Ads

বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। পঞ্চম পর্ব

।। জামান শামস ।।

সম্মানিত পাঠক! আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১৯ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে ঢাকার তেজগাঁও থানার পুলিশ জাকির হোসেন ব্যাপারী নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেন, যিনি তথ্য-পরিচয় গোপন করে, প্রতারণা করে ২৮৬টি বিয়ে করেছেন। এই বিপুল সংখ্যক বিয়ে করার জন্য তিনি ১৪ বছর সময় নিয়েছেন। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ খবরটি তখন ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

দেখা গিয়েছে অধিকাংশ বহুবিবাহ গোপনে সংগঠিত হয়।কেন ভাই,এতো গোপনীয়তা ? আপনি বলছেন,বিয়ে মানে মনোরন্জন (!) তাহলে চুরি করে কেন মনোরন্জন করতে হবে।আমি বিস্মিত যে এই লেখা চলা অবস্থায় অনেকে আমার মতের সংগে দ্বিমত পোষণ করেছেন।এটা স্বাভাবিক। একজন বলেছেন-“এই সম্পূর্ণ লেখনীর সাথে একমত হতে পারলাম না। এটা তাফসীর বির রায়! আল্লাহ্ যা হালাল সাব‍্যস্ত করেছেন তা দ্ব‍্যর্থহীন ভাবে হালাল। কে কী উদ্দেশ্যে হালালকে নিবে সেটা তার বিষয়। সক্ষম পুরুষ প্রয়োজনে নিজের মনোরঞ্জনের জন্য চারটি পর্যন্ত বিয়ে করতে পারে! নিকাহের আভিধানিক অর্থই তো ঐটা!”

প্রথম পর্ব- বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ১ম পর্ব

পাঠক বিচার করুন,যাদের কাছে বিয়ে মানেই মনোরন্জন তারা নিশ্চিত বিয়ের পবিত্র শরীয়াহর মাকাসিদ লংঘন করে একে গাম্ভীর্যহীন একটি তামাশায় রুপান্তর করবে । এতে কোন সন্দেহ নেই যেমনটি চলচিত্রের নট নটীদের বেলায় আমরা হর হামেশাই শুনি। একজনের বিষয়ে তো বাজারে রটনাই প্রচলিত যে তিনি বিয়ে করেন,সন্তান উৎপাদন করেন।আবার বিয়ে করেন, আবার উৎপাদন করেন এবং উৎপাদনের এ প্রক্রিয়া চলছেই।তার আবারো ভূমি কর্ষণের প্রস্ততি চলছে। এখন উপরের মন্তব্যকারীকে বলতে ইচ্ছে করছে-এমন উত্তম কৃষকের পক্ষ নিয়ে আপনার ঈমান রক্ষা কঠিন হবে বৈকি (!)

মানুষকে ইহকাল-পরকালের সমস্ত গুরুভার ও শৃংখল থেকে মুক্ত করা ইসলামী শরীয়ার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। (সূরা আরাফ:১৫৭) ন্যায় ও সদাচার প্রতিষ্ঠা করা শরীয়ার অন্যতম লক্ষ্য। (সূরা নাহল:৯০) এবং এই শরীয়তের বাহক হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টিকূলের জন্য রহমত ও অনুগ্রহ স্বরূপ প্রেরণ করা হয়েছে। (সূরা আম্বিয়া:১০৭) । ফলে শরীয়ার কোন বিধান হেকমত-প্রজ্ঞা ও কল্যাণ (مصلحة) বর্জিত বা বিরোধী হবে, এটা অসম্ভব ব্যপার। এজন্য আমরা যখন পৃথিবীর অন্যান্য ধর্ম-মতবাদ ও ইসলামের মাঝে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করি, তখন ইসলামী শরীয়ার প্রজ্ঞা ও কল্যাণ বারবার আমাদের হৃদয়কে নাড়া দেয়। ঈমানকে করে সতেজ ও মজবুত।

দ্বিতীয় পর্ব – বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ২য় পর্ব

বস্তুবাদী ধারণা মতে, যে বস্তুই সাময়িক প্রশান্তি ও আনন্দ সৃষ্টি করবে, সেটি “কল্যাণ” (مصلحة) হিসেবে গৃহীত হবে; পরিণাম ও ফলাফলের বিচারে তাতে যত অকল্যাণ ও ক্ষতিই থাকুক। উদাহরণ হিসেবে নর-নারীর বিবাহবহির্ভুত সম্পর্কের কথা বলা যায়। এটি মানুষকে আত্মিক আনন্দ ও দৈহিক প্রশান্তি দেয়; কিন্তু ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে এর অনিষ্টতা প্রকাশিত হয় বহুমাত্রিকভাবে; তবু, বস্তুবাদী ধারণায় একে “কল্যাণ” বিরোধী বা অকল্যাণ (مفسدة) হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে না। কেননা সবকিছুর পরেও এটি ভোগ, আনন্দ ও প্রশান্তির উপকরণ। বস্তুবাদী ধারণায় ধর্ম ও পরকাল চিন্তা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। অপরদিকে ইসলামি শরীয়া মতে কল্যাণের বিষয়টি আল্লাহপাকও পরকালের প্রতি বিশ্বাস এবং প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

মূলতঃ এ কারণে ইসলামের মহান ফকীহ, ইমাম ও মুজতাহিদগণ শরীয়তের সমস্ত বিধান পূর্ণরূপে পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান (استقراء) এর মাধ্যমে উদঘাটন করেছেন, শরীয়তের মাকাসিদ (مقاصد الشريعة) বা মূল উদ্দেশ্যসমূহ মোট পাঁচটি। ১. দীন সংরক্ষণ (حفظ الدين)২. প্রাণ সংরক্ষণ (حفظ النفس) ৩. মস্তিষ্ক সংরক্ষণ (حفظ العقل) ৪. বংশধারা সংরক্ষণ (حفظ النسل) ৫. সম্পদ সংরক্ষণ (حفظ المال)

তৃতীয় পর্ব- বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ৩য় পর্ব

শরীয়তের প্রত্যেকটি বিধান এই পাঁচ মাকাসিদ বা উদ্দেশ্যের কোন একটির অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ সমস্ত বিধান দ্বারা এই পাঁচটি জিনিসের সংরক্ষণ করতে চাওয়া হয়। এই পাঁচটি মাকসাদ যেন সঠিকভাবে সংরক্ষিত হয়, সে লক্ষ্যে শরীয়তে যে সকল বিধান দেওয়া হয়েছে, চরিত্রের বিচারে সেগুলো আবার তিনভাগে বিন্যস্ত। ১. জরুরিয়াত (الضروريات) ২. হাজিয়াত (الحاجيات)৩. তাহসীনিয়াত (التحسينيات)এ বিবেচনায় বিয়ে মানবজীবনের অন্যতম একটি জরুরত এবং তা মানব বংশধারা সংরক্ষণের নিমিত্তে। কোন বিবাহে শরীয়াহ’র এ মাকাসিদ অনুপস্থিত থাকলে (যেমনটি মনোরন্জনের অর্থে বলা হচ্ছে) তবে সে বিয়ে শরীয়াহ সমর্থিত কিনা,এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে।

পূর্বে যে পাঁচটি মাকসাদ এবং এগুলো অর্জনের তিনটি স্তর সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, মূলতঃ এসব কিছুই সর্বোচ্চ একটি মৌলিক ও কেন্দ্রিয় লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম ও উপকরণ। সেই সর্বোচ্চ লক্ষ্যটি হচ্ছে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পরিচয় লাভ করা, একনিষ্ঠ মনে তাঁর গোলামি ও বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকা। এর মাধ্যমে বান্দা তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করবে এবং জান্নাতের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হবে। বস্তুতঃ এটি দুনিয়ার সাথে পরকালীন জীবনের যোগসুত্র ও বন্ধন।

চতুর্থ পর্ব – বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। চতুর্থ পর্ব

পূর্বের চারটি পর্বের কোথাও আমি বলিনি যে একাধিক বিবাহ ইসলামে নিষিদ্ধ বরং বারংবার একাধিক জীবন সংগী হলে যে ইনসাফের কথা আল্লাহ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে প্রসংগে হাদীসে সাবধান করা হয়েছে আমি সেটাই পুনর্ব্যক্ত করতে চেয়েছি।একথাও বলার চেষ্টা করেছি যে আমাদের সমাজে প্রচলিত একাধিক বিয়েতে বিয়ের যে পবিত্রতা, গাম্ভীর্যতা ও সৌন্দর্য তা রক্ষা হচ্ছে না বরং সেটা বিয়েকে খেল তামাশায় পরিণত করেছে। আরো ভয়াবহ ব্যাপার হলো দ্বিতীয়,তৃতীয়,চতুর্থ এবং ক্ষেত্রবিশেষে পঞ্চম বিয়ে করা হয় অতি সংগোপনে । বহাল স্ত্রীকে না জানিয়ে, সমাজে জানান না দিয়ে। মানুষ বহুকাল পরে জানে যখন এটা নিয়ে স্ত্রীতে স্ত্রীতে চুলাচুলি বা তাদের পরিবারে পরিবারে কোপাকোপি হয়ে দু’চারজন আহত নিহত হয়। আর না হয় একটা স্ক্যান্ডাল হয় বা সন্তান জন্মের খবর চাউর হয়। কী আশ্চর্য ! বৈধ বস্তুতে এতো রাখঢ়াখ কেন ? ডালমে কুচ কালা হায় বলেই কি !!

পঞ্চম পর্ব-বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। পঞ্চম পর্ব

আরো পরিস্কার কথা,যে সমস্ত পুরুষ ঘরে বৈধ স্ত্রী থাকা সত্তেও পরনারী সংস্রবে যান, পতিতা ঘনিষ্ঠ হোন অথবা পরকীয়ায় আসক্ত তাদের জন্য দ্বিতীয় বিয়ে অনিবার্য।বিয়ে হালাল,জ্বেনা হারাম। আপাতত হালালে মনোযোগ দিন,হারাম যদি ছাড়তেই না পারেন।আল্লাহ আপনার জন্য অপশান উন্মুক্ত রেখেছেন।কিছু পুরুষ কারণে অকারণে বউ পিটান,তাদের উপর জুলুম করেন। নানা অযুহাতে তাদের প্রতি উদ্ধত আচরণ করেন। এগুলো পুরুষ নামের কলংক। কুরআনে বলা হয়েছে, وَ عَاشِرُوۡهُنَّ بِالۡمَعۡرُوۡفِ ۚ তাদের সাথে দয়া ও সততার সঙ্গে জীবন যাপন কর (সূরা নিসা ১৯) وَ قُوۡلُوۡا لَهُمۡ قَوۡلًا مَّعۡرُوۡفًا তাদের সাথে সদ্ভাবে কথা বল (সূরা নিসা ৫)।

ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব-বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব

লেখকঃ জামান শামস, কলাম লেখক এবং সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন । আসুন সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

আরও পড়ুন