব্দের ওপর আলোকপাত করেছেন। যেমন, ‘রাতের অন্ধকারের জন্য তখন কেউ তাঁদের চিনতে পারত না’- এর ব্যাখ্যায় হাফিজ ইবনু হাজার রাহ. বলেন, আদ দাউদির মতে, এ শব্দগুলোর অর্থ হচ্ছে রাতের আঁধারের কারণে পর্যবেক্ষকের পক্ষে তাদের নারী-পুরুষ পার্থক্য করা কঠিন ছিল; কেবল মানবাকৃতি বলে মনে হতো। (ফাতহুল বারী,ইবনে হাজার আসকালানী)

এর আরেকটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, নারীকে চেনা যাবে না, তার পরিচয় শনাক্ত করা যাবে না।’ কিন্তু এটি দূর্বল যুক্তি। কারণ, দিনের বেলাতেও নারীকে শনাক্ত করা যাবে না, যদি তিনি চাদর দ্বারা আবৃত হন। তাই এই যুক্তিটি অকার্যকর।অবশ্য শায়খ ইবনু উসাইমিন ব্যাখ্যা করেন, এই হাদিসে এটি স্পষ্ট যে, ইসলামি পোশাকবিধি অনুযায়ী সম্পূর্ণ দেহ ঢাকতে হবে। কেবল চেহারা ও হাত ঢেকে রাখলেই নারীকে চেনা অসম্ভব হবে। এটা ছিল সাহাবিদের বুঝ ও চর্চা। এ ছাড়া তাঁরা হলেন শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে সর্বোচ্চ সম্মানিত। তাঁদের ইমান পূর্ণাঙ্গ এবং তাঁদের চরিত্র সর্বশ্রেষ্ঠ। তাই সাহাবিদের সময়ের নারীদের চর্চা যদি হয় পূর্ণ পর্দা করা, তাহলে আমরা কীভাবে তাকে ব্যতিক্রম করতে পারি ?

মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা বর্ণনা করেন, আমি এক নারীকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালাম। আমি তাকে দেখার জন্য চুপিসারে তার বাগানে যাতায়াত করতাম এবং সেখানে তাকে দেখে ফেললাম। তাকে বলা হল, ‘তুমি রাসুলের সাহাবি হয়েও এটা কী করলে?’ আমি তাঁদের বলি, আমি রাসুল এর কাছ থেকে শুনেছি, ‘যখন কেউ কোনো নারীকে বিয়ের ইচ্ছা পোষণ করে, তখন সে ওই নারীকে দেখলে তাঁর কোনো পাপ হবে না। ‘(সুনানে ইবনু মাযাহ ১৮৬৪)

মহানবী সা: নারীজাতির শাস্তির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ১. আমি জাহান্নামে একজন মহিলাকে তার মাথার চুল দ্বারা ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পেলাম ওই সময় তার মাথার মগজ ফুটন্ত পানির ন্যায় টগবগ করে ফুটছিল। ২. একজন মহিলাকে স্বীয় স্তনে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পেলাম অর্থাৎ সমস্ত শরীরের ওজন স্তনের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।নবী কন্যা ফাতিমা রা: এ শাস্তির কারণ জানতে চেয়ে আরজ করলেন আব্বাজান! মহিলাদের এই ভয়াবহ শাস্তি ভোগের কারণ কি? উত্তরে মহানবী সা: এরশাদ করলেন : ‘নারীর শাস্তির প্রথম কারণ : যে মহিলা স্বীয় মাথার চুল দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় সাজা ভোগ করতে দেখেছিলাম তার এই শাস্তির কারণ হলো, সে চলার পথে পরপুরুষ থেকে নিজের চুলকে ঢেকে রাখত না। নগ্ন মাথায় পর পুরুষকে দেখানোর জন্য চুল ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে মহিলাদেরকে মাথা ঘাড় ও বুক মোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন।

আয়েশা সিদ্দিকা রা. থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, অনেক কাফেলা (হজের মৌসুমে) আমাদের অতিক্রম করছিল; আর আমরা ইহরাম অবস্থায় রাসুলের সঙ্গে ছিলাম। তাঁরা আমাদের সামনে এসে পড়লে আমাদের স্ত্রীলোকেরা মাথায় কাপড় টেনে মুখ ঢাকতেন। আর তাঁরা সামনে থেকে দূরে সরে গেলে আমরা আমাদের মুখমণ্ডল খুলতাম। (সুনানে আবু দাউদ ১৮৩৩) এ হাদিসে আয়েশা রা. বলছেন যে, তিনি ও তাঁর সঙ্গে থাকা অন্য নারীরা তাঁদের চেহারা ঢাকতেন, যখন কোনো কাফেলা তাঁদের কাছাকাছি আসত। এই হাদিসে নির্দিষ্টভাবে রাসুলের স্ত্রীদের কথা বলা হয়নি; বরং এটি সাধারণ আদেশ।

সুতরাং কুরআন ও হাদীসের যে নির্দেশিকা তাতে স্পস্ট যে কেবল মাথায় এক টুকরা বস্ত্রই হিযাব মিন করে না। বরং মাথাসহ ঘাড়,গলদেশ,বুক,হাতের কব্জি ও পায়ের পাতা পর্যন্ত নারীদের আওরাহর সীমা এবং এসব অংগ আবৃত করারই নির্দেশ।একই সংগে নারীদের পোশাক পুরুষের পোশাকের সাদৃশ্য বহন করবে না,আঁটসাঁট ও স্বচ্ছ (Tight and Transparent) হতে পারবে না।

আবুল বারাকাত আল দারদি রহঃ বলেন, গায়রে মাহরামের সামনে নারীর আওরাহ হচ্ছে তার পুরো দেহ; চেহারা ও হাতের তাল ছাড়া। এ দুটো অংশ আওরাহর অংশ না হলেও ফিতনার আশঙ্কায় চেহারা ও হত ঢেকে রাখা নারীরের জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা।(আশ শারহুল সাগির ৪০১)

হিজাব শব্দটি অনেক মুসলমান ব্যবহার করেন মাথায় কাপড় দিয়ে ঢাকা যা হতে পারে চেহারা সহ বা চেহারা ছাড়া , শুধু মাত্র চোখ ব্যতীত আবার কখনো কখনো একচোখও আবৃত করে রাখা। আরবি শব্দে হিজাবকে অনুবাদ করা হয় ঘোমটা,পর্দা আবৃত করে রাখা, ঢেকে রাখা অন্য অর্থে হিজাব বোঝায় পর্দা ঘেরা, বিভাগ বিভক্ত অবস্থা বিভাজক ইত্যাদি।

এটি কুরআনে সাত বার এসেছে, এর মধ্যে ৫ বার হিজাব এবং ২ বার হিজাবান দেখুন: হিজাব অর্থে ৭:৪৬ (প্রাচীর ), ১৭:৪৫ (প্রচ্ছন্ন পর্দা ), ১৯:১৭ (নিজেকে আড়াল করার জন্যে সে পর্দা করলো), ৩৩:৫৩ (পর্দার আড়াল থেকে চাইবে), ৩৮:৩২ (সূর্য ডুবে গেছে বা সূর্য আড়ালে গেছে), ৪১:৫ (আমাদের ও আপনার মাঝখানে আছে অন্তরাল), ৪২:৫১ (কিন্তু ওহীর মাধ্যমে অথবা পর্দার অন্তরাল থেকে)।

এই আয়াত সমুহের হিজাব শব্দটি কোরআনে একবারও সেই অর্থে ব্যবহার হয়নি যা আমরা সাধারণ মুসলমানগণ হিজাব বলে থাকি ।  মানে হিজাব শব্দটি নারীদের ড্রেস কোড হিসেবে বলা হয়নি। তাহলে সেটা একটা পার্ট হয়,সম্পূর্ণ গেহ নয়। সূরা নুর ৩১ আয়াতের শেষ অংশে আছে

وَ لَا یَضۡرِبۡنَ بِاَرۡجُلِهِنَّ لِیُعۡلَمَ مَا یُخۡفِیۡنَ مِنۡ زِیۡنَتِهِنَّ ؕ

তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে” অর্থাৎ তাদের শরীরের গোপন সাজ-সজ্জা দেখা যাবে কি না সেটা নির্ভর করে কোন ধরনের ড্রেস নারী পরিধান করে তার উপর মাথার কাপড়ের জন্য নয়। এই আয়াতে “জিনাতাহুননা” শব্দটি নারীর (সোন্দর্য)বডির অংশ নির্দেশ করে। শেষের দিকে আল্লাহ বলেন নারী যেন জোরে পদচারনা না করে তাদের সৈন্দর্য (জিনাত) প্রকাশের জন্য। নারীর সৌন্দর্য (গহনা বা অন্যকিছু ) প্রকাশের জন্য তার জোরে হাটার দরকার নেই কিন্তু যে ভাবে সে হাটবে বা জোরে হাটলে নারী তার প্রভাবে নারী শরীরের কিছু অংশ বোঝা যায়।

সূরা নুর আয়াত ৩১ থেকে আরো বোঝা যায়, পরপুরুষকে আকৃষ্ট করে এমন সব কাজ থেকে বিরত থাকা ঈমানদার নারীর কর্তব্য। কারণ পরপুরুষকে নুপুরের আওয়াজ শোনানোর উদ্দেশ্যে সজোরে পদনিক্ষেপ হাটা যখন নিষেধ করা হয়েছে তখন যে সকল কাজ, ভঙ্গি ও আচরণ এর চেয়েও বেশি আকৃষ্ট করে তা নিষিদ্ধ হওয়া তো সহজেই বোঝা যায়। মুসলিম নারীদের জন্য এটি আল্লাহ রাববুল আলামীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

অনেকে বলে, ‘মনের পর্দা বড় পর্দা। বাহ্যিক কোনো পর্দার প্রয়োজন নেই’ এরূপ উক্তি সম্পূর্ণ কুরআন-হাদিসের বিরোধী, কুফরি বা ঈমান বিধ্বংসী কথা। এমন কথা বললে বা বিশ্বাস করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। এসব কথা তারাই বলে যারা নারী পুরুষ অবাধ মেলামেশাকে প্রমোট করেন এবং এর আড়ালে নষ্টামীর প্রাকটিস করেন।আবার কেউ পর্দা করলে তাকে ঠাট্টা করতেও বলা হয়,‘মনের পর্দা ঠিক না করে বাইরে হিযাবী হলে কি লাভ ?’ আবার কেউ কেউ বেপর্দা থাকাকে আধুনিকতা মনে করেন। অবাধ মেলামেশাকে বলেন,ভাই-বোন সম্পর্ক।

এ কারণে বলছিলাম,পর্দা ইস্যুটা সামগ্রিক। এটা যেমন নারীর দেহ সম্পর্কিত, তেমনি তার চিন্তা সম্পর্কিতও। তাই আল্লাহ তাআলা পর্দার একটা পরিপূর্ণ গাইডলাইন দিয়েছেন আবার একই সংগে বলেছেন ذٰلِكُمْ اَطْهَرُ لِقُلُوْبِكُمْ وَ قُلُوْبِهِنَّ এই বিধান তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ। (সূরা আহযাব ৫৩) সুতরাং এটা পরিস্কার যে,নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য পর্দা নামক ইনস্টিটিউশানের মাধ্যমে আল্লাহ একটি ব্যাপক বিস্তৃত সমাজ সংস্কৃতি চান যা হবে সকল দিক থেকে পংকিলতামুক্ত ও পবিত্র। তাই কেবল বিশেষ একটি দিনে মাথায় একখন্ড বস্ত্র পরিধান করার বা অন্য ধর্মের নারীদের পরিধান করিয়ে হিযাবের প্রতি একাত্মতা প্রকাশে সীমাবদ্ধ না রেখে পর্দার প্রচলন ও তার মুখ্য উদ্দেশ্য অর্জনের আহ্বান জানানো অধিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর বিশ্ব হিযাব দিবসে পর্দার এ আসল ও তাৎপর্যময় লক্ষ্যই অর্জিত হোক। এই প্রত্যাশা করি সব সময় ।

আগের পর্ব ( প্রথম পর্ব)- বিশ্ব হিজাব দিবসঃ মুসলিম মহিলাদের জন্য এর তাৎপর্য কি?

লেখকঃ জামান শামস, কলাম লেখক এবং সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন এবং সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হইন । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

আরও পড়ুন