Ads

মাতৃত্ব ও ক্যারিয়ার একসাথে টিকিয়ে রাখবেন যেভাবে

ফারজানা মাহবুবা

“ক্যারিয়ার ব্রেক নিবো?”
“নাকি ক্যারিয়ার ছেড়ে দিবো?”
“নাকি এভাবেই যুদ্ধ করবো? কিন্তু আর যে পারিনা!”
-এই প্রশ্নগুলো ছোট ছোট একটা বা দুইটা বাচ্চার মা-আপুরা যখন করেন,
আমি বুঝি আপনারা আমাকে এই প্রশ্নগুলো করেন আমি মেয়েদের ক্যারিয়ার নিয়ে কথা বলি তাই। কিন্তু কথা হলো- আপনার এই প্রশ্নের উত্তর আপনি ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না। এমনকি আপনার জামাইও না। কেউ না। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিতে হবে আপনাকেই। আপনি যদি আমাকে দেখে ইনফ্লুয়েন্সড হোন, “ফারজানা পিএইচডি করেও দেখো দুই বাচ্চার জন্য ক্যারিয়ার ছেড়ে দিয়ে ঘরে বসে বিজনিস করে”- আপনার জামাই বা শ্বাশুড়ী বা অন্য পরিচিত কেউ যদি এই উদাহরণ দিয়ে আপনাকে ক্যারিয়ার ছাড়তে বলে আর আপনি ছেড়ে দেন, আমার আপনার জন্য দুঃখ করা ছাড়া আর কিছু বলার নেই। আমার-আপনার-আমাদের প্রত্যেকের সিচুয়েশান্স ইউনিক।

আমার ক্যারিয়ার সুইচ করার পিছনে একশ একটা কারন/সিচুয়েশান্স ছিলো, কিন্তু আমি বা অন্য কোনো মেয়েকে কী করেছে- তা দিয়ে আপনি নিজের সিদ্ধান্ত নিবেন না। আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনার নিজের সিচুয়েশান’র উপর। যেমন ধরুন বাকী সব কারন বাদ দিয়ে শুধু আমার মা যদি আমার দুই বাচ্চা হওয়ার সময় আমার সাথে থাকতো, মা না থাকুক, কেউ একজন থাকতো, একটা মানুষ থাকতো, খাওয়া দাওয়ার কথা বাদই দিলাম, একটু যদি ঘুমাতে পারতাম ঠিকমতো, একটু যদি বাচ্চাদেরকে কয়েক মিনিটের জন্য হলেও ধরার মানুষ থাকতো, তাহলে হয়তো ছোটটা হওয়ার চার/পাঁচ মাসের মাথায় আমার অমন নার্ভাস ব্রেক ডাউন হতো না, আজকে তাহলে হয়তো আমাকে বিজনিসে না দেখে একাডেমিক জগতেই দেখতেন। অসম্ভব প্যাশনেট ছিলাম যে একাডেমিয়া নিয়ে, শত পলিটিক্স আর ইন্টারনাল অনেক হাবিজাবি’র পরও হয়তো ঠিকই লেগে থাকতাম টীচিং আর রিসার্চের সাথেই।

আপনি যে ক্যারিয়ারেই আছেন, ক্যারিয়ারটা একদিনে ধুম করে হয়নি। এর পিছনে আপনার সাধনা করতে হয়েছে। শ্রম দিতে হয়েছে। দিনের পর দিন খাটতে হয়েছে। আপনি এর পিছনে কতটা নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন সে আপনি নিজে জানেন। এত সাধ্য সাধনা করে যে ক্যারিয়ার বিল্ডাপ করেছেন, কীভাবে আরেকজন অচেনা অজানা মানুষকে যে আপনাকে চিনে না জানেনা, আপনার লাইফের স্ট্রাগল সম্পর্কে যার কোনো ধারনাই নেই
এমন মানুষকে এত বড় সিদ্ধান্ত দিতে বলছেন?

মা-রা ক্যারিয়ার ছেড়ে দেয়ার পেছনে সবচে’ বড় ‘সাইলেন্ট’ কারণ থাকে মা’র ইন্টারনাল মাদারলি গিল্ট।ক্যারিয়ারের জন্য বাচ্চার বা বাচ্চাদের টেইক কেয়ারে, তাদেরকে বড় করার সাথে কম্প্রোমাইজ করতেহচ্ছে- আর দশজন ক্যারিয়ার-বিহীন মাদের মত সারাদিনরাত বাচ্চা’র পিছনে লেগে থাকতে পারছেন না- এই যে গিল্ট, আমার ধারনা, এটা সবচে’ বড় কারন। আর এটাই সবচে’ ভুল কারণ।

আমরা এখন আরে আগের জেনারেশনের মত এমন স্ট্রাকচারে থাকি না যেখানে আপনাকে খাবার প্রিপারেশান এবং প্রিজার্ভেশানে দিনের অধিকাংশ সময় কাটাতে হয়। আমাদের মা’দের সময়ে ফ্রীজ সহজলভ্য হয়েছে, আর আমাদের সময়ে এসে পুরো লাইফের স্ট্রাকচার র‍্যাডিক্যালি চেইঞ্জ হয়ে গিয়েছে। আগে মা-রা যা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন এখন আর আমাদেরকে তা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়না। এখন কয়জন মা-কে নিজের বাচ্চাদের কাপড় সেলাই করতে হয়? একসময় ঘরে ঘরে মা-দেরকে তাইই করতে হতো।
এখন অবস্থা এমন, আগের মা-দের মত আপনাকে যা করতে হচ্ছে না, সেই এটেনশানটাও সেই সময়টাও আপনি বাচ্চাকে/বাচ্চাদেরকে দিচ্ছেন। বাচ্চাগুলো আপনার চব্বিশ ঘন্টার তদারকিতে স্বাভাবিকভাবে বড় হতে পারছে না। কারণ আমাদের মা-দের জেনারেশনেও বাচ্চাদেরকে মা-রা সারাদিনে অল্প কিছু সময়ও দিতে পারতো না। কারণ সবকিছু সামলে তাদের কমপক্ষে চার থেকে পাঁচটা বাচ্চা থাকাও ছিলো খুব স্বাভাবিক।

এখন যা কিনা এক থেকে দুইয়ে নেমে এসেছে।আপনি বুঝতে পারছেন যে বাচ্চার সাথে সারাক্ষন লেগে থাকার এই যে মডার্ণ মাদারিং- এটা আপনার আর বাচ্চার দু’জনের জন্যই সাইকোলজিক্যালি কতটা ড্যামেজিং?!
বাচ্চাকে টেক কেয়ারের নামে বাচ্চাকে আপনার বানানো জেলখানায় বন্দী করে রাখছেন আপনি। এখনকার বাচ্চাদেরকে তাই দেখবেন কী ভীষন ডিপেন্ডেন্ট তাদের মা’র উপর। এরা পাঁচ/ছয় বছর হয়ে যায়, ন্যাপিতে হাগুমুতু করে। সাত/আটবছর হয়ে যায় নিজে নিজে খাবার খেতে পারে না। (আমি নিজের বাচ্চা দিয়েই উদাহরন দিচ্ছি)।

আমাদের জেনারেশনের আগের কোনো জেনারেশনেই, আগের কোনো সময়েই বাচ্চারা তাদের মা-দের থেকে এত বেশী এটেনশান পায়নি। আমরা আমাদের বাচ্চাদেরকে এই যে চব্বিশ ঘন্টা দারোয়ানের মত আগলে রাখছি, বাচ্চার নামে নিজের আইডেন্টীটি, নিজের ক্যারিয়ার, নিজের ফ্রেন্ডস, নিজের প্যাশন, নিজের সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে দিচ্ছি, এগুলো আমাদের সময়ের এবনরমাল কিন্তু এপিডেমিক ফেনোমেনা। এক মা-কে দেখে আরেক মা সেইম জিনিষটাই করছে। যে করছে না তাকে জামাই বা শ্বাশুড়ী বা নিজের মা-ও অনেক ক্ষেত্রে অন্য মেয়েদের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে “ভাল মা-রা ক্যরিয়ার ছেড়ে দিয়ে বাচ্চা দেখে সারাক্ষণ”।

মানুষের কথায় বা কমেন্টে যে গিল্ট তৈরী হয় আপনার ভিতর, সে গিল্টকে এক সাইডে রেখে ভেবে দেখুন তো এই যে ক্যারিয়ার আপনার, কত স্বপ্ন ছিলও আপনার এই ক্যারিয়ার নিয়ে? কত প্যাশন থাকলে আপনি এতদূর আসতে পেরেছেন? সেই স্বপ্ন, সেই প্যাশনকে এই যে স্যাক্রিফাইস করতে চাচ্ছেন, তার আগে একটু ভাল করে ভেবে দেখুন।
ক্যারিয়ার গিভ আপ না করে ক্যারিয়ার সার্ভাইভ করা যায় কিনা। বাচ্চারা মোটামুটি একটু বড় না হওয়া পর্যন্ত “ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট”র কথা ভুলেও মাথায় আনবেন না।এটা আরেকটা ভুল যেটা আমি করেছি। সুপারভাইজার আমার ভিতর পটেনশিয়াল দেখে এক্সপেক্টেশান্স বাড়িয়েছে, আমিও বোকার মত ভেবেছি আমার সাথের কলিগরা এগিয়ে চলে যাচ্ছে, আমি তো ওদের চেয়ে কোনো অংশে কম ক্যাপাবল না, তাহলে আমি কেনো এখানেই থেমে থাকবো?
এই চিন্তা থেকে মাদারহুড যে তার নিজস্ব চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে, সেই চ্যালেঞ্জগুলোকে ছোট করে দেখেছি, ভেবেছি ‘সবাই পারলে আমি কেনো পারবো না’, আর তাই করতে গিয়ে ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট তার যে স্ট্রেসগুলো সাথে নিয়ে আসে সব একসাথে মিলেমিশে পুরো নৌকা নিয়ে ডুবেছি। শেষে ক্যারিয়ারই ছেড়ে দিলাম।

আপনি কেনো এই ভুল করবেন? এমন পরিস্থিতিতে যাওয়ার দরকারই বা কি যেখানে আপনাকে ক্যারিয়ারই ছেড়ে দিতে হয়? ক্যারিয়ার ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ভাল করে ভেবে দেখুন স্রেফ কোনো রকমে ক্যারিয়ারের সাথে লেগে থাকা যায় কিনা। যেহেতু অভিয়াসলি মাদারহুড আপনার ফার্ষ্ট প্রায়োরিটি,বাচ্চারা একটা সাইজে না আসা পর্যন্ত ক্যারিয়ারের সাথে জাষ্ট কোনো রকমে হলেও, একটুর জন্য হলেও লেগে থাকা যায় কিনা।

আমি জানি আপনি ভাবছেন “লেগে থাকা এত কি সহজ?” না, মোটেও সহজ না। ইনফ্যাক্ট এই একইসাথে মডার্ন এবং পোষ্ট-মডার্ণ সময়ে আমাদের মেয়ে জীবনটাই সহজ না। আমাদের সময়ে “জেন্ডার” যতটা কনটেষ্টেড একটা ইস্যু, যতটা কনফিউজিং একটা ইস্যু, ইতিহাসের কোনো সময়ে এতটা কনফিউজিং, এতটা কমপ্লেক্স আইডেন্টীটি মেয়েদেরকে কখনো ফেইস করতে হয়নি। মেয়েরা তখন ক্লিয়ার কাট জানতো মেয়ে মানে কী। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যূলিশানের পর থেকে এবং রিসেন্ট সাইলেন্ট ডিজিটাল রেভ্যূলিশানের হাত ধরে আলোর গতিতে লাইফ স্টাইল আর সোশাল স্ট্রাকচার চেইঞ্জ হচ্ছে, এই সময়ে “মেয়ে” হওয়া মানে আসলে কী- মেয়ে এবং মানুষ এই দুইয়ের সমন্বয় কোথায় কীভাবে হবে- এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কোথাও ক্লিয়ার না।ইসলামিক সার্কেলেও না, ওয়েষ্টার্ন সমাজেও না।

কিন্তু একটা জিনিষ ক্লিয়ার। দিবালোকের মত ক্লিয়ার। তা হলো, আপনার স্বপ্ন। আপনার প্যাশন। কোনো মেয়েই তার শরীরে “কুকিং” এর ডিএনএ নিয়ে জন্মায় না। সংসারের ডিএনএ নিয়ে জন্মায় না। একমাত্র হ্যা, শুধুমাত্র মাদারহুড-কে সাথে নিয়ে জন্মায়। মেয়ের শরীর মাত্রই সন্তান প্রজননের ভেসেল/পাত্র। এটা সমস্যা না, এটা আপনার প্রিভিলেজ। মেয়েদের এই প্রিভিলেজকে প্রটেক্ট করার জন্যই ছেলেদেরকে পাশে দিয়েছেন আল্লাহ। মেয়েরাই এর ভিতর দিয়ে পুরো হিউম্যান রেইসকে বাঁচিয়ে রাখে।কিন্তু এটা তখনই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যখন এই প্রিভিলজকে সমাজ এবং চারপাশ মিলে আপনার “একমাত্ররেস্পন্সিবিলিটি” বানিয়ে দেয়। আপনাকে বাধ্য করে বাকী সমস্তকিছুর সাথে কম্প্রোমাইজ করতে।
পুরো চিত্রটা তখন উলটে যায়। যেন ছেলেদের ক্ষমতায়ন করতেই মেয়েরা সন্তান জন্ম দেয়, এবং যেন এই সন্তান জন্ম দেয়া এবং মানুষ করাই তখন মেয়েদের একমাত্র কাজ!!

নিজেকে নিজে প্রশ্ন করুন- আপনি কে?
আপনি কী চান?
আজকে আপনি গিল্টের কারনে হোক বা যে কারনেই হোক ক্যারিয়ার ছেড়ে না দিলে কে জানে কালকের সমাজ আপনি হয়তো যাইনাব বিনত আলী রাঃ এর মত পলিটিক্যালি শার্পড এন্ড স্কিল্ড এমন কেউ হতে পারতেন যার পলিটিক্যাল বক্তব্যে বা কথায় খোদ রয়াল কোর্ট নড়ে চড়ে বসে। বাধ্য হয় তাকে এবং তার পরিবারকে মুক্তি দিতে।
কে জানে আপনি হয়তো খাওলা রাঃ বা নুসাইবা রাঃ এর মত যোদ্ধা বা ডিফেন্স পার্সোনেল হয়ে বসতে পারেন!
কে জানে আপনি হয়তো রাবিয়া রাঃ এর মত সমাজের স্পিরিচুয়াল লীডার হয়ে বসতে পারেন! অথবা আরো পরে স্পেনের কর্ডোভার সেই বিখ্যাত ম্যাথমেটিশিয়ান/ অংক বিশারদ লুবনা’র মত এমন কেউ হয়ে বসতে পারেন যে ভবিষ্যত গবেষনার গতিপথ চেইঞ্জ করে দিবে! কেউ জানেনা আপনার ভিতর কী পটেনশিয়াল লুকিয়ে আছে।
কিন্তু আপনার কনফিডেন্স যদি বলে আপনার স্বপ্নকে খিঁচে ধরে রাখতে, ধরে রাখুন। খিঁচে ধরে রাখুন।

একসময় আপনার সন্তানরাই আপনাকে দেখে শিখবে- জীবনে স্বপ্নকে ছেড়ে দেয়া সহজ। কিন্তু মা শিখিয়েছে, স্বপ্নকে ছেড়ে দিতে নেই। মাতৃত্বের জন্য নিজের বাকী সব আইডেন্টিটির সাথে কম্প্রোমাইজ করতে নেই। অন্ততঃ মা’র মত চেষ্টা করতে হয়।
এই যে চেষ্টা,
এই যে আমাদের স্ট্রাগল,
এই যে আমাদের নিত্যদিনের যুদ্ধ,
এটাই আমাদের জীবনের সৌন্দর্য্য।
এটাই আমাদের জীবনের সুরেলা মহাকাব্য।
এর মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকার আনন্দ আমাদের।

 

লেখকঃ

, মোটিভেশনাল লেখক ও প্রবাসী বাংলাদেশী, সিডনী, অস্ট্রেলিয়া

 

 

আরও পড়ুন