Ads

প্রাচীন বাঙলার সমাজে নারীদের জীবনযাপনের চিত্র

।। মুস্তফা আজাদ ।।

সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের নারীদের নিয়ে অনেক মন্তব্য করা হয় এবং তাদেরকে নগ্নতার দিকে আহ্বান করা হয়।  নগ্নতাই নারীদের মুক্তির পথ বলে প্ররোচনা দেয়া হয়।  আর ক্ষমতায়নের নামে নারীদেরকে পুরুষ বানিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়, যা নারীদের প্রতি অপমানের তীর নিক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়।  সম্প্রতি মেয়েদের বিয়ে ও সন্তান গ্রহণের প্রতিও নিরুৎসাহিত করা হয়, শুধু তাই নয়- এসব কাজকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়।  বলা হচ্ছে পর্দা নাকি পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেয়া পোশাক ও রেওয়াজ। পর্দাহীনতাই নাকি আবহমান বাঙলার কালচার।   অথচ প্রাচীন বাঙলার ইতিহাস, ঐহিত্য ও কালচার বলছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।  ইতিহাস পাঠে জানা যায়, প্রাচীন বাঙলার সম্ভ্রান্ত অধিবাসীরাও পর্দা মেনে চলতেন।  আজ থেকে ২৫০০ বছর পূর্বে অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.)-এর একহাজার বছর আগে বাঙলার রাজ পরিবারের মহিলারা হেরেমের বাহির যেতেন না এবং পর্দার ভেতরে থেকে কথা বলতেন।  R C Majumdar, (old period, Hindu period) History of Bengal,p. 610,1943 He was VC of Dhaka university(১৯৩৭-১৯৪২)

বাঙলার পাল ও সেন আমলের লিপিগুলো পড়লে মনে হয় লক্ষ্মীর মতো কল্যাণী, বসুধার মতো সৰ্বংসহা ও স্বামীব্রতনিরতা নারীত্বই ছিল প্রাচীন বাঙালী নারীর চিত্তাদর্শ।  বিশ্বস্তা, সহৃদয়া, বন্ধুসমা ও স্থৈৰ্য এবং শান্তি ও আনন্দের উৎসস্বরূপ স্ত্রী হওয়াই ছিল তাদের একান্ত কামনা।  স্বামীর ইচ্ছাস্বরূপিনী হওয়াই ছিল তাদের বাসনা এবং শামুক যেমন মুক্তা প্রসব করে তেমনই মুক্তাস্বরূপ বীর ও গুণী পুত্রের প্রসবিনী হওয়াই ছিল সকল বাসনার চরম বাসনা।  বন্ধ্যা নারীর জীবন কেউই কামনা করতেন না।  লিপির পর লিপিতে এই সব কামনা, বাসনা ও আদর্শ নানা প্রসঙ্গে বারবার ব্যক্ত হয়েছে।  উচ্চকোটি শিক্ষিত সমাজে মা ও পত্নীর সম্মান ও মর্যাদা এই জন্যই বেশ উচ্চ ছিল, সন্দেহ নেই।

সমসাময়িক নারীজীবনের আদর্শ ও কামনা লিপিমালায় আরো সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। ধর্মপালের মাতা দদাদেবীর তুলনা করা হয়েছে চন্দ্রদেবতার পত্নী রোহিণী, অগ্নিপত্নী স্বাহা, শিবপত্নী সর্বাণী, কুবেরপত্নী ভদ্রা, ইন্দ্ৰপত্নী পেলোমী এবং বিষ্ণুপত্নী লক্ষ্মীর সঙ্গে।  শ্রীচন্দ্রের পত্নী শ্রীকাঞ্চনার তুলনা করা হয়েছে শচী, গৌরী এবং শ্রীর সঙ্গে।  ধবলঘোষের পত্নী সদ্ভাব্য তুলিত হয়েছেন ভবানী, সীতা ও বিষ্ণুজায়া পদ্মা  এবং বিজয়সেন মহিষী বিলাসদেবী লক্ষ্মী এবং গৌরীর সঙ্গে।  সমসাময়িক কামরূপ শাসনাবলীতেও এই ধরনের তুলনাগত উল্লেখ রয়েছে।

প্রাচীন বাঙলার সকল মায়ের কামনা ছিল শুভ্র নিষ্কলঙ্ক সুদর্শন সন্তানের জননী হওয়া।  অর্থাৎ মাতৃত্বে বিষয়টি তাদের কাছে ছিল গুরুত্বপূর্ণ।  শ্রীচন্দ্রের রামপাল লিপিতে সুবর্ণচন্দ্রের নামকরণ সম্বন্ধে একটি সুন্দর ইঙ্গিত আছে।  প্রসূতির স্বাভাবিক প্রবণতানুযায়ী সুবর্ণচন্দ্রের মায়ের ইচ্ছা হয়েছিল শুক্লপক্ষে নবেদিত চন্দ্রের পূর্ণ ব্যাসরেখা দেখবার, তার সে ইচ্ছা পূরণ হওয়ায় তিনি ‘সোনার মতো উজ্জ্বল’ অর্থাৎ ‘সুবর্ণময় একটি চন্দ্র’ (অর্থাৎ ‘সুবর্ণচন্দ্ররূপ পুত্র’) দ্বারা পুরস্কৃত হয়েছিলেন।  বঙ্গদেশে সাধারণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এ বিশ্বাস আজও সক্রিয় যে শুক্লপক্ষের গোড়ার দিকে নবোদিত চন্দ্রের পূর্ণ গোলকরেখা প্রত্যক্ষ করলে নাকি প্রসূতি চন্দ্রের মতো স্নিগ্ধ সুন্দর সন্তান প্রসব করেন।

সংক্রান্তি ও একাদশী তিথিতে এবং সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণে তীর্থস্নান, উপবাস ও দানে অনেক নারীই অভ্যস্ত ছিলেন; রাজাস্তঃপুরিকারাও ছিলেন।  স্বামী ও স্ত্রী একই সঙ্গে দান-ধ্যান করতেন, এমন দৃষ্টান্তও বিরল নয়।  স্ত্রী ও মায়েরা একক অনেক উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করছেন।

নারীরা বোধহয় কখনো কখনো সম্পন্ন অভিজাত গৃহে শিশুধাত্রীর কাজও করতেন! তৃতীয় গোপালদেব শৈশবে ধাত্রীর কাছে লালিত-পালিত হয়ে মানুষ হয়েছিলেন। মদনপালের মনহলি লিপিতে এই রকম ইঙ্গিত রয়েছে।  নারীরা প্রয়োজন হলে সূতা কেটে, তাঁত বুনে অথবা অন্য কোনো শিল্পকর্ম করে স্বামীদের উপার্জনে সাহায্য করতেন।

প্রাচীন বাঙলায় একটি মাত্র স্ত্রী গ্রহণই ছিল সমাজের সাধারণ নিয়ম সাধারণ লোকেরা সেটাই করতেন।  তবে, রাজরাজড়া, সামন্ত-মহাসামন্তদের মধ্যে, অভিজাত সমাজে, বহুবিবাহ একেবারে অপ্রচলিত ছিল না এবং সপত্নী বিদ্বেষও অজ্ঞাত ছিল না।

দেবপালের মুঙ্গের লিপিতে, ‘মহীপালের বাণগড় লিপিতে সপত্নী বিদ্বেষের ইঙ্গিত রয়েছে; আবার কোনো কোনো লিপিতে স্বামী সমভাবে সকল স্ত্রীকেই ভালোবেসেছেন, সে-ইঙ্গিতও আছে (‘ঘোষরাবা লিপি’)। প্রাচীন বাঙলার লিপিমালায় বহুবিবাহের দৃষ্টান্ত অনেক; তবে একপত্নীত্মই যে সুখী পরিবারের আদর্শ সেটা স্পষ্টই স্বীকৃত হয়েছে তৃতীয় বিগ্রহপালের আমগাছি লিপিতে।

নগর-সমাজের অভিজাত নারীরা লেখাপড়া শিখতেন বলেই ইতিহাসবিদরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। পবনদূত কাব্যে নারীদের প্রেমপত্র রচনার ইঙ্গিত রয়েছে।  বিভিন্ন কলাবিদ্যায় নৈপূণ্যও তাদের অর্জন করতে হতো।

আরও পড়ুন-নারীর সত্যিকারের স্বাধীনতা আসে যেভাবে

‘বাৎস্যায়নের সাক্ষ্যে’ যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে স্পষ্ট হয় যে, প্রাচীন বাঙলার ‘রাজান্তঃপুরের মেয়েরা’ বেপরোয়া চলাফেরায় খুব একটা অভিপ্রায়িনী ছিলেন না; পর্দার আড়াল থেকে তারা অপরিচিত পুরুষদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন। ‘অন্তঃপুরে অবগুণ্ঠনময়ী’র জীবনই সমাজের অভিজাত  পরিবারসমূহে সাধারণ নিয়ম ছিল।  সম্ভ্রান্ত নারীরা পথে ঘাটে যাতায়াতকালে পথযাত্রীদের দৃষ্টি থেকে নিজেদের আড়াল করেই চলতেন।

তথ্যসূত্র :

১. History of Bengal – R C Majumdar

২. বাঙালীর ইতিহাস (আদিপর্ব), নীহাররঞ্জন রায়

২- বাঙালি নারী-হাজার বছরের ইতিহাস, মাহমুদ শামসুল হক

৩- বাঙালি নারী : সাহিত্যে ও সমাজে, আনিসুজ্জামান

লেখকঃ কলাম লেখক ও সাংবাদিক

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়ন মূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিয়ে ফেসবুকে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন।প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন