Ads

মসজিদে বিয়ে পড়ানো ইসলামের সৌন্দর্য ও মুস্তাহাব

।। জামান শামস ।।

সভ্য পৃথিবীর জন্য পবিত্র ও বৈধপন্থায় বিবাহ বন্ধনের গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন,

وَ مِنۡ اٰیٰتِهٖۤ اَنۡ خَلَقَ لَکُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ اَزۡوَاجًا لِّتَسۡکُنُوۡۤا اِلَیۡهَا وَ جَعَلَ بَیۡنَکُمۡ مَّوَدَّۃً وَّ رَحۡمَۃً ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ

আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা রুম ২১)

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন,

‘وَ اَنۡکِحُوا الۡاَیَامٰی مِنۡکُمۡ وَ الصّٰلِحِیۡنَ مِنۡ عِبَادِکُمۡ وَ اِمَآئِکُمۡ ؕ اِنۡ یَّکُوۡنُوۡا فُقَرَآءَ یُغۡنِهِمُ اللّٰهُ مِنۡ فَضۡلِهٖ ؕ وَ اللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ وَ لۡیَسۡتَعۡفِفِ الَّذِیۡنَ لَا یَجِدُوۡنَ نِکَاحًا حَتّٰی یُغۡنِیَهُمُ اللّٰهُ مِنۡ فَضۡلِهٖ

তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিয়ে সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। যারা বিয়েতে সামর্থ্য নয়, তারা যেন সংযম অবলম্বন করে— যে পর্যন্ত না আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের অভাবমুক্ত করে দেন। (সূরা নুর, আয়াত, ৩২-৩৩)

বিয়ের প্রতি আগ্রহী করতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে, সে যেন বিয়ে করে নেয়, কেননা তা চক্ষুকে সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থান রক্ষা করে। (বুখারি, হাদিস, ৫০৬৬; মুসলিম, হাদিস, ১৪০০)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, ‘যখন বান্দা বিয়ে করে, তখন সে তার দ্বীনের অর্ধেক পূরণ করে। অতএব, বাকি অর্ধেকাংশে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে।’ (সহিহ আল-জামিউস সাগির ওয়া জিয়াদাতুহু, হাদিস,৬১৪৮; তাবরানি, হাদিস, ৯৭২; মুসতাদরাক হাকিম, হাদিস, ২৭২৮)

বিয়ের বিষয়টিকে সহজ ও অনাড়ম্বর করতে উৎসাহিত করা হয়েছে ইসলামে। যেই বিয়েতে খরচ যত কম হবে, সে বিয়েকে তত বরকতপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে হাদিসে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সর্বাধিক বরকতপূর্ণ বিয়ে হচ্ছে, যার খরচ যত সহজ ও স্বাভাবিক হয়।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস, ২৪৫২৯) সহজ-স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন বিয়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বরকতের দোয়া করেছেন।

আরও পড়ুন-বিয়ের জন্য কনে নির্বাচন করবেন যেভাবে?

এক হাদিসে হজরত আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুর রহমান ইবনু আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহুর গায়ে হলদে চি‎হ্ন দেখতে পেয়ে বললেন, কি ব্যাপার? তিনি বললেন, খেজুর বিচির পরিমাণ সোনার মাহরের বিনিময়ে আমি এক মহিলাকে বিয়ে করেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ্ তোমাকে বরকত দান করুন। ওয়ালিমা কর, একটি বকরী দ্বারা হলেও। (ইবনু মাজাহ, হাদিস, ১৯০৭, বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, হাদিস, ১০৯৪)

মুসলিম সমাজে মসজিদে বিয়ে পড়ানোর প্রচলন রয়েছে। ধর্মীয় ঐহিত্যের অংশ হিসেবে মুসলমানদের কাছে বর্তমানে মসজিদে বিয়ে পড়ানোর আগ্রহ বেড়েছে। সম্প্রতি সৌদি আরবের মক্কায় অবস্থিত মসজিদুল হারাম ও মদিনার মসজিদে নববীতে বিয়ের অনু্ষ্ঠান সম্পন্ন করার অনুমতি দিয়েছে সৌদি আরব। এ ক্ষেত্রে তারা বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে। শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে, জোরে শব্দ করে মুসল্লিদের মনযোগ নষ্ট করা যাবে না এবং কফি, মিস্টিসহ অন্যান্য খাবার বেশি পরিমাণে আনা যাবে না।

ইসলামি বিধান অনুযায়ী মসজিদে বিয়ে পড়ানো বা বিবাহ সম্পন্ন করা মুস্তাহাব, জরুরি কিছু নয় এবং গুরুত্বপূর্ণ সুন্নতেরও অংশ নয়। তবে হাদিসে মসজিদে বিয়ের বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায়। আহমদ ইবনু মানী রহিমাহুল্লাহ আম্মাজান হজরত আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণণা করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, أعلنوا هذا النكاح واجعلوه في المساجد واضربوا عليه بالدفوف বিবাহের ঘোষণা দিবে এবং তা মসজিদে সম্পন্ন করবে। আর এ উপলক্ষ্যে দফ বাজাবে। (ইবনু মাজাহ, ১৮৯৫, তিরমিজী হাদিস, ১০৮৯)

মসজিদে বিয়ে সম্পন্ন করার বিষয়ে আলেমরা বলেন, ইসলামের প্রাথমিক যুগ, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাদানি জীবন, (মদিনায় বসবাসের ১০ বছর সময়কাল) চার খলিফা ও সাহাবিদের জীবনকালে মুসলমানেরা নামাজ-ইবাদত ছাড়াও মসজিদে যেতেন। মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা করে সেখানে খাবার খাওয়া, ধর্মীয় আলোচনা করতেন। মসজিদভিত্তক সমাজ ব্যবস্থার বাস্তবচিত্র ছিল তৎকালীন সময়ে।

বস্তুতঃ বিবাহের জন্য কোন নির্ধারিত স্থান নেই। বর-কনের অভিভাবকদের সুবিধামত যেকোন স্থানে বিবাহ পড়ানো জায়েয। এমনকি সফর অবস্থাতেও বিয়ে করা জায়েয। রাসূল (ছাঃ) খায়বার যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে ছাফিয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন (বুখারী হা/৪২১১)।

আলেমদের মতে, মসজিদে বিয়ে সম্পন্ন করার বিষয়টি ইতিবাচক। তবে এক্ষেত্রে মসজিদের পবিত্রতা রক্ষার প্রতি সব্বোর্চ গুরুত্ব দিতে হবে।যেহেতু বিয়ে ইবাদত ও মসজিদ বরকতময় স্থান, মসজিদে জনসাধারণের উপস্থিতি থাকে। তাই খুব সহজেই বিয়ের ব্যাপারটি সবাই জানতে পারে- যেটা শরিয়তের দৃষ্টিতে পছন্দনীয়। এটুকুই,এর বেশী কিছু নয়। নবিজির (সা.) যুগে সাহাবিদের সব বিয়ের আকদ মসজিদে হতো না। নবিজিরও (সা.) সব বিয়ের আকদ মসজিদে হয়নি। নবিজি (সা.) খুব জোর দিয়ে সবার বিয়ের আকদ মসজিদে করার নির্দেশ দিয়েছেন এ রকমও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।তাই এটা অপরিহার্য বা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় যে প্রতিটি বিয়ের আকদ মসজিদেই হতে হবে। দুই পক্ষের সুবিধা অনুযায়ী যে কোনো জায়গায় বিয়ের আকদ হতে পারে।

আমরা এটা এ কারণে রিকমেন্ড করি যেন বিয়েতে ফাহেশা কাজ বর্জন করা যায়। বর্তমান সময়ে এক একটি বিয়ের অনুষ্ঠান যেন এক একটি দোজখ। গান বাজনা তো মামুলি বিষয় এখন অরকেস্ট্রা পার্টি ও নামী শিল্পী দিয়ে সারারাত নাচ ও গান হয়,যেখানে বর কণে উভয়েই নাচে অংশ নেয়। চার কোণে চাঁদরের নীচে কনেকে হর্ষধ্বনি ও গানের সূর্ বাজিয়ে মঞ্চে আনা হয়। এসবই ফাহেশা কাজ যেখানে পর্দার ফরজিয়তের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শিত হয়।আজ এমন একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে  আমি নিজেই বেওকুফ বনে গিয়েছি। সমানে ভারতীয় গান বাজছে, নাচ হচ্ছে, অতিথিদের মধ্যে নারী-পুরুষ ভেদ নেই।

মসজিদে বিয়ে হওয়ার কারণে যদি বিয়ের ইসলামের নির্দেশনাবিরোধী আচার অনুষ্ঠান কমানো সম্ভব হয়, তাহলে বিয়ে মসজিদেই করা উচিত। বরকতময় স্থান, জনসাধারণের উপস্থিতি ও দোয়ার সুযোগ ইত্যাদি কারণে মসজিদে বিয়ে হওয়া অবশ্যই পছন্দনীয় ও মুস্তাহাব। কিন্তু মসজিদে বিয়ে হওয়াকে অপরিহার্য বা মুআক্কাদা সুন্নাত মনে করা, মসজিদের বাইরে বিয়ে হওয়াকে নিন্দনীয় মনে করা সমীচীন নয়।

লেখকঃ  সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়ন মূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিয়ে ফেসবুকে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন।প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন