Ads

আন্তর্জাতিক রাজনীতিঃ চিরস্থায়ী প্রেম বলে কিছু নেই… 

এম আর রাসেল

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়গুলো বড়ই মজার। এখানে চিরস্থায়ী প্রেম বলে কিছু নেই, আছে শুধুই স্বার্থ উদ্ধার। এক সময় এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র ছিল চীন। Ping Pong Diplomacy -এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের প্রেমপর্ব শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালে। ১৯৭৯ সালে দূতাবাস প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সেই প্রেম প্রকাশ্য আনুষ্ঠানিকতা লাভ করে। প্রেম পর্বের উথাল পাতাল দিন শেষে এখন দুই দেশের সম্পর্ক বিষাদ পর্বে অবগাহন করেছে।

চীনকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে। ট্রাম্প আমলে সবচেয়ে আলোচিত ছিল ইন্দো প্যাসিফিক কৌশল। ওবামা আমলে এটা ছিল Pivot to Asia. অনেকে এটাকে Rebalancing Asia নামেও অভিহিত করে থাকে। প্যাসিফিক ও ভারত মহাসাগররে যুক্তরাষ্ট্র নিজের আধিপত্য বিস্তারে কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে তা পত্রিকায় চোখ বুলালেই বুঝতে পারা যায়।

এশিয়ায় চীনকে ঠেকাতে এবার যুক্তরাষ্ট্র মিত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে ভারতকে। ভারতের সাথে কিছুদিন পূর্বে যুক্তরাষ্ট্র BECA (Basic Exchange and Cooperation Agreement) নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। QUAD (Quadrileteral Security Dialogue) নামের ৪ দেশীয় জোটের কথাও এখানে উল্লেখ করা যায়। ৫ জুলাই ২০২০ গঠিত IPAC( Inter Parliamentary Alliance on China)  এর কথাও ভুলে যাওয়ার নয়।

অনেকে বিশ্লেষক চীন যুক্তরাষ্ট্রের এই লড়াইকে স্নায়ুযুদ্ধ-২ নামেও অভিহিত করেছেন। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধ থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে যেভাবে বিবাদ বাড়ছে তাতে করে সামনে একটি যুদ্ধের সম্ভাবনাকে একেবারেই উডিয়ে দেয়া যায় না। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্রাহাম এলিসন একটি বই লিখেছেন। “Destined for War: Can America and China Avoid the Thucydides Trap” নামের বই এ এলিসন যে ট্রাপের কথা বলেছেন তা বেশ মূল্যায়নের দাবি রাখে।

উদীয়মান শক্তির সাথে প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরোধ নিয়ে তিনি ১৬ টি উদাহরণ দিয়েছেন। যার মধ্যে ১২টিই শেষ হয়েছে যুদ্ধ দিয়ে। আবার চীন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে রবার্ট স্পালডিং “Stealth War” নামে একটি বই লিখেছেন। আগামীতে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতিকে তিনি Stealth War নামে অভিহিত করেছেন।

সবার জানা থাকার কথা Stealth বিমান শত্রুর রাডার ফাঁকি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। লেখক দাবি করেছেন চীন Stealth বিমানের মতই সব কিছুকে ফাঁকি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে আঘাত করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঐ দিকে চীন সারা বিশ্বে তাঁর প্রভাব বৃদ্ধি করেই চলেছে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক শত্রু দেশ ইরান। এই ইরানও এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেয়সী ছিল। এই প্রেয়সীর কাছে কিছু চাওয়ার পর তা পান নি এমনটা কখনই ঘটেনি বলে জানাচ্ছেন হেনরি কিসিঞ্জার। ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লব সেই প্রেমপর্ব একেবারেই শেষ করে দেয়। এখন সেই প্রাণপ্রিয় প্রেয়সীকে মেরে ফেলতে যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক অবরোধ আরোপ করে চলেছে।

ইরানের সাথে প্রণয়-লীলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের দিকে নজর দেয়। উদ্দেশ্য সোভিয়েত বিরোধিতার নামে এই অঞ্চলে কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। পাকিস্তানের ISI( Inter-services intelligence)  ও CIA ( Central Intelligence Agency)  এর যৌথ সহযোগিতায় গড়ে তোলে আফগান মুজাহিদ বাহিনী। যা আজকে তালেবান নামেই পূর্ব পরিচিত। এই তালেবানকে তৈরি করতে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসহ সকল সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মজার বিষয় হল এই তালেবান তৈরিতে অর্থ সহায়তা দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। তালেবান তৈরির সময় চীনও যুক্তরাষ্ট্রের পাশে ছিল।

আফগান মুজাহিদ বাহিনীতে প্রায় ৫০ হাজারের মত অ-আফগান ছিল। এরাই কালক্রমে আল কায়েদা, আবু সায়েফ নামে গেরিলা দল গড়ে তোলে। এই দলগুলোকে গুপ্ত হামলায় প্রশিক্ষণ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর তাই যখন এদের সাথে সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় তখন এদেরকেই সন্ত্রাসী বলে অভিহিত করতে যুক্তরাষ্ট্র এক মুহূর্ত দেরি করে না। ৯/১১ এর ঘটনার পর পৃথিবীময় War on Terror এর জন্ম তো এক বিশাল ঘটনা।

এভাবেই নানা ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এগিয়ে যায়, এগিয়ে যাবে সেই সূত্র ধরে যা বলেছিলেন লর্ড পালমারস্টোন “We have no eternal allies, and we have no perpetual enemies. Our interests are eternal and perpetual, and those interests it is our duty to follow.”

লেখকঃ শিক্ষার্থী, গবেষক ও কলাম লেখক 

আরও পড়ুন