Ads

বিধবার ইদ্দত যেমন হবে

।। মূল: ড. ওমর সুলাইমান ।।

।। অনুবাদ: ফাহমিনা হাসানাত ।।

একজন বিধবা কিভাবে শোক পালন করবেন সে ব্যাপারে কিছু হাদিস আছে। জয়নাব বিনতে আবি সালামা (রা:) বর্ণনা করেছেন, যখন আবু সুফিয়ান মৃত্যুবরণ করেন তার কন্যা অর্থাৎ রাসুলের স্ত্রী উম্মে হাবিবা (রা:) কিছু সুগন্ধি আনতে পাঠিয়েছিলেন। সেই সুগন্ধি তিনি তাঁর বাহুতে এবং তাঁর গালে ব্যবহার করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে উম্মে হাবিবা (রা:) বলেছিলেন, ‘এমন নয় যে এ সুগন্ধি এখন আমার প্রয়োজন ছিল, আমি তো কেবল রাসূলের (ﷺ) সুন্নতকে অনুসরণ করতে চেয়েছি।’

এভাবে উম্মে হাবিবা রাসূলের (ﷺ) সুন্নতের অনুসরণ করেছিলেন এবং আরো বলেছিলেন, ‘আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাসী কোনো নারীর জন্য তার স্বামী ব্যতীত অন্য কারো মৃত্যুতে তিনদিনের বেশি সময় ইদ্দত বৈধ নয়। আর স্বামীর মৃত্যুতে ৪ মাস ১০ দিন ইদ্দত পালন করবে।’ [সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৩৩৪]

الَّذِیۡنَ یُتَوَفَّوۡنَ مِنۡکُمۡ وَ یَذَرُوۡنَ اَزۡوَاجًا یَّتَرَبَّصۡنَ بِاَنۡفُسِهِنَّ اَرۡبَعَۃَ اَشۡهُرٍ وَّ عَشۡرًا ۚ فَاِذَا بَلَغۡنَ اَجَلَهُنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَیۡکُمۡ فِیۡمَا فَعَلۡنَ فِیۡۤ اَنۡفُسِهِنَّ بِالۡمَعۡرُوۡفِ ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرٌ

“আর তোমাদের মধ্য থেকে যারা মারা যাবে এবং স্ত্রীদেরকে রেখে যাবে, তাদের স্ত্রীগণ চার মাস দশ দিন অপেক্ষায় থাকবে। অতঃপর যখন তারা ইদ্দতকাল পূর্ণ করবে, তখন তারা নিজদের ব্যাপারে বিধি মোতাবেক যা করবে, সে ব্যাপারে তোমাদের কোন পাপ নেই। আর তোমরা যা কর, সে ব্যাপারে আল্লাহ সম্যক অবগত।[২:২৩৪]”

কিন্তু আমাদের সমাজে এই এই ইদ্দত পালনের ব্যাপারটি অনেকটা সংস্কৃতির সাথে মিশে গেছে, যা মোটেও রাসূলের (ﷺ) সুন্নত সম্মত নয়। তাহলে বিধবাকে ঘিরে সুন্নতগুলো আসলে কি, বিশেষ করে ইদ্দতের প্রসঙ্গে? সূরা বাকারার ২৩৪ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল আমাদের ইদ্দতের সময়কাল বলে দিয়েছেন। বিধবাদের ইদ্দতের সময়কাল চার মাস দশ দিন। যদি সেই বিধবা গর্ভবতী হয় তাহলে গর্ভবতীর ইদ্দত শেষ হবে প্রসবের পর, যদিও তা চার মাস দশ দিনের আগেও হয়, এমনকি তার স্বামীর মৃত্যুর পরের দিনও হয়। আবার সন্তান প্রসবের সময়ের উপর ভিত্তি করে এই ইদ্দতকাল চার মাস দশ দিনের বেশিও হতে পারে।

আরও পড়ুন- একজন নারী শিক্ষার্থী যদি নিকাব না খোলেন তাতে কার কি এসে যায়?

الۡاَحۡمَالِ اَجَلُهُنَّ اَنۡ یَّضَعۡنَ حَمۡلَهُنَّ ؕ وَ مَنۡ یَّتَّقِ اللّٰهَ یَجۡعَلۡ لَّهٗ مِنۡ اَمۡرِهٖ یُسۡرًا

আর গর্ভধারিনীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত। যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন।[৬৫:৪]

কাজেই একজন বিধবা চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন করবে, শোক করবে। এই ইদ্দতের সময়টা তাকে তার বাড়িতে রাত কাটাতে হবে। মৃত্যু সম্পর্কিত ফিকহ এবং আইনশাস্ত্র – বিশেষত ওহুদ যুদ্ধের প্রভাব থেকে আমরা জানতে পারি বিধবারা কিভাবে ইদ্দত পালন করবেন। একটি বর্ণনায় এসেছে ওহুদ যুদ্ধের পরে রাসূল (ﷺ) বিধবাদের বলেছিলেন, ‘দিনের বেলা বিধবারা একত্রিত হয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে পারে, শোক প্রকাশ করতে পারে, কিন্তু যখন রাতে ঘুমানোর সময় হয় তারা যেন নিজেদের ঘরে গিয়ে ঘুমায়।’

কাজেই ইদ্দতের সময় মহিলারা তাদের বাড়িতে রাত কাটাবে, কিন্তু দিনের বেলা তাদের প্রয়োজনে তারা বাইরে যেতে পারবে। এতে কোন সমস্যা নেই। এ ছাড়া তার পরিবার এবং সম্প্রদায় রয়েছেই, যারা সেই মুহূর্তে তার প্রয়োজনগুলো পূরণ করতে সাহায্য করতে পারে, যাতে সে বাসায় থেকে যথাযথ ভাবে শোক পালন করতে পারে।

এ সময় একজন বিধবা নিজেকে সাজসজ্জা এবং বিয়ে থেকে বিরত রাখবে। কিন্তু একই সাথে এ কথাও মনে রাখতে হবে এই কাজ করতে গিয়ে সে যেন নিজেকে শাস্তি না দেয়। এক্ষেত্রে একমাত্র বিধি-নিষেধ হল একজন বিধবাকে স্বামীর বাড়িতে রাত্রি যাপন করতে হবে। বিশেষ কোনো সমস্যা না হলে এই নিয়মটা তাকে পালন করতে হবে। আর এই ব্যাপারে আমি দু রকমের চরমপন্থা দেখেছি। কখনো কখনো আমি দেখেছি এই নিয়মটি একজন বিধবার উপর এমনভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে যখন এ ব্যাপারে কিছুটা শৈথিল্য অর্জন করা যায়। আবার কখনো কখনো কোন কারণ ছাড়াই বিধবারা এই নিয়মটি পালন করে না।

বাস্তবতা হলো এই দুইয়ের মাঝামাঝি। এর অর্থ কি? ইসলামে অন্যান্য সব বিষয়ের মতো এখানেও একই নিয়মই প্রযোজ্য। প্রয়োজন যখন খুব বেশি হয় তখন ইসলাম এমন ব্যাপারকেও অনুমোদন করে যা স্বাভাবিক অবস্থায় অনুমোদনযোগ্য নয়। উদাহরণস্বরূপ – একজন বয়স্কা বিধবা যিনি একা একা রাত কাটাতে পারেন না, বা নিজের যত্ন নিতে পারেন না, তিনি চাইলে তার সন্তান বা বোনের সাথে গিয়ে থাকতে পারবেন, যাতে করে তারা তার যত্ন নিতে পারে।

আরও পড়ুন-নারীর সত্যিকারের স্বাধীনতা আসে যেভাবে

আবার এমনও হতে পারে কারো স্বামী হয়তো হজ্জ করতে গিয়ে মারা গেছেন। সুবহানাল্লাহ! একবার এক হজ্জের গ্রুপে একবার এমন ঘটনা ঘটেছিল, এক মহিলা হজ্জে গিয়ে বিধবা হলেন। তাহলে কি সেই মহিলা তখন চার মাস দশ দিন মক্কায় ইদ্দত পালন করবেন? না, বস্তুত তিনি ফিরে আসবেন, এবং তার স্বামীর বাড়িতে চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন করবেন।

আবার এরকমও দেখা যায় কেউ কেউ ইদ্দত পালনের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। একজন বিধবাকে তার বাড়িতেই ইদ্দত পালন করতে হবে, যদি না পরিস্থিতি মাত্রাধিক্য কঠিন হয়, তবে দিনের বেলা বাইরে যেতে বাধা নেই। এক্ষেত্রে এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে যে একজন বিধবার উপর যেন অযথা অযৌক্তি বোঝা চাপিয়ে দেওয়া না হয়। এ পর্যায়ে একজন বিধবার সেবা করাকে তার পরিবার, বর্ধিত পরিবার, এবং তার সম্প্রদায় আর্শীবাদ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে ইনশাআল্লাহ তা’য়ালা, যাতে তিনি যথাযথভাবে শোক পালন করতে পারেন।

পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাচ্ছি তা হল সমবেদনার মত ইদ্দতের ক্ষেত্রেও কিছু সাংস্কৃতিক চর্চা সহজ সুন্নতকে কঠিন করে তোলে। কাজেই এসব সাংস্কৃতিক চর্চা যা সুন্নত সম্মত নয় তা কিন্তু একজন নারীর জন্য পরীক্ষা এবং তার দ্বীনের ক্ষেত্রে ফিতনা হতে পারে।

ইদ্দত পালনের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক ভাবে আরোপিত কিছু জিনিস আপনি দেখতে পাবেন, যেমন বিধবারা চার মাস দশ দিন হাসতে পারবে না। এসবের সবই সাংস্কৃতিক উদ্ভাবন যা একজন বিধবাকে অপরাধবোধের মধ্যে রাখে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিধবার জন্য সুন্নত হলো সাজসজ্জা থেকে বিরত থাকা এবং রাতে নিজের ঘরের বাইরে ঘুমানো থেকে বিরত থাকা।

কাজেই ইদ্দত পালনের ক্ষেত্রে অযথা একজন বিধবার দোষ ত্রুটি অনুসন্ধান করে এবং নতুন কিছু সংযোজন করে ইদ্দতের পুরো ব্যাপারটিকে জাহেলী যুগের জাহেলী প্রথার কাছাকাছি নিয়ে যাবেন না। প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলোতে কিভাবে ইদ্দতের ক্ষেত্রে নতুন কিছু সংযোজন করা হয়েছে তার অনুসরণ না করে কিভাবে আমরা একজন বিধবাকে সুন্নত সম্মত উপায়ে ইদ্দত পালন করতে সাহায্য করতে পারি, তার প্রয়োজনগুলো পূর্ণ করতে পারি, এবং রাসূলের (ﷺ) সুন্নতকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারি, অনুগ্রহ করে আসুন সে ব্যাপারটা আলোকপাত করি। আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে বুঝার তৌফিক দান করেন। আল্লাহুম্মা আমীন!

সিরিজ: অনন্তের পথে যাত্রা

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়ন মূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিয়ে ফেসবুকে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন।প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন