Ads

লোকে বলে পাঞ্জাবীর জারজ সন্তান !

এইচ বি রিতা 

‘লোকে আমায় বলে পাঞ্জাবীর বউ। ছেলেকে বলে পাঞ্জাবীর জারজ সন্তান। দেশের জন্য সম্ভ্রম দিলাম, স্বামী দিলাম, বিনিময়ে এ দেশ আমায় কি দিল?…..’ আবেগজড়িত কণ্ঠে নিজ জীবনের দূর্দশা নিয়ে কথাটি বলেন সিলেটের বীরাঙ্গনা প্রভা রানী মালাকার।

২০১৫ সালে এই বীরাঙ্গনার সাথে সাক্ষাৎ করতে ছুঁটে গিয়েছিলাম আমি সুদূর নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশ, সিলেটের কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সীবাজার ইউনিয়নের মির্জানগর গ্রামে। আলাপচারীতার এক পর্যায়ে, সামাজিক লাঞ্ছনায় ৭১ এর পর এখনো বেঁচে থাকাকে অভিশাপ হিসেবে ভাবতে শুরু করা বীরাঙ্গনা প্রভা রানী মালাকার বলেন, ‘১৯৭২ এ আমার এক ছেলের জন্ম হয়। কিছুটা মানসিক প্রতিবন্ধি। কয়েক বছর পর মিথ্যে মামলায় স্বামী কারাভোগের পর গত হোন। তাই আজ সন্তানের সঠিক পিতৃ পরিচয় প্রমান করতে পারিনা।’

বীরাঙ্গনা হনুফার ছেলে তাকে মা হিসাবে পরিচয় দিতে চাননা। ছেলে বলে, ‘তুমি আমার মা না, তোমার পরিচয় দিতে আমার লজ্জা করে…’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রমেশ চন্দ্র মজুমদার মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাটি বলেছিলেন বীরাঙ্গনা হনুফা।

হ্যা! বলছি আমাদের বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের কথা। পাকিস্তানি ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানি সেনা ও আধা-সামরিকবাহিনী যে সকল নারীদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করেছিল, আমি সেইসব ভ্যাগ্যহত নারীদের কথাই বলছি। মুক্তিযুদ্ধকালীন ধর্ষণের কারণে যেসব নিষ্পাপ শিশুদের জন্ম হয়েছিল, অপ্রত্যাশিতভাবে জন্ম নেওয়া যে অবুঝ শিশুগুলোকে আমাদের সমাজ আজও গ্রহণ করতে পারেননি, দিতে পারেননি অস্তিত্বের স্বীকার এবং অধিকার, আমি তাদের কথাই বলছি।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যা‌তিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সম্মান জানানোর পাশাপাশী আশ্রয়হীন বীরাঙ্গনাদের পিতার পরিচয়ের জায়গায় তার নাম ও ঠিকানা বসিয়ে দিয়েছিলেন ঠিকই, তবে সেই আশ্রয়হীন বীরাঙ্গনাদের গর্ভের যুদ্ধশিশু সন্তানটির নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারেনি বাংলাদেশ। তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে এগিয়ে আসে বাহিরের দেশগুলো।

কানাডা সর্বপ্রথম যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিতে শুরু করে। কানাডার দত্তক বিষয়ক সংগঠন ‘ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন’ ও ‘কুয়ান-ইন ফাউন্ডেশন’ দত্তক গ্রহণের কাজে সংযুক্ত হয়। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, সুইডেন এবং অস্ট্রেলিয়া এই উদ্যোগে যুক্ত হয়।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ যুদ্ধশিশুদের এসব দেশগুলোতেই দত্তক নেয়া হয়, যুদ্ধশিশু হিসাবে নয়; মানুষ হিসাবে। যারা তাদের দত্তক নিয়েছেন, মোটামোটি সবাই সে শিশুদের জন্ম ইতিহাস সম্পর্কে অবগত। এবং এই সত্যকে তাঁরা বেশ স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছেন। তাঁদের ডিকশ্যানারিতে ‘জারজ’ শব্দটির ব্যবহার নেই। কিন্তু আমার সোনার বাংলাদেশে আছে।

৭১এ বিক্রমকলস গ্রামে ও শমশের নগর ডাক বাংলোয় পাক সেনা ক্যাম্পে দু’বার পাক সেনা ও রাজাকারদের হাতে গণধর্ষণ হয়েছিলেন তাঁর প্রভা রানী মালাকার।
১৫ বছরের যুবতি প্রভা রানীর বৈশাখ মাসে বিয়ে হয়। চার মাস পর শ্রাবন মাসে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের সময় স্বামী কামিনী রাম মালাকার তাকে বাবার বাড়ী বিক্রম কলসে রেখে চলে যান ভারত। আর তখনই নেমে আসে প্রভা নারীর দুঃস্বপ্নের রাত। এক রাতে মায়ের সামনে থেকে গ্রামের জাকার নজির মিয়া ও জহুর মিয়া তাঁকে ধরে নিয়ে যান বাদল মাষ্টারের বাড়ী। সেখানে রেখে রাতভর পালাক্রমে ধর্ষণ করে তাঁকে। পরদিন সকালে আর্মিরা ছেড়ে দিলে বোনের বাড়ী আশ্রয় নেয় প্রভা রানী। সেখান থেকে আবারো তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় শমশের নগর ডাক বাংলায় পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্পে। সারা রাত পাকিস্তানী সেনারা আবারো তাঁকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে।
স্বাধীনতার এত বছর পরও জীবিকার প্রয়োজনে তিনি বেঁছে নিয়েছিলেন ফ্যারী করা। স্বামীর রেখে যাওয়া ভিটে মাটিটুকুও দখল করে নিয়েছিল ক্ষমতাধররা। তাঁর ভাগ্যে এখনো জুটেনি বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি।

এমন ‌অসংখ্য বীরাঙ্গনারা এখনো বেঁচে আছেন যারা সমাজে নিজ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। সাথে যুদ্ধ শিশুটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছেন পরিবার, পরিবেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে। সব যুদ্ধশিশুরা ভাগ্যবান হতে পারেননি, এখনো কিছু সংখ্যক যুদ্ধশিশুরা আমাদের সমাজে রয়ে গেছেন অবহেলিত।

আমরা মানুষ হতে গিয়ে আটকে আছি ধর্ম, সংস্কৃতি, মানবিকতা ও নৈতিকতার বেড়াজালে।
আমাদের সমাজ এখনো বীরাঙ্গনা এবং যুদ্ধশিশুদের স্বাভাবিকরুপে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর আজ বহু বীরাঙ্গনাদের কাগজে কলমে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হলেও বাস্তব জীবনে তাঁদের অনেকেই পাননি কোন সুযোগ সুবিধা।

ডিসেম্বর আমাদের আনন্দের মাস, বিজয়ের মাস। আমাদের অহংকার, গৌরবের মাস। এ মাস ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও দু’লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মাস। এ মাসে আমরা বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সকল বীর শহীদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনা মা বোনদের। আমরা শুধু স্মরণ করিনা ৭১ এ জন্ম নেয়া সেই যুদ্ধশিশুদের কথা। কেমন আছে তাঁরা? আমরা জানতেও চাইনা।

আমেরিকা জন্ম নেয়া সন্তানকে যখন ইতিহাস ঘেটে নিজ মাতৃভূমি উৎপত্তির গল্প শোনাই, এবং ছেলে যখন প্রশ্ন করে, ‘What about those war children? Why your society and country didn’t accept them?, তখন আর জবাব দিতে পারিনা।
তখন আর ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি হ্নদয়কে আন্দোলিত করেনা।

লেখকঃ কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক ও ইউএসএ প্রবাসী

আরও পড়ুন