Ads

বুক রিভিউঃ শিকড়ের সন্ধানে’র শিকড়ের গল্প

হাবিবা মুবাশ্বেরা

আলহামদুলিল্লাহ!! এবারের বই মেলায় হামিদা মুবাশ্বেরার জনপ্রিয় ফেসবুক সিরিজ ‘শিকড়ের সন্ধানে’ বই হিসেবে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে ইনশাল্লাহ। ইতিমধ্যে অনেকেই ফেসবুকে শিকড়ের সন্ধানে পড়েছেন। তাই এই বই নিয়ে আলোচনা করা আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমি বরং পাঠকদের জানাতে চাই ‘শিকড়ের সন্ধানে’র শিকড়ের গল্প । অর্থ্যাৎ এই বইয়ের লেখিকার শৈশব থেকে লেখিকা হয়ে ওঠার গল্পই এই লেখার উপজীব্য, যা পড়ে হয়তো অনেক অভিভাবকরাই আশান্বিত হতে পারবেন।

হামিদা মুবাশ্বেরা (সানিয়া) ছোট বেলায় মোটেই শান্ত শিষ্ট, গুড গার্ল বা তথাকথিত আঁতেল টাইপের ফার্স্ট গার্ল ছিল না। বরং ছোট বেলায় সে ছিল চঞ্চল,জেদী আর বহির্মুখী স্বভাবের। আমরা সরকারী কোয়ার্টারে থাকতাম, আশে পাশের বিল্ডিং এর বিভিন্ন আন্টিদের বাসায় ছিল তার অবাধ যাতায়াত। নিজের চেয়ে বয়সে বড় আপুদের সাথেই ছিল ওর বেশি খাতির (এই স্বভাব এখনও বিদ্যমান), এমনকি আন্টি শ্রেণির সাথেও সে অবিরাম গল্প করে যেতে পারতো। তবে এই বাচাল স্বভাব আর সেই সাথে বাসার সবার ছোট মেয়ে হওয়ায় পরিবার, আত্মীয়-স্বজনদের কাছেও আহ্লাদটা সে একটু বেশিই পেত। বিশেষ করে বাবার অতি আদরের কন্যা ছিল সে। আব্বা বাসায় এসেই ডাক দিতো ‘আমার সানি পানি’……কিংবা ‘মায়ন’। আমাদের দাদীর নাম ছিলো ‘হামিদা’। নিজের মায়ের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছিলেন, আব্বা আমাদের তিনজনের মাঝে ওকে যে বেশী আদর করতেন সেটা ছিল ওপেন সিক্রেট।

আমরা সানির সব ধরণের যন্ত্রণা হাসিমুখে সহ্য করে নেয়ার আর একটা কারণ ছিলো ওর মেধা। এমন সুন্দর করে পাকা পাকা কথা বলতো যে রাগ ধরে রাখা মুশকিল হয়ে যেত। তবে ওর মেধাটা ছিল অনেকটা মোমবাতির আগুনের মতো। আগুনটা সযত্নে আগলে রেখে তার থেকে আলোটুকু আদায় করে নিতে বেশ বেগ পেতে হতো।

আমাদের সমাজের স্বাভাবিক চিন্তা অনুযায়ী আর সবার মত আমরাও ভাবতাম ভালো রেজাল্টের মাধ্যমে ওর এই মেধার যথাযথ প্রতিফলন ঘটছে। এসএসসি, এইচ এস সি তে শ্রেষ্ঠ ফলাফলের পর সে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আই. বি. এ অনুষদে চান্স পেলো তখন আমরা মোটামুটি নিশ্চিন্ত। এখান থেকে পাশ করে বেরোলেই কর্পোরেট সেক্টরে হাই ফাই স্যালারিতে চাকুরি নিশ্চিত, একজন ভালো স্টুডেন্টের জন্যে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে??

কিন্তু মানুষের পরিকল্পনা আর আল্লাহর পরিকল্পনা ভিন্ন!! এবং অবশ্যই আল্লাহর পরিকল্পনা সর্বোত্তম।

আমাদের  আব্বা চাইতেন তার তিন ছেলেমেয়ের একজন অনন্ত ইসলামিক লাইনে পড়াশোনা করুক। আমাদের দাদা ছিলেন ইংরেজি, গণিতের পাশাপাশি আরবি ভাষায়ও পারদর্শী এবং খুব মেধাবী ছাত্র। আমাদের আব্বা চাইতেন আমরা একজন অন্তত যেন দাদার মতো ইসলামিক বিষয়ে জ্ঞানবান হই। বিশেষ করে সানিয়ার কথা ঊনি খুব বলতেন যে ওকে হাফিযা বানাবেন। কিন্তু আমাদের দেশের চিরাচরিত  দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী  মানবিক শাখায় তো ভালো  স্টুডেন্টরা পড়ে না আর ইসলামি সাব্জেক্টগুলো তো আরো ব্যাকডেটেড!! তাই আব্বার সেই স্বপ্ন পূরণ করার কোনো প্রচেষ্টাই আমরা কেউ করি নি, কিছুটা সচেতনভাবেই!

কিন্তু একজন ঈমানদার বাবা হয়তো নিরাশ হননি। মানুষের অন্তর পরিবর্তনের মালিকের কাছে সবার অগোচরে দুআ করে গেছেন প্রতিনিয়ত। দীর্ঘ সময় ধরে দুআ করার একটা অদ্ভূত ক্ষমতা ছিল তাঁর। ঘর অন্ধকার করে,  দুই চোখ বন্ধ করে তিনি এত মনোযোগ দিয়ে টানা দুআ করতেন যে, অনেক সময় জরুরী কথা বলতে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে হতো। আমরা বিরক্ত হয়ে চলে আসতাম, কিন্তু তার দুআ শেষ হতো না। যেন এক অন্য জগতে হারিয়ে যেতেন এইসময়। তখন বুঝিনি , কি অমূল্য উপহার তিনি রেখে যাচ্ছেন সন্তানদের জন্য!!

২০০৮ সালে তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর পর  তার সবচেয়ে ছটফটে ছোট মেয়ের অন্তরে হঠাৎ করেই ইসলামিক জ্ঞান আহরণের আকন্ঠ  পিপাসা তৈরি হলো মহান আল্লাহর অনুগ্রহে। এই পিপাসা মেটাতে সে ভর্তি হয়ে যায় ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটির ব্যাচেলর কোর্সে। আইবিএ থেকে ডিগ্রী অর্জনের পাশাপাশি সে ইসলামিক স্টাডিজে ব্যাচেলর কোর্সও সম্পন্ন করে।

আগে থেকেই টুকটাক লেখালেখির অভ্যাস আমাদের দুই বোনেরই ছিলো, সেটাও সম্ভবত আব্বার কাছ থেকেই পাওয়া। বাংলায় গ্রাজুয়েট  আব্বার লেখার হাত ছিলো দারুণ মাশাআল্লাহ। বিয়ের পর মালয়শিয়ার প্রবাস জীবনে  হামিদা ইসলাম নিয়ে তার অর্জিত সামান্য জ্ঞানটুকু অন্যদের সাথে শেয়ার করার জন্য ফেসবুককে প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বেছে নেয়। কুরআনের বাংলা অর্থ পড়তে গিয়ে সে নিজে যে বিড়ম্বনার শিকার হয়েছিলো, সেটা যেন অন্যদের না হয়, সেজন্য কিছুটা হঠাৎ করেই ফেসবুকে ও ‘শিকড়ের সন্ধানে’ সিরিজটা লেখা শুরু করে। সেটা ২০১৩ সালের কথা।

আমরা কেন মুসলিম ? ইহুদী ও ক্রিস্টান কারা ? তাদের সাথে আমাদের বিশ্বাসের পার্থক্য কোথায়——-কুরআনের আলোকে এই বিষয়গুলোতে আলোকপাত করা হচ্ছিলো এই সিরিজটাতে। প্রথম থেকেই লেখাগুলো প্রচুর পাঠকপ্রিয়তা পায়। কিন্তু ওই যে বললাম চঞ্চল স্বভাব! অনেক কিছুই শুরু করে শেষ করতে না পারা ওর মজ্জাগত অভ্যাস। তাই লেখাটা ও মোটেও একবারে শেষ করে নি। ইন ফ্যাক্ট আমার ধারণা লেখাটা আদৌ শেষ হত না যদি না বহু মানুষ ওকে অনেক উৎসাহ দিত, বলতো এই বই পড়ে কুরআনের সাথে তাদের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। অবশ্য এই লেখাটা লিখতে অনেক পড়াশোনা আর পরিশ্রম করতে হত। অসংখ্য লেকচার, বই, ভিডিও থেকে তথ্য নিয়ে অবশেষে হামিদা বইটা লেখা শেষ করে ২০১৭ সালে। এর মাঝে সে মালয়শিয়াতে মাস্টার্স করেছে, IOU তে ফ্যাকাল্টি হিসেবে ২ বছর পড়িয়েছে, IOU তে নিজের ব্যাচেলরটা শেষ করেছে, USA তে গিয়েছে, সেখানে পিএইচডি শুরু করেছে ইত্যাদি।

২০১৮ তে সে যখন এটার এডিটিং শেষ করে, তখন আমাদের ইলমু সোনাকে পেটে নিয়ে ও এই কাজ করেছে! এক সাথে এই চৌদ্দটা কাজ করার স্বভাব আবার সে পেয়েছে আমাদের আম্মার থেকে! আম্মাকে আমরা ছোটবেলা থেকে দেখেছি একসাথে অনেক কিছু ম্যানেজ করছেন, কলেজে ক্লাস নিতে যাওয়ার আগে যেটা পড়াবেন সেটা ৪-৫টা বই থেকে পড়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

তবে একটা লেখা ফেসবুকে প্রকাশ করা আর বই হিসেবে প্রকাশ করার মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য। পাঠকদের উৎসাহে ফেসবুকে লেখাটা শেষ করলেও বই হিসেবে প্রকাশের ব্যাপারে একটু দ্বিধাগ্রস্তই ছিলো হামিদা। কিন্তু প্রচুর অফার আসতে থাকায় একসময় ও রাজি হয়, শর্ত ছিলো যে বইটা একাধিকবার শরীয়াহ সম্পাদনা করা হবে।

বই হিসেবে প্রকাশের সিদ্ধান্ত ফাইনাল হবার পর হামিদা আমাকে দায়িত্ব দেয় একজন ‘সমালোচকের’ চোখ দিয়ে বইটা পড়ার জন্য। ও আমাকে বলেছিলো ‘তোকে এক মাস সময় দেয়া হল আপা, প্রতিদিন ১০ পেইজ করে পড়বি কিন্তু!’ বলাই বাহুল্য আমি হামিদার গুণমুগ্ধ পাঠক তো নইই, বরং ওর লেখার কঠোর সমালোচক। তাই এই দীর্ঘ বই পড়ার ব্যাপারে আমি তেমন আগ্রহ দেখালাম না। তথন ও কিছুটা অভিমান ভরা কন্ঠে বলল, “আমি এত বছর ধরে এত রেফারেন্স ঘেঁটে বইটা লিখতে পারলাম, আর তুই পড়তে পারবি না?”  That line touched my heart and I started reading the pdf copy from the next day.

বলতে দ্বিধা নেই, বইটা আমি মাত্র ৩ দিনে রুদ্ধশ্বাসে পড়ে শেষ করেছিলাম! বইটা পড়তে পড়তে আমি যতটা না এর ভিন্নধর্মী টপিকসে চমৎকৃত হচ্ছিলাম তার চেয়েও বেশি অবাক হচ্ছিলাম এটা ভেবে যে এটা আমাদের সানির লেখা!!  আমার বারবার মনে পড়ছিল ছোট্ট সানির কথা,  যাকে পড়তে বসানোর জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হতো, কোনো কিছু নোট করার জন্য বার বার কাটাকাটি করতে হলে বা বেশি বই ঘাটাঘাটি করতে বললে রাগ করে উঠে চলে যেত। তারপর অনেক সাধ্য সাধনা করে আদর করে, কোলে বসিয়ে তারপর তাকে আবার পড়তে বসাতে হত। আমি  অবাক হয়ে ভাবছিলাম সেই মেয়েটি কিভাবে ৪ বছর যাবৎ ধৈর্য্য ধরে ,এত এত রেফারেন্স পড়ে এত দীর্ঘ একটা বই লিখতে পারলো!! এতটা মনোযোগ আর এতটা জ্ঞানস্পৃহা সে কিভাবে পেল!!!

নিশ্চয়ই সবই আল্লাহর ইচ্ছা আর অদৃশ্য কোনো কার্যকরণের ফলাফল এটা। ঐ যে সেই অমূল্য উপহার আব্বা আমাদের জন্য রেখে গিয়েছিলেন এটা নিশ্চয়ই তারই ফলাফল। তাই বইটা পড়া শেষ হওয়া মাত্র আমি দুআ করলাম, “ হে আল্লাহ ! তুমি সানির এই বইটাকে আব্বার জন্য সাদকায়ে জারিয়া হিসেবে কবুল করে নিও।”

এত দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনা করার পেছনের কারণ পাঠকদের কাছে এই মেসেজটাই পৌঁছে দেয়া যে ,আপনি যদি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আপনার সন্তানকে সাদকায়ে জারিয়া হিসেবে তৈরি করার সদিচ্ছা পোষণ করেন তবে শৈশবে তার পাফরম্যান্স দেখে হতাশ হয়ে যাবেন না। বরং দুআ করতে থাকবেন সেই সত্তার কাছে যিনি চাইলে যে কাউকে যে কোনো সময় হেদায়েত করতে পারেন, যে কাউকে মুসলিম উম্মাহর জন্য উপকারী যে কোন কাজ করার উসিলা হিসেবে বেছে নিতে পারেন।

আসলে মানুষের তৈরি Morning shows the day এই বাণী সবসময় সত্য নয় বরং আল্লাহ কখনও কারও আকুল দুআ ফিরিয়ে দেন না এটাই সার্বজনীন সত্য। মাঝে মাঝে মনে হয় আজ যদি আব্বা বেঁচে থাকতেন তবে তাঁর তিন সন্তানের অন্তত একজন যে একটা ইসলামিক বই লিখতে সক্ষম হয়েছে –এটা দেখে কতই না খুশি হতেন!!! হয়তো নিজেই প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে আত্মীয়, পরিচিতদের কাছে বইয়ের কপি পৌঁছে দিতেন !!

কিন্তু পরমূহূর্তেই মনে হয় Allah is the best timer. তিনিই হয়তো চান ব্যাপারটা সারপ্রাইজ হিসেবে পরকালে আব্বার সামনে উপস্থিত হবে। তিনি অবাক হয়ে দেখবেন তার মৃত্যুর এক যুগ পর তার দুবির্নীত মেয়েটি কিভাবে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করেছে!! তখন তিনি উপলব্ধি করবেন, যে দুআ ইহকালে কবুল হলো না বলে আফসোস করি তা পরকালে কত বহুগুণ বিস্ময় নিয়ে ফিরে আসে!!!

সবশেষে বোন হিসেবে নয়, বরং একজন অভিভাবক হিসেবে সবাইকে অনুরোধ করবো ‘শিকড়ের সন্ধানে’ বইটি কিনে নিজে পড়বেন, সন্তানের জন্য বাসায় এক কপি রেখে দিবেন যেন সে মুসলিম হিসেবে তার শিকড়ের সাথে পরিচিত হতে পারে।

আর সন্তানের জন্য দুআ করতে গিয়ে ধৈর্য্য হারাবেন না। নিশ্চয়ই দুআ কবুল হবে, আপনার জীবদ্দশায় অথবা মৃত্যুর পর। ইহকালে সাফল্য পাক বা না পাক, পরকালের জন্য যেন সবার সন্তান সাদকায়ে জারিয়া হতে পারে!!! আমিন।

হাবিবা মুবাশ্বেরা সাহিত্যিক।

আরও পড়ুন