Ads

নিজেদের ভুলের জন্য কোমলমতি শিশুগুলো কঠিন না হয়ে যায়

সালমা তালুকদার

ডিসকো বয়েজ,নাইন স্টার ক্লাব,নাইন এম এম,সেভেন এম এম,বিগ বস।এসব কিশোর গ্যাং এর নাম।যারা ৪ ফেব্রুয়ারীর প্রথম আলো পত্রিকার আদনান কবীরকে নিয়ে লেখাটা পড়েছেন তারা তো বুঝতেই পারছেন আমি কি বলতে যাচ্ছি।যারা পড়েননি তাদের জন্য আরো কিছু তুলে দিচ্ছি।ফেইসবুকে তারা লিখে”ডিসকো বয়েজ আসছে,উত্তরা কাঁপছে।” “বিগবস-ডিসকো,টুগেদার হিয়ার টু সেভ ইউ ফ্রম বস্তি পিপল।” “ওয়ান্ট গ্যানজাম?ক্লাস এইট,নাইন,ইলেভেনের মাইলস্টোন কলেজের ছাত্ররা রেডী হও।উই আর কামিং টু মেক ইউ বড়।”কেউ আত্মহত্যা করতে চাইলেও ওদের কাছে এর সমাধান আছে।গিয়ে মেরে দিয়ে আসবে।ফেইসবুকের ওয়ালে ছুরি,গ্রেনেড,হাতুরি,স্ক্রু ড্রাইভার ও পিস্তলের ছবি।

গতকাল সারাদিন মাথায় ঘুরছিলো এসব।তাই হয়তো সন্ধ্যায় একটা কান্ড করে বসি আমি।গতকাল বইমেলা থেকে আসার সময় ট্রাস্টের বাস বিজয় স্মরনী সিগন্যালে এসে আটকে গেলো।মিনিমাম আধাঘন্টা বসে থাকবে জানি।এরকম হলে নেমে যাই।গতকালও নেমে গিয়ে হেঁটে আসছিলাম।পুরাণ এয়ারপোর্ট এর ব্রীজটা পার হওয়ার সময় দেখি একটা ছেলে ডিএসএলআর ক্যামেরা দিয়ে শুট করছে আর ডিরেকশান দিচ্ছে।যাকে দিচ্ছে সে ফুট ওভার ব্রীজের উপর রেলিং এ বসে সিগারেট ফুকে আকাশের দিকে তাক করে ধোঁয়া ছাড়ছে।জায়গাটা অন্ধকার ছিলো।তাই আমাকে দেখেনি।কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”কি হচ্ছে এখানে?”প্রথমে কিছু বলতে চাইছিলো না।পরে বললো নতুন ডিএসএলআর ক্যামেরা কিনেছে তাই ঠিক আছে কিনা দেখছে।বললাম,”আমাকে দেখে কি তোমাদের জোকার মনে হচ্ছে?আমি কি জোক করতে আসছি তোমাদের সাথে?”তারপর বাবার নাম ধাম জিজ্ঞেস করলাম।প্রথম ছেলেটি বললো।দ্বিতীয়টি হাত মুখ কাচুমাচু করতে করতে, “সরি সরি আর করবো না।এবারের মতো মাফ করে দেন” এক নাগারে বলেই যাচ্ছে।বললাম, “আমাকে কি দেখতে পুলিশ মনে হচ্ছে?এমন করছো কেন?”তারপর আরো অনেক কথা বললাম।সিগারেট,ইউটিউব,ইন্টারনেট,বাবা মা।বিশাল বয়ান শেষ করে বললাম,”আমি চলে গেলে আমাকে ভুলে যেও।কথাগুলো ভুলো না।আর সন্ধ্যায় বের হয়ো না।রঙিন চশমাটা খুলে বাস্তবটা দেখো।নিজের জীবনটাকে এভাবে ধ্বংস করো না।তোমাদের জায়গায় নিজের ছেলেকে কল্পনা করে এতগুলো কথা বললাম।তারপর ছেলে দুটোকে পেছনে রেখে চলে আসলাম।

খুব মন খারাপ হলো ছেলে দুটোর পরিবারের উপর।রাত বাজে ১০ টা।ছেলে দুটো বাইরে কেন থাকবে!ওরা আদমজী কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র।মনে আছে আমরা ভাই বোনরা কখনোই সন্ধ্যার পর বাসার বাইরে থাকার সাহস পাইনি।যুগ পাল্টেছে বলেই কি সন্তান মানুষ করার ধরণ পাল্টে যাবে!এটা কেমন কথা? ইন্টারনেট,স্মার্ট ফোন,ডিএসএলআর এর সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে সন্তানকে এভাবে ছেড়ে দিব? প্রথম আলোর খবরটা উত্তরার।কিন্তু আমি জানি আমার সন্তান যে স্কুলে পড়ে সেখানেও গ্যাং আছে। ক্লাশ সিক্স থেকেই ছেলে মেয়ে স্মার্ট ফোন ব্যাবহার করে।কখনো স্কুলে গেলে এরকম কিছু দেখলে নাম জিজ্ঞেস করে ধরিয়ে দিন স্টাইলে ধরিয়েও দিয়েছি অনেক বার।ছেলের কাছ থেকে শুনি ভালো রেজাল্ট করলে নাকি বাবা মা স্মার্ট ফোন দিতে বাধ্য!কেন? এর উত্তর কারো জানা আছে? ভালো রেজাল্ট করে কে কয়টা ভালো চাকরী পেয়েছে বলতে পারবে কেউ? আমি তো দেখি চাকরীতে লবিং থাকলেই হয়।আর নীলক্ষেত থেকে সার্টিফিকেট বানিয়ে আনলেই হয়।ভুল বললাম?

দায় কার প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন,এ পরিস্থিতির দায় প্রথমে পরিবারের, দ্বিতীয়ত শিক্ষা ব্যবস্থার।পরিবারের অশান্তিও অনেকাংশে দায়ী ।তার মানে আমরা সবাই সবকিছু জানি।তবু দেখবো না বলে পন করেছি।কারণ পরিবারের বাবা থাকেন সারাদিন টাকা রোজগারে ব্যাস্ত।মা থাকেন টিভি সিরিয়াল,মোবাইল চ্যাটিং, অনলাইন শপিং আর সন্তান নিজের মতো করে বড় হয়। এখন তো অবস্থা আরো খারাপ। বাবা,মা এর সম্পর্ক খারাপ।কারণ তারা কলিগ,পাশের বাসার ভাবী,ফেইসবুকে ইনবক্সে তৈরী হওয়া সম্পর্কে এত ব্যাস্ত যে সময় কই সন্তান লালন পালন করার? আমি পুরুষদের কিছু বলবো না।কারণ সন্তানের মর্ম তাদের চাইতে মায়েরাই বেশি বুঝবে।কারণ এই ছোট্ট নিষ্পাপ শিশুটা মায়ের পেট থেকেই বের হয়েছে। প্রচন্ড কষ্ট সহ্য করে একজন মা তার সন্তানকে পৃথিবীতে আনেন। সুতরাং দায়টা তারই বেশি। এখন আসলে প্রতিযোগীতা চলছে।যখনই একজন পুরুষ অন্য কোনো নারীতে আশক্ত হচ্ছে তখন নারীটি বলছে, “দায় কি আমার একার? সন্তান তো তারও।” অনেক সময় সন্তান ফেলে রেখে চলে যায়। আর যারা থাকে তারাও নিজের কষ্ট লাঘব করতে অন্য পুরুষের শরনাপন্ন হন।আর যারা নিতান্তই সহজ সরল নারী বা পুরুষ তারা নিজেদের মানসিক কষ্টের জন্য ঠিক মতো সন্তানের দিকে তাকাতে পারেন না।কিন্তু এতে করে কি সন্তানের বেড়ে উঠা থেমে থাকে? তা কিন্তু থাকে না। ওরা প্রতিদিন শরীরে, মনে বড় হতে থাকে।বাবা,মা এর আচরণ,পরিবেশ,পরিস্থিতি ওদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। একটা সময় পরে আর তারা কন্ট্রোলের মধ্যে থাকে না। বকা বা মাইরে তাদের কোনো কাজ হয় না।ফলে যা হওয়ার তাই হয়।এখানে বাবা মা এর সংযত আচরণ যে কত প্রয়োজন!

আমিও একজন মা। আমার ঘরেও টেলিভিশন,কম্পিউটার,ক্যামেরা,ডিএসএলআর,টেব,স্মার্ট ফোন সব আছে।আমি চেষ্টা করি আমার সন্তান যেন আমার অনুমতি ছাড়া এসবের কোনো কিছুতে হাত না দেয়।তাই বলে আমি বলছি না আমি অনেক কিছু জানি।আমি কিছুই জানি না।তবে আমি ছোট বেলায় যেভাবে মানুষ হয়েছি । যে নিয়মে বেড়ে উঠেছি; সেভাবেই আমার সন্তানকে বড় করার চেষ্টা করছি মাত্র।ওরা জানিয়ে দিয়েছি ইন্টারমিডিয়েট পাস করার আগে ওরা কেউ স্মার্ট ফোন হাতে পাবে না।এবং এটা ওরা সবার কাছে বড় মুখ করে বলে বেড়ায়।কারণ আমি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি ওদের জন্য কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ।জানি না কতটুকু কি হবে।তবে সন্তানের মা হিসেবে এই যুগে এটা আমার যুদ্ধ। তাই মানসিক অশান্তিতে থাকা অথবা ব্যাস্ত বাবা,মায়েদের বলবো,দয়া করে নিজের নিজের সন্তানের হাতটি শক্ত করে ধরুন।বাবা যদি ব্যাস্ত হন অথবা দায়িত্বজ্ঞানহীন হন তাহলে মায়েরা সন্তানের দিকে নজর দিন।একই কথা বাবাদের জন্যেও। এই ছোট্ট জীবনে দেখতে দেখতে সময় শেষ হয়ে যাবে।আজকে ব্যাস্ততার জন্য বা নিজের মনের অশাম্তির জন্য সন্তান গুলোর দিকে তাকাচ্ছি না।কিন্তু কিছুদিন পর যখন সন্তানের অধঃপতন দেখবো সইতে পারবো তো? কিংবা আদনান কবিরের মতো নিজের সন্তান যখন লাশ হয়ে ঘরে ফিরবে তখন এই শোক কতটা নিতে পারবো? তার চেয়ে সন্তান জন্ম দেয়ার আগেই ভেবে দেখি সন্তানকে সময় দিতে পারবো কিনা?

লেখকঃ
প্রাক্তন প্রভাষক
বাংলা বিভাগ
নর্থ ওয়েস্টার্ন কলেজ

 

আরও পড়ুন