Ads

অশ্রুর আড়ালে

।। আব্দুল্লাহ আরমান ।। 

 

বাড়িতে আসতেই রাবেয়ার মা বললো, “মাইয়্যাডা (রাবেয়া) কল করছিলো। জামাই নিয়া কাইল বেড়াইতে আইবো। ঘরে কয়ডা চাউল ছাড়া আর কিচ্ছু নাই। কাইল থেইক্যা আপনারে বাজার করার কথা কইতাছি……. ”।

 

আমার পাঁচ সন্তানের মাঝে রাবেয়া সবার বড়। রুপবতী-গুণবতী মেয়েটা আমার অনেক অভাব ও কষ্টে বড় হয়েছে। তবে স্কুল শিক্ষকের সাথে বিয়ে হয়ে আল্লাহর দয়ায় এখন সুখেই আছে। আমার মতো নেহায়েত গরীব মানুষের মেয়ে এমন ঘরের বউ হয়েছে এজন্য হাজারবার আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি।মেয়েটা বহুদিন হলো এখানে আসেনি। জামাইয়ের সাথে শহরে থাকে। ওকে দেখার জন্য মনটা খুবই আনচান করছিলো। একবার ভেবেছিলাম ওকে গিয়ে দেখেই আসি। কিন্তু মেয়ের বাড়ি যাওয়ার জন্য দু’হাত ভরে খরচের সামর্থ্য না থাকায় ইচ্ছেটা অঙ্কুরেই মরে গিয়েছে। আমার পিতৃ স্নেহ দারিদ্র্য আর সামাজিকতার কাছে হার মেনেছে।

 

এতদিন পর মেয়েটা আসার কথা শুনে আমার খুশি হওয়ার কথা কিন্তু মাথায় যেন চিন্তার আকাশ ভেঙে পড়লো। কামাই-রোজগার একেবারেই বন্ধ প্রায়। হাজী সাহেবের হোটেলে কাজ করে দিন হাজিরা হিসেবে দৈনিক যা পাই তা দিয়ে সংসার চালানো খুবই কষ্টের। রমজানে দিনের বেলা হোটেল বন্ধ থাকায় বেতন অর্ধেক কমেছে। হাতে যে কয়টা টাকা আছে তা দিয়ে বড়জোড় কেজি পাঁচেক চাল কেনা যাবে। মেয়ে জামাইকে উপযুক্ত মেহমানদারি করার মতো টাকা আমি কোথায় পাবো!

 

বাঙ্গালী স্বামী হিসেবে স্ত্রীর কাছে টাকা চাওয়া খুবই লজ্জার ব্যাপার। তবু চক্ষুলজ্জা ত্যাগ করেই বললাম, “ রাবেয়ার মাও, তোমার কাছে ট্যাকা-পয়সা কিছু আছে? মোর হাতডা একদম খালি। থাকলে দেও, বাজার থেইক্যা ঘুইরা আহি….”।
“পোলা-মাইয়াগোর কাপড়চোপড়ের দিকে তাকন যায় না। পুরান কাপড় পইরা স্কুল যাওনের সময় ছোড পোলাডা খালি কান্নাকাটি করে। মাইয়্যাডাও শেয়ানা হইতাছে। আমাগো অভাব দেইখ্যা কাপড়ের কথা মুখ ফুইট্যা কয় না। তাও সেদিন নামাজ পড়নের লাইগ্যা একটা বড় ওড়না চাইছে। ঈদের আগে পোলা-মাইয়্যাগো জন্য কাপড় কেনোনের লাইগ্যা কয়ডা ট্যাকা জমাইছি। ঐ ট্যাকাও আপনারে দিয়া দিলে কাপড় কিনুম কি দিয়া….!” কথাগুলো খানিকটা রাগের সুরেই বললো রাবেয়ার মা।

 

মা হিসেবে তার এই রাগ, এই অভিমান মোটেও অযৌক্তিক নয়। আমার যা ইনকাম তা দিয়ে ছয় সদস্যের পরিবারে ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করাই দুঃসাধ্য! বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ ও নতুন পোশাক আমার জন্য বিলাসিতাই বটে। ছেলেমেয়েদের কাপড় খুব একটা কেনার সুযোগ-সামর্থ্য হয় না। অন্যের কাঁথা সেলাই, গরুর গোবরের ঘুঁটে, শাক-সবজি ও হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করা টাকা জমিয়ে রাবেয়ার মা নিজের ও সন্তানদের জন্য কাপড় কেনে। উপুর্যুপরি সন্তান জন্ম হওয়ায় অপুষ্টি আর দিন-রাত সাধ্যাতীত পরিশ্রমের কারণে ওর শরীরে সর্বক্ষণ অসুস্থতা আর ক্লান্তির ছাপ লেগেই থাকে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করে ওর মুখের ঘাম মুছে দিয়ে দুই কাঁধ জড়িয়ে বলি, “এই গরীবের সংসারে খুব কষ্ট অইতাছে, তাই-না রাবেয়ার মা…?”। বলতে গিয়েও পারি না। শরম করে, ইতস্তত বোধ হয়। দারিদ্র্যের ঘুণপোকা আমাদের ভালোবাসা প্রকাশের অনুভূতিগুলো যেন নিঃশেষ করে দিচ্ছে। দারিদ্র্য আমাদের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশের অন্তরায় হলেও দু’জনের অব্যক্ত ভালোবাসা দু’জন ঠিকই বুঝতে পারি। এত কষ্টের মাঝে এই নীরব প্রেমটুকুই আমার সংসার টিকে থাকার অবলম্বন।

 

অভাব পুরুষের পুরুষত্ববোধ, বীরের বীরত্ব, সম্মানীর সম্মানবোধ, কর্তার কতৃত্ব, দায়িত্বশীলের দায়িত্ববোধ আর লাজুকের লজ্জা ও আত্মসম্মানবোধকে নিমিষেই মিটিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তাই আমিও মাথা নিচু করে সকল লজ্জা ঝেড়ে ফেলে বললাম, “দেও, ঐ ট্যাকাগুলোই দেও। পুরান কাপড় দিয়াও তো সম্মান ঢাকোন যায় কিন্তু ভালোভাবে মেহমানদারি করতে না পারলে মেয়ে জামাইয়ের কাছে আমার ইজ্জত বাঁচামু কি দিয়া,কও?”…. আমার এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দেওয়া হয়তো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। জীবনের কিছু প্রশ্নের আসলেই কোনো উত্তর থাকে না। রাবেয়ার মা’ও জবাব খুঁজে না পেয়ে বড় নিঃশ্বাস ফেলে টাকাগুলো বের করে দিলো, দিতে বাধ্য হলো! আমিও বেশরম বিজেতার মতো টাকাগুলো জয় করে হৃদয়ে নির্দয় উল্লাস নিয়ে বাজারের পথে রওনা হলাম…..!

 

সামনে ঈদ। মেয়ে জামাইকে ঈদ হাতখরচ, কাপড় ও ঈদের বাজার বাবদ কিছু টাকা পাঠাতে হবে। শ্বশুড়বাড়িতে মেয়ের মুখ রক্ষায় এই টাকা দিতে আমার মতো গরীবদের স্বেচ্ছায় ঋণের তরবারীর নিচে মাথা দিতে হয়। কিন্তু সেই উপায়ও আমার নেই! কারণ যাদের ঋণ পরিশোধের উপায় নেই তাদের কেউ ঋণও দিতে চায় না।
রাবেয়ার মা রান্নাঘরের খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে মাটিতে বসে আছে। অভাব আর দুশ্চিন্তার সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে ও যেন আজকাল হাসতেও ভুলে গেছে। তবে জায়নামাজ ছাড়া ওকে কখনও কাঁদতে দেখিনি। জায়নামাজ সিক্ত করা ওর চোখের জল দেখে আমি শক্তি পাই। আমার বিশ্বাস এমন নির্ভেজাল আকুতি ও চোখের জল কখনোই বৃথা হবার নয়। কোনো একদিন এই দুর্দিন ঘুচবে ইন শাআ আল্লাহ।

 

রাবেয়ার মায়ের পাশে গিয়ে বসে বললাম, “ভাবছিলাম কালো বকরিটা কুরবানি ঈদে বেচমু। কিন্তু এখনই বেচন ছাড়া ট্যাকা যোগাড়ের আর কোনো উপায় পাইতেছি না। বকরিটা বেচুম? তুমি কি কও?”

 

রাবেয়ার মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুধু একটা কথাই বললো, “কোরবানি ঈদে তো ট্যাকা আরও বেশি দরকার, তখন অত ট্যাকা কই পাইবেন?!”
বুকে জোর নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম,“ তুমি খালি জায়নামাজে বইস্যা দোআ কইরো, দেইখো আল্লাহ ঠেকাইবো না, ইন শা আল্লাহ”।
ছাগল বিক্রির টাকা দিয়ে কাঁচাবাজার, কেজিখানেক খোলা সেমাই,চিনি, একটা ব্রয়লার মুরগী আর ছেলেমেয়েদের জন্য হকার্স মার্কেট থেকে কিছু কাপড় কিনলাম। বাকী টাকা জামাইকে বিকাশে পাঠিয়ে দিলাম।

 

নতুন জামা পেয়ে বাচ্চাদের খুশি দেখে হৃদয়টা জুড়িয়ে গেলো। রাবেয়ার মা বললো, “আপনের একটা পাঞ্জাবি কিনতেন। কয়েক বছরের পুরান পাঞ্জাবি পইরা নামাজে যান, দেখতে আমার ভাল্লাগে না”।
“সরম দিতাছো রাবেয়ার মাও? তোমারে নতুন কাপড় দিতে পারি না কতদিন থেইকা কও? যেদিন তোমার জন্য কিনতে পারুম সেইদিন আমিও কিনুম”, সলজ্জ হেসে কথাগুলো বললাম।
আমার কথাগুলো শুনে রাবেয়ার মা মুচকি হেসে আমার চোখের দিকে তাকালো। ঐ চোখের ভাষা আমি বুঝি। আমার কথায় ওর শুকনো মুচকি হাসি আর ছলছল অপলক দৃষ্টিতে যেন প্রেমানন্দ ও কৃতজ্ঞতা ঠিকরে পড়ছিলো।

 

মেয়ে জামাই কল করেছিলো। ঈদের পরদিন ওদের বাড়িতে দাওয়াত। রাবেয়াও ভাইবোনদের নিয়ে খুব করে যেতে বললো। আমি শুধু বলেছি, “দেখি মা, যামু”।
একে-তো নতুন কাপড় তার উপর বোনের বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনে ছেলেমেয়েদের আনন্দ আর বাঁধ মানছে না। ওদের শিশুমন তো বোঝে না দরিদ্রদের জন্য দাওয়াতে যাওয়া যতটা না আনন্দের তার চেয়ে বেশি কষ্টের। কারণ দু’হাত ভরে খরচ না করে, ভালো কাপড় না পরে কুটুমবাড়ি যাওয়া যে বড়ই বেমানান!
ঈদের পরদিন বেয়াই সাহেব কল করে বললেন, “কি বেয়াই সাহেব কখন আইবেন। বিকাল গইড়া যাইতাছে, আসতাছেন না যে। তাড়াতাড়ি আহেন, আপনের লগে মেলা গপ্প জইমা আছে…!”

 

বললাম, “বেয়াই আর কইয়েন না, সকাল থেইকা প্যাট ভীষণ খারাপ। শরীরডাও দুর্বল দুর্বল লাগতাছে। যাওনের খুবই ইচ্ছা আছিলো। এই শরীর লইয়া বাইর হওনের সাহস পাইতাছি না। সামনের ঈদে যাইয়া গপ্প করুম, এবারের মতো আমার ছাইড়া দ্যান বেয়াই…..”।

 

পাশেই বড় ছেলেটা দাঁড়িয়ে আমার কথা শুনছিলো। কথা শেষ হলে ভ্রু কুঁচকে বললো, “বাবা! মিছা কতা কইলা ক্যান। তোমার শরীর তো ভালাই আছে!”
সবসময় ছেলেদের সত্য বলার উপদেশ দেই। অথচ ছেলের সামনে মিথ্যা বলে ধরা খাওয়ায় লজ্জায় পড়ে গেলাম…..হঠাৎ বুকফাটা কান্না আসলো। কোনোমতে কান্না সামলিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম, “হ বাপ মিছা কতা কইছি। আমার মনের উদ্দেশ্য কাইন্দা কাইট্যা আল্লাহরে বুঝাইয়া মাফ চাইয়্যা লইমু। আল্লাহ দয়ার সাগর। আমার বিশ্বাস, আল্লাহ আমার চোখের পানির আড়ালে লুকানো কষ্ট বুঝবো, আমারে মাফ কইরা দিবো। কারণ কেবল আল্লাহই জানে গরীব মানুষ যেমন সহজে মিছা কতা কয় না তেমনি সহজে কান্দেও না। কিন্তু তোর বোনের বাড়ির লোকদের আমার পকেটের অবস্থা ক্যামনে বুঝ দিমু, ক বাপ……?

 

লেখকঃ শিক্ষক, সাহিত্যিক ও ইসলামী বিষয়ে কলাম লেখক 

 

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়ন মূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিন।

এবং প্রিয় লেখক ! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected]

প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন