Ads

পরিপূরক

ফাহমিদা খানম

“মক্কায় পৌঁছে দুই ঘন্টা রেস্ট নিয়ে আমরা কাবাঘরে যাবো তাওয়াফ করতে , সবাই রেড়ি থাকবেন”
লম্বা জার্নি শেষ করে জেদ্দা বিমান বন্দর থেকে আমরা কাবার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবার সময় হজ্জ্ব গাইড জানালেন – সবাই মনে মনে উৎফুল্ল কারণ ইহরাম অবস্থায় অনেককিছুই মেনে চলতে হয় আর জীবনে প্রথম বারের মতো কাবাঘর দেখবো — সবাই মনে মনে খুবই রোমাঞ্চিত । হোটেলে রেস্ট নিয়ে রেড়ি হবার সময় শুনলাম এখন যাওয়া হবেনা গ্রুপের একজন সিক বলে , ৪৬ জনের গ্রুপ আমরা এই হজ্ব গাইডের অধীনে । অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করার পর উনি উত্তর দিলেন—“গ্রুপে বয়স্ক মানুষ আছে তাদের কথাও ভাবতে হবে , চিন্তা করুন এরা আপনার মা-বাবা হলে কি আচরণ করতেন আপনারা ? মনে রাখবেন হজ্ব মানে হলো – ক্ষমা ,ধৈর্য আর ত্যাগ”
সবাই চুপ হয়ে গেলো , প্রথমবার তাওয়াফ করবো যাতে ভুল না হয় সেজন্যেই সবাই একসাথেই করতে হবে । রাতে আমাদের নিয়ে তাওয়াফ করতে গেলেন হজ্ব গাইড , তাওয়াফ করার সময় একজন বয়স্ক লোক বারবার পিছিয়ে পড়ছিলেন আর সেজন্যে গাইড নিজেও আস্তে হাঁটতেন । উনাকে দেখার পর মনে হয়েছিলো আহারে মুল হজ্বের সময় এই বয়স্ক মানুষ কি করবেন ? হজ্বের আসল কাজতো শুনেছি অনেক কষ্টের । যেহেতু গ্রুপ বেঁধে চলতাম – আবিষ্কার করলাম আসলে উনি নয় –উনার স্ত্রীর জন্যেই পিছিয়ে যেতেন উনি – আন্টির হাঁটুতে ব্যথা সেজন্যে উনি জোরে হাঁটতে পারেন না – আংকেল স্ত্রীর পাশে থাকেন । মদীনায় আমরা হোটেল থেকে হেঁটে ৫ বার মসজিদে নবমীতে যেতাম ,রাস্তায় চোখে পড়তো আংকেল আন্টির হাত ধরে রাস্তা পার করছে –খুবই ভালো লাগতো আমাদের , একদিন গাইড জানালেন কেউ যদি সোনার গহনা কিনতে চায় উনাকে যেনো জানায় – উনার পরিচিত দোকান আছে । ক্লান্ত হয়ে এসে ঘুম পেতো আর এসবে আগ্রহ নেই বলে আমি যাইনি কিন্তু পরদিন অন্যদের মুখে শুনলাম অনেকের সাথে সেই আংকেল নাকি গেছেন স্ত্রীর জন্যে গহনা কিনতে ।
আবারো মক্কায় ফিরলাম আমরা, প্রতিবার তাওয়াফ করার সময় আংকেল আন্টির পিছনেই থাকতেন যাতে করে ভিড়ের ঠেলায় উনি পড়ে না যান আর ততদিনে কেউ কারো জন্যে অপেক্ষা করতো না কারণ হচ্ছে তখন মানুষ বেড়ে গিয়েছিল ।

মুল হজ্বের সময় পাঁচদিন বাহিরেই কাটাতে হয় , আরাফাতের ছাউনিতে আংকেল কোথা থেকে যেনো একটা আইসক্রিম নিয়ে এলেন আন্টির জন্যে —
“আমার ডায়বেটিস বেড়ে যাবে আপনি খান”
“আরে খাও ,গরমে আরাম পাবে যে গরম পড়েছে ! ১/২ দিন খেলে কিচ্ছু হয় না !”
আংকেল এতো সুন্দর করে রাণী ডাকতেন যে আমরাও আংকেলকে দেখলেই বলতাম –
“আন্টি রাজা মহাশয় আপনাকে ডাকছেন”
আন্টিও হাসতেন কিছুই বলতেন না , যেহেতু মেয়েদের আলাদা তাঁবু আর আমরা সবাই একসাথে আংকেল বারবার আমাদের বলতেন উনার স্ত্রী যেনো মাটিতে না বসে সেটা খেয়াল রাখতে ,বসলে নাকি উঠার সময় ভয়ানক যন্ত্রণা হয় আন্টির । আংকেল স্ত্রীর জন্যে নিজেই চেয়ার বয়ে নিয়ে এসেছেন , যারা হজ্ব করেছেন তারাই জানেন একটা চেয়ার বয়ে নিয়ে চলা কতো কষ্টের ! হজ্বের শেষদিন এতো ভিড়ে সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম তবে শুনলাম আন্টি নাকি মাথা ঘুরে রাস্তায় পড়ে গেছেন উনাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে – গাইডের কাছেই শুনেছিলাম ।
হজ্ব শেষ হবার পর একদিন হোটেলের লিফটের সামনে অপেক্ষা করার সময় দেখি উনারা দুইজন –
“এখন কেমন আছেন আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালই আছি মা ,হিট স্ট্রোক করেছিলো”
“আল্লাহপাক অসীম দয়ালু ,যাক সুস্থ্য আছেন এটাই বড় কথা”
লিফটে উঠার পরে আন্টির মাথা থেকে কাপড় পড়ে গেলো , তাকিয়ে দেখি নতুন কানের দুল ,চেইন আর হাতে চুড়ি , একদম রাণীর মতই লাগছে উনাকে
“নতুন কিনলেন আন্টি ? খুব সুন্দর হয়েছে”
“নারে মা তোমার আংকেল শখ করে কিনেছে তাই পরে আছি”
“আংকেল আপনি এখনো অনেক রোম্যান্টিক , যেভাবে আন্টিকে দেখে রাখেন এখনো !”

হাসতে হাসতেই বললাম আমি । উত্তরে  তিনি বললেন-
“সুখে দুঃখে ,বিপদে আপদে স্ত্রীই আমার সঙ্গী , আজ এতো বছর সে সংসার ,বাচ্চাকাচ্চা একাই সামলেছে – আমিতো চাকুরী নিয়ে বিভিন্ন জেলায় থাকতাম – সে না হলে সংসার টিকে থাকতো ? আজ অব্ধি আমাকে দেখে রাখছে আমি যদি তাকে এটুকু না বুঝি চলবে মা ?”

উনার বয়স প্রায় ৭৫ + মতো , আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম উনার কথায় — আচ্ছা কয়জন বুঝেন এই সত্যিটা !
“তোমার আন্টি চায়নি কিন্তু আমিই কিনেছি – নাইবা থাকলো প্রয়োজন, জীবনে আর হজ্বে আসতে পারবো কিনা জানি না এটা স্মৃতি হিসাবেই না হয় থাকুক!”
শ্রদ্ধায় ,কৃতজ্ঞতায় মন আপনাআপনি নুয়ে এলো , সবাই বিয়ে করে স্বামী হয় কিন্তু নিজের বউকে জানার ,বুঝার আগ্রহ কয়জনের হয় ? বেশিরভাগ মানুষই ধরে নেয় বিয়ের পর বউই সব করবে কিন্তু একজন নারীর কথা সেভাবে কি কেউ ভাবে ? কবুল পড়ে স্বামী বা স্ত্রী হওয়া যায় কিন্তু বুকের বাঁ পাশের দলিল হতে যোগ্যতা লাগে , চিন্তা করুন উনার সন্তানেরা বাবার দেখানো পথেই হাঁটতে শিখবে – প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে । আচ্ছা বিয়ে মানে যে একে অন্যের পরিপূরক এটাই জানেন কয়জন ?

“হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়,
সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়!”

– শঙ্খ ঘোষ

লেখকঃ কবি ও সাহিত্যিক

 

আরও পড়ুন