Ads

বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। চতুর্থ পর্ব

।। জামান শামস ।।

বহুবিবাহের পক্ষে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওসাল্লামের উদাহরণ দেয়া এবং তাকে সুন্নাত সাব্যস্ত করে নিজ জীবনে আমলকারীদের বহুবিবাহের স্পিরিট ও ব্যাকগ্রাউন্ড কি জানা আছে ?

নবিজীর প্রথম স্ত্রী খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদকে রা. প্রায়শই মুসলমানরা ” বিশ্বাসীদের মা ” বলে উল্লেখ করে । ইসলামে , তিনি তার কন্যা ফাতিমা বিনতে মুহাম্মাদ , রুকাইয়া বিনতে মুহাম্মদ, উম্মে কুলসুম বিনতে মুহাম্মদ এবং জয়নাব বিনতে মুহাম্মদের পাশাপাশি চার ‘স্বর্গের মহিলা’র একজন হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ মহিলা ব্যক্তিত্ব । মুহাম্মদ সা. তার ২৫ বছর বয়সে তাকে বিয়ে করেছিলেন। নবীজি খাদিজা (রা.)-এর জীবদ্দশায় কোনো নারীকে বিয়ে করেননি। এটিও একটি সুন্নত। দীর্ঘ ২৪ বছর তার সাথে সংসার করেছেন।

বহুবিবাহের আয়াত নাজিল হয়েছিল ওহুদ যুদ্ধের পর। যখন বিপুল পরিমাণ মুসলিম পুরুষ সৈন্য মারা গেলেন। নারীরা তখন কেউ বিধবা হলো, কেউ এতিম হলো। স্বাভাবিকভাবেই পুরুষের সংখ্যা কমে গেল। বহুবিবাহ ছাড়া সব মেয়ের জন্য স্বামীর ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল না। এ প্রেক্ষাপটে আল্লাহ জায়েজ ঘোষণা করেছেন; কিন্তু বিশেষ শর্ত ও নিরুৎসাহসের সঙ্গে। আর এখানে নারীর সম্মান, মর্যাদা ও সম্ভ্রম সুরক্ষাই মূল উদ্দেশ্য।

প্রথম পর্ব- বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ১ম পর্ব

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় বিয়ের হুকুম এসেছিল নারীর স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে, পুরুষের খায়েশ মিটানোর জন্য নয়। সেসব নারীদের প্রেক্ষিতে এই আয়াত যারা বিধবা ও অসহায়। তাদের আশ্রয়ের জন্য। তাদের ও তাদের সন্তানের নিরাপত্তা ও হেফাজতের জন্য। আজকে যারা আওয়াজ তুলছেন, তারা কী কখনও এমন অসহায় নারীদের নিয়ে ভাবছেন? তাদের প্রয়োজনে বিবাহ করে দায়িত্ব নিচ্ছেন? বরং অধিকাংশই শর্তের বাইরে শুধু নিজের মনোরঞ্জন মেটানোর জন্য এসব বিষয় ভাইরাল করছেন। মুখেই কেবল সমাজের বিপন্ন বিধবা ও বিধ্বস্থ নারীদের জন্য মায়া, কিন্ত মাসনার সময় কুমারী,সধবা ও সুন্দরী নারীদের দিকে দৃষ্টি ! এটি ইসলামের শিক্ষা নয়। যে বিজ্ঞতায় ইসলাম একাধিক বিয়েতে মত দিয়েছে সেটা এখানে লংঘিত হচ্ছ বলে অনেকের মত।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) তার প্রথম স্ত্রী বিবি খাদিজার (রা.) ইন্তেকালের পরবর্তী জীবনের বিয়েগুলো ছিল কোনোটা সামাজিক কারণে, কোনোটা রাজনৈতিক কারণে, কোনোটা ধর্মীয় কারণে। নবীজি (সা.) খাদিজাতুল কুবরা (রা.) ছাড়া সব স্ত্রীকে আল্লাহর নির্দেশে, ইসলামের প্রয়োজনে বিয়ে করেছিলেন।

দ্বিতীয় পর্ব – বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ২য় পর্ব

যেমন, পালিত পুত্রের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা দেয়া নাজায়েজ এবং বিধবা হলে বা ডিভোর্স হলে বিয়ে করা জায়েজ; এই নিয়ম প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি নিজেই তালাকের পর পালিত পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করেছিলেন। আম্মাজান আয়েশার সঙ্গে তাঁর বিয়ের পয়গাম সয়ং আল্লাহতায়ালা পাঠিয়েছিলেন। কারণ তিনি উত্তম পরিকল্পনাকারী। মূলত অল্প বয়সে মানুষের স্মৃতিশক্তি ভালো থাকে। কাজেও দেখা গেল রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মৃত্যুর পর উম্মুল মোমেনিন আয়েশা (রা.) সর্বোচ্চসংখ্যক হাদিস বর্ণনা করেছেন।

হজরত আলী (রা.) রাসুলের কাছে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘যে আমার ফাতিমাকে কষ্ট দেয়, সে যেন আমাকেই কষ্ট দিল।’ অর্থাৎ তিনি নিজেও প্রথম স্ত্রীর জীবদ্দশায় দ্বিতীয় বিয়েকে নিরুৎসাহিত করেছেন।

হজরত মেসওয়ার ইবনে মাখরামা (রা.) বলেছেন- ‘আমি রসুলুলাহ (সা.)-কে মিম্বরে বসে বলিতে শুনেছি- হিশাম ইবনে মুগীরা আলী ইবনে আবু তালেব (রা.)-এর কাছে তার মেয়ে বিবাহ দেওয়ার জন্য আমার কাছে প্রস্তাব করেছে। কিন্তু আমি অনুমতি দিইনি এবং আলী (রা.) আমার কন্যা ফাতেমা (রা.)-কে তালাক না দেওয়া পর্যন্ত আমি অনুমতি দেব না। কেননা ফাতেমা হচ্ছে আমার শরীরের অংশ। আমি ওই জিনিস ঘৃণা করি, যা সে ঘৃণা করে এবং তাকে যা আঘাত করে তা আমাকেও আঘাত করে।’ (বোখারি, ৭ম খণ্ড, ১৫৭)।

নিজের মেয়ের বিষয়েও তিনি দ্বিতীয় বিয়েকে অপছন্দ করেছেন এবং নিরুৎসাহিত করেছেন। বিয়েতে জোর গলায় মহরে ফাতেমিকে সুন্নত মানলে একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে ফাতেমি এই সুন্নত মানা জরুরি নয় কেন? প্রয়োজন প্রেক্ষাপটে জায়েজ এতে কারও কোনো আপত্তি নেই। তবে ঢালাওভাবে নয়।

তৃতীয় পর্ব- বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ৩য় পর্ব

রাসুলের পবিত্র স্ত্রীরা ছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের জন্য নির্বাচিত ও সম্মানিত। এই মর্যাদাবান উম্মাহাতুল মুমিনিনগনের মধ্যেও সতীনসুলভ আচরণ, ঝগড়া, মান-অভিমানের কথা হাদিসে এসেছে। স্ত্রীদের এসব আচরণে নবিজী (সা.) কষ্ট পেয়ে দীর্ঘ দিন আম্মাজানদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এ নিয়ে আল্লাহপাক কোরআনের আয়াত নাজিল করেছেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের সিরাতের এসব ঘটনা উম্মতের জন্য কী বার্তা দেয়?

এছাড়া রাসুলুল্লাহর (সা.)-এর বহু বিবাহের মাঝে সুপ্ত ছিল বহু প্রজ্ঞা। আরশের স্রষ্টা আল্লাহর নির্দেশেই তিনি এ মহৎ কাজ সম্পাদন করেছেন।

আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ততক্ষণ আমি কোনো নারীকে বিবাহ করিনি এবং আমার মেয়েদের অন্য কারও কাছে বিবাহ দেইনি যতক্ষণ না আমার প্রভুর পক্ষ থেকে জিবরাইল (আ.) বিবাহের আদেশ সংবলিত বার্তা না এনেছেন। (উয়ুনুল আছার – ২/৩০০, শরহে মাওয়াহিব – ৩/২১৯)।

চতুর্থ পর্ব – বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। চতুর্থ পর্ব

তাই আমভাবে, শর্তহীন কেবল নিজের নফসানিয়্যাত ও খায়েশাত পূরণের নিমিত্তে বহুবিবাহ করা কিংবা এর জন্য অন্যকে উৎসাহিত করা, কিংবা এটিকে মিশন বানিয়ে কাজ করার সুযোগ ইসলাম আপনাকে ঢালাওভাবে অনুমতি দেয়নি। কারও প্রয়োজন হলে শর্ত সাপেক্ষে এটিকে জায়েজ করা হয়েছে নিরুৎসাহিতভাবে। যেমন একইভাবে তালাককে নিরুৎসাহিত ও ঘৃণিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করেই প্রয়োজনে শর্ত সাপেক্ষ জায়েজ করা হয়েছে নিরুৎসাহিতভাবে। তালাক নিয়ে যেমন মার্কেটিং করার সুযোগ নেই, তেমনি মাসনা নিয়েও উৎসাহিত করার সুযোগ ইসলামে দেয়া হয়নি।

একজন পুরুষ একাধিক স্ত্রীর সাথে বিবাহিত হতে পারে যতক্ষণ না তার কাছে তার সমস্ত স্ত্রীর প্রতি নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিপূর্ণতা এবং জ্ঞান থাকে। পত্নীগণের জীবন আনন্দদায়ক হবে না যতক্ষণ না তারা বহুবিবাহের নিম্নলিখিত কয়েকটি সহজ শর্ত মেনে চলে-

১.পরিবারের উপযুক্তমানে জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদের সাথে আর্থিক স্বচ্ছলতার বিধান নিশ্চিত করা উচিত। একজন স্ত্রী একজন স্বামীর কাছে অনুমোদিত নয়,যতক্ষণ তার বহুগামী স্বামী তাকে এবং তার সন্তানদের আর্থিকভাবে সমর্থন না করে। বিয়ে করে স্ত্রী ও সন্তানদের ফেলে রাখবেন,কোন খোঁজ খবর করবেন না।আবার আরেক ফুলের মধু খাবেন।এমন তামাশা করার জন্য তো এই আল্লাহ এটা জায়েজ করেন নি। আমাদের সমাজে মোস্টলি এমনই ঘটনা ঘটছে।

পঞ্চম পর্ব-বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। পঞ্চম পর্ব

২.পুরুষকে অবশ্যই তার সমস্ত স্ত্রীকে সমানভাবে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হতে হবে এবং তার কোন স্ত্রীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাতে পারবে না। নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেনঃ যার দু’জন স্ত্রী আছে এবং তাদের একজনের প্রতি অন্যায়ভাবে ঝুঁকে থাকবে, সে কিয়ামতের দিন তার শরীরের অর্ধেক ঝুঁকে আসবে। এটি বহুগামী বিবাহে থাকা পুরুষদের তাদের সমস্ত স্ত্রীর সাথে সমানভাবে তাদের সময় ভাগ করতে এবং তাদের সাথে একই স্তরের স্নেহ ভাগ করে নিতে বাধ্য করে।

৩.লোকটিকে অবশ্যই জ্ঞানী এবং ইনসাফগার হতে হবে। খাদ্য, বস্ত্র, সমস্ত স্ত্রীর সাথে আচরণ এমনকি অন্য যেকোন তুচ্ছ বিষয়েও তাকে অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। একজন মানুষ অসুস্থ হলেও এই স্তরের প্রতিশ্রুতি বজায় রাখতে হবে। এটি নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর কর্ম দ্বারা স্পষ্ট করা হচ্ছে যেমনটি তাঁর স্ত্রী আয়েশা রা. সাক্ষ্য দিয়েছেন:

আল্লাহর রাসুল যখন অসুস্থ ছিলেন, তখন তিনি তাঁর সকল স্ত্রীকে ডেকে বললেন, আমি আর তোমাদের সকলের সাথে দেখা করতে পারব না, তাই যদি তোমরা আপত্তি না করো যে আমি আয়েশার সাথে থাকি তবে তোমরা আমাকে অনুমতি দাও। এটি দেখায় যে একজন স্বামী যদি একজন স্ত্রীর সাথে বেশি সময় কাটাতে চান তবে অন্য স্ত্রীদের কাছ থেকে তার সম্মতি চাওয়া এবং তারাও সম্মতি দেয়া উচিত।

চলবে…

ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব-বহুবিবাহের প্রচারণা ও কুরআনের নির্দেশ ।। ষষ্ঠ ও শেষ পর্ব

লেখকঃ জামান শামস, কলাম লেখক এবং সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন । আসুন সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

আরও পড়ুন