Ads

অ্যাপেলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের বাবা একজন মুসলিম!

।। শারমিন আকতার ।।  

স্টিভ জবস তার বাবা পল জবস এবং মা ক্লারার  ঘরে বেড়ে উঠলেও স্টিভ জবস আসলে তাদের নিজেদের সন্তান ছিলেন না । স্টিভ জবসকে  তারা দত্তক নিয়েছিলেন সানফ্রান্সিসকোর বিশেষ এক ডাক্তারের অধীনে থাকা প্রসূতি এক অসহায় মার থেকে। আপনাদের অনেকেই জেনে অবাক হবেন যে অ্যাপেলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের সত্যিকারের  বাবা খ্রিষ্টান নন, বরং একজন মুসলিম । তার বাবা সিরিয়ান এক মুসলিম পরিবারে বড় হয়েছেন। জবসের বাবার নাম আব্দুল ফাতাহ জন জান্দালি । জান্দালি তথা স্টিভ জবসের সত্যিকারের বাবা ও তার পূর্বপুরুষেরা  সিরিয়ার নাগরিক।মুসলিম বাবার সাথে থাকার সৌভাগ্য হলে হয়তো মুসলিম পরিচয়ে বেড়ে উঠতেন স্টিভ জবস। তার নাম হতে পরতো মুসলিমদের মতোই। হয়তো মাঝে মাঝে রক্ষণশীল মুসলিম দাদীর কোলে খুনসুটি কাটতেন শিশু জবস অথবা সিরিয়ান মুসলিম ব্যবসায়ী দাদার হাত ধরে ঘুরে বেড়াতেন সিরিয়ার পথে প্রান্তরে কিশোর স্টিভ জবস।

বাবা মুসলিম হলেও স্টিভ জবসের আসল মা ছিলেন একজন ক্যাথলিক খ্রিষ্টান। তার নাম জোয়ান শেবল । তিনি আমেরিকান অধিবাসী। রক্ষণশীল ক্যাথলিক পরিবারে বেড়ে উঠা জবসের মার সাথে তার বাবার পরিচয় হয় আমেরিকার উইসকন্সিনে, যখন জবসের বাবা জান্দালি ইউনিভার্সিটি অব উইসকন্সিনে গ্রাজুয়েশনের জন্য আসেন।

সিএনএন এর সাবেক চেয়ারম্যান এবং টাইম ম্যাগাজিনের সাবেক সম্পাদক  ওয়াল্টার আইজ্যাকসনের লেখা স্টিভ জবসের  জীবনীমূলক বই  “স্টিভ জবস” এ  উঠে এসেছে  স্টিভ জবসের  আসল বাবা-মার গল্প । দুই বছর ধরে স্টিভ জবসের চল্লিশটা আর তার পরিবার, সহকর্মী, বন্ধু- শত্রুদের একশতরও বেশি সাক্ষাৎকার নিয়ে একটু একটু করে তৈরি হয়েছে এই বই । ছবির মত ফুটে উঠেছে সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা  স্টিভ জবসের জীবন । বইয়ের প্রথমেই রয়েছে এই কাহিনী ।  নিচে সেই বই থেকে হুবুহু তুলে ধরা হল-

“জোয়ান শেবলের বেড়ে উঠা জার্মানির উইসকন্সিনে । তার বাবা আর্থার শেবলের পারিবারিক অবস্থা বেশ ভালোই । মিঃ শেবলের মিল্ক ফার্ম ছিল তাছাড়াও রিয়েলএস্টেট আর ফটোএনগ্রেভিং  এর ব্যবসাও । ভদ্রলোক বেশ কঠিন । বিশেষ করে মেয়ের সম্পর্কের ব্যাপারে । একবার এক নন ক্যাথলিক আর্টিস্টের সাথে সম্পর্ক করায় জোয়ানকে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল । আর সেখানে জোয়ান যদি এক মুসলিম টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টকে ভালোবাসে তাহলে মিঃ শেবল যে তাকে কেটে পানিতে ফেলে দেয়ার হুমকি দিবেন তাতে অবাক হওয়ার কি আছে?  ছেলেটার নাম আব্দুল ফাতাহ জন জান্দালি ।  ইউনিভার্সিটি অব  উইসকন্সিনের গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট ।

জান্দালি সিরিয়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে । নয় ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট । তার বাবার তেল রিফাইনারীসহ  আরও অনেকগুলো ব্যবসা ছিল  । দামাস্কাস আর হোমসে বেশ ভালো প্রতিপত্তি ওদের পরিবারের । এলাকার গমের দাম জান্দালির বাবার মর্জি মতো বাড়ে কমে । এদিকে তার মা আর পাঁচটা মুসলিম মহিলার মতোই সাধারণ, রক্ষণশীল, শান্তশিষ্ট গৃহিণী । আব্দুল ফাতাহ বইরুতের একটি অ্যামেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্ডারগ্রাজুয়েট ডিগ্রী নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব উইসকন্সিনে গিয়েছিল পলিটিক্যাল সাইন্সে ডিগ্রী নিতে ।

আরও পড়ুন- কেন জাহেল আরব জাতি নেতৃত্ব ও নবুওয়াত পেয়েছিল?

১৯৫৪ সালে জোয়ান আব্দুল ফাতাহর সাথে সিরিয়া আসলো । দুই মাস থাকলো হোমসে জান্দালির বাড়িতে । জান্দালির বাড়িতে জোয়ান বেশ ভালই সিরিয়ান ডিশ রান্না করতে শিখে গেল। তারপর উইসকন্সিনে ফিরে আবিস্কার করল যে সে গর্ভবতী । তখন দুজনেরই বয়স তেইশ বছর । জোয়ানের বাবা বলে রেখেছে, জান্দালিকে বিয়ে করলে সে জোয়ানকে ত্যাজ্য করবে । আবার ক্যাথলিক সোসাইটিতে গর্ভপাতকে খুব একটা ভালো চোখে দেখা হয় না । বাবার কঠিন হুমকির কারণে মুসলিম জান্দালিকে ঐ সময় আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করতে না পেরে শেষে ১৯৫৫ এর শুরুর দিকে জোয়ান পাড়ি জমালো সানফ্রান্সিসকো ।  সেখানে এক ডাক্তারের কাছে আশ্রয় নিলো । এই ডাক্তার অবিবাহিত মায়েদের দেখাশুনা করতো  আর তাদের বাচ্চাদের দত্তকের ব্যবস্থা করে দিত । জোয়ানের শর্ত ছিল একটাই, যারা তার বাচ্চাকে দত্তক নেবে তাদের অন্তত কলেজ গ্র্যাজুয়েট হতে হবে। ডাক্তার সেই মত ব্যবস্থা করল।  এক উকিল আর তার স্ত্রী নেবেন  জোয়ানের বাচ্চাকে । ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি ২৪ তারিখে বাচ্চাটা জন্ম নিল । কিন্তু উকিল আর উকিলের পত্নীর চাই মেয়ে, তারা চুক্তি বাতিল করে বিদায় নিল । অবশেষে জোয়ানের ছেলেটাকে দত্তক নিল হাইস্কুল ড্রপ আউট  এক শখের মেকানিক আর তার বউ । পল জবস আর ক্লারা তাদের সন্তানের নাম রাখল স্টিভেন পল জবস।

সব জানার পর জোয়ান এডোপশন পেপারে সাইনই করতে চাচ্ছিল না । স্তগিতাদেশও এসেছিল । কিন্তু শেষ পর্যন্ত  জবসেরই কাছে থাকল । শেষে জোয়ানের শান্তনা এটুকুই যে পল-ক্লারা বাচ্চাটাকে কলেজ গ্র্যাজুয়েট বানাবে বলে কথা দিল ।

জোয়ানের ইতস্তত করার আর একটা কারণ হল, জোয়ান ঠিক করে রেখেছিল বাবা মারা গেলেই জান্দালিকে বিয়ে করবে । তাহলে হয়তো বাচ্চাটাকে ছাড়তে হবে না । এসব কথা সে পরে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে বলেছিল ।

অর্থার শেবল মারা গেল ১৯৫৫ সালের আগস্টে । ততদিনে এডোপশনের সব কাজ শেষ । সে বছরই ক্রিসমাসে জোয়ান ও আব্দুল ফাতাহ জান্দালি বিয়ে করে । তারপর তাদের আরেকটা বাচ্চা হয় । মেয়ে  বাচ্চা, তার নাম মোনা । পরে ১৯৬২ তে জোয়ান ও জান্দালির ডিভোর্স হয় । মোনা বড় হয়ে হল বিখ্যাত লেখিকা মোনা সিম্পসন । তার বিখ্যাত বই  “এনিহোয়ার বাট হেয়ার” (Anywhere But Here) । প্রায় ২০ বছর পর তাদের দুই ভাই বোনের দেখা হয় ।

আরও পড়ুন-নাসার রকেট কর্মসূচীর ঘাঁটিতে টিপু সুলতানের বাহিনীর ছবি

স্টিভ জবস অনেক ছোটবেলা থেকেই জানতো যে ও এডোপ্টে চাইল্ড । স্টিভ, ‘ মা-বাবা আমার সাথে এ ব্যাপারে বেশ খোলামেলা ছিল ।’ ছোটবেলার একটা স্মৃতি সব সময় ওর কাছে স্পষ্ট ছিল । ঘটনাটা ঘটে বাড়ির লনে । তখন ওর বয়স ছয়-সাত, পাশের বাড়ির একটা মেয়ে বলল, ‘তার মানে তোমার বাবা-মা তোমাকে চায়ই নি ?’ আমার মাথায় যেন বাজ পড়লো, স্টিভের নিজের ভাষায়, ‘আমার মনে আছে, আমি কাঁদতে কাঁদতে ভিতরে গেলাম । আমার মা- বাবা বলল, না তোমাকে বুঝতে হবে।’ সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ওরা বলল, ‘ কে কি বলে বলুক, আমরা তোমাকে চাই । সেই জন্যই আমরা তোমাকে বেছে নিয়েছি । আমরাই তোমার বাবা-মা । আমার স্পষ্ট মনে আছে, মা-বাবা দুজনই একসাথে ধীরে ধীরে জোর দিয়ে উচ্চারণ করেছিল প্রত্যেকটা শব্দ ।’

বর্জিত (Abandoned), অর্জিত (Chosen), স্পেশাল (Special) । এই তিনটা শব্দ জবসের অংশ হয়ে গিয়েছিল । এই শব্দগুলো দিয়েই ও নিজেকে ব্যাখ্যা করতো । ওর খুব কাছের বন্ধুদের ধারণা, ওর জন্মের সময় ওর মা-বাবার ওকে ছেড়ে যাওয়াটা ওর মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছিল । দীর্ঘ সময়ের কলিগ ডেল ইয়োকাম বলেছে, ‘ আমার মনে হয় আশেপাশের সব কিছুকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের যে ইচ্ছাটা ওর ভেতর ছিল, সেটা ওর ব্যক্তিত্ব থেকে এসেছে । আর এর উৎস ওর জন্মের সময় ওর মা-বাবার ওকে ছেড়ে যাওয়াটা।’ গ্রেগ ক্যালহন স্টিভের আরেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু । কলেজ শেষ করার পর ওর খুব কাছাকছি ছিল । সে বলেছে, আসল মা-বাবা দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য স্টিভের ভেতর যে কষ্টগুলো ছিল, সেগুলো নিয়ে অনেক কিছুই বলত ও । সব শুনে আমার মনে হয়েছে, ব্যাপারটা তাকে আরেকটু স্বাধীন হতে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু ওকে অনেক দিক থেকেই ভিন্নপথে চলতে বা ভিন্নভাবে ভাবতে বাধ্য করেছিল ।’

পরবর্তীতে স্টিভও নিজের বাচ্চাকে ঠিক ওর বাবার মতই ত্যাগ করেছিল । অবশ্য পরবর্তীতে বাচ্চাটার দায়িত্ব নেয় ।  বাচ্চাটার মা ক্রিসান ব্রেনানেও একই সূরে কথা বলেছে । ক্রিসানের কাছেও মনে হয়েছে জবসের জীবনের এই দুর্ঘটনা থেকে ওর ব্যক্তিত্বের অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করা যায় । এন্ডি হার্জফেল্ড নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে স্টিভের সাথে কাজ করতো আর সেই অল্প কয়েকজনের একজন যারা জবস-ব্রেনান দুইজনের কাছের মানুষ ছিল । তার মতে, ‘স্টিভ কেন কারও কারও প্রতি বেশ  নিষ্ঠুর আচরণ করেছে, এ প্রশ্নের উত্তরও পাওয়া যায় মা-বাবার কাছ থেকে ওর পরিত্যক্ত হওয়ার ঘটনার ভেতর ’ । ”

পরিশেষে বলা যায় যে জবসের রক্ষণশীল ক্যাথলিক নানার জিদের জন্য মূলত মুসলিম বাবার ঘরে বেড়ে উঠার সৌভাগ্য হয়নি  স্টিভ জবসের। জবসের মা জোয়ান প্রথমে জবসের মুসলিম বাবা জান্দালিকে বিয়ে করতে না পারলেও জবসের নানার মৃত্যুর পর তার মুসলিম বাবাকে বিয়ে করেন এবং তার সাথে প্রায় সাত বছরের দাম্পত্য জীবন  অতিবাহিত করেন। সেখানে তার মোনা নামের এক বোন বেড়ে উঠলেও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কারণে জবস বেড়ে উঠেন খ্রিস্টান পালক বাবা-মা পল ও ক্লারার ঘরে। জোয়ান ও জান্দালির মাঝে যদি জবসের নানা তার খ্রিস্টানীয় রক্ষণশীল মনোভাব নিয়ে না দাড়াতেন তাহলে বিশ্বে মানুষ স্টিভ জবসকে হয়তো মুসলিম প্রযুক্তিবিদ হিসাবে চিনতো!

রেফারেন্স:

বই: স্টিভ জবস

লেখক: ওয়াল্টার আইজ্যাকসন

লেখকঃ  শারমিন আকাতর, সম্পাদক, মহীয়সী 

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন । আসুন সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে মহীয়সীর সম্পাদক শারমিন আকতার

আরও পড়ুন