Ads

মেয়েদের চাকরী করা না করার সুবিধা-অসুবিধা

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক

মেয়েদের চাকরী করা না করার সুবিধা-অসুবিধা ও কর্মজীবী নারীদের সংসার জীবনের ভালোমন্দ সে সম্পর্কে আজকে আলোচনা করতে চাই ।“কর্মজীবী মহিলা যারা সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনার জন্য চাকুরী করেন, ইসলামে তাদের কেমন মর্যাদা দেয়া হয়েছে? তাদের সাথে আমাদের ব্যবহার কেমন হওয়া উচিত? আমার আম্মু জানতে চেয়েছেন।“– একজন ইনবক্সে প্রশ্ন করেছে।

নারী অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে ইদানীং পরপর কিছু লেখা প্রকাশ করার কারণে প্রথমে ভাবছিলাম রেসপন্স না করি। পরে ভাবলাম, উত্তর না দেয়াটা বোধ হয় অশোভন হবে। প্রশ্নকারী আমার পরিচিত। স্নেহভাজন প্রাক্তন ছাত্র। তার চেয়েও বড় কথা হলো, প্রশ্ন করেছে ওর মায়ের তরফে।

কর্মজীবী নারীদের আমি সম্মান করি। বরং আমি মনে করি, নারী অধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য সমকালীন প্রেক্ষাপটে সব নারীদেরই উচিত, কিছু না কিছু আয়-রোজগারের সাথে লেগে থাকা। ইসলাম চায়, নারীদের আর্থিক দায়ভার পুরুষেরা বহন করুক। এর থেকে কেউ কেউ মনে করে, নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার দরকার নাই। এটি ভুল ধারনা। ধর্মের চেয়েও এই ভুল ধারনার কারণ বিদ্যমান সামাজিক অপসংস্কৃতি। বিশেষ করে, পুরুষতান্ত্রিক মন-মানসিকতা।

দেখা যায়, পুরুষেরা নারীদের ওয়ারিশি সম্পত্তির ভাগ দিতে চায় না। মোহরানা হয়ে গেছে নামকাওয়াস্ত, তামাশা। অথচ, অর্থনৈতিক ভিত বা শক্তি না থাকলে কোনো মানুষেরই, থাকে না যথোপযুক্ত মানবিক মর্যাদা। হোক সেটা নারী অথবা পুরুষ। যে কেউ, যে কারো জন্য এটি সত্য।

একজনকে বিএ-এমএ পাশ করাতে কী পরিমাণ টাকা রাষ্ট্রকে ব্যয় করতে হয়, তা জানার চেষ্টা করলে আমরা বুঝতে পারবো, শিক্ষিত নারীদের চাকরী না করা রীতিমতো দণ্ডনীয় অপরাধ। মানলাম, শিক্ষা সবার অধিকার। কিন্তু সেটা প্রাথমিক শিক্ষা। শখের বশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা হলো সুযোগের অপব্যবহার। এটি নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। বিশেষ করে আমাদের মতো গরীব দেশের জন্য এই ধরনের বিলাসিতা হলো জাতীয় অপচয়।

যেসব শিক্ষিত নারী চাকুরী করতে চান না বা যাদের স্বামী চাকুরী করতে দেয় না, তাদের ব্যাপারে তাই শোভন কোনো মন্তব্য এ মুহুর্তে আমার আকলে ধরছে না। আল্লাহ মা’লুম, বাচ্চাকে অ-আ-ক-খ পড়ানোর জন্য বিএ/এম পাশ করার কী দরকার …! বউকে চাকরী করতে দিতে নারাজ, অথচ চাই উচ্চশিক্ষিত বউ, এই ধরনের মানসিকতা যেসব পুরুষের তারা হলো পুরুষতান্ত্রিকতার নিকৃষ্ট উদাহরণ।

মেয়েদের মধ্যেও দেখেছি, এমনকি আমি যাদের মধ্যে কাজ করি এমন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী পর্যারের একাধিক নারী আমার কাছে স্বীকার করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রীদের অধিকাংশই পড়াশোনা করছে মূলত ভালো বিয়ে হওয়ার জন্য। তাই, বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে তাদের মধ্যে আয়-উপার্জনের কোনো একটা ব্যবস্থা করার জন্য তেমন সিরিয়াসনেস আর লক্ষ করা যায় না। ইদানীং অবশ্য এ অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন হচ্ছে।

আমি যেহেতু কম্পিটেন্ট গার্লদের পছন্দ করি, ইচ্ছা আছে ‘কম্পিটেন্ট গার্লস’ টাইপের কিছু একটা করার, তাই আমি চাই, সব মেয়েরাই কিছু একটা করুক। শুধু চাকরী কেন, তারা ছোট বড় ব্যবসায়িক উদ্যোগও নিতে পারে। শুধু ভক্তিতে গদগদ হয়ে খাদিজা (রা.) কথা বললে হবে না, নারীমাত্রেরই হওয়া উচিত উনার মতো স্বাবলম্বী ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হবার চেষ্টা করা। কর্মজীবী নারীদের দাম্পত্য সম্পর্ক ও পারিবারিক জীবনের মডেল হতে পারেন ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নারীদের একজন দ্যা গ্রেট লেডি খাদিজা রাদিআল্লাহু আনহা।

পাশ্চাত্য জীবনদৃষ্টি বা প্যারাডাইমপ্রসূত নারীর ক্ষমতায়নের কথা যারা বলে, যেমন এনজিওগুলো, তাদের সাথে আমার মতবিরোধ অত্যন্ত মৌলিক। তারা নারী ও পুরুষের মধ্যকার প্রকৃতিগত পার্থক্যকে পারতপক্ষে স্বীকার করতে নারাজ। তাদের মতে নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য মাত্রই সমাজ আরোপিত। অতএব, তা বৈষম্য বা জুলুম। এখনকার সমাজ ব্যবস্থায় যে ডমিন্যান্ট পুরুষতন্ত্র, বিশেষ করে পারিবারিক নির্যাতন বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের যে সমস্যা, সেটাকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করে তারা নারীদেরকে তাদের পছন্দমতো বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন করার কথা বলে। দেখবেন, নারীদের উত্তরাধিকার সম্পত্তি পাওয়া, মোহরানার টাকা পাওয়া, ইত্যাদি বিষয়ে ভুলেও তারা কোনো কথা বলে না।

তাদের ঘোষিত মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন। ভালো কথা। দারিদ্র বিমোচনে নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এটি অস্বীকার্য। কিন্তু তাদের এই দারিদ্র বিমোচন কার্যক্রমে প্রধান কর্মশক্তি তথা পুরুষেরা কই? তারা এক্সক্লুডেড কেন? আমার ধারনায়, নারীদেরকে যতটা সহজে ভুল বোঝানো সম্ভব, পুরুষদেরকে ম্যানিপুলেট করা ততটাই কঠিন। আসলে এদের অঘোষিত উদ্দেশ্য ও হিডেন এজেন্ডা হচ্ছে, আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোতো ফাটল ধরানো। পারলে এই স্ট্রাকচার ভেংগে দিয়ে তদস্থলে তথাকথিত উন্নত বিশ্বের মতো লিভিং টুগেদার সিস্টেম চালু করা।

লিভিং টুগেদার সিস্টেম ও পরিবার ব্যবস্থার মধ্যে মূল পার্থক্য হচ্ছে, পারিবারিক ব্যবস্থায় থাকে প্রাতিষ্ঠানিক ক্রমসোপান বা হাইয়ারআর্কি। বলাবাহুল্য, ইসলামের দৃষ্টিতে পুরুষ হলো পরিবারের প্রধান। এক নম্বর ব্যক্তি। ন্যায়সংগত যে কোনো বিষয়ে তার কর্তৃত্ব বজায় থাকতে হবে। যে কোনো প্রতিষ্ঠানে যেভাবে মান্য-গণ্যের একটা ধারাবাহিকতা বজায় থাকতে হয়।

 

প্রকৃতি সংগত কারণে ইসলাম পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক ব্যবস্থার কথা বলে। কর্মজীবী নারী কীভাবে এই ব্যবস্থার সাথে মানিয়ে চলবে সেইটা বুঝার জন্য আমাদেরকে প্রফেট মুহাম্মদ (স.)এর সাথে খাদিজাতুল কুবরার পারিবারিক জীবন কেমন ছিলো, তা ভালো করে বুঝতে হবে। আগেই বলেছি, কর্মজীবী মুসলিম নারীদের জন্য তিনি হলেন আদর্শ উদাহরণ।

 

কর্মজীবী নারীদের প্রথম দায়িত্ব হলো সংসারে কন্ট্রিবিউট করা। তা না করে স্বামীর কমান্ড ও এডমিনিস্ট্রেশনের পাল্টা হিসাবে প্যারালাল-এডমিনিস্ট্রেশান ও ইকনমিক স্ট্রাকচার গড়ে তূললে সেই সংসার পরিণত হবে কুরুক্ষেত্রে। যে মেয়ে টাকা কামায়, সে যদি দুর্ব্যবহার না করে, তাহলে আমার ধারণায় তার সংসারে সুখ-শান্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কথা যা-ই থাকুক না কেন, বাস্তবে দেখা যায় অনেক কর্মজীবী নারী স্বামীর হাতে নির্যাতিত। এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হলো, সহনীয় মাত্রার সর্বোচ্চ পর্যায়ে সেক্রিফাইস করার পরও যদি স্বামীর অত্যাচার না থামে, নির্যাতন যদি সহ্যের সীমা পেরিয়ে যায় তাহলে সংশ্লিষ্ট নারীর উচিত মনকে শক্ত করে ‘কঠোর’ সিদ্ধান্ত নেয়া। এটি যেহেতু একান্ত ব্যক্তিজীবনের নানাবিধ আবেগ, অনুভূতি ও প্রয়োজনের সাথে সংশ্লিষ্ট, তাই বাহির থেকে এ ব্যাপারে আমরা বেশি কিছু বলতে পারি না।

বিবাহিত নারীদের উপার্জনের টাকার মালিক কে? এটি একটি ক্রুশিয়াল এন্ড সেনসিটিভ কোশ্চন। ইদানিংকার টেলিভিশন-হুজুরদের পপুলিস্ট বয়ান অনুসারে, বউয়ের টাকার বউই মালিক। আমি আলেম নই। ফকীহও নই। কিন্তু ইসলামিক বিষয়ে ন্যূনতম লেখাপড়া করা একজন কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ ও নিষ্ঠাবান মুসলমান। তাই বলছি, একশ্রেণীর পপুলিস্ট আলেমের এই ধরনের নারী-তুষ্টিমূলক কথা সামগ্রিক বিবেচনায় খন্ডিত বা অর্ধ সত্য।

এর বিপরীতে আমরা দেখতে পাই,কর্মজীবী নারীদের অনেক স্বামীর ধারণা, বউয়ের টাকার মালিক বউ নয়। বরং বউয়ের স্বামী হিসেবে সে নিজে। বউ যেন তার টাকা কামানোর মেশিন। কিংবা বাগানে লাগানো টাকার গাছ। এ ধরনের পুরুষবাদী ধ্যান-ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এ বিষয়ে আমার অভিমত হলো, এই উভয় ধারনাই প্রান্তিকতা ও ভুল চিন্তা।

পাঠক, আপনার টাকা একান্তই আপনার। আমার টাকা একান্তই আমার। আপনার আমার মধ্যকার মালিকানার সম্পর্ক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বা মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ। পারিবারিক পরিমণ্ডলে ব্যাপারটা এরকম ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ধরনের নয়। স্বামীর অর্থ-সম্পদে স্ত্রীর থাকে পরোক্ষ মালিকানা। এক ধরনের অধিকার। তেমনি স্ত্রীর অর্থ-সম্পদেও থাকে স্বামীর এক ধরনের পরোক্ষ মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ। পরষ্পরের নীরব-মতৈক্য, সম্মতি বা অনাপত্তির ভিত্তিতে তারা পরষ্পরের সম্পদ হতে ব্যয় করতে পারে। পরষ্পরের সম্পদ ব্যবহার করতে পারে।

স্ত্রীর মোহরানা বা ওয়ারিশি সম্পত্তি যতটা স্ত্রীর একান্ত ও স্বাধীন মালিকানাধীন, চাকুরী কিংবা ব্যবসার মাধ্যমে স্ত্রীর উপার্জনের টাকা তার ততটা এক্সক্লুসিভ বা একান্ত নয়। নিজের টাকা খরচের বেলায় স্ত্রী তার সংসারের প্রয়োজনকে প্রায়োরিটি দিবে, এটাই স্বাভাবিক। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে খরচের খাত ভাগাভাগি হতে পারে। সংসারের জরুরী প্রয়োজন মিটিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বা বৈধ যে কোনো কাজে একজন কর্মজীবী নারী তার টাকাপয়সা খরচ করতে পারে। অংশত সঞ্চয়ও করতে পারে।

কিন্তু, পুনরায় খেয়াল করেন, আপনার-আমার মধ্যে যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মালিকানা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পদের মালিকানার বিষয়টি কিন্তু ততটা স্বতন্ত্র নয়। ইসলামের আলোকে ব্যাপারটা কেমন হওয়া উচিত তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি, স্ত্রীর চাকুরী করার ব্যাপারে স্বামীর অনুমতি থাকার শরয়ী বাধ্যবাধকতা থেকে। যার চলাচল আরেকজনের অনুমতির ওপর নির্ভর করে তার আয়-উপার্জনের উপরেও সেই অনুমতিদাতা অথরিটির এক ধরনের প্রত্যাশা ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

এটি কি করে হতে পারে যে, গাড়ি চালাবে একজন, অথচ সেই গাড়ির এক্সেলেটরে আরেকজন মাঝে মাঝে নিজের খেয়াল খুশি মতো চাপ দিতে পারবে? কোনো পরিবার বা প্রতিষ্ঠানে অর্থ সরবরাহ ব্যবস্থা হচ্ছে একটি গাড়ির জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থার মতো। গাড়ির ইঞ্জিনে জ্বালানি সরবরাহকে গাড়ির চালক নিয়ন্ত্রণ করে এক্সেলেটরএর উপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে। তাই, পূর্ণ সমঝোতার মাধ্যমে ড্রাইভ করা না হলে, এ ধরনের এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত ও পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক যৌথ পরিচালনার গাড়ি যে এক পর্যায়ে দুর্ঘটনার সম্মুখীন হবে তা হলফ করে বলা যায়।

এই বিষয়টিসহ এ রকম বহু বিষয়েই ইসলামী শরীয়াহ কিছুটা অনির্ণেয়তা বা ইনডিটারমিনিজম রেখে দিয়েছে। যেন লোকেরা নিজেদের যুক্তি-বুদ্ধি, কাণ্ডজ্ঞান, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পারষ্পরিক সহানুভূতির ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিছুটা কম-বেশি করে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে চলতে পারে।

যেমন, মা-বাবার সেবা করা প্রত্যেক সন্তানের দায়িত্ব। মেয়েদেরকে এই দায়িত্ব থেকে রেহাই দেয়া হয় নাই। তো, শ্বশুড় বাড়ীতে থাকা কোনো মেয়ে কীভাবে নিজের বাবা-মায়ের সেবা করার দায়িত্বপালন করবে? আবার বউ যদি সহযোগিতা না করে তাহলে একজন ছেলে কীভাবে নিজের বাবা-মায়ের সেবা করার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করবে? কমনসেন্স থেকে আমরা ধারণা করতে পারি, বউ যদি নিজের শ্বশুড়-শ্বাশুড়িকে সম্মান করে, তাদের উপযুক্ত সেবা করে তাহলে জামাইও তার শ্বশুড়-শ্বাশুড়িকে মর্যাদা দেয়া ও তাদের দেখাশোনা করার ব্যাপারে যত্নবান হবে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ব্যাপারটা এমনই তো হওয়ার কথা। ইসলাম এটাই চায়।

বলা বাহুল্য, সব কিছুকে তাই আইনের মাধ্যমে সমাধান না করে অনেক বিষয়কে ইসলাম সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের পারষ্পরিক নির্ভরশীলতা, নৈতিকতা ও কাণ্ডজ্ঞানের ওপর ছেড়ে দিছে। স্ত্রীর উপার্জনের বিষয়টিও এরকমেরই একটা ইস্যু।

অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সঙ্গত কারণেই কর্মজীবী নারীরা হয় অধিকতর শালীন ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তাদের মধ্যে মানবিক গুণের বিকাশ হয় অধিকতর হারে। সমাজ ও রাষ্ট্র সম্বন্ধে তারা হয় তুলনামূলকভাবে বেশি সচেতন। কথায় বলে, ‘যে রাঁধতে জানে, সে চুলও বাঁধতে জানে’।

কর্মস্থলের ছুটি ছাড়াও এমন দিন নিশ্চয় আপনার গেছে যে দিন আপনি ঘর থেকে কোথাও বের হননি। সেদিন দেখবেন, আপনার উদ্যম ও কর্মশক্তি অনেকখানি বাধাগ্রস্ত ও স্তিমিত। কেমন জানি জড়তা এবং আলসেমি আপনাকে পেয়ে বসেছে। এর বিপরীতে, আপনি যখন বাইরে যান বা খানিকটা ঘুরে আসেন তখন দেখবেন, ক্লান্তিবোধের সাথে সাথে আপনার মধ্যে সজীবতা ও কর্মউদ্যমের মাত্রাও বেশ খানিকটা বেড়ে যায়। বুঝতেই পারছেন, সঙ্গত কারণেই কর্মজীবী কিংবা সমাজকর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী নারীরা আত্মকেন্দ্রিক গৃহবঁধূদের তুলনায় হয়ে থাকে অধিকতর কনফিডেন্ট, কম্পিটেন্ট এন্ড প্রো-একটিভ।

এসব কথা বলার জন্য কেউ আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমার কথাগুলো বাস্তবধর্মী, কিন্তু ব্যতিক্রমী। তাইতো একেকটা পয়েন্টকে ভেঙে ভেঙে আলোচনা করার মাধ্যমে পুরো বিষয়টাকে ক্লিয়ার করার চেষ্টা করছি।

সব মেয়েদের চাকরী করতেই হবে, এমন কথা নাই। চাকরী করুক বা না করুক, মানুষ হিসাবে, আল্লাহর খলিফা হিসাবে, একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে সব নারীরই উচিত নিজ সংসার ও ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে দেশ ও দুনিয়া সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা। চিন্তাভাবনা করা। অন্যায় প্রতিরোধ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী হওয়া। স্বীয় আদর্শের দাবি পূরণে যথাসম্ভব দৃঢ় ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।

ফেইসবুকে লাইক, কমেন্ট করে ও পলিটিক্যালি সেনসিটিভ কথাবার্তা বলে কেউ যদি মনে করেন যে এর মাধ্যমে তার সামাজিক দায়িত্বপালন সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে, তিনি আসলে ভুল করছেন। বরং, প্রত্যেকেরই উচিত, সামাজিক ও সামষ্টিক দায়িত্বসমূহ পালনে মিনিংফুল, এফেক্টিভ ও কন্সিস্টেন্ট ওয়েতে কর্মতৎপর হওয়া। বৃহত্তর অঙ্গনে সামাজিক ও সামষ্টিক দায়িত্বসমূহকে মূলত ছেলেদের কাজ, এমন মনে না করে সাধ্যমতো সোশ্যাল ওয়ার্ক করা কর্মজীবী ও অ-কর্মজীবী নির্বিশেষে প্রত্যেক নারীর একান্ত দায়িত্ব। ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে গিয়ে গণমানুষের জীবনমান উন্নয়ন করার জন্য পার্সোনালি কন্ট্রিবিউট করার এই দায়িত্ব, একটি নাগরিক দায়িত্ব। মানবিক দায়িত্ব। নিজেকে তাই অবলা নারী হিসেবে না ভেবে, সব সময়ে স্মরণে রাখবেন, দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবেন, ‘স্ত্রী ও মা হওয়ার পাশাপাশি, আমি একজন স্বাধীন ও স্বতন্ত্র মানুষ। আমিও একজন যোগ্য ও দায়িত্বশীল নাগরিক। আমার অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতাগুলোই আমার জীবনের শেষ কথা নয়।’

‘আপা, আপনি কী করেন?’ উত্তর যদি হয়, ‘আমি সংসার করি। এছাড়া আর কিছু করি না’ তাহলে, সরি টু সে, একজন শিক্ষিত নারী হিসেবে আপনার লজ্জিত হওয়া উচিত। কারন, আপনি জাতিকে বঞ্চিত করছেন। ঠকাচ্ছেন। এ ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনামূলক পরিস্থিতি হতে নিজেকে বাঁচানোর জন্য আপনার উচিত, কিছু না কিছু আপনার মতো করে সিরিয়াসলি করে যাওয়া। কীভাবে আপনি দেশ ও জাতিগঠনে ভূমিকাপালনের এই দায়িত্ব পালন করবেন, সেটার উপায়, পথ ও পদ্ধতি বের করা আপনার একান্ত ব্যক্তিজীবনের মতো আপনারই একান্ত দায়িত্ব।

হ্যাঁ, হতে পারে, আপনি মা হতে চলেছেন। তাই চাকরী করছেন না। হতে পারে আপনি পর পর অনেকগুলো সন্তানের মা হয়েছেন। তাদেরকে সামলাতে হচ্ছে। আমরা তো জানি, কষ্টের দিক থেকে বলেন, গুরুত্বের দিক থেকে বলেন কিংবা মর্যাদার দিক থেকে বলেন, মাতৃত্বের চাকরীর চেয়ে তো বড় কোনো চাকরী নাই। কিন্তু, দেখা যায়, দু’একটা বাচ্চা নিয়ে কোনো কোনো শিক্ষিত মহিলা জীবন পার দিচ্ছেন। সংসার করা ছাড়া আর বিশেষ কিছু না করেই। এটি কখনোই একজন মুসলিম নারীর জীবন হতে পারে না। ইকামতে দ্বীন বা সামাজিক-আদর্শিক দায়িত্ব তো নারী-পুরুষ সকলের দায়িত্ব। এমনকি, এই দায়িত্ব, কোনো যৌথ-দায়িত্বও নয়। সামাজিক-আদর্শিক তথা নৈতিক দায়িত্ব, প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত দায়িত্ব। হাশরের ময়দানে প্রত্যেককে আল্লাহ তায়ালা স্বতন্ত্রভাবে জিজ্ঞাসা করবেন। ‘আমার জামাই ঘর হতে বের হতে দেয় নাই’ বা ‘তিনি পছন্দ করতেন না’, বা ‘নিজের বাচ্চাদেরকেই সব সময় দিয়েছি’ এ’ধরনের কথা বলে পার পাবেন না। নিশ্চিত থাকেন।

কর্মজীবী নারীদের প্রতি তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যবহার কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সোনার ডিম পাড়া হাঁসের প্রতি মানুষের যেমন যত্নশীল হওয়ার কথা, কর্মজীবী নারীদের সাথে তাদের স্বামীদের আচরণও তেমনই ভালো হওয়ার কথা। কিন্তু, জানি, এটি নিছকই তত্ত্বকথা। বাস্তবতা অনেকখানি ভিন্ন। বিরূপ। এই বিরূপতার বর্ণনা দেয়া ও করণীয় সম্পর্কে নসীহত করার পরিবর্তে একজন কর্মজীবী স্ত্রীর স্বামী হিসাবে আমার জীবনধারা সম্পর্কে দু’একটা কথা বলা সমীচীন মনে করছি।

আমি যথাসম্ভব নিজের কাজগুলো নিজে করার চেষ্টা করি। লবণ খেতে পারি না। ঝাল হজম হয় না। এ ছাড়া খাওয়ার মেন্যু নিয়ে কখনো উচ্চবাচ্য করি না। সহযোগিতামূলক কোনো কিছু পেলে আলহামদুলিল্লাহ! না পেলেও চুপচাপ থেকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করি। অথবা অপেক্ষা করি। হাতের কাছে কোনো কাজ থাকলে সেটা সেরে ফেলি। ‘এটি পুরুষ মানুষের কাজ নয়’ – সাংসারিক কোনো কাজ সম্পর্কে এমনটা মনে করি না। এর মানে অবশ্য এই নয় যে আমি সব কাজ করি। বরং, এক্ষুনি যা বললাম, এটি মনে করি যে, প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত হলো নিজের কাজগুলো যথাসম্ভব নিজেই সম্পন্ন করা। পরনির্ভরশীলতা ব্যক্তিত্বহীনতার পরিচায়ক। পরনির্ভরশীলতা আর ভালোবাসা এক নয়। সংসার জীবনে ভালোবাসা একটা ফাও কথা। থাকলে ভালো। না হলেও অসুবিধা নাই তেমন। দায়িত্বপালন ও অধিকার আদায়ই মূল কথা। আবেগি রোমান্টিকতা দিয়ে হানিমুন হয়, সংসার হয় না।

কর্মক্ষেত্র একই হওয়ার কারণে আমি ও আমার স্ত্রীর ক্ষেত্রে প্রয়োজন না পড়লেও একজন কর্মজীবী নারী হিসাবে আপনার উচিত, আপনি কখন কোথায় যাবেন, যাচ্ছেন, কতক্ষণ থাকছেন, কখন ফিরবেন ইত্যাদি বিষয়ে স্বামীকে অবহিত রাখা। তিনি জানতে না চাইলেও। এটি পারষ্পরিক আস্থার জন্য জরুরী। সব সময়ে নিজের প্রাইভেসিকেই যদি আপনি প্রায়োরিটি দেন তাহলে হতে পারে তিনি আপনার ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়বেন। সংসার করার জন্যই সংসার করবেন। তার পৌরুষত্বকে গুটিয়ে নিবেন। পুরুষের পৌরুষত্ব, ইংরেজীতে যাকে শিভলারি বা ম্যাসকিউলিনিটি বলে, আমার ধারণায় স্বাভাবিক রূচিসম্পন্ন নারীদের দৃষ্টিতে এটি কোনো পুরুষের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক। পৌরুষত্বকে দমিয়ে রাখা এই অবনমিত চরিত্রের স্বামীর সংসারে বাচ্চারা ঠিক মতো গড়ে উঠবে না। স্বামী-স্ত্রীর বিরূপ সম্পর্কের প্রতিক্রিয়ায় তারা নানা ধরনের মানসিক জটিলতার শিকার হবে। আপনি নিশ্চয়ই এটি চান না।

সুন্দর দাম্পত্য সম্পর্কের জন্য বিয়ের আগে মেয়ের চাকুরী ইত্যাদি বিষয়ে কথাবার্তা সব ভেংগে নিতে হবে। প্রয়োজনে সেগুলো লিখিতও হতে পারে। এতে ধর্মীয় কোন বাধা নাই। এটি বিয়ে রেজিস্ট্রেশান করার মতো। তদুপরি, কুফু বা বিয়েতে সমতার যে কথা বলা হয়েছে, তা বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। কোনো কারণে তা না হলেও ঘরের মধ্যে নিজেকে প্রফেশনাল হিসাবে ভাব দেখানোর পরিবর্তে হযরত খাদিজা (রা.) মতো পারিবারিক আবহে মমতাময়ী ইমেজ বজায় রাখতে হবে।

তাও সম্ভব না হলে নিত্যদিন ঠোকঠুকি করে ভুল মানুষের সাথে দুঃসহ জীবন কাটানোর পরিবর্তে নিজ জীবন সম্পর্কে ‘কঠোর’ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, জীবনের প্রয়োজনে বিয়ে। বিয়ের জন্য জীবন নয়। চাকুরীজীবী নারীদের পুনর্বিবাহে তো তেমন সমস্যা হওয়ার কথা না, তাদের প্রত্যাশা যদি অতি-উচ্চ না হয়।

এ বিষয়ে এবার অন্যদিকের কিছু কথা বলি। নারীর ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদাবোধ সংরক্ষণ ও সংসারে সুখের জন্যেই তো নারীদের চাকুরী ও আয়-উপার্জন। তা না হয়ে, বিলাসিতা বা বাহুল্য ব্যয়, স্বামীকে পাত্তা না দেয়া ও লাগামহীন ব্যক্তিস্বাধীনতা চর্চা যদি হয় চাকুরীজীবী কোনো এমপাওয়ার্ড নারীর আচরণগত বৈশিষ্ট্য, তাহলে বলতে হয়, তিনি পাশ্চাত্য উগ্রনারীবাদী এনজিও-প্রচারণার ফাঁদে পড়েছেন। তাকে আমার আর কিছু বলার নাই। তিনি আর আমি পরষ্পর বিরোধী পক্ষ।

আদর্শগত দিক থেকে যিনি যে পক্ষেই থাকুন না কেন, সমাজ পরিবর্তনের এই চলমান আন্দোলনে অবশেষে আমাদের দেখা হবে ময়দানে। আমার অবস্থান আমি পরিষ্কার করেছি। আপনি কোন পক্ষ নিবেন সেটা আপনার নিজস্ব বিবেচনা। নিজের ব্যাপারে বলতে পারি, স্বার্থপর, ভীরু ও নিষ্ক্রিয় স্বপক্ষীয়দের চেয়ে বিরোধী পক্ষের সক্রিয় ও সিনসিয়ার অ্যাক্টিভিস্টদেরকে আমি বেশি আপন মনে করি। আদর্শিক সক্রিয়তার দিক থেকে, মৃতদের মধ্যে সুখে থাকার চেয়ে জীবিতদের মধ্যে আমি বেঁচে থাকতে চাই। হোক সেটা শান্তিতে কিংবা সংগ্রামে।

আমার জন্য দোয়া করবেন। একজন সত্যনিষ্ঠ সমাজকর্মী হিসেবে আপনার জন্যও রইল আমার শুভেচ্ছা ও সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা। ভালো থাকুন, এই বিশ্বজগতের একমাত্র সভ্য প্রজাতির তেমনই যোগ্য ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একজন মানবিক মানুষ হিসেবে।

লেখকঃ কলাম লেখক ও পরিচালক, মুক্তবুদ্ধি চর্চা কেন্দ্র, সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র

এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট লেখা-

মেয়েরা কী কারণে চাকরির প্রতি আগ্রহী?

 

আরও পড়ুন