Ads

স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে কি দিবস লাগে ?

।। জামান শামস ।।

স্ত্রীকে ভালোবাসার জন্য, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য কি দিবস লাগে ? কেন এমন অদ্ভুত দিবসের প্রশস্তি ? গত রোববার ফেবু জুড়ে “স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা” দিবসের আর্জি ও আবেদন লক্ষ্য করলাম। এতে আমি কিছুটা পুলকিত হলেও উদ্বিগ্ন না হয়ে পারিনি। প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের তৃতীয় রোববার যুক্তরাষ্ট্রে স্ত্রীর প্রশংসা দিবস উদযাপিত হয়। ২০০৬ সালে দেশটিতে প্রথম দিবসটি উদযাপিত হয়। তারপর থেকে এটি অনেক দেশে পালিত হয়ে আসছে। তবে, দিবসটি নিয়ে খুব বেশি তথ্য জানা না গেলেও মনে করা হয়, স্ত্রীর প্রশংসা দিবসটি মূলত স্ত্রীদের সম্মান জানানোর জন্য উদযাপন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতি ও পরিবার ব্যবস্থা আমাদের থেকে ভিন্ন,কোথাও পুরোপুরি বিপরীত। সেখানে স্বামী-স্ত্রী নিখাঁদ ভালোবাসা দুষ্প্রাপ্য। সেরকম সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী মানুষেরা সারাবছর বউ পেটালেও আজ একদিন বউয়ের প্রশংসা করে মুখ রক্ষা করতে চান।

ছেলে মেয়ে বয়ঃসন্ধিকাল আগমনের আগেই পরষ্পর বন্ধুত্ব হয়। এরপর আঠারোর আগে বিপরীত লিংগের সংগীর সাথে নিভৃতচারী হয়। বিবাহের পূর্ণ স্বাদ আস্বাদ গ্রহন করে।দু’চারটি সন্তান জন্ম দেওয়ার পর মনে পড়ে আমরা তো বিয়েই করিনি।কেউ রেডিমেড সন্তানাদি নিয়ে বিবাহ বিহীন পূরো জীবনই কাটিয়ে দেয়।আমরা যেটাকে যেনা ব্যভিচার বলি সেটা সেখানে কোন অপরাধই নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বামীরা স্ত্রীদের চেয়ে বেশি পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে থাকেন। সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিবাহিতদের মধ্যে স্ত্রীকে লুকিয়ে অন্য নারীদের সাথে পরকীয়ায় আবদ্ধ এমন পুরুষের সংখ্যা নারীদের চেয়ে দ্বিগুণ। কেবলমাত্র মুসলিম দেশগুলো ছাড়া দুনিয়ার কোন দেশে পরকীয়াকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয় না। এখন আপনিই ভাবুন,যেসব দেশে বিবাহ ব্যতীত পুরুষ নারীর সম্পর্ক স্বীকৃত সেসব দেশে স্বামীই কি আর স্ত্রীই কি,কারোই পরিবার নিয়ে ভাবনা নেই। স্ত্রীর স্বীকৃতি থাকলে তো মর্যাদা ও সম্মানের কথা। যে দু’চারটি বৈধ ও পবিত্র দাম্পত্য বন্ধন টিকে আছে,সেখানে পরষ্পরের জন্য অঢেল মায়া আছে।তাদের ভালোবাসা প্রতিদিন,প্রতি ক্ষনের।

আরও পড়ুন-ব্যভিচারের বিস্তৃতি বিয়ের প্রয়োজন বিলোপ করছে কি?

ইসলামে বিবাহের মাধ্যমে স্বামী ও স্ত্রী মিলে একটি পরিবার গড়ে উঠে । পরিবারে উভয়ে কন্ট্রিবিউট করে। কেউ বাইরে রুটি রুজির সন্ধানে, আর কেউ অভ্যন্তরে সব গুছিয়ে রাখে। আবার কোথাও দু’জনেই ভিতর বাহির সমানভাবে সামলান। আপনি আলাদা করে স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই পারেন, করতে পারেন তার একটু প্রশংসা। প্রশংসা পেলে যে কোনো মানুষই একটু খুশি হয় । কিন্তু একজন স্ত্রীর নিকট স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া প্রশংসার মূল্য অন্যরকম। অনেক স্বামীই আছেন, যারা স্ত্রীর প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেন, খুঁত খুঁজে বেড়ান। তবে অনেক পুরুষ আছেন, যারা সব কাজেই স্ত্রীর প্রশংসা করেন। এতে সম্পর্কও ভালো থাকে। সংসারের সুখ বাড়িয়ে তুলতে বিভিন্ন কাজে স্ত্রীর প্রশংসা করা যেতেই পারে। এতে স্ত্রীর মন ভালো থাকবে এবং আপনার প্রতি তার সম্মান ও ভালোবাসা বাড়বে। এর জন্য তো দিন ঠিক করার দরকার নেই। তবে কি সেটা মেকী হয়ে গেলো না ? আমেরিকানরা স্ত্রীকে সাধারনত কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ দেয় না বলে দিন তারিখ ঠিক করে। আপনারও কি তেমন ?

আপনার বিয়ের বয়স এক বছর, দশ বছর বা ৫০ বছর- যাই হোক না কেন, অবশ্যই স্ত্রীর প্রশংসা করা উচিত। তাহলে তিনি বুঝতে পারবেন তিনি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিছু পুরুষের কাছে এটি স্বাভাবিক মনে হলেও, কারো জন্য আবার খুব কঠিন হতে পারে। দিবসটি উদযাপনের বদলে প্রতিদিন ফজর নামাজের পর আপনার স্ত্রীর হাতে সুন্দর একটি ফুলের তোড়া তুলে দিয়ে বলুন-আলহামদুলিল্লাহ ! সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি আমাদের জুড়ি বানিয়েছেন। আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং তোমার উপর সন্তষ্ট। আল্লাহ তোমার উপর সন্তষ্ট হোন ! রাতের তাহাজ্জুদে তার জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করুন। বলুন,হে আল্লাহ ! তার আমলকে শুদ্ধ করে দিন,তার আখলাককে মহোত্তম করে দিন । আর তাঁকেই আখিরাতের জান্নাতে আমার সঙ্গী করে দিন।

পরিবারের সবদিক সুনিপুণভাবে দেখভাল করে থাকেন যে মানুষটি তিনি আপনার স্ত্রী। আর তাই আপনার প্রশংসা ও দোয়ার দাবিদার তিনি। এজন্য আজকের দিনটিই বেছে নিতে হবে কেন ? আর কেবল স্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে দিবস হলে পুরুষ তো আরো কঠিন ও দায়িত্বপূর্ণ কাজ পরিবারের জন্য করে। তার নিশীথ ভাংগে আয় রুজির চিন্তা ও পেরেশানিতে।সারাদিন বাইরের হাঁড়ভাংগা পরিশ্রম ও মস্তিষ্কের সমস্ত শিরা-উপশিরার ব্যস্ত করে,দেহের ঘাম নিংড়িয়ে সংসারের জন্য আয় উপার্জন করেন,তার তো আরো বেশী ধন্যবাদ পাবার কথা। স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন থাকলে স্বামীর জন্যও “থ্যাংকস গিভিং ডে” থাকা বাঞ্ছনীয় নয় কি ?

দাম্পত্য জীবনে স্বামী ও স্ত্রীর উভয়েরই রয়েছে নির্দিষ্ট অধিকার ও কর্তব্য। স্বামী ও স্ত্রী একে অন্যের সহায়ক ও পরিপূরক। সুতরাং উভয়েরই রয়েছে উভয়ের প্রতি বিশেষ দায়িত্ব ও করণীয়। আল্লাহ তাআলা কুরআনুল করিমে বলেন, ‘ہُنَّ لِبَاسٌ لَّکُمۡ وَاَنۡتُمۡ لِبَاسٌ لَّہُنَّ ؕ তারা তোমাদের আবরণ এবং তোমরা তাদের আবরণ।’ (সুরা বাকারা,আয়াতাংশ ১৮৭)।

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‎اَلرِّجَالُ قَوّٰمُوۡنَ عَلَی النِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ اللّٰہُ بَعۡضَہُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ وَّبِمَاۤ اَنۡفَقُوۡا مِنۡ اَمۡوَالِہِمۡ ؕ পুরুষ নারীদের অভিভাবক, যেহেতু আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু পুরুষগণ ব্যয় নিজেদের অর্থ-সম্পদ করে। (আন নিসা – ৩৪)

পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হচ্ছে সাধারণভাবে জ্ঞান-বুদ্ধি, পরিচালনা-ব্যবস্থাপনার যোগ্যতা ইত্যাদিতে তার অগ্রগামিতা। বলা বাহুল্য, এসব কেবলই পার্থিব জিনিস, আর এর ভিত্তিতে যে শ্রেষ্ঠত্ব, তাও কেবল পার্থিব শ্রেষ্ঠত্ব। এই শ্রেষ্ঠত্বের পাশাপাশি পুরুষের উপর রয়েছে নারীর ভরণ-পোষণের দায়িত্বভার। এ দুই কারণে পুরুষকে নারীর অভিভাবক বানানো হয়েছে। শরীআতের অন্যান্য বিধানের সাথে এই অভিভাবকত্ব পুরুষের প্রতি শরী’আতের এক বিশেষ বিধান। এমনিভাবে তার সে অভিভাবকত্ব মেনে নেওয়াটা নারীর প্রতি অন্যান্য বিধানের সাথে এক বিশেষ বিধান। সুতরাং উভয়েই আপন আপন ক্ষেত্রে শর’ঈ বিধানের অধীন। শরীআতের সমস্ত বিধান মেনে চলাকে এক কথায় তাকওয়া বলে। আখিরাতের শ্রেষ্ঠত্ব তাকওয়ার উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সেই বেশি মর্যাদাবান, যে বেশি মুত্তাকী (হুজুরাত)। সুতরাং নর-নারী প্রত্যেকের কর্তব্য, আল্লাহ তাকে যে অবস্থানে রেখেছেন তাতে খুশী থেকে তাকওয়ায় অগ্রগামী হওয়ার চেষ্টা করা।

আরও পড়ুন- কর্মক্ষেত্রে নারীর পদচারণা : ইসলামী মূলনীতি ও সতর্কতা

বিয়ের পর যাবতীয় দায়িত্ব স্বামীর কাঁধে বর্তালেও স্ত্রীরও কিছু কর্তব্য রয়েছে। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নারী যখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, রমজান মাসে রোজা রাখে, স্বীয় সতীত্ব ও সম্ভ্রম রক্ষা করে শালীনতা বজায় রেখে চলে এবং স্বামীর আনুগত্য প্রকাশ করে; তখন সে বেহেশতের যে কোন দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে।’ (আবু দাউদ শরিফ)। স্ত্রী হিসেবে স্বামীর দেখভাল করা স্ত্রীর দায়িত্ব। স্বামীর সংসারের দেখাশোনা করা এবং স্বামীর সম্পদ সংরক্ষণ করাও স্ত্রীর অন্যতম দায়িত্ব।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‎وَمِنۡ اٰیٰتِہٖۤ اَنۡ خَلَقَ لَکُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ اَزۡوَاجًا لِّتَسۡکُنُوۡۤا اِلَیۡہَا وَجَعَلَ بَیۡنَکُمۡ مَّوَدَّۃً وَّرَحۡمَۃً ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ

আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো তিনি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের জন্য সঙ্গী জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং যাতে তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি লাভ করো এবং তোমাদের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য।’ (সুরা রুম ২১)

সন্তানের দায়িত্ব পিতার। তার ভরণপোষণ ও চিকিৎসা ও শিক্ষা যাবতীয় ব্যয়ভারও বাবাই বহন করবেন। মা তাকে দুধ পান করাবেন। যত্ন করে লালন করবেন। কুরআন করিমে এ বিষয়ে বিবৃত হয়েছে,

‎وَالۡوَالِدٰتُ یُرۡضِعۡنَ اَوۡلَادَہُنَّ حَوۡلَیۡنِ کَامِلَیۡنِ لِمَنۡ اَرَادَ اَنۡ یُّتِمَّ الرَّضَاعَۃَ ؕ وَعَلَی الۡمَوۡلُوۡدِ لَہٗ رِزۡقُہُنَّ وَکِسۡوَتُہُنَّ بِالۡمَعۡرُوۡفِ ؕ لَا تُکَلَّفُ نَفۡسٌ اِلَّا وُسۡعَہَا ۚ

আর জননীগণ যদি চান তাঁদের সন্তানদের দুগ্ধপান পূর্ণ করতে, তবে পূর্ণ দুই বৎসর দুধ পান করাবেন। আর সন্তানের পিতার দায়িত্ব তাদের খাবার ও পোশাক। কোনো ব্যক্তিকে তার সাধ্যের অতীত কার্যভার দেওয়া হয় না। (সুরা বাকারা ২৩৩)।

স্ত্রী হলেন সহধর্মিণী, অর্ধাঙ্গিনী, সন্তানের জননী; তাই স্ত্রী সম্মানের পাত্রী। স্ত্রীর রয়েছে বহুমাত্রিক অধিকার; সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য। স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে এবং উভয়ের পরিবার প্রত্যেকে নিজ নিজ অধিকারের সীমানা ও কর্তব্যের পরিধি জেনে তা চর্চা করে তাহলে তা সংসারের জন্য মঙ্গলজনক হবে।এটি আল্লাহর প্রেসক্রিপশান। মুখে “লাভ ইউ,লাভ ইউ” বলে একদিন ভালোবাসার প্রদর্শনী করবেন আর বাকী দিন তাকে নিগ্রহ ও জুলুম শিকার বানাবেন-ইসলাম এমন দ্বৈত আচরনের সমর্থন করে না। আল্লাহ আমাদের বুঝার তৌফিক দিন। আমিন।

আরও পড়ুন- স্ত্রীকে প্রশংসা করার দিনে সম্পর্ককে রাঙিয়ে তুলুন

লেখকঃ লেখক ও প্রাক্তন এএমডি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

ফেসবুকে লেখক 

আরও পড়ুন