Ads

নীল বিষাদ (১ম পর্ব)

জিনাত তাসনিম

তিথির মন আজ খুব খুব ভালো। ওর আজ প্রজাপতির মতো উড়তে ইচ্ছে হচ্ছে, গুনগুন করে গান গাইছে।জীবনের সব পাওয়া গুলো আজকের প্রাপ্তির কাছে তুচ্ছ মনে হচ্ছে। আজ সকালে হাসপাতাল থেকে আসার পর তিথি ভাবছে, হাসপাতাল থেকে এতো আনন্দ নিয়ে সে কখনো ফেরেনি।প্রিয় মানুষগুলোকে বারবার ফোন করে,কুশল জানতে চাইছে। কিন্তু যে আনন্দের কথাটি বলতে চায়,সেটা বলতে লজ্জাবতী লতার মতো নুয়ে পড়ছে।বলতে পারছে না।এইতো আসিফ অফিস যাবার পথে ওকে হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে গেলো।এখন বেলা দুটা বাজে।চারঘন্টা আগে তিথি ওর রিপোর্ট দেখেছে। আসিফকে পাঁচবার ফোনও করলো,কিন্তু আনন্দের সংবাদটি বলা হয়নি।তিথি আজ যত্ন করে খাবার খেলো,তারপর খুব সাবধানে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লো।আজ থেকে আর অনিয়ম নয়,নিজেকে নিজেই শাসালো।ভাবির কাছে শুনেছে, এসময় খুব নিয়ম করে, সাবধানে চলতে হয়।পেটে হাত দিয়ে বুঝতে চেস্টা করছে,এখানে একটা প্রাণের স্পন্দন আছে।এখানে তার বাবুটা আছে।তার আর আসিফের সন্তান।তিথির বিয়ে হয়েছে, একবছর হলো।প্রতিটা মাসেই তিথি এই কাঙ্খিত সময়টার জন্য অপেক্ষা করেছে। আসিফ অবশ্য সন্তানের ব্যাপারে কিছু বলে না।তিথি মাঝে মাঝে আসিফকে প্রশ্ন করে,শোনো তুমি বাবা হবে এটা শোনার পর তুমি কি করবে?আসিফ বলে-সে দ্যাখা যাবে পরে।আগে হোক।তিথি আবার শুধোয়,আচ্ছা তুমি ছেলে চাও না মেয়ে? আসিফ হাই তুলতে তুলতে বলে-সেটা পরে দেখা যাবে।এখন ঘুমাও।

এই ক্লান্ত দুপুরে তিথির কিছুতেই ঘুৃম আসছে না।আজ আসিফকে কিভাবে বলবে খুশির কথাটা?আসিফ কি করবে?তিথি ফিক করে হেসে ফেলে। ফোনটা হাতে নিয়ে আবার আসিফকে ফোন করে। রিং হচ্ছে, তিথির বুকটা ধুপ ধুপ করছে।আসিফ ফোন ধরলো।আসিফ-বলো,কোনো সমস্যা? বারবার ফোন করছো যে আজ?তিথি বলল-কি করো?আসিফ -কাজ করছি। তিথি-খেয়েছো? আসিফ-হু,খেয়েছি। কিছু বলবে?তিথি-না কিছু না।বাসায় আসবে কখন?আসিফ -ছুটি হলেই আসবো।জরুরি কিছু বলার না থাকলে ফোন রাখ।আর বারবার ফোন করো না,কাজের সমস্যা হয়।তিথি-ঠিক আছে,রাখি।তিথি ফোন রেখে ঘুমানোর চেস্টা করছে।ঘুৃম আসছে না।আচ্ছা ছেলে হলে কি নাম রাখা যায় আর মেয়ে হলে? নামের সাইটগুলো ভিজিট করেই দেখি।নাম… আ দিয়ে কি কি সুন্দর নাম আছে?লিস্ট করতে হবে।আসিফ তো সময়ই পায় না।পরে ওর সাথে আলোচনা করে একটা নাম ঠিক করলেই হবে। আচ্ছা, বেবিদের পেজগুলোতে দেখি তো কি কি আছে?বেবি পেজের জিরো সাইজ জামা দেখে আর হাসে তিথি।কি ছোট কি কিউট।ওর খুশিতে পানি চলে আসে চোখে।ইস,আসিফ থাকলে বেশ হতো?এ আনন্দ তো ওদের দুজনেরই।আবার ফোনটা হাতে নেয়।কিন্তু আসিফ তো ফোন করতে বারণ করলো।ঘড়ির দিকে তাকায় তিথি-চারটা বাজে।আরো দু’ঘন্টা। আসিফ ছ টায় আসে।বিছানায় আর ভালো লাগছে না।ভাবিকে একটা ফোন দেই।ভাবি ফোন ধরে বলল-কিরে তিথি কি খবর?ভালো আছিস? তিথি-হু,ভালো আছি খুব ভালো। ভাবি-বাপরে,তুই চাকরি পেয়েছিস, না…তোর বরের প্রমোশন?তিথি-এর চাইতেও ভালো কিছু, কিন্তু তোমাকে আগে বলবো না,সবার আগে আসিফকে বলবো।ভাবি-কি বলিস,আচ্ছা, বুঝছি,হুম,নতুন মানুষ আসবে নাকি?থাক,থাক আমাকে বলতে হবে না,আসিফকেই আগে বল।এই তিথি তোর মনে আছে,তানহা হওয়ার আগে আমি যখন তোর ভাইয়াকে বললাম -তুমি বাবা হবে।সে কি পাগলামী।আমাকে শাসন করা শুরু হলো,এটা করা যাবে না,সাবধানে থাকতে হবে,ডাক্তারের কাছে চলো,এটা খাও,এটা করো,বাপরে বাপ।নয় মাস কঠিন শাসন চললো।তিথি হেসে বলে-সব মনে আছে। আচ্ছা ঠিক আছে এখন রাখি।ভাবি-আচ্ছা,সাবধানে থাকিস।ফোন করবো পরে।।

তিথি এলো পায়ে আয়নার সামনে এলো,নিজেকে খুটিয়ে দেখছে।কোনো পরিবর্তন খুজে পাচ্ছে না।আবার গুগল এ সার্চ করতে বসলো-কি কি পরিবর্তন হয় এসময়? পরির্বতনগুলো পড়ছে,একই সাথে ভয় আর আনন্দের অনুভূতি হচ্ছে।হঠাৎ ঘড়িতে ছ টার ঘন্টা বাজলো।তিথি সমস্ত ভালো লাগা নিয়ে, দরজার সামনে এলো।ফোন টা বেজে উঠলো,আসিফের ফোন।তিথি ফোন ধরে হ্যালো, বলতেই আসিফ জানতে চায়,কিছু আনতে হবে? তিথি বলল-না,কিছু লাগবে না,তুমি বাসায় আসো?ফোন রেখে তিথি ডাইনিং এ বসে।ওর সব কিছু কেমন ঘোরের মতো লাগছে।সেই সংসার জীবনের প্রথম দিনের মতো।কিভাবে কথাটা বলবে আসিফকে।গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। তিথি পানি খেলো।ডোরবেলটা বাজছে।আসিফ এসেছে ।তিথি আড়ষ্ট পায়ে দরজার কাছে গেল।দরজা খুলেই তিথি ফিক করে হেসে দিলো।আসিফের প্রশ্ন-আজ এতো খুশি যে?তিথি আসিফের ক্লান্ত মুখে তাকিয়ে আবেগের রাশ টানে।বলে-আগে ফ্রেস হয়ে নাও।আসিফ রুমে চলে গেলো।তিথি ডাইনিং এ আসিফের খাবার গুছাতে গুছেতে শাওয়ারের শব্দ শুনছে।আসিফ ফ্রেস হয়ে ডাইনিং এ আসে।তিথি রান্না ঘরে আসিফের প্রিয় কড়া লিকারের চা বানাচ্ছে। এই চা টা আসিফ খুব পছন্দ করে। আবেগে ওর হাত কাপছে,নাকে শিশির বিন্দু।চায়ের কাপ হাতে তিথি দরজায় দাড়ালো।এখান থেকে আসিফের পিঠটা দেখা যাচ্ছে। তিথি জড়ানো কন্ঠে বলে-তুমি হাসপাতালে দিয়ে এলে,আর তে কিছু জানতে চাইলে না।আসিফ মুখটা ঘুরিয়ে বলে-ভুলেই গেছিলাম,কি ব্যাপার বলো তো?তিথি টেবিলে রাখা রিপোর্ট টা দেখিয়ে দেয়।আসিফ রিপোর্ট পড়ে,তিথিকে বলে-মানে?তুমি প্রেগন্যান্ট? বলকি?তোমাকে কতবার সাবধান থাকতে বলেছি।সামনে অনেক সময় আছে, এখনো নিজের ক্যারিয়ার ঠিক মতো গুছাতে পারিনি,আর তুমিও তো একটা জবের ট্রাই করছো।কিছু দিন চাকরি করো।তিথি শূন্য চোখে আসিফের দিকে চেয়ে আছে।সেখানে কোনো আবেগ বা আনন্দ দেখতে পেলো না।বিরক্তিতে ওর কপাল কুচকে আছে।আসিফ আবার বলে-এখন বাচ্চা নেয়া সম্ভব না।কাল হাসপাতালে গিয়ে একটা ব্যবস্থা করতে হবে।তিথির হাত থেকে চায়ের কাপটা পড়ে গেলো।পায়ের কিছুটা অংশ কেটে গেলো।কিন্তু সে ব্যাথাটা ও বুঝতে পারছে না।চোখের পানিতে সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।আস্তে আস্তে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো তিথি। পিছনে আসিফের রাগ ঝরা কন্ঠ কানে এলো-আশ্চর্য!আমি তোমাকে বাস্তবতা টা বুঝাতে চেয়েছি।তুমি এভাবে রিএক্ট করছো কেন? আর কিছু শুনতে পারছে না তিথি।শুধু বুকে একটা চাপা কষ্ট ছাড়া।নীল বিষাদে ছেয়ে গেল মন ।

(চলবে)

লেখকঃ সাহিত্যিক

আরও পড়ুন-

দাম্পত্য সিরিজঃ অরাজনৈতিক ঝগড়া (পর্ব-৭)

আরও পড়ুন