Ads

উত্তরাধিকার

ফাহমিদা খানম

মায়ের সাথে এতোক্ষন ফোন এ কথা হলেও মাকে সত্যি কথা বলার সাহস আমার আর হয়নি। শুনলে মা হয়তো আমাকে কেটেই ফেলবে। আগের দুই বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে মরতে মরতে ফিরেছি আমি। আমার চাওয়া না চাওয়ার কথা কেউ জিজ্ঞেস করার দরকার মনে করেনি। আমার শ্বশুরবাড়ির শুধু উত্তরাধিকার চাই।
আমি মনি, চারভাইবোনের মাঝে সবার বড়, আমার পর দুই বোন সবার ছোট ভাই। অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দেবার পর ভালো পাত্র পেয়ে বাবা আর হাতছাড়া করেননি, পরের দুই বোন ও তরতর করে বেড়ে উঠছে! বিয়ের পর আমার স্বামী বললো অনার্সে লম্বা সময় লাগে, তুমি বরং ডিগ্রি পরীক্ষা দাও, আমিও মেনেই নিলাম। সুদর্শন রাজপুত্র স্বামীর সবকথাকেই আমি মেনে নিতাম। প্রায় মনে হতো পড়ালিখা করার দরকারইবা কি? না চাইতেই আমি সব পেয়েছি। কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করা এসি আই গ্রুপ এ চাকুরী করা এমন পাত্র যে আমার ভাগ্যে ছিল –মাঝেমধ্যে তাই বিশ্বাস হতে চাইতো না অন্যরা আমাকে হিংসা করবে কি? আহাদ আমার স্বামী আমাকে বলেছে আমাকে চাকুরী করতেই দিবে না। চাকুরী করতে নাকি অনেক কস্ট! আমি সংসার দেখবো আর ও চাকুরী। কি যে ভালো লেগেছে শুনে আমার!
বিয়ের কয়েকমাস খুব আনন্দে কেটে গেলো, শুধু দাওয়াত খেয়ে বেড়ানো আর সাজুগুজু করে বেড়ানো আমি খুব এঞ্জয় করতাম। শ্বাশুড়ীমা একটু রাগী হলেও মানুষ কিন্তু খারাপ না। দুই ননদের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে, ছোট দেবর প্রেম করে আগেই বিয়ের কাজ সেরে ফেলেছিল, অবশ্য বিয়ের আগে এটা আমদের জানায়নি। আজকাল প্রেম করে পালিয়ে এতো বিয়ে হচ্ছে যে, এটা কোন ব্যাপারই মনে হয়নি আমার কাছে। আমার বিয়ের ৫ মাসের মাথায় আইভি —দেবরের বউ কন্সিভ করে ফেললো, এই খবর শুনামাত্র আহাদ পিছিয়ে থাকতেই চাইলো না।
“”ওদের বিয়ে হয়েছে দুই বছরের বেশী, আমারতো মাত্র ৫ মাস “”
“মনি আমি সব ব্যাপারেই কি পিছিয়েই থাকবো? আমার মান সম্মানের ব্যাপার এটা “”
আমার চাওয়া না চাওয়া ব্যাপার নয়, মা আমাকে হতেই হবে কিন্তু চাইলেই কি আর সব সাথে সাথেই পাওয়া যায়? এটাতো মানুষের হাতে নয়। প্রতিমাসে আহাদ অপেক্ষায় থাকতো আর বিফল হয়ে আমাকেই দোষারোপ করতো, ও ভাবতো আমি গোপনে পিল খাচ্ছি। তন্নতন্ন করে সব খুঁজতো। চার মাস দীর্ঘ সময় না হলেও আহাদের জন্য দীর্ঘকাল ছিলো। যাই হোক ৪ মাস পর আমার কন্সিভের খবরে বাসায় আনন্দের বহর বয়ে গেলো, সবচেয়ে খুশী হলেন শ্বাশুড়িমা। আহাদ উনার প্রথম সন্তান। খুশী হয়েই বললেন
“”এবার বংশে উত্তরাধিকার আসবে ”
আমি বুঝেই পেলামনা উনি কিভাবে জানেন পেটেরটা ছেলে না মেয়ে!!
পেটে সন্তান আসার পর আমার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেলো, কিছুই খেতে পারি না, সারাক্ষণ বমি হয়, বিছানা থেকে মাথাই তুলতে পারি না। বাবামা ডাক্তারের পরামর্শে ক্লিনিকে ভর্তি করালেন। এক সপ্তাহ দুনিয়ার টেস্ট আর স্যালাইন চললো,তারপর রেস্টে থাকার অনুমতির বিনিময়ে বাসায় ফিরলাম। আমার বাবামা অনেক চেয়েছিল ওরা দেয়নি। বাসায় ফিরে সবার মুখ দেখে ভয় পেলাম। ছোট জা এক ফাঁকে জানালো
“”শ্বাশুড়ি মা বলেছে দুনিয়ায় আর মেয়েরা মা হয়না! যত্তসব আদিখ্যেতা! আমার দুই মেয়ে মা যেন হয়নি!! ”
কথাটা কিন্তু তিক্ত হলেও সত্যি ছিল। আমার জা “রিতুর সব স্বাভাবিক ছিল, খাওয়া, চলাফেরা সব। আমি ভেবেই পেলাম না আমার সমস্যাটা কোথায়! আহাদের কথায় ক্ষোভের উত্তাপ পেতাম। ওর গায়ের গন্ধেও আমার বমিভাব হতো। কিন্তু কেউ বুঝতেই চাইতো না সবার শরীরের ধরণ এক নয়। সবাই ভাবতো আমি ইচ্ছে করেই এমনসব করছি। খুব অসহায় মনে হতো নিজেকে।
৩ মাস পার হবার পর নতুন সমস্যা দেখা দিলো , অল্প অল্প করে ব্লাড যাওয়া শুরু হলো, ডাক্তারকে জানানোর পর বেড রেস্টে দিয়ে দিলেন। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! রিতুর সময় ঘনিয়ে এসেছিল, আমি বিছানায়, শ্বাশুড়ী মাকে সবকিছু করতে হতো। আহাদ আর মায়ের ক্ষোভতা টের পেতাম কথায়। কয়েকদিন পরেই স্বাভাবিকভাবে ছোট জায়ের এক মেয়ে হলো, বাচ্চা নিয়ে বাসায় ফেরার পরে উৎসবমুখর পরিবেশ হলেও আমি মনি দেখতে যেতেও উঠতে পারিনি। একটু পর রিতুই মেয়ে নিয়ে রুমে এলো। মাশাল্লাহ কি যে সুন্দর হয়েছে বাবুটা! পেটে হাত দিয়ে আল্লাহতালার কাছে একটা সুস্থ্য, সবল বাচ্চাই চাইলাম আমি।
আটমাসের সময় ডাক্তার আল্ট্রাসনোগ্রাম করে জানালেন জটিলতা আছে, আগাম সিজারিয়ান করতে হবে। আমার স্বামী বারবার নরমাল ডেলিভারির উপরে জোর দিতে লাগলেন। ডাক্তার বললেন প্লাসেন্টা নিচে, রোগির জীবন বিপন্ন হতে পারে। আমার স্বামী চেম্বার থেকে বের হয়েই বললেন “”সব টাকা কামানোর ধান্দাবাজি “”
আমি সেদিন প্রথম আবিস্কার করলাম দেখতে সুন্দর হলেই মানুষ কিন্তু সুন্দর  হয় না।
নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই আমাকে অপারেশন টেবিলে ছুরি, কাঁচির নীচে বসতে হলো। অর্ধেক অবশ ছিলো, ডাক্তার বললেন “”অভিনন্দন, আপনার মেয়ে হয়েছে “”
“”শোকর আলহামদুলিল্লাহ “”
বেডে দেবার পর দেখি দুই পরিবারের সবাই সেখানে। শ্বাশুড়ি মায়ের মুখ ছিল থমথমে, খুশী যে হননি বোঝাই যাচ্ছে, কিন্তু এখানে আমার কি দোষ!! একটা সুস্থ্য, সবল বাচ্চা হওয়াই কি সকলের একান্ত কাম্য হওয়া উচিত নয়?
পেটে বাচ্চা থাকার সময় শ্বাশুড়ীমা আমার মাকে জানিয়েছিলেন প্রথম সন্তানের খরচ নাকি মেয়ের মাবাবা দেয়, উনিও দুই মেয়েকে দিয়েছেন । মাবাবা উনার আবদার মেটানোর পরেও উনি প্রায় আমার বাবুটাকে কথায় কথায় লাখ টাকার বেটি বলতেন। চোখ ফেটে কান্না চলে আসতো আমার, এতটুকুন বাচ্চা কি দোষ করেছে? আসলে বাচ্চাকে বলে আমাকে শোনানো হতো এসব কথা। রিতুকে হিংসা লাগতো আমার। তবে ওকেও ছাড় দিতেন না মা। পাক পবিত্রতার দোহাই দিয়ে দুই নাতনীকে কোলেই কম নিতেন। আমি চুপ করে থাকলেও কোন এক বিষয় নিয়ে একদিন মায়ের সাথে তুমুল ঝগড়া হলো, রিতু মেয়ে কোলে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যাবার সময় আমাকে বললো “”আমি আর এই বাসায় ফিরছি না ভাবি “”
খুব খারাপ লাগছিল আমার, একমাত্র এই বাসায় ওর সাথেই আমার মনের কথা হতো।
মেয়েটার বয়স যখন তের মাস হঠাৎ আমি আবারো খুব সিক হয়ে গেলাম। শ্বাশুড়িমা বললেন, জন্ডিস হইছে। সবকিছুতেই আমি গন্ধ পাই আর সারাদিন মাথা ঘোরায়, বাধ্য হয়ে ডাক্তারের কাছে নেবার পর আল্ট্রাসনোগ্রাফী করে জানা গেলো আমি আবারো মা হতে যাচ্ছি। মাথায় বাজ পড়লো আমার, মেয়েটা যে এখনো অনেক ছোট!
আমার মা জানার পর ছুটে বাসায় চলে এলেন।
“”মনি তুই মরে যাবি, বরং বাচ্চা নস্ট করে ফেল “”
“”বেয়াইন এতো বড় পাপ আমি থাকতেও করতে দিবো না “”
পাঁচ মাসের সময় শ্বাশুড়ি মা আমাদের সাথে ডাক্তারের কাছে গেলেন, পেটের বাচ্চার লিংগ জানতে। সনোগ্রাফীর ডাক্তার কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না, শ্বাশুড়ি মায়ের কাকুতিমিনতিতে ডাক্তার নরম হলেন। হায় আমি এবারো স্বামী, শ্বাশুড়ি কাউকেই খুশী করতে পারলাম না, এবারো মেয়ে।
“”এখন কি বাচ্চা নস্ট করা যায় না? “”
মায়ের মুখের দিকে হতভম্ব হয়ে তাঁকিয়েই রইলাম, দুই মাসের সময় আমার মা এই কথা বলায় উনি পাপের অংশীদার হতে চাননি, আজ কি পাপের ভাগীদার হবেন না উনি?
“”সময় অনেক আগেই পেরিয়েছে, এখন মায়ের জীবন বিপন্ন হবে “”
ডাক্তারের কথায় মা মন:ক্ষুণ্ণ হলেন।
খুব কাছাকাছি সময়ে দুই বাচ্চা পেটে আসায় আমার পেটের ভিতরের সেলাই খুলে গিয়েছিল, তাই আবারো সময়ের আগেই সিজার করা হলো। আমি অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। বেডে দেবার পর দেখি দুই বেয়াইনের মুখ থমথমে, শ্বাশুড়ি মায়ের কারণ বুঝলেও মায়ের কারণ বুঝলাম না। আমার মেয়েটাকে নিয়ে শ্বাশুড়িমা রুমের বের হতেই জিজ্ঞেস করলাম—
“”মা তুমিও কি মেয়ে পছন্দ করো না? “”
“আমি শুধু বলেছিলাম সিজারের সাথে তোর লাইগেশন করাতে, বেয়াইন আর জামাই এতো রাগ হবে বুঝিনি “”
“”শুধুশুধু বলতে গেলে কেনো মা? “”
“”আমি যে তোর মা মনি,তোর কষ্ট আমার সহ্য হয়না “”
“”মা মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফেললে তখন মেয়ে আর নিজের থাকেনা “”
মায়ের চোখ দিয়ে টপটপ পানি দেখেও আমি নির্বিকার রইলাম।
দ্বিতীয় বাচ্চার বয়স তিন পার হবার পর তৃতীয়বারের মতো মা হতে চলেছি আমি। নাহ অসতর্কতায় নয়, স্বামী, শ্বাশুড়ির ইচ্ছার কাছেই নত হতে হয়েছে আমাকে, তাদের উত্তরাধিকার চাই ই চাই। রিতুকে বলার পর ও নাকি শ্বাশুড়ি মায়ের মুখের উপরেই বলেছিলো এক মেয়ের মা হয়েই সে অনেক খুশী আর বাচ্চাকাচ্চা নেবার শখ তার নেই। সবচেয়ে বড় কথা ওরা দুজন কাজিন বলে বাচ্চা নিতে গেলেও সমস্যা আছে। মেয়েটাও পুরোপুরিভাবে সুস্থ্য হয়নি, ছোট বেলায় বোঝা না গেলেও বড় হবার পর সমস্যাদি দেখা দিচ্ছে। তাই কোপের মুখে বলির শিকার আমি মনি।
জানিনা এই সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে? আচ্ছা যদি ছেলে না হয় তাহলে কি আমাকে আবারো মা হতে হবে? আমিতো মা হয়েই খুশী, ছেলের মা হলে কি দাম বেড়ে যাবে আমার? আমি মা হতে চাই কিনা সেটা অন্যরা কেন নির্ধারণ করবে? আমার ইচ্ছে -অনিচ্ছের কোন দাম নেই কেন? মেয়ের মা বলে! যদি আমি মরে যাই, আমার দুই সন্তান কে দেখবে!!!!!!!

যুগ পাল্টালেও কিছু মানুষ নিজেদের বদলাতে পারেনা, নারী হয়েও কিছু সংখ্যক নারী পুরুষতন্ত্রের বাহক আজ অব্ধি। মায়ের কথা মনে হয় আমার——একটা ছেলের জন্য তাকেও চারবার মা হতে হয়েছ। যুগ কি সত্যি ই পাল্টেছে??????????

লেখকঃ

কবি ও সাহিত্যিক

আরও পড়ুন