Ads

সুখের সন্ধানে

।। আব্দুল্লাহ আরমান ।।

“আমার বউ আমার ইনকাম করা টাকায় চলে” বাক্যটি বর্তমান নারী অধিকারের প্রেক্ষাপটে খানিকটা ঝাঁঝালোই মনে হয়। সত্যি বলতে এই কথার মাঝে পুরুষের যেমন অহংকার ও গৌরব করার কিছু নেই তেমনি ‘স্বামীর টাকায় চলা’ নারীর জন্য লজ্জা কিংবা অসম্মানেরও কিছু নেই। কারণ মুসলিম পুরুষ হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি আমাদের সহধর্মিণীর যাবতীয় খরচ বহন করা আমার জন্য ইবাদত ও আসমানী দায়িত্ব। এই ইবাদত ও কর্তব্যের ক্ষেত্রে ত্রুটি হলে আমাকে অবশ্যই জবাবদিহিতা করতে হবে মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর সামনে। সুতরাং ইবাদত করে অহমিকা প্রকাশ করলে তা কি আর ইবাদত থাকে?
স্বামীর টাকায় জীবনযাপন একজন নারীর আল্লাহ প্রদত্ত অধিকার। যারা ‘অধিকার’ শব্দের অর্থ জানেন তারা ঠিকই বুঝবেন হক বা অধিকারের সাথে লজ্জা বা সম্মানহানির দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের বৈধ নাগরিক হিসেবে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় সুযোগসুবিধা গ্রহণ করতে আমরা যেমন লজ্জা পাই না তেমনি স্বামী ও সন্তানের টাকায় আজীবন ভরণপোষণ লাভ করাও লজ্জার কোনো বিষয় নয়, বরং এটা সম্মানের। ‘দায়িত্ব ও অধিকারের’ এই সরল সমীকরণ যাদের হৃদয়ঙ্গম হবে না তাদের কাছে এই পবিত্র সম্পর্কের প্রকৃত ম্যাকানিজম চিরদিন অজানাই থেকে যাবে।

 

৯৩,০০০+ হাজার ফলোয়ারের অধিকারিণী একজন লেখিকা কিছুদিন আগে গৌরব করে লিখেছেন, “আমি মোট ১৯টা দেশে ঘুরেছি এবং নিজের ইনকাম করা টাকায় ঘুরেছি। শুভ, মানে আমার হাজবেন্ড এবং আমি যখন কোথাও ঘুরতে যাই তখন পাই পাই হিসাব থাকে। ট্যুর শেষে আমার টুরের খরচ আমি দেই, শুভরটা শুভ দেয়। আমার পায়ের স্যান্ডেল থেকে আমার ফ্ল্যাট, আমার গাড়ি আমার কেনা…. সক্ষমতা না থাকলে ট্যুরে যাবো না, কিনব না , দরকার হলে পুরাতন টপস দিয়েই বছরের পর বছর কাটিয়ে দেব, কিন্তু কারো কাছ থেকে নেব না…..মেয়ে মানুষের তেজ থাকতে হয়, জেদ থাকতে হয়, আর আত্ম-সম্মানবোধ প্রখর হতে হয়। যে মেয়ের মেরুদণ্ড সোজা থাকে, যে নিজের পয়সায় কেনা শাড়ি পরে, নিজের পয়সায় ট্যুর দিয়ে, বরফের পাহাড়ে দাড়িয়ে নিজের পয়সার কেনা ক্যামেরাটা জামাই এর হাতে দিয়ে বলতে পারে, ছবি তুলে দাও তো। সেই মেয়ে কে ভেঙে দেয়া সম্ভব না, তাকে ফেলে দেয়া সম্ভব না, তাকে চাইলেই বলে ফেলা যায় না,…………আমি দেই বলেই , এত ফুটানি করতে পার !”

 

লেখিকা ওনার সক্ষমতা ও ব্যক্তিত্ব বোঝাতে গিয়ে তার প্রিয় স্বামীকে ছোট করেননি তো? স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে গিয়ে ‘পাই পাই’ করে হিসাব রেখে স্ত্রীর কাছ থেকে টাকা বুঝে নেওয়া কিংবা কোনো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষের কাজ?! আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ স্বামীও এই কাজ করতে লজ্জা পাবে। দাম্পত্য সম্পর্কের মাঝে আর্থিক বিষয়ে ‘পাই পাই’ সম্পর্ক থাকলে সেটাকে দাম্পত্য সম্পর্ক না বলে কমার্শিয়াল সম্পর্ক বললে অত্যুক্তি হবে কি?

 

লেখিকা আরও বলেছেন, নিজের টাকায় কাপড় কিনতে না পারলে বছরের পর বছর পুরাতন কাপড়েই কাটিয়ে দেবেন। দাম্পত্য সম্পর্কটা কি আসলেই এমন চ্যালেঞ্জিং! সাংসারিক জীবনে পুরুষরাও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। কোনো না কোনোভাবে তারাও নারীদের উপর নির্ভরশীল। আমাদের পারস্পরিক এই মধুর নির্ভরতা কি আসলেই অন্যায়, অপরাধ, অনৈতিক ও অসম্মানের? যদি তাই হয় তাহলে লিভ টুগেদারের সাথে দাম্পত্য সম্পর্কের পার্থক্য কোথায়?

 

তিনি আরও বলেছেন, যে নারীরা নিজের টাকায় জীবন চালায় তারাই সত্যিকারের তেজস্বিনী, জেদি ও মেরুদণ্ডসম্পন্ন নারী। তাহলে স্বামীর ইনকামে সন্তুষ্ট থেকে যারা নিজেদের চাহিদা ও জীবনাচরণকে সাজিয়ে নেন তারা মেরুদণ্ডহীন নারী? নিজের সম্মান বাড়াতে গিয়ে পৃথিবীর সকল গৃহিণী মা-বোনদের তিনি হেয় করলেন না তো?

 

আসলে নারী অধিকারের আড়ালে এটা মূলত পুঁজিবাদেরই জয়গান। কারণ পুঁজিবাদ সকল কাজ ও সম্পর্ককে কমার্শিয়াল দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে। তাই বসের অধীনে থেকে, উর্ধ্বতন কর্মকতাদের কটুবাক্য হজম করে, রাস্তাঘাটে পরপুরুষদের কামুক দৃষ্টি সহ্য করে, অফিসিয়াল চাপ ও দায়বদ্ধতা নিয়ে সারামাস কাজ করে সামান্য যে টাকা বেতন পান সেটাই তাদের নিকট সত্যিকারের সম্মান, সত্যিকারের স্বাধীনতা! স্বামীর সংসারে নিঃস্বার্থ ও বিনামূল্যে ডেডিকেশন যদি নারীর জন্য দুর্বলতা অসম্মানের হয় তাহলে আমরা পুরুষরা নিঃস্বার্থভাবে আজীবন পরিবারের ভরণপোষণের জন্য নিজেদের জীবন, শরীর ও মেধাকে বিলিয়ে দিচ্ছি, এটাও অসম্মানের?

 

আসলে আমাদের অনেকেই দাম্পত্য সম্পর্ককে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হই, তাই এসব সীমাহীন কুতর্কে লিপ্ত হই। এই সম্পর্ক কোনো প্রতিযোগিতা নয়, তাই এখানে অহেতুক চ্যালেঞ্জ, হার-জিত, লাভ-লোকসানের প্রসঙ্গ আনাই অযৌক্তিক। সম্পর্কটা হলো ভালোবাসা, সম্মান, ত্যাগ, সৌজন্যতা, দায়িত্ববোধ, নিঃস্বার্থ মনোভাব ও আন্তরিকতার। এই গুণগুলো অর্জন এবং পারস্পরিক মূল্যায়নে যে দম্পতি যতটা পিছিয়ে তারা ততটাই অসুখী, হিসাবটা একেবারেই সিম্পল।

 

প্রাসঙ্গিকতার কারণে নিজের দাম্পত্য জীবনের ছোট্ট স্মৃতি শেয়ার করতে চাই। একদিন আমার সহধর্মিণীকে এমনিতেই বলেছিলাম (যতদূর মনে পড়ে), “গ্রাজুয়েশন তো শেষ, চাকুরী করবে?” ও একটু শক্ত করেই জবাব দিলো, “আমি চাকুুরী করতে যাবো কেন! ওটা আপনার কাজ, আপনিই করবেন। আমি দো’আ করবো যেন আল্লাহ আপনার ইনকাম বাড়িয়ে দেন”। শক্ত ভাষার ওর জবাবটা আমার দারুণ লেগেছিলো। ইসলামের দেওয়া অধিকার ও সম্মানের ব্যাপারে নারীদের এমন সচেতন হওয়া চাই।
আরেকদিন ওকে বললাম, প্রতিমাসে তোমাকে আলাদাভাবে (নির্দিষ্ট সংখ্যার) হাতখরচ দিতে চাই। সে জবাব দিয়েছিলো, “টাকা দিয়ে আমি কি করবো! আমার যা প্রয়োজন তাতো আপনি দিচ্ছেনই। আলাদা করে দেওয়ার প্রয়োজন নেই”।

 

এরপরও আমি যেটুকু দেই ঘুরেফিরে ওটা সংসারের কাজেই লাগায়। সত্যি বলতে ওর কাছে ব্যক্তিগতভাবে ১০০ টাকাও জমা নেই। আমার প্রতি এই আস্থা তার দুর্বলতা নাকি উদারতা? পুঁজিবাদের দৃষ্টিতে আমার সহধর্মিণী দরিদ্র, অসুখী, বোকা, বঞ্চিত, বেকার ও মেরুদণ্ডহীন নারী। আসলেই কি তাই?

 

ভালোবাসার যেমন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই তেমনি সুখী দাম্পত্য জীবনেরও কোনো সংজ্ঞা নেই। কারণ সংসার ও ভালোবাসা মূলত একই সত্তার দুটি আলাদা নাম। লেখিকা যেভাবে সুখে আছেন সেটাই যে সুখের প্রকৃত রূপরেখা তার ভিত্তি কোথায়? আজ সারা বিশ্বে আশংকাজনকভাবে বিবাহবিচ্ছেদের ক্রমবর্ধমান হারই প্রমাণ করে আমরা ভুল পথে হাঁটছি। কোথাও একটা শূন্যতা অবশ্যই আছে। বৈষয়িক বিষয়ে আমাদের উত্তরোত্তর উন্নতি, নারীদের কর্মসংস্থান সবই বাড়ছে তবু কেন আমরা বিবাহবিচ্ছেদের উর্ধগতি ঠেকাতে পারছি না?
আমার মনে হয় সেই শূন্যতা আমাদের নারী ও পুরুষদের মানসিকতায় । তাই অর্থোপার্জনকে সুখের একমাত্র মানদণ্ড না বানিয়ে আমাদের মানসিক সংস্কারে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন, নইলে আজীবন সুখের সন্ধান করলেও সুখ চিরদিন অধরাই থেকে যাবে।

 

লেখকঃ শিক্ষক, সাহিত্যিক ও ইসলামী বিষয়ে কলাম লেখক 

 

 

লেখকের আরও লেখা পড়ুন- অশ্রুর আড়ালে

 

 

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়ন মূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিন।

এবং প্রিয় লেখক ! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected]

প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

 

আরও পড়ুন