Ads

ঐতিহাসিক উপন্যাসঃ ইয়ুকি একটি মেয়ের নাম (পর্ব-০৬)

আরশাদ উল্লাহ
ঘরে ফিরে এসে ইয়ুকি দেখতে পেল ফুরুকাওয়ার স্ত্রী তমকো একটি বই পড়ছেন। তার পিছনে গিয়ে সে দাঁড়াল – কিন্তু মহিলা পিছনে ফিরে তাকালেন না। ইয়ুকি খালা বলে ডাক দেওয়ার পরে পিছনে ফিরলেন। রুমাল দিয়ে তিনি চোখের জল মুছলেন। মহিলা কেন কাঁদছেন জানার আগ্রহ হল ইয়ুকির।
বলল, “আপনি কাঁদছেন কেন খালা?”
মহিলা রুমাল দিয়ে চোখের জল আবার মুছে বললেন, “তোমার জীবনের দুঃখের কাহিনী শুনেছি। এখানে এসেছ অনেক বছর হল। যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখিনি। তোমার দুর্ভাগ্যের কথাও ভাবি। ভাল করেছ তুমি আমাদের বাড়িতে এসে। আমি জানি অন্তরে তুমি সুখী নও। আর, কেমনে সুখী হবে? পিতামাতা নেই। ওকিনাওয়াতে তোমার জন্ম। কিন্তু সেখানে যে তোমার কেউ বেঁচে নেই আমি ধারণা করতে পারি। তবুও তুমি ফুলের মত সুন্দর হয়ে বড় হচ্ছ। হয়তো মনে তোমার অনেক স্বপ্ন আছে!” এতটুকু বলে মহিলা থামলেন। তারপর হাতের বইটি দেখিয়ে বললেন, “টোকিও ট্রায়ালের উপর লেখা বই। অর্ধেক পড়েছি। আজ আর চোখের পানি সামলে রাখতে পারলাম না। যাক সে কথা, রান্না করে রেখেছি। তুমি খেয়ে আস!”
ইয়ুকি এই মহাযুদ্ধের ইতিবৃত্ত কিছুই জানে না। কেন এই মহাযুদ্ধ, কেন জাপানের পরাজয় এবং কেন লক্ষ লক্ষ জাপানি ইমপেরিয়াল সেনাবাহিনীর সৈন্য নিহত হল এ ধারণা তার নেই। সে শুধু জানে যে তার বাবা ওকিনাওয়া যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে প্রাণে রক্ষা পেতে তাকে এবং তার মাকে কিওশিওর গ্রামটিতে রেখে গিয়েছিলেন। তার পরিণতি কি হয়েছে তা জানে। আরেকটি চরম সত্য সে জেনেছে। তা হল, যাদের মৃত্যু হয় তারা আর ফিরে আসে না।
প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপটির নাম পৃথিবীর প্রায় সবাই জানে। কিংবদন্তীর এই দ্বীপটি একসময় একটি স্বাধীন দেশ ছিল। পরে আমেরিকা ছলচাতুরি করে রাজ্যটির হাওয়াইয়ের রাজা লিমুয়ালানি কালাকাওয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করে। রাজা কালাকাওয়ার জন্ম ১৮৩৬ সালে এবং মৃত্যু ২০ জানুয়ারী ১৮৯১ সালে। তারপর থেকে হাওয়াই পরাশক্তি অ্যামেরিকার অন্তুর্ভূক্ত হয়। রাজ্যটির রাজধানী হনোলুলু। হাওয়াইয়ের পার্লহারবারে অ্যামেরিকার সপ্তম নৌবহর মোতায়েন করা আছে। তখনকার পৃথিবীর গালিভার ছিল বৃটেন। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসগরের অধিকাংশ দ্বীপ এখনো অ্যামেরিকার অধিনে রয়েছে। অষ্ট্রেলিয়া, সলোমন, ফিজি, টোঙ্গা, নিউজিল্যান্ড বৃটেনের কলোনি। বৃটেন এবং অ্যামেরিকা পৃথিবীর অধিকাংশ এলাকা দখল করে নিয়ে তাদের কলোনি করেছে। পার্লহারবারের নৌঘাটিটি জাপানের ইম্পেরিয়াল নৌবাহিনি ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর কোন প্রকার পূর্ব ঘোষণা না করেই অতর্কিতে এক ভয়াবহ আক্রমণ করে ধ্বংশ করে দেয়। জাপানের সেনাবাহিনি তার নামকরণ করেছে “হাওয়াই ওপারেশন”।
বিনা উস্কানিতে ‘হাওয়াই ওপারেশন’ করেছে তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর শক্তি জাপান। বিনা উস্কানিতে যুদ্ধকে বর্বরতার সাথে তুলনা করা করা যায়। যা অত্যন্ত ঘৃন্যতম। আজকের ইতিহাসে সেকথা প্রমাণীত। কোন যুক্তি-তর্ক দিয়ে এমনতর ঘৃন্যতম বর্বরতার কালিমা মুছা যায় না। পার্ল হার্বার আক্রমণ করে অ্যামেরিকার সপ্তম নৌবাহিনী ধ্বংস করে জাপান চূড়ান্ত ভুল করল। কারণ, তখন অ্যামেরিকা জাপানের প্রতি কোন হুমকি ছিল না। আমেরিকা জাপান আক্রমণ করবে তার কোন প্রকার আচার আচরণে প্রকাশ পায় নি।
যে কোন অঘটন, তা ছোট আকারে হোক কিংবা বৃহৎ আকৃতির হোক, ইচ্ছা করলে করা যায়। কিন্তু তার পরিণামের কথা প্রথমে ভেবে দেখে না।
পার্ল হার্বারে অ্যামেরিকার শক্তিশালী নৌবহরে ছিলঃ
সেগুলি হল ৮টি যুদ্ধজাহাজ, ৮টি ক্রুজার, ৩০টি ডেস্ট্রয়ার, ৪টি সাবমেরিন, ৩টি ইউ এস সি জি কাটার্স, ৪৭টি বিভিন্ন ধরনের জাহাজ এবং ৩৯০টি যুদ্ধ জাহাজ।
জাপান যেদিন পার্লহারবার আক্রমণ করে তার ইম্পেরিয়াল সেনাবাহিনীতে ছিলঃ
৬টি যুদ্ধ বিমান বহনকারী জাহাজ, ২টি যুদ্ধ জাহাজ, ২টি হেভি ক্রুজার, ১টি লাইট ক্রুজার, ৯টি ডেস্ট্রয়ার, ৮টি ট্যাংকার, ২৩টি ফ্লীট সাবমেরিন, ৫টি মিজেট সাবমেরিন এবং ৪১৪টি যুদ্ধ বিমান।
জাপান দুটি তরঙ্গে এই আক্রমণ চালায়। অ্যামেরিকার নৌবাহিনী অপ্রস্তত ছিল। তবুও কিছুটা প্রতিরোধ করেছে। জাপানের ৪টি মিজেট সাবমেরিন ডুবে যায়, ১টি ধ্বংস হয়, ৭৪টি যুদ্ধ বিমান হারায়, তাদের নিহত হয় ৬৪ জন সৈন্য এবং এক জনকে জীবন্ত ধরেছে।
অ্যামেরিকার ক্ষতি হয়েছে বিপুল পরিমাণ।
সেগুলির মধ্যে ৮টি যুদ্ধ জাহাজ, ৮টি ক্ষতিগ্রস্ত, ১টি যুদ্ধ জাহাজ ও ১টি হারবার টাগ্‌ ডুবে যায়, ৩টি ক্রুজার ও ৩টি ক্ষতিগ্রস্ত, ৩টি জাহাজ ডুবে যায় এবং ১৮টি যুদ্ধ জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়াও ১৫৯টি বিভিন্ন ধরণের জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে।
আর, ২,৩৩৫ জন সৈনিক নিহত ও ১,১৪৩ সৈনিক আহত হয়।
অতর্কিতে আক্রমণ করে শত্রু হোক বা মিত্র হোক আক্রমণকারি যদি বিনা উস্কানিতে আক্রমণ চালায় তখন প্রতিপক্ষের কি পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে উপরে উল্লিখিত ক্ষয়ক্ষতির যে ধারণা দেওয়া হয়েছে তা দেখে বুঝা যায়।

পরবর্তি পর্যায়েমহাশক্তিধর অ্যামেরিকার শক্তি ও রণকৌশলের মোকাবিলা করতে পারেনি জাপান। অ্যামেরিকা যুদ্ধ ঘোষণা করে জাপানের প্রতি পাল্টা আক্রমণ চালায়।
কেন জাপান পার্ল হার্বার আক্রমণ করেছিল তা অনেকেই জানে না। অধিকাংশ জাপানিরাও এব্যাপারে পরীষ্কার ভাবে কিছু জানে না।
সে ব্যাপারের ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায় তা হলোঃ
অনেকের ধারণা যে জাপান মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করেছে ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বরের ১৮ তারিখে। আসলে তা যুক্তিযুক্ত তারিখ হয় না। ১৯০৪ সালে জাপান রাশিয়া আক্রমণ করে। সেটাকে রুশো-জাপানিজ যুদ্ধ বলে। সে যুদ্ধে রাশিয়া পরাজয় বরণ করেছিল। তারপর থেকে সমগ্র কোরিয়া ও দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়া জাপানের দখলে চলে আসে। তার পূর্বে জাপান মাঞ্চুরিয়া অনেকবার আক্রমণ করেছিল এবং দক্ষিণাঞ্চল দখল করেছিল। প্রথম আক্রমণ করেছিল ১৮৯৪ সালে। সেগুলি ছিল ছোট আকারের আক্রমণ। বড় ধরণের আক্রমণ করেছিল ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বরে। তখন সমগ্র মাঞ্চুরিয়া দখল করে সাম্রাজ্য বিস্তার করে।
তারপর তৎকালীন বিশ্বরাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন হয়। ১৯৩২ সালে League Nations থেকে মাঞ্চুরিয়ার ঘটনার উপরে তদন্ত হয় এবং জাপানকে মাঞ্চুরিয়া থেকে সরে যেতে বলা হয়। কিন্তু জাপান সিদ্ধান্তে অটল থেকে ‘লীগ ন্যাশন’ থেকে বের হয়ে আসে। তখন জাপানের উপর তেল ও লোহা আমদানির উপর অবরোধ করা হয়। রণসাজে সাজার জন্য এই দুটি দ্রব্যের ব্যাপক প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রথম দিকে জাপান এই অবরোধকে তেমন মূল্যায়ন করেনি। মূল্যায়ন না করার পিছনে হয়তো জাপানের নেতাদের মনে ভিন্ন ভাবনা বা পরিকল্পনা ছিল।
তারপর থেকে জাপান শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করে। আর সেনাপতিদের হাতে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ কিছুটা চলে যায়। তাদের মধ্যে আগ্রাসী ভাব প্রবল হয়ে উঠে। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত দেশ ইন্দোনেশিয়াতে অবস্থিত ‘ডাচ ও ফ্রান্স কলোনীগুলিতে আক্রমণ চালিয়া যাতে সহজে শত্রুকে পরাভূত করা যায় সেরকম পরিকল্পনা করে। আর, সেসব দেশ, যেগুলি পশ্চিমা বিশ্বেরই কলোনি, সেগুলিতে আক্রমণ চালাবার সময়ে যাতে অ্যামেরিকা তার সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে হস্তক্ষেপ করতে না পারে – সম্ভবত এটাই ছিল পার্ল হারবারে অ্যামেরিকার নৌঘাটিতে আক্রমণ চালাবার প্রধান কারণ।
পার্ল হারবারে আক্রমণ করে অনেক ক্ষতি সাধন করার পরেও অ্যামেরিকা কিছু যুদ্ধ জাহাজ দ্রুত মেরামত করে নৌবহর তৈরী করেছে। কিন্তু তার পূর্বেই জাপানের নৌবাহিনীর প্রধান এডমিরাল ইছোরকু ইয়ামামতো বিশাল এক নৌবহর নিয়ে গিয়ে ফিলিপাইন আক্রমণ করেন। তখন সেখানে জেনারেল ম্যাক্‌আর্থার ছিলেন। ইয়ামামতোর বাহিনীর মোকাবিলা করতে না পেরে তিনি তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ছোট একটি জাহাজে করে অষ্ট্রেলিয়া পালিয়ে যান। পালিয়ে যাবার সময় তিনি বলেছিলেন, “আমি আবার ফিরে আসব!”
জাপানের ইম্পেরিয়াল সেনাবাহিনী দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের দেশগুলি থেকে ডাচ এবং ফ্রান্সকে সহজে পরাভূত করে বিশাল এলাকা দখল করে নিল। অন্যদিকে হংকং মালয়শিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে বৃটিশ সেনাবাহিনীকে পরাভূত করে বৃটিশ বার্মা দখল করে ভারতের মনিরাম ষ্টেটের রাজধানী ইম্‌ফাল দখল করল।
জাপানের নিকটবর্তি দেশ ফিলিপাইন অ্যামেরিকার দখলে। ১৮৯৮ সালে অ্যামেরিকা স্পেইনের কলোনি আক্রমণ করে ফিলিপাইনকে অ্যামেরিকান কলোনিতে পরিণত করে। জাপান তা ভাল চোখে দেখেনি। ইন্দোনেশিয়াতে হল্যান্ডের কলোনি, মালয়শিয়া সিঙ্গাপুর হংকং বৃটিশ কলোনি। জাপানের চতুর্দিকে পশ্চিমা বেণিয়াদের কলোনি। অনেকের মতে পার্ল হারবার আক্রমণের হেতু এখানে নিহিত। তৎকালীন পরাশক্তিগুলির একটি তখন জাপান। পশ্চিমারা এশিয়াতে কলোনি বিস্তার করেছে তাদের দেশের তৈরী দ্রব্যাদি ও যন্ত্রপাতির বাজার সৃষ্টি করার জন্য। জাপান মনে করেছে এশিয়াতে পশ্চিমা শক্তিগুলি তার সার্থের পরিপন্থী। তাই পার্ল হারবার নৌঘাটি যুদ্ধ ঘোষণা করার পূর্বেই অতর্কিতে আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। তারপর জাপান ফরম্যাল যুদ্ধ ঘোষণা করে।…

সেদিন ইয়ুকিকে পৌছে দেওয়ার পর আকিহিরো সাইকেলে ঘরে ফিরে এল। ইয়ুকিকে বড় দুর্বোধ্য মনে হল তার। ক্লাশের অনেক মেয়ে তার সাথে গায়ে পড়ে কথা বলে। প্রেমপত্রও দেয়। কিন্তু এই ইয়ুকি মেয়েটি তাদের মতো নয়। ইয়ুকির সাথে হাত মিলাবার সময় এক আস্বাভাবিক রোমাঞ্চ বোধ করেছে সে। তার বড় হাতের মধ্যে ইয়ুকির ছোট হাতখানি বড় কোমল মনে হয়েছে। তখন ইয়ুকির মুখাবয়বের পরিবর্তনও সে লক্ষ করেছে। ইয়ুকিকে আজ প্রথম তার বড় কাছের একজন মনে হল। কথা বলার সময় তাকে বড় দূরের মনে হয় কেন আকিহিরো ভেবে পায় না। ইয়ুকি সুন্দরী মেয়ে তাতে কোন ভুল নেই। কিন্তু আকিহিরোর নিকট তাকে বড় দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে কেন! ইয়ুকি কি কোন রহস্যময়ী নারী। হোক সে রহস্যময়ী। আকিহিরো তার প্রতি এমন আকর্ষণ বোধ করছে কেন! এই সব অসংলগ্ন কিছু চিন্তা এসে আকিহিরোকে বিহবল করে ফেলেছে।
রাতের খাবার যখন খাচ্ছিল তখন আকিহিরোর মা কথা প্রসঙ্গে ইয়ুকির ব্যাপারে কথা বললেন।বললেন, ‘ইয়ুকির জীবন বড় দুঃখের, বড় করুণ!’
একথা ফুরুকাওয়া একদিন আকিহিরোর মাকে বলেছিলেন। ফুরুকাওয়ার স্ত্রী তমকো মাঝে মাঝে ইয়ুকির অতীত ইতিহাস জানার চেষ্টা করেন।ইয়ুকিও মাঝেমধ্যে নিজের কথা কিছু বলে।যখন ফুরুকাওয়ার স্ত্রী জিজ্ঞাসা করেন – তখন তার মা, সায়োরির কথা মনে মনে করে নিরবে কাঁদে। তমকোর মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। কিন্তু বেশী চাপ দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে ইয়ুকি শুধু কাঁদে।
আকিহিরো বলল, ‘মা ইয়ুকির অতীত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে ইচ্ছা হয়। সে যেদিন দোকানে আসে তখন তুমি জিজ্ঞাসা করলে হয়তো সে বলবে!’
ইকিহিরোর মা বাধা দিয়ে বলেন, “সে যখন বলতে চায়না – তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা না করাই ভাল।আমি শুধু এতটুকু জানি যে তার পিতামাতা যুদ্ধে মারা গিয়েছে। একথা অবশ্যই বিশ্বাষ করা যায়!”
আকিহিরো বলল, সে কথা অনেকেই জানে। কিন্তু তার দাদা দাদী, নানা নানী সম্পর্কে সে কাউকে কিছু বলেনি।
আকিহিরোর মা বললেন, সে যখন এই গ্রামে এসেছে তখন মাত্র নয় বৎসরের এতটুকু মেয়ে ছিল। হয়তো অতীতের কথা সে ভুলে গেছে। অযথা তাকে সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে তার মনে দুঃখ দেওয়ার কোন মানে হয় না।তাছাড়া এখন তার বয়স আঠার। অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে এই ইয়ুকি মেয়েটি। একথা গ্রামের সবাই বলে।কিন্তু সুন্দরী হলে কি হবে, লেখাপড়া জানে না। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। সমস্যা হল এখানে।
আকিহিরো প্রতিবাদ করল, “মা, আমাদের বাবাও যুদ্ধে মারা গেছেন।তুমি আছো বলে আমরা দু’ভাই স্কুলে যাচ্ছি। যদি ইয়ুকির মত আমাদের অবস্থাটা হত তখন কি অবস্থা হতো বলতো?
আকিহিরোর মা আর কিছু বললেন না।প্রশংগ পাল্টিয়ে বললেন, ‘তোর পরীক্ষা তো এই বৎসরে – তাই না?’
“হ্যাঁ, মা। আর মাত্র চার মাস বাকি আছে!”
পাশ করার পরে কি আরো পড়াশোনা চালিয়ে যাবার ইচ্ছা আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবি?
‘না’, আকিহিরো বলল।‘আমি পাশ করার পরে চাকুরি করব।তুমি আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছ।তোমার এখন বিশ্রাম নেওয়ার বয়স মা’।
‘সে ব্যাপারে তোর এত ভাবনা কিসের? আমি তো ভালই আছি!’
‘মা!’ আকিহিরো বলল, “আমরা যখন শিশু ছিলাম। তুমি রাতদিন আমাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য রেষ্টুরেন্টে, সবজির দোকান থেকে মাঠে, ঘাটে, কাজ করেছ। দিন মজুরের মতো জমিতে কাজ করেছ। আমি সেদিনের কথা ভুলে যাইনি মা!”
এবার ছোট ভাই তমহিরোকে জিজ্ঞাসা করল তার মা, ‘তোর তো আরো দেড় বৎসরের উপর রয়েছে, তাই না?’
‘হ্যাঁ মা, আরো দেড় বৎসর বাকি আছে’।
‘তাই যদি হয় – স্কুল পাশ করে কি তুইও কাজে লেগে যাবি না কি আরো পড়াশোনা করবি?’
‘না মা’, তমহিরো বলল, ‘আমি তোমার কাজটা করে যাব।তোমার দোকান চালাব!’
গত দু’দিন ইয়ুকি দোকানে আসেনি। সাপ্তাহে গড়ে তিন দিন সে কজিমা সানের দোকানে আসে। অপ্রয়োজনে কখনো আসেনি।
আকিহিরোর মা বললেন।কোন সর্দি কাশিতে ভোগছে কি না কে জানে!
‘তাই নাকি?’ আকিহিরো বলল।আমি গিয়ে দেখে আসব কি মা?
‘সময় থাকে তো দেখে আয়!’
‘মা, কাল শনিবার, বারটায় পর্যন্ত ক্লাশ চলবে। স্কুল থেকে ফিরার পথে তাকে আমি দেখতে যাব!’
শনিবার বারটায় স্কুল থেকে ফিরার পথে আকিহিরো ফুরুকাওয়ার বাড়িতে ইয়ুকিকে দেখতে গেল। ফুরুকাওয়া ও তার স্ত্রী ঘরে আছেন। আকিহিরোকে দেখে তারা দু’জনেই খুশি হয়ে বললেন, “ভালতো আমাদের বাড়িতে আসলে।আমি এক সময়ে তোমার বাবার সহপাঠি ছিলাম।আমরা এক সঙ্গে খেলাধুলা করেছি। বাবার মৃত্যুর পরে কৃষকের পেশা নিয়েছি। তাই সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে ডাকে নি। কারণ, যুদ্ধ করতে হলে খাদ্যের দরকার আছে। তোমার বাবা টাউন কাউন্সিলে কাজ করতেন বলে তাকে যুদ্ধে যেতে হয়েছে।যাই হোক, তুমি ঘরের ভিতরে এসে বস!”
আকিহিরো ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে এদিক সেদিক চোখ বুলিয়ে ইয়ুকির অবস্থান বুঝার চেষ্টা করল। কিন্তু তাকে না দেখে বলল, ‘ইয়ুকি কোথায়, কাকা?’
ইয়ুকি কোথায় বলছো? পাশে বসা ছিলেন ফুরুকাওয়ার স্ত্রী তমকো। তিনি বললেন, ‘তার ঠান্ডা লেগেছে। শরীরে সামান্য জ্বর আছে মনে হয়!’
‘ঔষধ সেবন করেছে কি?’
‘তা করেছে। ডাক্তার এসে তাকে দেখে ঔষধ দিয়েছেন।সে এখন পাশের রুমে ঘুমাচ্ছে। তুমি কি আজ তাকে দেখতে এসেছ?’
আকিহিরো মহিলার কথা শোনে লজ্জা পেল। তারপর বলল, ‘হ্যা, খালা, মা বলেছেন তাকে দেখে যেতে। তাই আমি আজ স্কুল থেকে সোঝা আপনাদের বাড়িতে এসেছি!’
ফুরুকাওয়ার স্ত্রী মৃদু হেসে বললেন, ‘যাও, পাশের রুমে গিয়ে তাকে দেখে আস!’
আকিহিরো বিলম্ব না করে পাশের রুমে ইয়ুকিকে দেখতে গেল। জানালা সব বন্ধ রয়েছে।রুমের ভিতরে কিছুটা অন্ধকার। তাই প্রথমে আকিহিরো ইয়ুকির অবস্থান বুঝতে না পেরে নিম্ন স্বরে ডাকল, ‘ইয়ুকি তুমি কোথায়?’
‘কে এসেছে?’ ইয়ুকি তাড়াহুড়া করে উঠে বসল।
আকিহিরো এতক্ষণে তাকে দেখতে পেল। জবাবে বলল, “ইয়ুকি আমি আকিহিরো!”
বিদ্যুৎ গতিতে তখন ইয়ুকি তার শরীরের কাপড় গুছিয়ে নিল। তার পরনে সুতির পিঙ্ক রঙের ‘ইয়ুকাতা’ কিমনো। তারপর ইয়ুকি বলল, “আকিহিরো তুমি কি আমাকে দেখতে এসেছ?”
আবেগের বশে আজ প্রথম ইয়ুকি আকিহিরোকে ‘তুমি’ সম্বোধন করল। তারপর দ্রুত নিজেকে সংশোধন করে বলল। “মাপ করবেন, আমি আপানাকে ‘তুমি’ বলে ফেললাম!”
আকিহিরো প্রতিউত্তরে কিছু না বলে ইয়ুকির বিছানার এক পাশে বসে বলল, “আমি শোনে খুশি হলাম আমাকে আজ ‘তুমি’ সম্বোধন করেছ। আগে ভাবতাম তুমি আমাকে দূরের লোক ভাব। আজ বুঝতে পারলাম যে তুমি আমাকে তোমার নিকটতম লোকের মতই মনে কর!”
ইয়ুকি কি বলবে তৎক্ষণাৎ কিছু ভেবে পেল না। তার সারা দেহে তখন ঘাম এসেছে।উত্তেজনা ও আবেগের মিশ্রণে তার মনে হচ্ছিল যে তার শরীর প্রায় অবশ হয়ে যাচ্ছে। ইয়ুকি কথা বলতে গিয়েও আবেগের বসে বলতে পারল না।কিছুক্ষণ এভাবে চলে গেল। ইয়ুকি তখন নীরবে চোখের জল ফেলছে।
মুহূর্তের মধ্যে আকিহিরো যখন বুঝতে পারল যে ইয়ুকি কাঁদছে, তখন সে অভিমানের সুরে বলল, “ইয়ুকি তুমি কাঁদছ? ‘তাহলে এখন আমি এখন যাই’’, বলে সে রুম থেকে বের হওয়ার ভান করল।
সে সময় ইয়ুকি লাফ দিয়ে উঠে গিয়ে রুমের দরজা আগলে ধরে বলল, “না, না, আমি কাঁদি না। চেয়ে দেখ এখন আমি কেমন হাসতে পারছি!” এতটুকু বলে ইয়ুকি আবার ঢুক্‌রে কাঁদতে লাগল।
আকিহিরো তখন তার কান্না দেখে প্রথমে বোবার মত দাঁড়িয়ে রইল। সে তখন কি করবে ভাবছিল। এখন কি বলে সে ইয়ুকিকে শান্তনা দিবে – ভাষা খুঁজে পেল না। তারপর মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে ইয়ুকির দু’টি হাত ধরে তাকে তার বিছানার দিকে টেনে নিয়ে বলল, “তোমার জ্বর, দোহাই তোমার – কাঁদবে না। আকিহিরো তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলল, ‘এখন তুমি কথা বলতে পার।আমি যাচ্ছি না। কাছে বসে তোমার কথা শুনব!
ইয়ুকি তার পরনের কিমনোর এক প্রান্ত টেনে তার চোখ মুছে নিল। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, “আকিহিরো, খালা ভাল আছেন তো? আমি দু’দিন জ্বরের জন্য যেতে পারিনি!”
‘সে জন্যই মা আমাকে এখানে পাঠালেন।ও, ‘খালা’ আমাকে দেখতে পাঠিয়েছেন?’
অবশ্যই মা বলেছেন, ‘তাছাড়া…’
‘তাছাড়া কি বল?’
এবার কোন কথা না লুকিয়ে আকিহিরো তার মনের কথাটিও বলে ফেলল, “তাছাড়া দু’দিন তুমি মায়ের দোকানে যাওনি শুনে আমার ভাল লাগছিল না। তোমাকে দেখার জন্য আমার মন ব্যাকুল ছিল!”
আকিহিরো তার স্কুলের ব্যাগের ভিতর থেকে একটি আপেল ও দু’টি কমলা বের করে ইয়ুকির বালিশের পাশে রেখে বলল, ‘এগুলি তুমি খাও!’
ইয়ুকি মলিন হেসে বলল, ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আকিহিরো। তবে এগুলি কেন আনলে তুমি? যাই হোক, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ! একটু আগেও আমার গায়ে জ্বর ছিল। তোমাকে দেখে শরীরে এমন ঘাম এল যে – এখন আমার মনে হচ্ছে সেই ঘামের সাথে আমার জ্বর চলে গেছে!’
আকিহিরো বলল, ‘সত্যি বলছ তোমার গায়ে জ্বর নেই?’ সে ইয়ুকির কপালে হাত লাগিয়ে দেখল। তারপর বলল, ‘হ্যা, আমারও মনে হচ্ছে তোমার এখন জ্বর নেই। কিছুক্ষণ পরে আকিহিরো উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ইয়ুকি এখন আমাকে যেতে হবে!’
ইয়ুকি ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে? তাহলে আমার খারাপ লাগবে। কথা বলার কেউ যে আমার নেই!’ ইয়ুকি হাঁটুর উপর মাথা রেখে কাঁদতে লাগল।
‘হ্যাঁ, এখন আমি যাব ইয়ুকি!তুমি মন শক্ত কর।’
“একটু বস। আমার একটা কথা বলার আছে!” চোখ মুছে ইয়ুকি বলল।
কি কথা বল?
ইয়ুকি আকিহিরোর মুখের দিকে চেয়ে বলল, “আকিহিরো তুমি আমায় ভালবাস কি?” এই সময়ে এমন কথা শোনার জন্য আকিহিরো সম্ভবত প্রস্তুত ছিল না।ইয়ুকির কথা শোনে কেন যেন তার হৃদপিন্ড অস্বাভাবিক ভাবে কেঁপে উঠল। সে মনে মনে বলল, ‘মেয়েরা কি এমন উল্টো ভাবে ভালবাসার কথা বলে?’ এই মুহূর্তে ইয়ুকির কথার কি উত্তর দিবে সে ভাবনায় পড়ল। এভাবে কিছুক্ষণ চলে গেল।তারপর বলল, ‘‘ইয়ুকি তোমাকে যদি আমি ভাল না বাসতাম তাহলে কি আজ তোমাকে দেখতে আসতাম? তুমি কি আমাকে দেখে কিছুই বুঝ না?”
আকিহিরোর তার কথা শোনে আনন্দ মিশ্রিত আবেগে আকিহিরোর ডান হাতটি ধরে ইয়ুকি বলল, “আকিহিরো তুমি কি সত্যি বলছ?”
‘কেন মিথ্যা বলব!’
তারপর ইয়ুকি একটি কমলা আকিহিরোর হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা ছিলে দাও!’
আকিহিরো কোন মন্তব্য না করে কমলাটি ছিলে ইয়ুকির হাতে দিল। কিন্তু ইয়ুকি সেটা আকিহিরোর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “আমাকে এটা খাইয়ে দাও!”
অনিচ্ছা সত্তেও হাসল আকিহিরো।সে কমলাটি ভেঙ্গে ইয়ুকির মুখে একটি টুকরা দিয়ে কললার বাকি অংশ নিজ হাতে রাখল। ইয়ুকি সেটা খেতে খেতে কমলার বাকী অংশ থেকে একটি টুকরো হাত বাড়িয়ে নিয়ে তার নিজের হাতে এক টুকরা আকিহিরোর মুখে দিল।
আকিহিরো ধন্যবাদ বলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ইয়ুকি, আমাকে এখন যেতে হবে। স্কুল ছুটির দিনে একসময় দু’জনে কথা বলব, কেমন?”
ইয়ুকি মাথা নাড়িয়ে বলল, “আচ্ছা, খালাকে বলবে যে আমি এখন ভাল আছি। আমার জ্বর সেরে গেছে।”
আকিহিরো ইয়ুকির রুম থেকে বের হয়ে ফুরুকাওয়া দম্পতির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ইয়ুকির জ্বর এখন নেই।আশা করছি শীঘ্রই সে সুস্থ হয়ে !’
ফুরুকাওয়ার স্ত্রী বললেন, ‘তোমার যখন সময় হয় আবার তাকে দেখতে এসো!’
আকিহিরো ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরে ফুরুকাওয়ার স্ত্রী বললেন, “এমন শান্ত ও ভদ্র ছেলে এই গ্রামে দু’টো নেই। কজিমা সানের তো দু’টি ছেলে।ইয়ুকিকে এই ছেলেটির সাথে বিয়ে দিয়ে তাকে ঘরজামাই করে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসব, কি বল?”
ফুরুকাওয়া বলল, “ছেলেটির মা রাজী হবেন কিনা জানি না। কারণ, তিনি জানেন ইয়ুকি আমাদের নিজের সন্তান নয়!”
তমকো বললেন, “আমাদের ইয়ুকির মতো সুন্দরী মিষ্টি মেয়ে এই গ্রামে দু’টি নেই। তাছাড়া গ্রামের সবাই জানে যে ইয়ুকি আমাদের সন্তান এবং ভবিষ্যতে সে আমাদের সম্পত্তির মালিক হবে!”
ফুরুকাওয়া বললেন, “তা হতে পারে। কিন্তু মনে রেখো কারো সন্তান যদি ইয়ুকিকে তার রূপ দেখে বিয়ে করতে রাজী হয় – তখন তার অভিবাবকেরা বাধা দিবেন।কারণ, তারা ইয়ুকির পূর্বপুরুষদের সন্ধানও করবে। মেয়েটি তো এখন কিছুই স্মরণ করতে পারছে না!”
“তা না পারুক, তাতে কিছু এসে যায় না। আমরা বলব ইয়ুকি আমাদের সন্তান। আমাদের ধন সম্পত্তি সব ইয়ুকিকে দিব। তখন অনেকের ছেলে খুশি হয়ে তাকে বিয়ে করতে চাইবে!”
স্ত্রী তমকোর কথা শোনে হাসলেন ফুরুকাওয়া। তারপর বললেন, “বিয়ে করতে চাইলে তো আর কোন কথাই নেই। মনে রেখো তোমার সে দাবী সমাজ গ্রহণ করবে না। এখন যুদ্ধে দেশ বিধ্বস্ত বটে,সমাজ কিন্তু তার আপন ধারাতেই চলছে!”
আকিহিরো ঘরে ফিরে ইয়ুকির কথা তার মাকে খুলে বলল। ইয়ুকি সুস্থ শোনে তিনি খুশি হলেন।
পরের রোববারে ইয়ুকি দোকানে এল।আকিহিরোর মা তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তোমার শরীর ভাল নেই শোনে আমি চিন্তায় ছিলাম ইয়ুকি!’
ইয়ুকি হেসে বলল, “জ্বর আমাকে কাবু করতে পারবে না খালা। আমার জানা মতে এবারই আমি প্রথম জ্বরে ভোগেছি। তাছাড়া আমি হলাম কুয়োর বেঙের মতই একজন। ঐ যে একটা কথা আছে না, ‘বেঙের আবার সর্দি!’
এবার আকিহিরোর মা রাগত স্বরে বললেন, ‘ভাল কথা বলতে পার তো তুমি।এসব কথা তোমাকে কে শিখিয়েছে? নিজেকে কখনো কারো নিকট ছোট করে দেখাবে না। প্রত্যেক লোকের ভিতর গর্ব করার কিছু না কিছু আছে এবং তা তোমার মাঝেও আছে।তুমিও মানুষ আমিও মানুষ, মানুষ হিসাবে আমরা সমান!’
ইয়ুকি অপ্রতীব হয়ে বলল, “আমার ভুল হলে ক্ষমা করবেন খালা। আমাকে তো কেহ স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করতে বলেনি। যা কিছু আমি শিখেছি তা প্রকৃতি থেকে শিখেছি। কেউ যদি বলে ইয়ুকি তুমি স্কুলে যাওনি কেন? তখন আমার লজ্জা করে। আমি তো এই পর্যন্ত এক জায়গাতেই রয়েছি। আমি শহর নগর কিছুই দেখিনি।তাই ‘কুয়োর বেঙের সাথে নিজে্র তুলনা করলাম।
“শোন ইয়ুকি, বুদ্ধি দিয়ে লজ্জা ঢাকা যায়। ফুরকাওয়া তোমার অনেক প্রশংসা করেন। তিনি বলেছেন যে তুমি সব কাজ নিজে নিজেই করতে পার এবং তোমাকে কিছু বলে দিতে হয়না। তাই তোমাকে বলছি যে তোমার যোগ্যতার পরিচয় তোমার বুদ্ধির মাধ্যমে প্রমাণীত করব”। তারপর বললেন, যদি তুমি কিছু মনে না কর – তোমাকে একটি প্রশ্ন করতে চাই!’
ইয়ুকি বলল, “শুধু একটি প্রশ্ন কেন খালা, আপনার ইচ্ছা হয় তো দশটি করতে পারেন। আমি যথা সম্ভব সঠিক জবাব দেবার চেষ্টা করব!”
দু’কাপ সবুজ চা ও কিছু সেম্বে পিঠা ইয়ুকির সামনে রেখে মহিলা ইয়ুকির পাশে বসে বললেন, “তোমার বাবা মায়ের কথা শুনতে চাই আমি। তাঁদের মৃত্যু কি ভাবে হয়েছে আমাকে খুলে বলবে কি?”
ইয়ুকি বলল, ‘আমার বাবা ওকিনাওয়ার যুদ্ধে মৃত্যু বরণ করেছেন। আর আমার মা কিউশিওর একটি মোরগীর ফার্মে কাজ নিয়েছিলেন। কয়েক মাস পরে শত্রুর বোমায় মা সেই ফ্যাকটিরীতে মারা যান।”
আকিহিরোর মা বললেন, “সে ব্যাপারে সামান্য শোনেছি। তারপর তুমি কি করে এতদূরে নাকাজাতো গ্রামে আসলে?
ইয়ুকি আওমরিতে তার আসার কথা খুলে বলল। সাইয়োরি এবং তার মায়ের মৃত্যর কাহিনীও বলল। তানাকা পরিবারের কথাও বলল।
কিন্তু তোমার ঘর বাড়ি এখন কে দেখা শোনা করছেন।
ইয়ুকি বলল, আমাদের কোন ঘর বাড়ি নেই। কিউশিওতে আমরা ভাড়াটে বাড়িতে থাকতাম। আসলে আমরা ওকিনাওয়ার বাসিন্দা।শত্রু যখন ওকিনাওয়াতে হামলা করে তখন বাবা আমাকে ও মাকে নিয়ে ওকিনাওয়া থেকে কিউশিওর একটি গ্রামে একটি ঘর ভাড়া করে রেখে গিয়েছিলেন। মায়ের মুখে যদ্দুর শোনেছি আমার দাদা দাদী ওকিনাওয়াতেই শত্রুর বিমান হামলায় মৃত্য বরণ করেন।
তোমার নানা নানীকে তুমি দেখেছ?
দেখেছি, কিন্তু তারা সম্ভবতঃ জীবিত নেই।তাদের সম্পর্কে আমি এখন কিছুই জানি না। কিছুক্ষণ চিন্তা করে ইয়ুকি বলল, আপনি নিশ্চয় শুনেছেন ওকিনাওয়ার অর্ধেকের চেয়েও বেশী লোক মারা গেছে। আমি মনে করি না যে তাঁরা আজবধি বেঁচে আছেন। আর আমার পক্ষে সেখানে গিয়ে তাদের খুঁজ খবর নেয়াও সম্ভব নয়। আমি পৃথিবীর এমন একজন এতিম যার বংশের শেখর সবগুলি যুদ্ধের কারণে উপড়ে গিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। আমার এই দুর্বস্থার জন্য কাকে দায়ি করব আমি। কে শুনবে আমার আমার নালিশ?” আমি একটি শিকড় বিহীন গাছের মতো। তাইফুন যে কোন সময় এসে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আমার খুঁজে কেউ যাবে না। কেউ ফেলবে না চোখের জল। আমার পরিচয় শুধু আমি, আর কেউ নেই!”
আকিহিরোর মা ইয়ুকির করুন কাহিনী শোনে চোখের জল মুছে বললেন, তা কক্ষণো সম্ভব হবে না, ইয়ুকি। সেই সময়ের ঝড় তুফান যখন তোমাকে উড়িয়ে নিতে পারল না।এখন কার ছোট ঝড় তুফানও তোমাকে উড়িয়ে নিতে পারবে না। একটু থেমে মহিলা বললেন, তুমি নিজেকে এতটা হালকা ভাব কেন, ইয়ুকি? ফুরুকাওয়া সান ও তার স্ত্রী ভাল মানুষ। তারা তোমাকে তাদের মেয়ে বলেই জানেন। তোমাকে তাদের প্রয়োজন আছে বৈ কি!
“খালা আমি জানিনা ফুরুকাওয়ার পরিবার সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন”, প্রতিবাদের সুরে বলল ইয়ুকি। “আমি সেখানে দক্ষিণ থেকে ভেসে এসে তাদের ওখানে কাজ করছি। তারা এখন সবাইকে বলেন যে আমি তাদের দত্তক মেয়ে। কিন্তু আপনি একটু চিন্তা করে দেখেছেন কি যে আজবধি আমি তাদের বাড়ির একজন মেইড সারভেন্ট হয়েই কাজ করছি। তারা যদি আমাকে তাদের মেয়ে মনে করতেন – তাহলে আমাকে স্কুলে পাঠায়নি কেন? স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করার প্রবল ইচ্ছা ছিল! সে যাই হোক, আমার কথায় আপনি কিছু মনে করবে না খালা। আমি মনে করি যে শুধু মুখে বলে অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তান করা যায় না। আমি তো তখন মাত্র নয় বৎসর বয়সের মেয়ে ছিলাম। আমাকে যদি তাদের মেয়ে করার ইচ্ছা থাকত – তখনই করতে পারতেন!”
ইয়ুকি তার চোখের জল মুছে বলল, “এত ধন সম্পত্তি দিয়ে তারা কি করবেন!” তবে একটি কথা মনে রাখবেন খালা, “কোন ধন সম্পত্তির উপর আমার বিন্দু মাত্র লালসা নেই। সেখানে আমি কাজ করে খাচ্ছি মাত্র।চীর দিনের জন্য সে বাড়িতে আমি থাকতে চাই না। আমি নিজেকে সে বাড়ির একজন মেইড ছাড়া অন্য কিছু মনে করি না। এখন আমি একজন প্রাপ্ত বয়ুষ্কা নারী। আমার ভাগ্য আমি নিজেই নির্ধারণ করব। কারো প্রভাবে আমি চলব না!”
আকিহিরোর মা ইয়ুকিকে শান্তনা দিয়ে বললেন, “আমার চেয়েও তোমার জীবন বড় করুন।আমি আমার দু’টি শিশু সন্তানকে বাঁচাবার জন্য সব রকম কাজ করেছি। বিপদের দিন গুলিতে কেউ আমাকে সাহায্য করেনি। আমি তোমার মনের কথা সব বুঝতে পারছি”। মহিলা চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, ‘সেই দিন গুলিতে তোমার মত নীরবে আমিও কম কাঁদি নি। আমি আমার সন্তানদের দিকে তাকিয়ে তোমার কথাও চিন্তা করি। আমি আমার অন্তরের অনুভূতি দিয়ে তোমার কথা ভাবি।আজকের জাপানে তোমার মত এমন অনেকেই আছে – যারা বিপন্ন জীবন যাপন করছে’।
ইয়ুকি বলল, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, খালা। এত দিন কারো নিকট আমার মনের কথা খোলে বলার কোন লোক পাইনি। আজ আপনাকে কিছু কথা বলতে পেরে নিজেকে কিছুটা হালকা বোধ করছি।তারপর ইয়ুকি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, খালা, আমাকে এখন ফিরতে হবে।লিষ্টের জিনিষ গুলি দয়া করে দেন। রাত হলে একা আমি ঘরে যেতে পারব না।শিয়াল দেখে আমি ভয় পাই!”
আকিহিরোর মা বললেন, ‘পরের বার তুমি বরং আরো সকালে এসো। তাহলে অনেক কথা বলা যাবে। কেমন?’
ইয়ুকি বলল, ‘খালা, আমাকে সব রান্নার কাজ করতে হয়। ইচ্ছা থাকলেও আরো সকালে আমার পক্ষে দোকানে আসা সম্ভব নয়’’।হাতে ব্যাগটি নিয়ে সে বলল, ‘একদিন তাদের অনুমতি নিয়ে আমি আসব খালা। তখন অনেক কথা বলা যাবে’।
বের হওয়ার সময়ে আকিহিরো স্কুল থেকে ফিরল। ইয়ুকিকে দেখা মাত্র সে হাত তুলে দাঁড়াতে ইঙ্গিত দিয়ে বলল, “আমি ফিরে আসলাম মাত্র, আর এখন তুমি চলে যাচ্ছ?”
ইয়ুকি বলল, “রাত হয়ে যাবে, এক কিলোমিটার পথ আমি একা রাতে যেতে পারব না। আর, রাতে খেঁকশিয়াল দেখলেও আমি ভয় পাই। এখন তুমি আমাকে যেতে দাও!”
আকিহিরো বলল, “সন্ধ্যায় আমি সেদিনের মতো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসব। দয়াকরে তুমি পনের মিনিট অপেক্ষা কর!”
ইয়ুকি অস্ফুট স্বরে বলল, ‘খালা দেখলে মাইন্ড করবেন। তুমি আমাকে আটকে রেখো না!’
কিন্তু আকিহিরো ইয়ুকির কোন কথা শোনল না। সে ইয়ুকির হাত ধরে তার মায়ের সামনে টেনে নিয়ে গেল।
আকিহিরোর মা বললেন, “তুই তাকে যেতে দে, মেয়ে মানুষ, সন্ধ্যা হলে তার ফিরতে সমস্যা হতে পারে” !
ইয়ুকি বলল, তুমি কিছু বুঝ না আকিহিরো, ঘরে ফিরে আমাকে তাদের দু’জনের রান্না করে খাওয়াতে হবে। এখন দয়াকরে আমাকে যেতে দাও।তারপর ইয়ুকি ব্যাগটি হাতে নিয়ে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে হাঁটতে লাগল। আকিহিরো কিছু বলতে গিয়েও সেদিন আর বলতে পারল না।
সেদিন আকিহিরো আর কোন কথা বাড়াল না।সে শুধু ইয়ুকিকে আরো কিছুক্ষণ থাকতে বলেছিল।কিন্তু তাকে আটকিয়ে রাখতে পারল না। এখন সে অনুভব করতে পারল যে ইয়ুকি তার মনের কোণে বড় এক ভাবনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে।ইয়ুকিকে সে মনের কিছু কথা বলতে চায়।কিন্তু সময় খারাপ। সামনে পরীক্ষা, তাকে এখন রাত জেগে পড়াশোনা করে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। এখন ডিসেম্বর মাস, সামনের ফেব্রুয়ারী মাসে ফাইনাল পরীক্ষা।কিন্তু এখন একটা দিন ইয়ুকিকে না দেখে সে থাকতে পারে না।ইয়ুকি প্রতিদিন বিকাল তিনটায় দোকানে আসে।এখন এই দোকানে আসা যাওয়াটাই ইয়ুকির জন্য বড় আনন্দের ব্যাপার। একথা ইয়ুকি আগেও তাকে বলেছিল।তবে হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে ইয়ুকির কথা ভেবে এখন সে রাত জেগে পড়শোনা করে।ইয়ুকিকে যদি সে আপন করে পেতে চায়, তাহলে প্রথমে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে।ইয়ুকির কষ্টের দিনের অবসান চায় আকিহিরো।আরেকটি ব্যাপার সে জানতে চায়। তা হল ইয়ুকির অতীত ইয়িহাস। তার জন্মস্থান ওকিনাওয়া। কিন্তু দ্বাদশ শ্রেণী পাশ করলে যে সার্টিফিকেট তার হাতে আসবে – তা দিয়ে সে চাকুরি পাবে। তাই সেসব কথা মনে চাপা দিয়ে পড়াশুনাতে মনোযোগ দিল।সেদিন রাতে সামান্য খেয়ে পড়ার টেবিলে গিয়ে বসল আকিহিরো।

লেখকঃ জাপান প্রবাসী কবি ও সাহিত্যিক। 

উপন্যাসের আগের পর্ব-

ঐতিহাসিক উপন্যাসঃ ইয়ুকি একটি মেয়ের নাম (পর্ব-০৫)

 

আরও পড়ুন