Ads

বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব

।। জামান শামস ।।

এটি বেশ কয়েক বছর আগের খবর। রাজশাহীতে একই ছাদের নিচে চার স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করছেন পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নের এএসএম জুবায়ের হোসেন মণ্ডল জুয়েল (২৮)। তিনি পেশায় পানচাষী। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন ফসল স্টকের ব্যবসা করেন। জানা যায়, এ পর্যন্ত জুয়েল মণ্ডল ছয়টি বিয়ে করেছেন। বর্তমানে চার স্ত্রীকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে সংসার করছেন। জুয়েলের বাবা ও মাসহ চার স্ত্রী মিলেমিশে একই বাড়িতে থাকছেন। তিনি বাবা মার একমাত্র সন্তান।

এ বিষয়ে পবা উপজেলার বড়গাছী ইউপি চেয়ারম্যান শাহাদাত হুসাইন জানান, দুই বছর হলো তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি কখনো জুয়েল মণ্ডলের স্ত্রীদের কোনো অভিযোগ শোনেননি। কেউ কখনো অভিযোগও করেননি। জুয়েলকে তিনি আগে থেকেই চেনেন। তারা ভালোই আছেন। এ বিষয়ে জুয়েল জানান, তার স্ত্রীদের মধ্যে কোনো ঝগড়া-বিবাদ নেই। বাবা-মাসহ চার স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে সুখের সংসার তার। চার স্ত্রীই তার যত্ন নেন এবং তাকে খুব ভালোবাসেন। তার স্ত্রীরা হলেন রিমা, রোপা, ময়না ও হাসি। এরকম বহু উদাহরণ আছে।

প্রথম পর্ব- বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ১ম পর্ব

এটাও পত্রিকায় দেখেছি, পাকিস্তানের এক স্বামীর জন্য প্রথম স্ত্রী তার জন্য দ্বিতীয়জনকে খুঁজে দিয়েছেন,পরে দু’জন মিলে তৃতীয় একজনকে এনেছেন এবং আরো পরে তিনজন মিলে চতুর্থজনকে আমন্ত্রণ করে এনেছেন এবং এরা সকলে এক স্বামীর বৈধ স্ত্রী হিসাবে একই ছাদের নীচে অনেক বছর ধরেই বিনা অভিযোগে শান্তির সাথে বসবাস করছেন।

বেশিরভাগ মুসলিমই এই চর্চাকে সমর্থন করলেও, তারা এটাকে বাস্তব জীবনে খুব একটা প্রয়োগ করে না। এর কারণ যাই হোক, সামাজিক ট্রেন্ড এমন যে আপনি শত লাম্পট্য করলেও কেউ কোথাও কোন অভিযোগ করে না কিন্ত চরিত্রহীনতা থেকে বাঁচতে এক নারীর বেশী বৈধভাবে জানান দিয়ে বিয়ে করলেও আপনাকে প্রথমেই “চরিত্রহীন” আখ্যা দিবে। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই বহুবিবাহের চর্চায় ভিন্নতা আছে। কিছু মুসলিম দেশে এটা খুব সাধারণ ব্যাপার আবার কিছু দেশ যেমন: আজারবাইজান, তিউনিশিয়া এবং তুরস্কে বিবাহের ক্ষেত্রে ইসলামিক আইনকে গ্রহণ করা হয় নি। ফলে সেখানে বহুবিবাহ বৈধ নয়।

দ্বিতীয় পর্ব – বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ২য় পর্ব

প্রথম মুসলিম দেশ তুরস্ক ১৯২৬ সালে পুরুষের বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ করে। এই নিষেধাজ্ঞা কোনো ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ছিল না বা কোন ধর্মীয় গোষ্ঠির ফতোয়ায়ও নয়। ধর্ম নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। এরপর ১৯৫৬ সালে তিউনিশিয়া বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ করে। তুরস্কের মত তিউনিসিয়া ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নয় বরং তাদের মতে,দুইটি ধর্মীয় কারণে নিষিদ্ধ করেছে। প্রথমত, কুরআন পুরুষের বহুবিবাহের চর্চাকে সীমিত করেছে এবং এই চর্চাকে উৎসাহিত করে না দ্বিতীয়ত, কুরআনে বলা হয়েছে, সমস্ত স্ত্রীর সকল চাহিদা সমান ভাবে পুরণ করা, যা অসম্ভব।

আরো যে দেশগুলোও বহুবিবাহের চর্চাকে নিষিদ্ধ করে তাদের মধ্যে মিশর (১৯২০) সুদান (১৯২৯) আলজেরিয়া, জর্ডান (১৯৫১), সিরিয়া (১৯৫৩) মরক্কো (১৯৫৮)। ইরাক (১৯৫৯) ইরান (১৯৬৭, ১৯৭৫) কুয়েত ও লেবানন। বাংলাদেশে বহুবিবাহ সম্পুর্ণভাবে নিষিদ্ধ নয়। এখানে পুরুষকে বহুবিবাহ করতে হলে কিছু প্রধান শর্ত (বর্তমান স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব, দৈহিক দূর্বলতা, দাম্পত্য সম্পর্কের জন্য দৈহিক অনুপযুক্ততা, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য প্রদত্ত আদালতের কোন ডিক্রিকে ইচ্ছাকৃতভাবে এড়ানো, বর্তমান স্ত্রীর মানসিক অসুস্থতা এবং এসব সমস্যা সাপেক্ষে স্ত্রীর সজ্ঞানে সম্মতি পুরন এবং সেগুলো প্রমাণ করে, বহুবিবাহ করতে পারে।

তৃতীয় পর্ব- বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ৩য় পর্ব

মালয়েশিয়াতে নিয়মটা কিছুটা ব্যতিক্রম। এখানে দ্বিতীয় বিবাহ করতে হলে, প্রথম ও ভবিষ্যৎ পত্নী থেকে অনুমতি নিতে হবে পাশাপাশি ধর্মীয় অথোরিটি থেকে অনুমতি নিয়ে বিবাহ করতে পারবে। (তথ্যসমূহ উইকিপেডিয়া থেকে সংগৃহীত)

এটা সব মাযহাবেই স্বীকৃত যে,শর্তসাপেক্ষে একজন পুরুষ মুসলমানকে চারটি পর্যন্ত বিবাহ করার যে অনুমোদন দেয়া হয়েছে তা অদ্যাবধি বলবৎ আছে এবং সূরা নিসায় চার বিয়ে ইয়াতিম মেয়েদেরকে নয় বরং ইয়াতিম ব্যতিত অন্য সাধারণ মেয়েদেরকে করার জন্য বলা হয়েছে মর্মে প্রতিয়মান হয়। হানাফী মাযহাবে কুরআনের দু’টি নির্দেশের মধ্যে ভারসাম্যতার উপর জোর দিয়ে বলা হয় যে এটি গ্রহণযোগ্য জায়েজ তবে বাধ্যতামূলক নয়। অন্য তিনটি মাযহাবের পূর্বের উলেমাগণের সাথে বর্তমান উলেমাগণের ব্যাখ্যায় ভিন্নতা রয়েছে। শাফিঈ মাযহাবের আইন শাস্ত্রের আশ-শিরবেনি বলেছেন: “আপাত প্রয়োজন না থাকলে একাধিক স্ত্রীকে বিয়ে না করাই সুন্নত।” [মুগনী আল-মুহতাজ ৪/২০৭] শাফিঈ মাযহাবের আরেকজন আইনবিদ আল-মাওয়ার্দী বলেছেন: “আল্লাহ একজন পুরুষকে চারটি স্ত্রী পর্যন্ত বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছেন, কিন্তু আল্লাহ পরামর্শ দিয়েছেন যে এটি মানুষের জন্য কাম্য যে সে শুধুমাত্র একজন স্ত্রীকে বিয়ে করবে, কারণ আল্লাহ বলেছেন: {…কিন্তু যদি আপনি ভয় করেন যে আপনি ন্যায়পরায়ণ হতে পারবেন না, তবে [শুধু একজনকে বিয়ে করো]” [আল-হাউই আল-কাবির ১১/৪১৭] হাম্বলী মাযহাবের ইবনু কুদামাহ, আশ-শারহ আল-কাবীরে বলেছেন: “একজন স্ত্রীকে বিয়ে করাই অধিকতর উপযুক্ত।

চতুর্থ পর্ব – বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। চতুর্থ পর্ব

মতভিন্নতা সত্তেও বহুবিবাহকে কেউ নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেননি।এখনো অব্দি এটি ইসলামের অন্যতম একটি সোপান ও সৌন্দর্য হিসাবে বহমান। এটা জোর দেওয়া উচিত যে বিয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল পারিবারিক প্রেম, প্রশান্তি এবং স্নেহ। সূরা রুম এ আল্লাহ বলেন- وَ مِنۡ اٰیٰتِهٖۤ اَنۡ خَلَقَ لَکُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ اَزۡوَاجًا لِّتَسۡکُنُوۡۤا اِلَیۡهَا وَ جَعَلَ بَیۡنَکُمۡ مَّوَدَّۃً وَّ رَحۡمَۃً ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ “আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে।” এ আয়াতটি এক আর একাধিক-উভয়ে ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

মনে রাখতে হবে, ইসলাম পুরুষদের তাদের বিবেক তুষ্ট করার জন্য পুনর্বিবাহ করতে এবং অপ্রকাশিত আনন্দের জন্য পারিবারিক প্রেম ও শান্তি বিসর্জন দিতে উৎসাহিত করে না। যেখানে ইসলাম বহুবিবাহকে স্বীকার করার কারণই হল ব্যক্তির সামাজিক পবিত্রতা রক্ষা,চরিত্রের হিফাযত ও বিধবা নারীদের অধিকার রক্ষা।

পঞ্চম পর্ব-বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। পঞ্চম পর্ব

বলাবাহুল্য যে যদি বহুবিবাহের জন্য কোন ব্যক্তিগত বা সামাজিক প্রয়োজনীয়তা না থাকে তবে একগামীতা পছন্দনীয় এবং যদি সমাজে বা কিছু ব্যক্তির জন্য বহুবিবাহের প্রয়োজন হয় তবে এই লক্ষ্য অর্জনে অবশ্যই সহযোগিতা করতে হবে। যে ব্যক্তি এই কারণগুলির মধ্যে একটির জন্য পুনর্বিবাহ করতে ইচ্ছুক, তাকে অবশ্যই তার আর্থিক এবং শারীরিক উপায়গুলি মেনে চলতে হবে এবং যদি দুটি পরিবার পরিচালনা করার সামর্থ্য না থাকে তবে তাকে অবশ্যই পুনর্বিবাহের চিন্তা ত্যাগ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের বুঝার তৌফিক দিন। আমিন।

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন । আসুন সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

আরও পড়ুন