Ads

বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ২য় পর্ব

।। জামান শামস ।।

আমি অবাক হয়ে ভাবি দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্ত্রী গ্রহনের কি আর কোন কল্যাণপ্রসু যুক্তি আমাদের সামনে নেই ? একজন লিখেছেন-এতে একের অধিক বিবাহের দুনিয়াবি ফায়দা যেমন,এক স্ত্রী প্রেগন্যান্ট বা অসুস্থ অবস্থায় থাকলে আপনি অন্য স্ত্রীর সাথে নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন, ফেতনায় পড়তে হবে না। এক স্ত্রী অসুস্থ থাকলে অন্য স্ত্রী রান্নাবান্না সহ বাসার সব কাজ করতে পারবে,সেই সাথে সুস্থ স্ত্রী অসুস্থ স্ত্রীরও সেবা করতে পারবে। স্বামী অফিস বা ব্যবসার কাজে একটু বেশি রাতে বাড়ি ফিরলে সব স্ত্রী মিলে নির্ভয়ে থাকতে পারবে। শত্রু বা তেলাপোকা/টিকটিকি বা ভুতের ভয় থেকে বেচে থাকতে পারবে। ঘরের কাজকর্ম যেমনঃ ঘর গোছানো, রানাবান্না করা এগিয়ে থাকবে মিলেমিশে সকল স্ত্রী বোনের মত থেকে বাড়িকে সাজিয়ে রাখবে। ফলে সকলের পরিশ্রম কম হবে। পুরুষ শারিরীক ও মানসিক ভাবে চনমনে থাকলে তার প্রতিদিনের কাজকর্মও সুন্দর হবে, ফলে চাকরি ও ব্যবসায় বরকত হবে।

আরেকজন সম্মানিত মহিলা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন কুড়ি বৎসরের যুবতী তিনি খুঁজছেন তার স্বামীর সেবার জন্য মাসনা হিসাবে। তিনি বলেছেন,তার স্বামী অসুস্থ ও শয্যাসায়ী। তিনিও এখন আগের মতো সন্তানদের লালন পালন,নিজের চাকুরী ও ব্যবসা সামাল দিয়ে স্বামীকে সময় দিতে পারেন না। তাই তার ভিতরে দহন হচ্ছে। তিনি আল্লাহর কাছে কি জবাব দিবেন ? তিনি আরো বলেছেন,তার স্বামীর জন্য একজন সার্বক্ষনিক খাদেমা স্ত্রী হিসাবে পেলে সকল অধিকারসহ এ কাজে লাগাবেন আর তিনি ফ্রি হয়ে মাদ্রসার শিক্ষকতার কাজে মন লাগাতে পারবেন।

প্রথম পর্ব- বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ১ম পর্ব

তাহলে,যে মেয়েটি দ্বিতীয় স্ত্রী হিসাবে আসবেন তার জৈবিক চাহিদা কে মিটাবে ? তিনি তার যৌবনে স্বামীর সাহচর্য নিয়ে যেমন ধন্য হয়েছেন আরেকটি মেয়েও তো তাই চায়। আরেকজন মেয়েকে দাসী বানিয়ে তিনি রানী সাজতে চান !! আহা কি জঘন্য চিন্তা !! আমি আর কোন মন্তব্য করবো না। এগুলো মাসনা, সুলাসা, রুবায়ার -দুই তিন ও চার স্ত্রী অনুমোদনের মোটেও কোন কারণ নয় বরং এরা চরম মানের ফাঁকিবাজ যারা ইসলামের এরকম একটি মহৎ উদ্দেশ্যকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়। আল্লাহর কসম,এগুলো বহুবিবাহ অনুমোদনের কারণ নয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরে আসছে।

লা হাওলা অলা কুওআতা ইল্লা বিল্লাহ। যারা এক নারী নিয়ে জীবন পার করে দিয়েছেন,গত হয়েছেন তারা কতইনা অভাগা। এসব ফয়েজ বরকত থেকে বঞ্ছিত।

এ সূরার ১২৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে,

وَ لَنۡ تَسۡتَطِیۡعُوۡۤا اَنۡ تَعۡدِلُوۡا بَیۡنَ النِّسَآءِ وَ لَوۡ حَرَصۡتُمۡ فَلَا تَمِیۡلُوۡا کُلَّ الۡمَیۡلِ فَتَذَرُوۡهَا کَالۡمُعَلَّقَۃِ ؕ وَ اِنۡ تُصۡلِحُوۡا وَ تَتَّقُوۡا فَاِنَّ اللّٰهَ کَانَ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا

তোমরা কক্ষনো স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা করতে পারবে না যদিও প্রবল ইচ্ছে কর, তোমরা একজনের দিকে সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পড়ো না এবং অন্যকে ঝুলিয়ে রেখ না। যদি তোমরা নিজেদেরকে সংশোধন কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

দ্বিতীয় পর্ব – বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ২য় পর্ব

কোন এক স্ত্রীর প্রতি যদি তোমার আন্তরিক আকর্ষণ বেশী হয়ে যায়, তবে সেটা তোমার সাধ্যায়ত্ব ব্যাপার নয় বটে, কিন্তু এ ক্ষেত্রেও অন্যজনের প্রতি পরিপূর্ণ উপেক্ষা প্রদর্শন করা জায়েয হবে না। সূরা আন-নিসার এ আয়াতে ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করতে না পারার আশংকার ক্ষেত্রে এক বিয়েতেই তৃপ্ত থাকার নির্দেশ এবং পরবতী আয়াতে “তোমরা কোন অবস্থাতেই একাধিক স্ত্রীর মধ্যে সমতা রক্ষা করতে পারবে না” এ দু’আয়াতের মধ্যে সমন্বয় হচ্ছে, এখানে মানুষের সাধ্যায়ত্ব ব্যাপারে স্ত্রীদের মধ্যে সমতা বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় আয়াতে যা মানুষের সাধ্যের বাইরে অর্থাৎ আন্তরিক আকর্ষণের ব্যাপারে সমতা রক্ষা করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করা হয়েছে। সুতরাং দু’টি আয়াতের মর্মে যেমন কোন বৈপরীত্ব নেই, তেমনি এ আয়াতের দ্বারা একাধিক বিবাহের অবৈধতাও প্রমাণিত হয় না। যদি আমরা এ আয়াতের শানে-নুযুলের দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলছেন, একটি ইয়াতীম মেয়ে এক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে ছিল। লোকটি সে ইয়াতীম মেয়েটির সাথে সম্পদে অংশীদারও ছিল। সে তাকে তার সৌন্দর্য ও সম্পদের জন্য ভালবাসত। কিন্তু সে তাকে ইনসাফপূর্ণ মাহ্‌র দিতে রাযী হচ্ছিল না। তখন আল্লাহ্‌ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করে মাহ্‌র দানের ক্ষেত্রে ইনসাফপূর্ণ ব্যবস্থা কায়েম করার নির্দেশ দেন। ইয়াতীম হলেই তার মাহ্‌র কম হয়ে যাবে, এমনটি যেন না হয় সেদিকে গুরুত্বের সাথে লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দান করা হয়। [বুখারীঃ ২৪৯৪, ৪৫৭৪, ৫০৯২, মুসলিমঃ ৩০১৮]

অর্থাৎ “যতই চাও না কেন, তোমরা স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা করতে পারবে না।” ইতিপূর্বে সূরা নিসার প্রথম দিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের মধ্যে সমতা ও ন্যায় নীতি বজায় রাখা অবশ্য কর্তব্য। যার ধারণা হবে, এ কর্তব্য আমি পালন করতে পারবো না, তার একাধিক বিয়ে করা উচিত নয়।

তৃতীয় পর্ব- বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ৩য় পর্ব

এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছেঃ

فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا تَعْدِلُوا فَوَاحِدَةً

অর্থাৎ “আর যদি তোমরা আশংকা কর যে, সমতা রক্ষা করতে পারবে না, তবে একজন স্ত্রীই যথেষ্ট।”

হযরত রাসূলে করীম (সা) কথা ও কাজে স্ত্রীদের মধ্যে সমতা ও ন্যায়-নীতি বজায় রাখার উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং তা লংঘন করার বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সা) স্বীয় স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায়-নীতি ও সমদর্শিতা বজায় রাখার প্রতি তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখতেন। সাথে সাথে মহান আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে আরয করতেনঃ

اللهم هذا قسمى فيما املك فلا تلمني فـيـمـا تملك ولا املك

অর্থাৎ “ইয়া আল্লাহ্! যতদূর আমার ইখতিয়ারভুক্ত তার মধ্যে আমি সমবণ্টন ও সমব্যবহার করলাম। অতএব যা আমার ইখতিয়ার-বহির্ভূত কিন্তু তোমার ইখতিয়ারভুক্ত (অর্থাৎ আন্তরিক আকর্ষণ ও ভালবাসা) সে ব্যাপারে আমাকে অভিযুক্ত করো না।”

রাসূলে করীম (সা)-এর চেয়ে অধিক সংযমী ও আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসম্পন্ন আর কে হতে পারে ? কিন্তু তিনিও মনের আকর্ষণকে ইখতিয়ার-বহির্ভূত বলে সাব্যস্ত করেছেন এবং আল্লাহ্ তা’আলার মহান দরবারে ওজর পেশ করেছেন।

চতুর্থ পর্ব – বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। চতুর্থ পর্ব

সূরা নিসার প্রাথমিক আয়াতে বোঝা গিয়েছিল যে, স্ত্রীদের মধ্যে সর্বতোভাবে সমতা বজায় রাখা ফরজ যার ফলে আকর্ষণ ও ভালবাসার ক্ষেত্রেও সমতা রক্ষা করা ফরয সাব্যস্ত হচ্ছিল। অথচ এটা স্বামীর ইচ্ছাধীন নয়। তাই এখানে মূল বক্তব্য স্পষ্ট করা হয়েছে যে, তোমাদের সাধ্যাতীত ব্যাপারে সমতা রক্ষা করা ফরয নয়, বরং খোরপোশ, আচার-ব্যবহার, রাত যাপন প্রভৃতি তোমাদের ইখতিয়ারভুক্ত ব্যাপারেই সমতা ও ন্যায়-নীতি বজায় রাখতে হবে। আল্লাহ্ তা’আলা এ উপদেশটি এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যে, যে কোন রুচিবোধসম্পন্ন মানুষ তা মানতে বাধ্য। ইরশাদ হয়েছেঃ

وَلَنْ تَسْتَطِيعُوا أَنْ تَعْدِلُوا بَيْنَ النِّسَاءِ وَلَوْ حَرَصْتُمْ فَلَا تَمِيلُوا كُلَّ الْمَيْلِ فَتَذَرُوهَا كَالْمُعَلَّقَةِ

“যতই চাও না কেন, তোমরা স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা করতে পারবে না। অতএব, এমনভাবে একদিকে পুরোপুরি ঝুঁকে পড়ো না, যাতে তাদের একজন মাঝপথে ঝুলে থাকে!

এখানে বলে দেওয়া হয়েছে যে, দুজন স্ত্রীর মধ্যে সমতা বজায় রাখার যতই চেষ্টা করো না কেন, মনের আকর্ষণ ও ভালবাসার দিক দিয়ে সমতা রক্ষা করতে পারবে না। কারণ এটা তোমাদের ইচ্ছাধীন নয়। তবে হ্যাঁ, তোমরা এক দিকে ঝুঁকে পড়ো না; মনের আকর্ষণে উন্মুক্ত হয়ে আদান-প্রদানের ব্যাপারেও তাকে অগ্রাধিকার দিও না যার ফলে অন্য স্ত্রী মাঝপথে ঝুলে থাকে। বেচারীকে অধিকারও দেবে না আর বিদায়ও করবে না, এমন যেন না হয়।

পঞ্চম পর্ব –বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। পঞ্চম পর্ব

এই আয়াতে সমতা রক্ষা করাকে সাধ্যাতীত বলা হয়েছে। বস্তুত এটা আকর্ষণ ও অনুরাগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অতঃপর فَلَا تَمِيلُوا كُلَّ الْمَيْلِ অর্থাৎ “একদিকে পুরোপুরি ঝুঁকে পড়ো না”—বাক্য দ্বারা সতর্ক করা হয়েছে যে, আন্তরিক আকর্ষণ ও অনুরাগ তোমাদের ক্ষমতা-বহির্ভূত হওয়ার কারণে ক্ষমার্হ। কিন্তু পক্ষপাতিত্ব করে তোমাদের আয়ত্তাধীন ক্ষেত্রেও তাকে প্রাধান্য দেওয়া জায়েয নয়। এভাবে এ আয়াত সূরা নিসার প্রথম আয়াতের এই ব্যাখ্যা দিচ্ছে যে, উক্ত আয়াত দ্বারা স্থুল দৃষ্টিতে আকর্ষণ ও অনুরাগে সমতা রক্ষা করা ফরয বোঝা গিয়েছিল। অতঃপর এই আয়াত দ্বারা সুস্পষ্ট বুঝিয়ে দেওয়া হলো যে, এটা ক্ষমতা- বহির্ভূত হওয়ার কারণে ফরয নয়। শুধু আয়ত্তাধীন ক্ষেত্রেই সমতা ও ন্যায়-নীতি বজায় রাখা ফরয।

এতে দু’টি শব্দ রয়েছে। একটি (اَدْنٰى) এটি (دُنُوٌّ) ধাতু থেকে উৎপন্ন, যার অর্থ হয় নিকটতর। দ্বিতীয় শব্দটি হচ্ছেঃ (لَاتَعُوْلُوْا) যা (عال) শব্দ হতে উৎপন্ন, অর্থ ঝুঁকে পড়া। এখানে শব্দটি অসংগতভাবে ঝুঁকে পড়া এবং দাম্পত্য জীবনে নির্যাতনের পথ অবলম্বন করা অর্থে ব্যবহৃত করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, এ আয়াতে তোমাদের যা বলা হল যে, সমতা বজায় রাখতে না পারার আশংকা থাকলে এক স্ত্রী নিয়েই সংসারযাত্রা নির্বাহ কর -এটা এমন এক পথ যা অবলম্বন করলে তোমরা যুলুম থেকে বেঁচে থাকতে পারবে। বাড়াবাড়ি বা সীমালংঘনের সম্ভাবনাও দূর হবে।

চলবে…

ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব-বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব

লেখকঃ জামান শামস, কলাম লেখক এবং সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন । আসুন সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

আরও পড়ুন