Ads

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন ও বাইডেনের ইসরাইল প্রীতি

এম আর রাসেল 

৩৬৫ বর্গ কি.মি আয়তনের ভূ-খণ্ড গাজা ইসরাইল, মিশর ও পূর্ব ভূমধ্যসাগর দ্বারা বেষ্টিত। এই ভূ-খণ্ডে প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাস করে। কয়েক যুগ ধরে তারা ইসরাইল কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজা ভূখণ্ড সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আরব ইসরাইল ৪টি যুদ্ধ শেষে প্যালেস্টাইনের মোট ভূখণ্ডের অধিকাংশই দখলে নিয়ে নেয়। পশ্চিম উপত্যকা ও গাজা উপত্যকা এই দুই স্থান নিয়েই প্যালেস্টাইন প্রশাসন পরিচালিত হচ্ছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান অধিভুক্ত অঞ্চলগুলোর শাসনভার ব্রিটিশদের হাতে ন্যস্ত হয়। প্যালেস্টাইন অঞ্চল ব্রিটিশদের অধীনে শাসিত হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ প্যালেস্টাইন ভুখণ্ড দুই ভাগ করে দুটি রাষ্ট্র তৈরির সুপারিশ করে। এই লক্ষ্যে ১৮১ নম্বর প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে ৪৫ শতাংশ ভূমি ফিলিস্তিনিদের এবং বাকি ৫৫ শতাংশ ভূমি ইহুদীদের হাতে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সংগত কারণেই ফিলিস্তিনিরা সিদ্ধান্ত প্রত্যাখান করে।

ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শেষ হয়ে গেলে ইসরাইল স্বাধীনতা ঘোষণা করে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে। এই দিনটি ফিলিস্তিনিরা নাকাবা ডে হিসেবে পালন করে। আর ইহুদীরা এই দিনকে জেরুজালেম ডে হিসেবে পালন করে থাকে। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিনই আরব রাষ্টগুলো ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যুদ্ধ ঘোষণা করে। বলা যায় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এক প্রকার ইসরাইল রাষ্ট্রের বৈধতা দেয়া হয়। আরব রাষ্ট্রগুলোর ঐক্যহীনতা যুদ্ধে ইসরাইলের জয় নিশ্চিত করে।

ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বিন গুরিয়ন ১৯৪৮ সালে বলেছিলেন, ‘এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এ রাষ্ট্র কখনো তার আয়তন ও সীমান্ত নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে না। নীল নদ থেকে ফোরাত উপকূল পর্যন্ত ইসরাইলের সীমানা বিস্তৃত হবে।’

গুরিয়নের স্বপ্ন এখনও হারিয়ে যায়নি। গ্রেটার ইসরাইল গড়তে ইনন পরিকল্পনা বাক্সবন্দীও হয়নি। ইসরাইল প্যালেস্টাইন ভূখণ্ড পুরো দখল না করে ক্ষান্ত হবে না। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ইসরাইল ৭৭ শতাংশ ভূমি দখল করে নেয়। বাকি ২৩ শতাংশ ভূমি মিশর ও জর্ডান ভাগাভাগি করে নেয়। গাজা উপত্যকা মিশরের অধীনে, পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীর জর্ডানের দখলে চলে যায়।  ১৯৫৬ সালের যুদ্ধে গাজা ইসরাইল দখল করে নেয়। আন্তর্জাতিক চাপে ১৯৫৭ সালে মিশরের কাছে ফিরিয়ে দেয়। ১৯৬৭ সালে ছয়দিনের যুদ্ধে আবার এই ভূখণ্ড পুনরায় ইসরাইলের কবজায় চলে যায়।

দীর্ঘদিন গাজা ইসরাইল দখল করে রাখে। ১৯৮৭ সালের প্রথম ইন্তিফাদা ও ২০০০ সালের ২য় ইন্তিফাদা উভয়ই এই গাজা উপত্যকা থেকেই জন্ম নিয়েছিল। প্রথম ইন্তিফাদার বছরেই হামাসের জন্ম হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে রাজধানী ঘোষণা করলে হামাসের নেতা ইসমাইল হানিয়া তৃতীয় ইন্তিফাদার ডাক দেন। সে সময় ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদ খুব একটা জোরালো ছিল না। সাম্প্রতিক সংঘাত পুনরায় তৃতীয় ইন্তিফাদাকে পুনরূজ্জীবিত করে তুলছে৷ অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ‘এবার তৃতীয় ইন্তিফাদা গতি পেতে পারে।’

১৯৯৩ সালের অসলো শান্তি চুক্তি গাজায় প্রত্যাখাত হয়। ইয়াসির আরাফাতের সাথে হামাসের বৈরিতা বৃদ্ধি পায়। নানা ঘটনার পথ মাড়িয়ে ২০০৩ সালে এরিয়েল শ্যারন গাজা থেকে ইসরাইলি সৈন্য ও ইহুহীদের সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন। ২০০৫ সালে এক চুক্তি অনুযায়ী গাজা থেকে ৫০ হাজার ইহুদী ও ৮৫০০ ইসরাইলি সেনা সরিয়ে নেয়া হয়। তখন থেকে গাজায় কর্তৃত্ব ধরে রেখেছে হামাস। বলা যায় হামাস ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর থেকেই ইসরাইল ও মিশর গাজায় অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। মাঝে মাঝে মিশর অবরোধ শিথিল করলেও ইসরাইল কখনই মমতা দেখায়নি।

চতুর্দিক থেকে অবরুদ্ধ এই জনপদের মানুষ কতটা অসহায় অবস্থায় রয়েছে তা অনুভব করা যায়। ভূখণ্ডটির প্রায় পঞ্চাশ ভাগ মানুষ চরম দারিদ্র‍্যের মাঝে রয়েছে, ৭০ শতাংশ তরুণ বেকার। ক্ষণে ক্ষণে ইসরাইলি বোমা হামলায় এই ভূখণ্ড কেপে উঠে। সম্প্রতি সপ্তাহব্যাপী চলমান ইসরাইলি বোমা হামলায় এখন পর্যন্ত দুইশতাধিকের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। প্রতি ছয় মিনিটে একজন করে শিশু নিহত হচ্ছে। জাতিংঘের মহাসচিব বলছেন, ‘বর্তমান সংঘাত নিয়ন্ত্রণহীন সংকটের জন্ম দিতে পারে।’

ইসরাইলের হামলাকে রুখে দিতে হামাসও পাল্টা হামলা পরিচালনা করে। এর মধ্যে রকেট নিক্ষেপ উল্লেখযোগ্য। সত্যিটা হল অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত ইসরাইলি বাহিনীকে হামাস খুব একটা কাবু করতে পারে না। ক্ষতির পাল্লা হামাসের দিকে বেশি ঝুঁকে।২০০৮ সাল থেকে বর্তমান সময়ের পূর্ব পর্যন্ত হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে তিনটি বড় ধরণের সংঘর্ষ হয়েছে। ২০০৮-০৯ সালে ইসরাল ‘অপারেশন কাস্ট লিড’ পরিচালনা করে। ২২ দিনের এই অভিযানে প্রায় ১৩০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়।

২০১২ সালে ইসরাইল ‘অপারেশ পিলার অফ ডিফেন্স’ পরিচালনা করে। এতে প্রায় ১৬৭ জন ফিলিস্তিনি ও ৬ জন ইসরাইলি নিহত হয়। এই অপারেশন চলাকালীন শিনবেতের হামলায় নিহত হন হামাসের শীর্ষস্থানীয় নেতা আহমেদ আল জাবারি নিহত হয়। ২০১৪ সালে ৫০ দিন ব্যাপী চলমান যুদ্ধে ইসরাইল ‘অপারেশন প্রটেকটিভ এজ’ পরিচালনা করে। এতে ২২০০ ফিলিস্তিনি, ৭২ জন ইসরাইলি নিহত হয়। গেল বছরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এই যুদ্ধে ইসরাইলের যুদ্ধ অপরাধ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।

সাম্প্রতিক রকেট হামলায় পশ্চিমা বিশ্ব ইসরাইলের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। এমনটাই হবার কথা। এর বিপরীত কিছু ঘটলেই বরং অপ্রত্যাশিত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র বলছে ‘ইসরাইলের আত্নরক্ষার অধিকার রয়েছে৷’ একবারও বলছে না যে গাজার অধিবাসীদেরও  আত্নরক্ষার অধিকার আছে৷ কয়েক যুগ ধরে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের উপর অত্যাচার করেই চলেছে। এরপরও পশ্চিমারা সর্বদা ইসরাইলের পক্ষেই সাফাই গাইতে থাকেন।

নেতানিয়াহু টুইটারে ২৫ টি রাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করে ইসরাইলকে সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ইসরাইলের সবচেয়ে বড় আশ্রয়দাতা হল যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার ফেরি করলেও কার্যত ইসরাইলের সকল অপকর্মে প্রত্যক্ষ মদদ দিয়ে থাকে। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্টার গোড়া সমর্থক ছিলেন সাবেক হ্যারি এস ট্রুম্যান। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ইসরাইলকে গুরুত্ব দিয়েই রচিত হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ইসরাইলি লবির শক্তিমত্তা সম্পর্কে অনেক তথ্যই পাওয়া যায়।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিলিস্তিনিদের সহায়তা বন্ধ করলেও ইসরাইলকে দেয়া সহায়তা বন্ধ করেননি। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে ৩ বিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা দেয় যার সিংহভাগ ব্যয় হয় সামরিক খাতে। আলোচিত ‘আয়রন ডোম’ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেশ দুটি মিলেমিশেই তৈরি করেছে। বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর অনেকের প্রত্যাশা ছিল ফিলিস্তিনিরা কিছুটা সুনজর পাবেন। ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’-র বদলে নতুন কোন পদক্ষেপ দেখা যাবে৷ এই আশায় গুড়েবালি। পিছনের ইতিহাস বলে ইসরাইল ইস্যুতে বাইডেন সর্বদা সরব ছিলেন। তিনি ইসরাইলের একজন কট্টর সমর্থক হিসেবেই পরিচিত।

বাইডেন সিনেটর নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম ইসরাইল সফরে গোল্ডা মেয়ারের সাথে দেখা করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ইসরাইল রাষ্ট্র না থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় ইসরাইল তৈরি করতে হতো।’ ১৯৮২ সালে কয়েকজন সিনেটর মিলে বাইডেন মোনাচেম বেগিনের সাথে গোপন বৈঠক করেন। বেগিনের মতো একজন যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে তিনি সাফাই গেয়েছেন। মনে করিয়ে দেই, ১৯৮২ সালে লেবাননে চলমান ইসরাইলি আগ্রাসন চলছিল। এটাকে সমর্থন করে তিনি বলেছিলেন, ‘ইসরাইলের জায়গায় তিনি থাকলে একই কাজ করতেন।’

২০০১ সালে ইসরাইলের গুপ্তহত্যার জন্য বুশ প্রশাসন মৃদু সমালোচনা করলে বাইডেন এর কঠোর বিরোধিতা করেন। তিনি বলেছিলেন ‘ইসরাইলের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্যের বিষয়গুলো এভাবে প্রকাশ্যে আনা উচিত নয়।’ ২০০৬ সালে ইসরাইল লেবানন ও গাজায় বোমা হামলা চালায়। এই ঘটনাকে সমর্থন করে তিনি বলেছিলেন, ‘ইসরাইল সঠিক কাজই করছে।’ এই কাজকে যুক্তরাষ্ট্রের আফগান দখল অভিযানের সাথে তুলনা করেছিলেন।  ইসরাইলের রাজধানী জেরুজালেমে সরিয়ে নেয়ার পক্ষেও প্রচার চালিয়েছেন বাইডেন। যা ট্রাম্প আমলে বাস্তবায়ন হয়েছে। বারাক ওবামা আমলে বাইডেন ইসরাইল সফর করেন। তখন নেতানিয়াহু মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইসরাইলি জনগণ বাইডেন পরিবারকে তাদের নিজের পরিবার মনে করে।’

মজার বিষয় হল বাইডেন প্রায় সময় ইসরাইলি দখলদারিত্ব নিয়ে আওয়াজ তুলেছেন। কিন্তু তাঁর কর্মে তা কখনই প্রতিফলিত হয়নি। বাইডেনের কথা ও কাজের বৈপরীত্য যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বৈদেশিক নীতির মাঝেও ফুটে উঠছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আল জাজিরায় ২৯ এপ্রিল প্রকাশিত মারওয়ান বিশরার কলাম ‘Biden’s stratagem is no grand strategy for a superpower’ পড়লে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে।

সাম্প্রতিক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে নতুন করে কোনো সম্ভাবনাকে খুঁজতে যাওয়া বৃথা। গাজায় চলমান হামলার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। কত লোক মারা গেল সেদিকে ইসরাইল দৃষ্টি দিবে না বলে জানিয়েছে। এর শেষ কবে হবে তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে।

মহীয়সীতে আরও পড়তে পারেনঃ

ইসরাইল-ফিলিস্তিন বর্তমান সংকট ঘিরে রাজনীতির খেলা

বেয়াড়া সন্তানকে কেউ শাসন করে না

ইরান-ইসরাইল সংঘাতঃ মধপ্রাচ্যের প্রধান ইস্যু হবে

আরও পড়ুন