Ads

বাংলার নারীর উচ্চশিক্ষার দিশারীঃ ফজিলতুন নেসা জোহা

।। শাহানারা স্বপ্না ।।

আজকের সময়ে বাংলাদেশের নারী সমাজ কত সহজে স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে যাচ্ছে,  ডাক্তারী ইন্জিনিয়ারিং শিখছে । শুধু তাই নয় শিক্ষার এমন কোন দিক নেই, কাজের এমন কোন শাখা-প্রশাখা নেই, যেখানে মেয়েদের পদচারনা পড়েনি। প্রতিটি সেক্টর প্রতিটি অঙ্গনই আজ নারীদের পদভারে প্রকম্পিত! কিন্তু আজ থেকে ৯৬ বছর আগের পরিস্থিতি ছিল একেবারে ভিন্ন। তখন কোন মুসলিম মেয়ে ঘরে বার হয়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে, এ ছিল কল্পনার বাইরে। তখনো বৃটিশদের প্রবর্তিত বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষার প্রসার হয়নি,  তেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। ছেলেদের জন্য মাত্র তিনটি স্কুল তৈরী করা হয়েছিল ঢাকায় ।  ১৮৩৫ সালের ঢাকা কলোজিয়েট স্কুল, ১৮৭৪ সালে ইসলামিয়া সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় ও গভ: মুসলিম হাইস্কুল। মেয়েদের কোন বিদ্যালয় ছিল না। কুমিল্লায় নবাব ফয়জুন্নেসা ১৮৭৩ সালে মেয়েদের জন্য স্থাপন করেন ’ফয়জুন্নেসা গার্লস স্কুল। অবশেষে ১৯৪০ সালে ইডেন স্কুল ও কলেজ স্থাপন করা হয় ঢাকায়।

ভারতবর্ষের সাতশ’ বছরের গৌরবময় মুসলিম শাসন শেষে ১৭৫৭ সালে বৃটিশরা এদেশে ঔপনিবেশিক শাসন চালু করে। দুশ’ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন, শোষন ও নিষ্পেষণে  ভারতের মুসলিম সমাজ ছিল অবরুদ্ধ। রাষ্ট্রীয় সমস্ত অবকাঠামো থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করা হয়েছিল।  যার ফলে গৌরবময় ঐতিহ্যশীল সমাজে দেখা দেয় চরম হতাশার অন্ধকার।  সাময়িকভাবে তারা ডুবে যেতে থাকে অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের নিগড়ে। ১৮৩৫ সালে ইংরেজরা এদেশের প্রচলিত সব ভাষা বন্ধ করে শুধুমাত্র ইংরেজী ভাষা চালু করে এবং মুসলমান আমলে শিক্ষাখাতে বরাদ্দকৃত যাবতীয় লাখেরাজ ভূমি বাজেয়াপ্ত করে নেয়। এতে মুসলমানদের শিক্ষাক্রম বন্ধ হয়ে যায়  ও শিক্ষার সাথে জড়িত সকলেই  বেকার হয়ে পড়েন। নি:স্ব ও দারিদ্রতার কবলে পড়ে কালের প্রবাহে দূরে সরে পড়ে জ্ঞানার্জন থেকে। মেয়েদের জ্ঞানার্জনও একপ্রকার নিষিদ্ধ থাকে।

সেই ঘোর দুর্দিনের অন্ধকার ফুঁড়ে আবির্ভূত হলেন টাঙ্গাইলের করোটিয়ার এক গাঁয়ের মেয়ে-ফজিলতুন নেসা। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে  অবিভক্ত বাংলার মুসলিম মেয়ে ফজিলতুননেসা উচ্চশিক্ষা সিঁড়ির শীর্ষে উঠে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন।

ফজিলতুন নেসা ১৯০৫ সালে জন্ম নেন টাঙ্গাইল জেলার করটিয়া থেকে দুই মাইল দুরে ‘কুমল্লীনামদার’ গ্রামে। পিতার নাম আবদুল ওয়াজেদ খান। করটিয়ার জমিদারী সেরেস্তায় চাকরীতে নিযুক্ত ছিলেন। তখন কারও কন্যা সন্তান পড়তে দেখলে সমাজের লোকেরা নিন্দায় সোচ্চার হতো। তবুও পূর্ব-শিক্ষার আলোক একেবারেই নিভে যায়নি। অনেক অভিজাত পরিবারে তখনো শিক্ষার প্রদীপ নিবু নিবু জ্বলছিল। সে রকমই ছিল ফজিলতুন নেসার পিতার পরিবার। মুসলিম আমল থেকেই পরিবারে শিক্ষা-দীক্ষার প্রচলন ছিল। সমাজের মূর্খদের নিন্দাার ডালি উপেক্ষা করে তাই আবদুল ওয়াজেদ খান কন্যার শিক্ষাক্রম জারী রাখতে পেরেছিলেন।

আরও পড়ুন-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেনো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো?

ফজিলতুন নেসার ছয় বছর বয়সে পিতা তাকে ‘করোটিয়া সরকারী প্রাথমিক স্কুলে’ ভর্তি করেন। এখানে প্রতিটি ক্লাসে তিনি প্রথম হন। এতে তার শিক্ষার প্রতি পিতা খুবই আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গাঁয়ের লোকের কথা উপেক্ষা করে তিনি  সন্তানের শিক্ষার দিকে আরো বেশী যত্নশীল হন  এবং গাঁয়ের স্কুল শেষে শহরে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প করেন।  গাঁয়ের পরিবেশে এবং আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে তিনি তীব্র বাঁধার সম্মুখীন হন। কিন্তু শিক্ষার সুফলতার  প্রতি অবিচল মনোভাব থাকায় সমস্ত প্রতিকূলতাকে দূরে সরিয়ে দেন।

তিনি ফজিলতুন নেসাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি করে দেন তখনকার একমাত্র সরকারী নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠান- ‘ইডেন গার্লস হাইস্কুল এন্ড ইন্টারমিডিয়েট  কলেজ’ এ। ১৯২১ সালে তিনি এখান থেকে ম্যাট্রিকুলেট পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগের সকল পরীক্ষার্থীদের মাঝে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। গৌরবোজ্জ্বল ফলাফলের জন্য  প্রথম শ্রেনীর বৃত্তি লাভ করেন। এখান থেকেই ১৯২৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায়ও  তিনি কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন এবং এবারও বৃত্তিলাভ করেন।

১৯২৩ সালে ফজিলতুন নেসা কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হয়ে সৃষ্টি করেন এক যুগান্তকারী ঘটনা। সেখানকার উচ্চশিক্ষার রুদ্ধ কপাট মেলে ধরেন মুসলিম মেয়েদের সামনে। একমাত্র মুসলিম মেয়ে হিসেবে তিনি কোনঠাসা হয়ে ছিলেন না; বরং মেধায়, মিষ্টি ব্যবহারে, সৌজন্যে, শিক্ষায় ও সরলতায় সকলের মন জয় করে নেন। দু’বছর পর ১৯২৫ সালে ডিস্টিংশন নিয়ে বি এ পাস করেন। আর্টসে ডিস্টিংশন পাওয়া অনেক কঠিন। সেই অসাধ্য কাজ সাধন করে তিনি সেদিন বাংলার মুসলিম সমাজের মুখ উজ্জ্বল করেন এবং বেথুন কলেজে  মুসলিম নারীর উচ্চশিক্ষার মজবুত বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯২৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন  মিশ্র অংক শাস্ত্রের মত কঠিন বিষয়ে।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে  এম এ  ক্লাসে ফজিলতুন নেসাই  একমাত্র  প্রথম মুসলিম নারী শিক্ষার্থী। ১৯২৭ সালে ফলিত গনিত শাস্ত্রের এম এ পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণীতে ১ম স্থান অধিকার করেন। সে সময় পর্যন্ত ভারতীয় নারীদের মধ্যে  আর কেউ অংকশাস্ত্রে এরূপ কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। খবরটি ফলাও করে প্রকাশ করেন নারী জাগরনের অগ্রদূত মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন তাঁর ‘সওগাত’ পত্রিকায়। এরপর ফজিলতুন নেসা উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে এ ব্যাপারে আবেদন করলে তা নাকচ করা হয়।

আরও পড়ুন-বেগম রোকেয়া ধর্মহীনা না ধর্মমনা?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে একজন মেয়েকে বিলেতে পাঠাতে অস্বীকৃতি জানায়।  ফজিলতুন নেসা সওগাত সম্পাদক নাসির উদ্দিন ও খান বাহাদুর আবদুল লতিফ এর সহায়তায় ‘ষ্টেটস স্কলারশীপ’ যোগাড় করেন। ফলে তাঁর বিলেত যাওয়ার পথ সুগম হয়। তিনিই একমাত্র মুসলিম নারী, যিনি সেকালে সরকারী বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ পড়ি দেন, যখন স্কুল-কলেজের চৌকাঠ ডিঙ্গিয়েছেন হাতে গোনা মাত্র ক’জন নারী মাত্র। এই বিরাট সাফল্য অবশ্যই এক ঐতিহাসিক ঘটনা। অবিভক্ত বাংলায় ফজিলতুন নেসাই প্রথম মুসলিম নারী যিনি সরকারী বৃত্তি পেয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন। বিলেতে তিনি খুবই সক্রিয়ভাবে দুই বছর একাডেমিক শিক্ষা-সময় পার করেন। ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ পিতার গুরুতর অসুখের খবর পেয়ে কোর্স শেষ না করেই তিনি দেশে ফিরে আসেন। এরপর আর তাঁর বিলেত যাওয়া হয়নি।

১৯৩০ সালে তিনি লন্ডন থেকে ফিরে কলকাতায় স্কুল ইন্সপেক্টরের চাকুরিতে যোগদান করেন। এরপর ১৯৩৫ সালে কলকাতার বেথুন কলেজে গণিতের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান দেন । তিনিই ছিলেন প্রথম বেথুনের মুসলিম অধ্যাপক। বেথুন কলেজের তিনি শুধুমাত্র জাঁদরেল মুসলিম নারী অধাপকই নন, ছিলেন মেথামেটিকসের হেড অব দি ডেপার্টমেন্ট। বেথুন কলেজে তাঁর সরাসরি ছাত্রী এবং পরবর্তীতে সহকর্মী অধ্যাপক আখতার ইমাম খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখেছেন। আখতার ইমাম ছিলেন তাঁর খুবই ঘনিষ্ট  মিত্র এবং অবসর জীবনের বন্ধু। বেথুন কলেজে অধ্যাপক হিসেবে মিসেস জোহার অনেক কদর এবং ফজিলতুন নেসা নিজের গাড়ি চড়ে কলেজে আসতেন বলে তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন। “বেথুনে একমাত্র মুসলিম প্রফেসর ফজিলতুন নেসার কাছে অংক ক্লাস করতে পেরে গর্বিত বোধ করতাম। সে যুগে মুসলিম মহিলা-শিক্ষার প্রসারটা মোটেও উল্লেখযোগ্য ছিল না।  সে ক্ষেত্রে মিসেস জোহা বিজ্ঞান ও কলা বিভাগে অধ্যাপনা করতেন”।…মিসেস জোহার গাড়িটির কথা খুবই মনে আছে। প্রায়ই তাঁর শিশু কন্যা একজন বিহারী আয়ার সঙ্গে গাড়িতে করে মাকে নিয়ে যেতে আসতো। এতে আমি হৃদয়ে একটা তৃপ্তির স্পর্শ পেতাম। মনে হতো আমাদের মুসলিম সমাজের একজন অধ্যাপক এমন শান-শওকাতে বেথুনে কর্মরত আছেন। আরো ভাবতাম ফতুলদি কতো মেধাবী নচেৎ অঙ্কস শাস্ত্রে এতো বড় সরকারী চাকরী একজন মুসলিম মহিলা কি করে পেতে পারেন?….বেথুন কলেজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম ফার্স্টগ্রেড কলেজ। সেখানে সে যুগেই অনেকগুলো বিষয়ে অনার্স পড়ানো হতো। সেই কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল একজন মুসলিম মহিলা। মিসেস জোহার পদটি যে মুসলমানদের মধ্যে কতখানি গৌরবের বিষয় ছিল সে কথা সে যুগে কতজন উপলব্ধি করেছিলেন বলা কঠিন।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর স্বেচ্ছায় তিনি বেথুন কলেজের  প্রিন্সিপাল পদের লোভনীয় হাতছানি  বিসর্জন দিয়ে  পূর্ব-পাকিস্তানে চলে আসেন। এখানে বেথুনের সম-মানের কোনো কলেজ না থাকায়  বাধ্য হয়ে একমাত্র  ইডেন গার্লস হাই স্কুল ও কলেজের প্রিন্সিপাল হন। “ এটি আসলে  কামরুন্নেসা স্কুল ও কলেজের সঙ্গে ইডেন স্কুল ও কলেজ একত্রিত হয়ে গঠিত হগয় দেশ বিভাগের ফলশ্রুতিতে”। মিসেস জোহা কাজের দায়িত্বভার গ্রহন করেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন স্কুল-কলেজ সম্মিলিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অসুবিধেগুলো”।

আরও পড়ুন-ফজিলতুন্নেসা: ঢাবি’র প্রথম মুসলমান ছাত্রী

চারদিকে জোরতালে চলছিলো দেশ গড়ার কাজ। মিসেস জোহা চিন্তা করতে লাগলেন কি করে ইডেন ও কামরুন্নেসার স্বাধীন সত্ত্বা প্রতিষ্ঠা করা যায়। এ ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে প্রস্তাব পেশ করলেন। সরকারও সহানুভূতির সাথে সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হলো।  অবিলম্বে সরকারী আদেশ জারী হলো। কামরুন্নেসার স্কুল সেকশন এবং ইডেনের স্কুল সেকশন একত্রিত হয়ে ‘কামরুন্নেসা স্কুল’ নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করলো এবং কামরুন্নেসা ও ইডেনের কলেজ সেকশন দু’টো একত্রিত হয়ে রূপান্তরিত হলো ‘ইডেন কলেজ’ নামে। ..সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি সম্ভব হলো একমাত্র মিসেস জোহার পূর্ব পাকিস্তানে নারীর উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের প্রতি আগ্রহ, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার কারণে”।

বকশি বাজারে অবস্থিত  নবকুমার স্কুলের একটি শাখা ছিল জয়নাগ রোডের দোতলা বাড়িতে। সেখানেই প্রথম পূর্ণ কলেজ হিসেবে ইডেন স্কীকৃতি পেলো। কিন্তু বাড়িটি ছিল খুবই ছোট। ফজিলতুন নেসা অনেক চেষ্টা  ও পরিশ্রম করে সরকারের কাছ থেকে পারমিশন আদায় করলেন ‘বকশি বাজার নবকুমার স্কুল’ এ এটিকে স্থানান্তর করার জন্য। এখানকার জায়গা বেশী বড় না হলেও কয়েকটি আলাদা আলাদা একতলা দোতলা বিল্ডিং ছিলো।  সুতরাং প্রশাসন অফিস, টিচার্স কমন-রুম, এবং প্রিন্সিপাল অফিসের স্থান হয়ে গেল।

এদিকে  ইডেন কলেজের ছাত্রী সংখ্যা অতি দ্রুত বাড়তে লাগলো। ফজিলতুন নেসার দৃষ্টান্ত  অনুসরণ করে পূর্ব বাংলায় নারী  শিক্ষায় জোয়ার সৃষ্টি হলো। “এমন কি বিজ্ঞান সেকশন খোলার তাগিদ আসতে থাকলো অনবরত, যা কোনো ক্রমেই সম্ভব ছিলো না ইডেনের সে সময়ের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। কলা বিভাগের শিক্ষক যোগাড় করার ঝামেলা তখনো শেষ হয়নি। কিন্তু সমাজ নারী শিক্ষা সম্প্রসারণে এতো তাড়াতাড়ি সচেতন হয়ে পড়লো যে, একই সময়ে চারদিক থেকে কলা বিভাগে ডিগ্রী কলেজ খোলারও প্রেসার আসতে থাকলো। অদম্য উৎসাহে তিনি ইন্টারমিডিয়েটে বিজ্ঞান বিভাগ এবং বি এ ডিগ্রী ক্লাস খোলার সিদ্ধান্ত নেন”। এসব কাজ বাস্তবায়নে অপরিসীম মেধা, যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তিনি দিনের পর দিন সরকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। অবশেষে এই অসাধারণ ব্যাক্তিত্বময়ী দুরূহ কা্জগুলি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন। তিনি ১৯৪৮ সালেই ডিগ্রী ক্লাসের কাজ শুরু করে দিলেন। অসংখ্য রকমের সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা দূর করতে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের অসাধারণ প্রভাব খাটিয়ে নব-লব্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সংকট দূর করতে সচেষ্ট হন।

তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও অবিরাম প্রচেষ্টায় ১৯৫০ সালে ইডেন কলেজে  বিজ্ঞান বিভাগ শুরু হয়ে গেল। কিন্তু বিজ্ঞানের বিষয়গুলো ইডেনে পড়া  সম্ভব ছিলো না। তখনো বিজ্ঞানের শিক্ষক, ল্যাবরেটরী ইত্যাদি কিছুই নেই। ফজিলতুন নেসা সরকারের সহযোগিতায় অনেক কাট-খড় পুড়িয়ে মেয়েদের বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন ‘ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ’ এ।  তখন ঢাকা কলেজ রমনার নিজস্ব ভবন থেকে  স্থানান্তরিত হয়ে ঢাকার সিদ্দিক বাজারে অবস্থান করছিলো। সে যুগে মেয়েদের পক্ষে সিদ্দিক বাজারে যাতায়াত সহজ ছিলো না। তখন বিজ্ঞানের ছাত্রীদের জন্য ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা করেন। এভাবে একের পর এক বাধা পেরিয়ে তিনি ছুটতে থাকেন সাফল্যের পথে।

আরও পড়ুন- হার্ভার্ডের মতো একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে হবে কি?

দিনে দিনে ইডেনের ছাত্রী সংখ্যার চাপে আর নবকুমার স্কুলে জায়গা হচ্ছিল না, অসংখ্য সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।  এসব  সমস্যা সামাধানে তিনি সরকারের শরনাপন্ন হন। ইডেনের জন্য ভবন নির্মাণে সরকারের সহানুভূতিপূর্ণ অনুমোদন পান। কিন্তু এতবড় জায়গা পাওয়া নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আজিমপুরের ’ধাঙড় কলোনী’কে নির্বাচন করা হলো। এ্যখানেই তৈরী হবে ছাত্রীদের কলেজ এবং হোস্টেল! এখানকার সুইপার ও তাদের শুকর পালের জন্য অন্যত্র জায়গা করে দেয়া হলো। ফজিলতুন নেসার আন্তরিকতায় ও সরকারের সহযোগিতার সম্মিলনে এদেশে নারী শিক্ষার যুগান্তকারী অধ্যায় শুরু হলো।  ইডেন কলেজের নিজস্ব ভবনের প্রথম ধাপ ফজিলতুন নেসার তত্ত্ববধানেই তৈরী হলো। আর তখন থেকেই দূর হলো বাংলাদেশের নারী শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা। নতুন একটি দেশের দুর্গম পথ কেটে শিক্ষা সম্প্রসারণের কাজটি তিনি যথার্থভাবেই  এগিয়ে নিয়ে যান।

ফজিলতুন নেসা নারী-শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর সারগর্ভ বহু প্রবন্ধ লিখেছেন তৎকালীন ’সওগাত’সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। তিনি  শিক্ষায়, সমাজ সংস্কারে, ক্ষুরধার লেখনিতে অসামান্য মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। কলকাতার অ্যালবার্ট হলে অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় মুসলিম সমাজ-সেবক-সংঘে’র বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতি হিসেবে তার বক্তব্যটি নারী জাগরণের মাইল ফলক হয়ে আছে। তিনি আমাদের গৌরবদীপ্ত ইতিহাসের অংশীদার, সুমহান ঐতিহ্যের অধিকারী। অথচ নিদারুন উদাসীন ও অবহেলায় আলোকিত এ মহান  নারী-ব্যাক্তিত্ব আমাদের কাছে  প্রায় অপরিচিত।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষে, বিংশ শতাব্দীর  প্রাক্কালে শিক্ষাক্ষেত্রে  তিনি যে মাইল ফলক সৃষ্টি করেছেন, সে বিষয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান ও গবেষণা করে তাঁর যোগ্য আসনে তাঁকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা কালের দায়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর অসীম দু:সাহসী ও বিদূষী ফজিলতুন নেসাই এদেশে নারীর উচ্চশিক্ষার পথে দিশারীর ভূমিকা পালন করেন।

লেখকঃ আইনজীবি ও প্রাবন্ধিক

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন এবং সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হই ।

আরও পড়ুন