Ads

আজারবাইজান-আর্মেনিয়া সংকট

।। আসাদ পারভেজ ।।

২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব রাজনীতি আবারও টালমাটাল। দুইটি প্রতিবেশি রাষ্ট্র (আর্মেনিয়া-আজারবাইজানি) যুদ্ধে লিপ্ত হয়।যার মধ্য দিয়ে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলে আসা দেশ দু’টির দ্বন্দ্বে এক নব অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। নাগোরনো-কারাবাখ সংযোগ রেখা, আজারবাইজানি-আর্মেনীয় সীমান্ত এবং আজারবাইজানি-ইরানি সীমান্ত বরাবর এই সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। দেশ দু’টির দ্বন্দ্বের পেছনে তাদের জাতিগত এবং রাষ্ট্রদ্বয়ের অবস্থানগত বিষয়টি নিঁখুদভাবে জড়িত।

আজারবাইজান

আজারবাইজান কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যবর্তী স্থলযোটক দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলের সবচেয়ে পূর্বে অবস্থিত পূর্ব ইউরোপের একটি প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র, যার আয়তন ৮৬,৬০০ বর্গ কি.মি.। দেশটির উত্তরে রাশিয়া, পূর্বে কাস্পিয়ান সাগর, দক্ষিণে ইরান, পশ্চিমে আর্মেনিয়া, উত্তর-পশ্চিমে জর্জিয়া দ্বারা পরিবেষ্টিত। এছাড়াও ছিটমহল নাখচিভানের মাধ্যমে তুরস্কের সাথে দেশটির একচিলতে সীমান্ত আছে। আর্মেনিয়ার পর্বতের একটি সরু সারি নাখচিভান ও আজারবাইজানকে পৃথক করেছে। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের একটি এলাকা নাগোরনো-কারাবাখের আনুগত্য বিতর্কিত। কাস্পিয়ান সাগরে অবস্থিত অনেকগুলি দ্বীপও আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত। ৫৫০০ বর্গ কি.মি. আয়তনের ‘নাখচিভান স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র’টি দেশটির স্বশাসিত একটি ছিটমহল।৪,৫৬,১০০ জনসংখ্যাবিশিষ্ট অঞ্চলটি উত্তর ও পূর্বে আর্মেনিয়া, দক্ষিণ ও পশ্চিমে ইরান এবং উত্তর-পশ্চিমে তুরস্ক দ্বারা পরিবেষ্টিত।

আজারবাইজানিরা ‘বৃহত্তর তুর্কি’ জাতির অংশ।তারা আজারবাইজানি ভাষায় কথা বলে; যেটি তুর্কি ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত ‘ওঘুজ তুর্কি’ শাখার অন্তর্ভুক্ত। আজারবাইজানে প্রায় ১ কোটির অধিক লোকের বাস। কিন্তু আজারবাইজানের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ইরানে দেড় কোটি থেকে ১ কোটি ৮৫ লক্ষ আজারবাইজানি বসবাস করে। আজারবাইজান ও ইরানের বাইরে রাশিয়ায় ১৫ থেকে ৩০ লক্ষ, তুরস্কে ৮ থেকে ৩০ লক্ষ এবং জর্জিয়ায় আড়াই থেকে ৩ লক্ষ জাতিগত আজারবাইজানি বসবাস করে। এছাড়া কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, জার্মানি, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জাতিগত আজারবাইজানি বসবাস করে। এদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ লোক জাতিগতভাবে আজারবাইজানি। এছাড়া লেজগীয়, রুশ, আর্মেনীয় ও তালিশ জাতির লোক রয়েছে। আজারবাইজানের ৯৭ ভাগ মানুষ মুসলমান; যারমধ্যে ৮৫ শতাংশ শিয়া এবং ১৫ শতাংশ সুন্নি। আজারবাইজান বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক শিয়াবহুল দেশ। খ্রিষ্টধর্ম- ২.৮ ভাগ, অন্যান্য ধর্ম- ০.১ ভাগ, অধার্মিক- ০.১ ভাগ।

দেশটির সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যে খ্রিষ্টানরা রুশ ও জর্জীয় অর্থডক্স এবং আর্মেনীয় প্রেরিতীয়। একটা অংশ লুথারবাদী, বাপ্তিস্মবাদী ও মলোকান। ২০০৩ সালে রোমান ক্যাথলিকদের সংখ্যা ছিল ২৫০। এছাড়া দেশটিতে ছোট একটি প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ও রয়েছে। আজারবাইজানে একটি প্রাচীন (২ হাজার বছর পুরনো) ইহুদি সম্প্রদায়েরও বসবাস রয়েছে; যাদের সংখ্যা ১০ হাজারের মতো। আজারবাইজানে বাহাই ধর্ম, ইস্কন ও জেহোভার সাক্ষীর পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে।

১৮শ ও ১৯শ শতকে ককেশীয় এই দেশটি পর্যায়ক্রমে রুশ ও পারস্যদেশের শাসনাধীন ছিল। ১৮০৪-১৮১৩ এবং ১৮২৬-১৮২৮ সালের রুশ-ইরানি যুদ্ধদ্বয়ে রুশ সাম্রাজ্য ইরানকে পরাজিত করে এবং ইরানের কাছ থেকে বর্তমান আজারবাইজানের ভূমি দখল করে নেয়। ১৯১৮ সালের পূর্বে ‘ইরানি আজারবাইজান’ নামে পরিচিত উত্তর ইরানের ৪টি প্রদেশকে মূল আজারবাইজান হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে দেশটির জাতীয়তাবাদী জনতা উসমানীয় সাম্রাজ্যের সহযোগিতা প্রত্যাশা করে। উসমানীয় সহায়তায় ১৯১৮ সালের ২৮ মে ‘আজারবাইজান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ নামে স্বাধীন ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু ১৯২০ সালের ২৮ এপ্রিলে বলশেভিক লাল ফৌজ এটি আক্রমণ করে পুনরায় রুশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। আজারবাইজানি বলশেভিকরা ‘আজারবাইজান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ নামক একটি স্বাধীন, কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রটি সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগদান করে। পরবর্তী প্রায় সাত দশক রাষ্ট্রটি কমিউনিস্ট রুশ শাসনের অধীনে ছিল। তবে ১৯৩৬ সালে আন্তঃককেশীয় সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রটি তিনটি আলাদা প্রজাতন্ত্র আজারবাইজান, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়াতে ভেঙে দেওয়া হয়। তখন থেকেই আজারবাইজানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং নাগোরনো-কারাবাখ এলাকার খ্রিস্টান আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত।

১৯৯১ সালের ৩০ আগস্ট রাষ্ট্রটি স্বাধীনতা ঘোষণা পরবর্তী ২০ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করলে এই দ্বন্দ্ব সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নেয়। ফলে নতুনভাবে স্বাধীন দেশটির প্রথম বছরগুলি রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, অর্থনৈতিক অবনতি, এবং নাগোরনো-কারাবাখের যুদ্ধে অতীবাহিত হয়। ১৯৯৪ সালের মে মাসে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর দীর্ঘ ২৮ বৎসর নাগোরনো-কারাবাখ এবং সংলগ্ন ৭টি আজারবাইজানি জেলা বিচ্ছিন্নতাবাদী আর্মেনীয়দের নিয়ন্ত্রনাধীন ছিল। কিন্তু ২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে দখল হয়ে যাওয়া এলাকা উদ্ধারে আজারবাইজান সামরিক অভিযান শুরু করলে ৪৮ দিন পর এলাকাটি নিয়ন্ত্রনে আসে। বর্তমানে নাগোরনো-কারাবাখের কিছু অংশ এবং ১৯৯৪ সালে আর্মেনিয়া কর্তৃক দখল হয়ে যাওয়া ৭টি আজারবাইজানি জেলা আজারবাইজানের সামরিক নিয়ন্ত্রণে আছে।

আজারবাইজানের রাজধানী বাকুর তেলক্ষেত্রগুলি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেলক্ষেত্রগুলির মধ্যে অন্যতম। কিন্তু নানা কারণে দেশটি খনিজ সম্পদ থেকে সম্ভাব্য মুনাফা অর্জনে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।আজারবাইজানের অর্থনীতি বর্তমানে একটি সন্ধি পর্যায়ে বিদ্যমান, যেখানে সরকার এখনও একটি প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে চলেছে। বৈচিত্র্যময় জলবায়ু অঞ্চলের উপস্থিতির কারণে দেশটির কৃষি খাতের উন্নতির সম্ভাবনাও প্রচুর।

 

আরও পড়ুন-বাংসামোরো-মিন্দানাওঃ ফিলিপাইনের মুসলিম জনপদ

আর্মেনিয়া

আর্মেনিয়া প্রজাতন্ত্রপূর্ব ইউরোপের একটি রাষ্ট্র। জর্জিয়া ও আজারবাইজানের সাথে এটি দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের স্থলযোজকের উপর অবস্থিত। জাতিগত আর্মেনীয়রা নিজেদের হায় বলে ডাকে এবং আর্মেনিয়ার ৯০% লোক হায় জাতির লোক। ১৯২২ সালে এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হলেও ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৯৫ সালে দেশটির প্রথম সোভিয়েত-পরবর্তী সংবিধান পাশ হয়।

আর্মেনিয়ার প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ অব্দে উরার্তু বা ভান রাজ্যের অংশ হিসেবে। রাজ্যটি ককেসাস অঞ্চল ও পূর্ব এশিয়া মাইনর এলাকাতে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। সেলেউসিদ সাম্রাজ্যের ধ্বংসের পর ১৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম আর্মেনীয় রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ৯৫ থেকে ৬৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত এই নবগঠিত রাষ্ট্রের চরম উৎকর্ষের সময়। কিছু সময়ের জন্য আর্মেনিয়া ছিল রোমান পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য। ৬৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এটি রোমান সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয় এবং রাজনৈতিক, দার্শনিক ও ধর্মীয়ভাবে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি অণুসরণ করা শুরু করে।

যিশুর দুই শিষ্য বার্থেলেমিউ ও থাদেউস প্রথম শতকেই এখানে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেন। ৩য় শতকে আর্মেনিয়ার রাজা খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হন। ৩০১ খ্রিষ্টাব্দে আর্মেনিয়া ইতিহাসের প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ এবং আর্মেনীয় গির্জাব্যবস্থার গোড়া পত্তন করে। আজও আর্মেনীয় গির্জা রোমান ক্যাথলিক গির্জাব্যবস্থা এবং পূর্ব অর্থডক্স গির্জাব্যবস্থা অপেক্ষা স্বাধীন গির্জাব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে আর্মেনিয়ার রাজনৈতিক সংকটের সময় এই গির্জা আর্মেনিয়ার অদ্বিতীয় জাতীয় সত্তা সংরক্ষণে সাহায্য করে। আনুমানিক ১১০০ থেকে ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদের কেন্দ্র দেশের দক্ষিণদিকে সরে যায়। তখন আর্মেনীয় সিলিসিয়া রাজ্য ইউরোপীয় ক্রুসেডার রাজ্যগুলির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মাইনর এলাকাতে সমৃদ্ধি অর্জন করে, যদিও রাজ্যটি শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের করায়ত্ত হয়।বর্তমানে দেশটিতে স্বল্পসংখ্যক ইহুদি, ইয়াজিদি ও মুসলমান অধিবাসী বসবাস করেন

৪র্থ থেকে ১৯শ শতক পর্যন্ত আর্মেনিয়া বিভিন্ন বড় শক্তির শাসনাধীনে আসে। এদের মধ্যে পারসিক, বাইজেন্টীয়, আরব, মোঙ্গল এবং তুর্কি জাতি উল্লেখযোগ্য।ঊনবিংশ শতাব্দীতে আর্মেনীয় ভূমির পূর্বাংশ রুশ সাম্রাজ্যে এবং পশ্চিমাংশ উসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, এবং আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীরা ১৯১৮ সালের ২৮মে পূর্ব আর্মেনিয়ায় ‘আর্মেনিয়া প্রজাতন্ত্র’ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর মিত্রশক্তি পশ্চিম আর্মেনিয়াকে আর্মেনিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে, কিন্তু ১৯২০ সালে তুর্কি আর্মেনীয় যুদ্ধে আর্মেনিয়া পরাজিত হয় এবং তুর্কিরা পশ্চিম আর্মেনিয়া পুন:অধিকার করে নেয়। ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে বলশেভিক লাল ফৌজ আর্মেনীয় বলশেভিকদের সহায়তায় পূর্ব আর্মেনিয়া দখল করে এবং সেখানে ‘আর্মেনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রটি সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগদান করে, এবং পরবর্তী প্রায় সাত দশক অঞ্চলটি কমিউনিস্ট শাসনের অধীন ছিল। ১৯৯১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রটি সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।

১৯১৫ সালে সংঘটিত আর্মেনিয় গণহত্যা দেশটির এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়।১৯১৮-১৯২০ সাল পর্যন্ত এটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ছিল। ১৯২০ সালে স্থানীয় সাম্যবাদীরা ক্ষমতায় আসে এবং সোভিয়েত সেনাবাহিনী দেশটি দখল করে। ১৯২২ সালে আর্মেনিয়া আন্তঃককেশীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অংশে পরিণত হয়। ১৯৩৬ সালে এটি আর্মেনিয়া সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। অবশেষে দেশটি ১৯৯১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

আর্মেনিয়ায় ২০১৭ সালে সাংবিধানিক গণভোটে আয়োজন করে। সেখানে আর্মেনীয়রা সংসদীয় শাসনব্যবস্থার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। অতঃপর এক দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট সার্জ সার্গসিয়ান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে তীব্র সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়; যা আর্মেনীয় ভেলভেট বিপ্লব নামে পরিচিতি লাভ করেছে। ফলে ২০১৮ সালে সার্গসিয়ান পদত্যাগ করেন এবং নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিরোধী নেতা নিকোল পাশিনিয়ান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

আর্মেনিয়ার দুই-তৃতীয়াংশ লোক শহরে বাস করে। নদী উপত্যকায়, বিশেষত হ্রাজদান নদীর তীরে বসতির ঘনত্ব বেশি। হ্রাজদান নদীর তীরেই আর্মেনিয়ার বৃহত্তম শহর ও রাজধানী ইয়েরেভান অবস্থিত। আর্মেনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হল গিয়ুমরি। আর্মেনীয়রা জাতি হিসেবে স্বতন্ত্র। ৯৮শতাংশ অধিবাসী আর্মেনীয় ভাষায় কথা বলে। ১৯১৫ সালে আর্মেনিয়ার গণহত্যার সময় অনেক আর্মেনীয় পশ্চিম আর্মেনিয়াতে (বর্তমান তুরস্কের অংশ) পালিয়ে যায়। সংখ্যালঘুদের মধ্যে রুশ ভাষা, কুর্মানজি(ইয়েজিদীয়) নামের একটি কুর্দি উপভাষা, নব্য-আসিরীয়, গ্রিক ও ইউক্রেনীয় ভাষা ব্যবহৃত হয়। আর্মেনীয়দের প্রায় ৯০শতাংশ আর্মেনীয় ও রুশ উভয় ভাষাতেই স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারেন।

৩০,৮০০ বর্গ কি.মি. আয়তনের দেশটিতে জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ।রাষ্ট্রটি উত্তরে জর্জিয়া, পূর্বে আজারবাইজান ও আর্তসাখ, দক্ষিণে ইরান ও আজারবাইজানের নাখচিভান এবং পশ্চিমে তুরস্ক দ্বারা পরিবেষ্টিত। আর্মেনিয়া একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র।দেশটিতে অ্যাপসল গির্জার ধর্ম (খ্রিস্টানধর্মের পার্ট-‘অ্যাপোস্টলিক/অর্থোডক্স চার্চে’র) পালন করেপ্রায় ৯০শতাংশ অধিবাসীকিন্তু বিশ্বের অধিকাংশ জাতিগত আর্মেনীয় বসবাস করে আর্মেনিয়ার বাইরে। রাশিয়ায় ২০-২৫ লক্ষ, যুক্তরাষ্ট্রে ৮-১৫ লক্ষ এবং ফ্রান্সে প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ জাতিগত আর্মেনীয় বসবাস করে। এছাড়া জর্জিয়া, ইরান, সিরিয়া, লেবানন, ইউক্রেন, পোল্যান্ড, গ্রিস, জার্মানি, কানাডা, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জাতিগত আর্মেনীয় বাস করে।

আরও পড়ুন- কলম্বিয়া সরকার ও ফার্ক গেরিলাগোষ্ঠী

ইতিহাসের পাতায়: নাগোরনো-কারাবাখ

নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যকার বিরোধ চিরকালীন নয়Ñ এই বিরোধ প্রাচীন কোনো ঘৃণার ভিত্তিতেও তৈরি হয়নি। রুশ সাম্রাজ্যের আগমনের আগপর্যন্ত আর্মেনীয় ও আজেরি এই দুই জাতি বহু শতাব্দী ধরে শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে বাস করে আসছিল। আজকের দ্বন্দ্বের উৎস হলো সার্বভৌম আজারবাইজানে আর্মেনিয়ার সামরিক দখলদারিত্ব। আর্মেনিয়া এই সংঘাতকে মুসলিম আজারবাইজানের সঙ্গে ‘সভ্যতার সংঘাত’ হিসেবে চিত্রিত করে ‘খ্রিষ্টান কার্ড’ খেলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেই প্রচার খুব একটা বিকোচ্ছে না।আজ নেদারল্যান্ডস যেভাবে একটি খ্রিষ্টান দেশ হিসেবে পরিচিত, আজারবাইজানও প্রায় একইভাবে মুসলিম দেশ হিসেবে সবার কাছে সুপরিচিত। ফলে ধর্মীয় পার্থক্যকে এই দ্বন্দ্বের ভিত্তি ভাবা ঠিক হবে না।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বর্তমান আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ সময় জাতিগত আজারবাইজানিরা রুশদের নিকট ‘ককেশীয় তাতার’ নামে পরিচিত ছিল। রুশ সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে আর্মেনীয় ও ককেশীয় তাতারদের মধ্যে জাতিগত সংঘাত ছিল বিরল। কিন্তু শতাব্দীর শেষ দিকে রুশ সাম্রাজ্যের অন্যান্য জাতির মতো ককেশীয় তাতার ও আর্মেনীয়দের মধ্যেও জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটে। ফলশ্রুতিতে জাতি দুইটির মধ্যে সংঘাত দেখা দেয়। সেসময় আর্মেনীয় বা ককেশীয় তাতারদের জন্য স্বতন্ত্র কোনো ‘জাতিগত অঞ্চল’ ছিল না, ফলে দক্ষিণ ককেশাস জুড়ে জাতি দুইটি মিশ্রভাবে ছড়িয়ে ছিল।

১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে ককেশীয় তাতার ও আর্মেনীয়দের মধ্যে প্রথম গুরুতর দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়। একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাকু, মে মাসে নাখচিভান, আগস্টে শুশা এবং নভেম্বরে এলিজাবেথপোলে আর্মেনীয় ও ককেশীয় তাতারদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়। ১৯০৭ সাল পর্যন্ত এই জাতিগত সংঘাত অব্যাহত থাকে। অবশেষে রুশ সেনাবাহিনীর কসাক সৈন্যদের হস্তক্ষেপে ভয়াবহ দাঙ্গার অবসান ঘটে। এই দাঙ্গার ফলে ৩-১০ হাজার আর্মেনীয় ও ককেশীয় তাতার নিহত হয়।১২৮টি আর্মেনীয় ও ১৫৮টি ককেশীয় তাতার গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। দাঙ্গায় তুলনামূলকভাবে ককেশীয় তাতাররা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কেননা আর্মেনীয়রা ছিল অধিকতর সুসংগঠিত।

১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং এর ফলে রুশরা দক্ষিণ ককেশাসের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ১৯১৮-১৯২০ সাল দক্ষিণ ককেশাসের জন্য অত্যন্ত বিশৃঙ্খলাপূর্ণ সময়। এসময় স্থানীয় বিভিন্ন জাতি ও দল ক্ষমতার জন্য পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব লিপ্ত ছিল। বিভিন্ন শক্তি (উসমানীয় সাম্রাজ্য, জার্মানি, ব্রিটেন ও রুশ বলশেভিকরা) এই অঞ্চলে নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের জন্য হস্তক্ষেপ করে। ফলে অঞ্চলটির বিভিন্ন অংশে রাজনৈতিক নেতৃত্বে দ্রুত পরিবর্তন ঘটে।

এ সময় থেকেই ককেশীয় তাতাররা ‘আজারবাইজানি’ হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করে। ১৯১৮ সালের মার্চে বাকু ও এর আশেপাশের অঞ্চলে বলশেভিক ও আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীরা প্রায় ১২ হাজার বেসামরিক আজারবাইজানিকে খুন করে। এপ্রিলে আজারবাইজানি, আর্মেনীয় ও জর্জীয় বলশেভিক বিরোধী নেতৃবৃন্দ সম্মিলিতভাবে একটি ‘ট্রান্সককেশীয় ফেডারেশন’ গঠন করে। কিন্তু পারস্পরিক বিরোধের কারণে এটি টিকতে পারেনি। ১৯১৮ সালের মে মাসেই আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এ সময় থেকেই রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে ভূখণ্ড নিয়ে সংঘাত আরম্ভ হয়।

১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে উসমানীয় ও আজারবাইজানি সৈন্যদের সমন্বয়ে গঠিত ‘ইসলামি সৈন্যবাহিনী’ বাকু দখল করে নেয়। যুদ্ধে ১০-৩০ হাজার আর্মেনীয় নিহত হয়। একই বছরে আর্মেনীয়রা জাঙ্গেজুরে গণহত্যা চালিয়ে প্রায় ১০ হাজার বেসামরিক আজারবাইজানিকে খুন করে। ১৯১৯ সালের জুনে কারাবাখ অঞ্চলে আজারবাইজানিরা প্রায় ৭০০ জন বেসামরিক আর্মেনীয়কে হত্যা করে। ১৯২০ সালের মার্চে শুশা অঞ্চলে আজারবাইজানিদের সাথে আরেকটি যুদ্ধে ২০ হাজার আর্মেনীয় নিহত হয়। কিন্তু যুদ্ধের মাধ্যমে কোনো চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হয়নি। এ সময় আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিরা পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধের পাশাপাশি নিজেদের মধ্যেও রাজনৈতিক সংঘাতে লিপ্ত ছিল। আজারবাইজানি ও আর্মেনীয় বলশেভিকরা উভয় রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল। অবশেষে সোভিয়েত রুশ সৈন্যদের সহায়তায় ১৯২০ সালের এপ্রিলে আজারবাইজানি বলশেভিকরা এবং ডিসেম্বরে আর্মেনীয় বলশেভিকরা নিজ নিজ রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেয়।

মস্কো আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর উদ্যোগ গ্রহণ করে। মস্কোর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিরোধপূর্ণ নাখচিভান, কাজাখ ও কারাবাখ অঞ্চল আজারবাইজানের আর জাঙ্গেজুর অঞ্চল আর্মেনিয়ার। নাখচিভান ও কাজাখ অঞ্চলে আজারবাইজানিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং জাঙ্গেজুরে আর্মেনীয়রা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তাই এই অঞ্চলগুলোর হস্তান্তর বড় ধরনের কোনো সমস্যার সৃষ্টি করেনি। কিন্তু কারাবাখ নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়, কারণ কারাবাখের সিংহভাগ অধিবাসী আর্মেনীয় হলেও এটিকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কারাবাখ অঞ্চলটি উচ্চ কারাবাখ ও নিম্ন কারাবাখ নামক দুইটি অঞ্চলে ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত। মস্কো আর্মেনীয় অধ্যুষিত উচ্চ কারবাখকে সোভিয়েত আজারবাইজানের অন্তর্গত একটি ‘স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে’ পরিণত করে। নিম্ন কারাবাখ আজারবাইজানের সঙ্গে পুরোপুরি অঙ্গীভূত হয়ে যায়।

সোভিয়েত সরকার আজারবাইজানি ও আর্মেনীয়দের মধ্যেকার জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে জাতিগত সম্প্রীতি স্থাপনের প্রচেষ্টা চালায়। ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যে মোটামুটিভাবে জাতিগত সৌহার্দ্য বজায় ছিল। বহুসংখ্যক আর্মেনীয় আজারবাইজানে ও বহুসংখ্যক আজারবাইজানি আর্মেনিয়ায় বসতি স্থাপন করে। ১৯৭০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় দেখা দেয়। সেই প্রেক্ষাপটে আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

নাগোরনো-কারাবাখে বসবাসকারী আর্মেনীয়রা ১৯৮৭ সালের আগস্টে আর্মেনিয়ার সঙ্গে যোগদানের জন্য মস্কোর অনুমতি প্রার্থনা করে। এই দাবিতে ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে নাগোরনো-কারাবাখ ও আর্মেনিয়ায় বিক্ষোভ শুরু হয়। আজারবাইজানিরা এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে এবং আর্মেনীয়দের সঙ্গে তাদের সংঘাত শুরু হয়।

১৯২০-এর দশকের শুরুতে নাগোরনো-কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল (এনকেএও) গঠিত হয়। আজারবাইজানীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের (এএসএসএসআর) সীমানার মধ্যে এই ভূখণ্ডে প্রথম থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী হলো আর্মেনীয়রা। তৎকালীন সোভিয়েত ককেশাস কমিটির প্রধান জোসেফ স্তালিন এএসএসআরের কাছে এনকেএও-কে ‘হস্তান্তর’ করেছিলেন। এনকেএও সৃষ্টির আদেশের নথিতে বলা হয়েছে, এই অঞ্চল আজারবাইজানের সঙ্গেই ‘থাকা উচিত’। এর অর্থ, এই ভূখণ্ডকে শুরু থেকেই আজারবাইজানের অংশ হিসেবে মনে করা হতো।

১৯৮৮ সালেঅবৈধভাবে এনকেএও আঞ্চলিক কাউন্সিল আর্মেনিয়ান এসএসআরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পক্ষে রায় দেয়। সোভিয়েত আইনে বলা ছিল, নাগোরনো-কারাবাখ কেবল ইউএসএসআরের (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) অংশ অথবা আজারবাইজানের অংশ হিসেবে থাকার বিকল্প প্রস্তাব দিতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতা ঘোষণা কিংবা আর্মেনিয়ায় তাদের যোগ দেওয়ার বিষয়ে গণভোট গ্রহণ আইনিভাবে বৈধ ছিল না।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া সোভিয়েত সরকারের টেনে দেওয়া সীমান্ত নিয়েই স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল। এর অর্থ হলো, আন্তর্জাতিক আইন নাগোরনো-কারাবাখকে আজারবাইজানের সার্বভৌম অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং সেখানে আর্মেনিয়ার সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিকে দখল হিসেবে দেখে। অথচ সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙাকালীন সময়ে আর্মেনীয় বাহিনী এই অঞ্চলে আক্রমণ করে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটায়।

১৯৯১ সালে যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে আর্মেনীয়রা পশ্চাৎপসরণে বাধ্য হলেও পরবর্তীতে যুদ্ধের চাকা ঘুরে যায়। যুদ্ধ চলাকালে আর্মেনীয় সৈন্যরা বেসামরিক জনসাধারণের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি গণহত্যা চালায়। ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আর্মেনীয় সৈন্যরা খোজালিতে ৬১৩ জন বেসামরিক আজারবাইজানিকে হত্যা করে। বিপরীতে এপ্রিলে আজারবাইজানি সৈন্যরা মারাগায় ৪৩ জন বেসামরিক আর্মেনীয়কে খুন করে। এই যুদ্ধে কমপক্ষে ১,২৬৪ জন বেসামরিক আর্মেনীয় এবং অনুরূপ সংখ্যক বেসামরিক আজারবাইজানি নিহত হয়।

১৯৯৪ সালে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যুদ্ধের অবসান ঘটে। যুদ্ধে ৫,৯০০-৬,০০০ আর্মেনীয় সৈন্য নিহত ও প্রায় ২০ হাজার সৈন্য আহত এবং ১৯৬ জন সৈন্য নিখোঁজ হয়। অন্যদিকে, ২৫-৩০ হাজার আজারবাইজানি সৈন্য নিহত, প্রায় ৫০ হাজার সৈন্য আহত এবং ৪,২১০ জন সৈন্য নিখোঁজ হয়। যুদ্ধের ফলাফল ছিল সম্পূর্ণভাবে আর্মেনীয়দের অনুকূলে, কারণ তারা নাগোরনো-কারাবাখের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ এবং এর আশেপাশের ৭টি আজারবাইজানি জেলা দখল করে নিতে সক্ষম হয়। দখলকৃত অঞ্চলে ‘আর্তসাখ প্রজাতন্ত্র’ নামক একটি কার্যত স্বাধীন, কিন্তু আর্মেনিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে।

আর্তসাখের আয়তন ১১,৪৫৮ বর্গ কি.মি. এবং বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। রাষ্ট্রটিকে আর্মেনিয়া বা জাতিসংঘের অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্র স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। কিন্তু আর্মেনিয়া, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, লেবানন ও অস্ট্রেলিয়ায় আর্তসাখের ‘প্রতিনিধিত্বমূলক কার্যালয়’ রয়েছেÑ যেগুলো কার্যত দূতাবাসের কাজ করে থাকে। অবশ্য প্রিদনেস্ত্রোভিয়া, দক্ষিণ ওসেতিয়া ও আবখাজিয়া আর্তসাখকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে, কিন্তু প্রিদনেস্ত্রোভিয়া নিজেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিবিহীন এবং দক্ষিণ ওসেতিয়া ও আবখাজিয়া মাত্র অল্প কয়েকটি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করেছে। অন্যদিকে, আজারবাইজান আর্তসাখের ভূমিকে আজারবাইজানের ‘অবিচ্ছেদ্য অংশ’ হিসেবে বিবেচনা করে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই ব্যাপারে একমত।

আর্মেনিয়ান বাহিনী এ পর্যন্ত আজারবাইজানের প্রায় ২০ শতাংশ অঞ্চল দখল করেছে। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আর্মেনিয়ান বাহিনীকে আজারবাইজানের অধিকৃত অঞ্চল থেকে অবিলম্বে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব অনুমোদন করে। কিন্তু আর্মেনিয়া সেই প্রস্তাব উপেক্ষা করেছে। আর্মেনিয়ার বাহিনী নাগোরনো-কারাবাখ থেকে ৭ লাখ ৮০ হাজার আজেরি মুসলিমকে তাড়িয়ে দেয়। এর প্রতিশোধ হিসেবে আজারবাইজানে থাকা আর্মেনীয়দের ওপর আজেরিরা চড়াও হয় এবং আজারবাইজান থেকে আড়াই লাখ আর্মেনীয় আর্মেনিয়ায় পালিয়ে যায়।

বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার আর্মেনীয় আজারবাইজানের বাকু, গাঞ্জা এবং অন্যান্য শহরে আছে। নাগোরনো-কারাবাখ নিয়ে গত তিনদশক ধরে এই দুই দেশ দ্বন্দ্বে লিপ্ত। ৪,৪০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের পর্বতাঞ্চলটি সোভিয়েত আমলে আজারবাইজান প্রজাতন্ত্রের অধীনে স্বায়ত্তশাসিত এলাকা হিসেবে পরিচিতি পায়। তাছাড়া এখনও অঞ্চলটি আজারবাইজানের বলেই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু  জনসংখ্যার অধিকাংশই জাতিগত আর্মেনিয়ান এবং নিয়ন্ত্রণ করে জাতিগত আর্মেনিয়ানরা। ১৯৯৪ সালের যুদ্ধবিরতির পর থেকে অনেকটাই অচল অবস্থা বিরাজ করছিল।

১৯৮৮-১৯৯৪ সালের যুদ্ধে আজারবাইজান পরাজিত হলেও বস্তুত নাগোরনো-কারাবাখ দ্বন্দ্বের অবসান হয়নি। নাগোরনো-কারাবাখ সংযোগ রেখা বরাবর উভয় পক্ষের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। কিছুদিন পরপরই এই সংঘাত নতুন করে শুরু হয়। ২০০৮ সালের মার্চে এবং ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি, জুন ও সেপ্টেম্বরে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে ৪ দিনব্যাপী যুদ্ধে আজারবাইজান আর্তসাখের কাছ থেকে ৮ থেকে ২০ বর্গ কি.মি. ভূমি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।

২০২০-এর জুলাইয়ে নাগোরনো-কারাবাখ থেকে মাত্র এক শ’ কিলোমিটার দূরে আজারবাইজানের টভুজ শহরে আবার লড়াইয়ের সূত্রপাত হয়। সেপ্টেম্বরে সীমান্ত সংঘাত থেকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। নিহত হন প্রায় ৬ হাজার ৫০০ মানুষ। ছয় সপ্তাহের লড়াইয়ের পর রাশিয়ার মধ্যস্থতায় চুক্তির মাধ্যমে নিজ ভূখণ্ড উদ্ধার করে আজারবাইজান। তবে চুক্তিতে নাগোরনো-কারাবাখের ‘স্ট্যাটাস’ অনিষ্পন্ন ছিল। মস্কো সেখানে ২ হাজার শান্তিরক্ষী মোতায়েন করে।সংঘর্ষের সময় রাশিয়া আর্মেনিয়াকে সামরিক সহায়তা দিয়েছে। এটি আজারবাইজানকে হতাশ করেছে। কারণ, গত ১৫ বছরে তারা মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছে। যুদ্ধবিরতির জন্য রাশিয়া মধ্যস্থতা করলেও ২৭ সেপ্টেম্বর লড়াই আবার শুরু হয়। তখন থেকে আর থামেনি।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা এ বছর এই মাত্রায় সেখানে সংঘাত দেখছি কেন। ২০১৮ সালেনিকোল পাশিনিয়ান আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন। তার প্রথম দিককার বক্তব্য এই দুই দেশের দ্বন্দ্ব সমাধানে বড় আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু তিনি যখন দেখলেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আর্মেনীয় ভোটারদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করতে পারছেন না এবং তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে, তখন তিনি ভোটারদের মন জয় করতে কট্টর জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠলেন। গত আগস্টে পাশিনিয়ান আজারবাইজানের অধিকৃত অঞ্চলগুলোকে আর্মেনিয়ার অঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করেন। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে যুদ্ধের পর থেকে কোনো আর্মেনীয় রাজনীতিবিদ তা বলেননি। এরপরই আজারবাইজান মারমুখী হয়ে ওঠে।

২০২২ সেপ্টেম্বর আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বিরোধপূর্ণ নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চল। এখানে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার সেনাদের মধ্যে ১৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার তুমুল লড়াই হয়েছে। আর্মেনিয়া বলেছে, সীমান্তে সংঘর্ষে তাদের ৪৯ জন সেনা নিহত হয়েছেন। জেরমুক, গরিস, কাপানসহ আজারবাইজান সীমান্তবর্তী কয়েকটি শহরে মঙ্গলবার দিনের শুরুর দিকে গোলাবর্ষণ করা হয়। হামলার জন্য আজারবাইজানকে দায়ী করে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান বলেন, নাগোরনো-কারাবাখের ‘স্ট্যাটাস’ নিয়ে সমঝোতায় রাজি না হওয়ায় এই হামলা চালানো হয়েছিল। পার্লামেন্টে দেওয়া বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, সংঘর্ষের তীব্রতা কমেছে, তবে একটি অথবা দুটি ফ্রন্টে আজারবাইজান থেকে হামলা অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে সীমান্তবর্তী দাশকেসান, কেলবাজার ও লাচিন এলাকায় ‘বড় ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড’ চালানোর জন্য আজারবাইজান আর্মেনিয়াকে দায়ী করেছে বলে আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, ট্রেঞ্চ মর্টারসহ বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে দেশটির সেনা অবস্থানে হামলা চালানো হয়েছেÑ ফলে তাদের ৫০ সেনা নিহত হয়েছেন।অন্যদিকে আজারবাইজানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ইলনুর মামাদোভা গতকাল বলেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে আমাদের সেনা চৌকিতে একের পর এক হামলা চালিয়ে আসছে আর্মেনিয়া। গত কয়েকদিনে বেসরকারি অবকাঠামোতেও হামলা হয়েছে। মঙ্গলবার এসব হামলা মাত্রা ছাড়ালে আমরাও পাল্টা জবাব দিয়েছি। ২০২০ সালের পর এই অঞ্চলে এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী সংঘাতের ঘটনা, যা ওই অঞ্চলে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করেছে। তাই দুই পক্ষের কাছে লড়াই বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।

নাগোরনো-কারাবাখ আজারবাইজানের ভেতরে অবস্থিত একটি ভূখণ্ড। আজারবাইজানের অভিযোগ, অঞ্চলটির আশপাশের বিশাল আজারবাইজানি ভূখণ্ড দখল করে রেখেছিল আর্মেনিয়া।এর আগে সোভিয়েত পতনের পর ১৯৯১ সালের সর্বাত্মক যুদ্ধেও নাগোরনো-কারাবাখ অঞ্চলে প্রাণ যায় প্রায় ৩০ হাজার মানুষের।

রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত আর্মেনিয়া। মঙ্গলবারের লড়াইয়ের পর মস্কো জানিয়েছে, দুই পক্ষ দ্রুত একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব কার্যকরে সম্মত হয়েছে। এক বিবৃতিতে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নাগোরনো-কারাবাখে লড়াইয়ের ঘটনায় মস্কো ভীষণ উদ্বিগ্ন। নতুন করে যাতে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু না হয় তাই গতকাল সকালে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। দুই পক্ষ প্রস্তাবের শর্ত মেনে চলবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে তুরস্কের মিত্র দেশ আজারবাইজান। মঙ্গলবারের লড়াইয়ের বিষয়ে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলিত সাভাসগলু বলেন, ‘দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে শান্তি আলোচনা এগিয়ে নেওয়া ও সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় অগ্রাধিকার দেবে তুরস্ক।’

বর্তমান সংঘাত আজারবাইজানি-আর্মেনীয় জাতিগত দ্বন্দ্বকে আরো তীব্রতর করে তোলার বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। স্বাধীন আজারবাইজানের জনসাধারণের মধ্যে আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ভয় অত্যন্ত তীব্র। ‘আর্মেনীয়ভীতি’ (Armenophobia) আজারবাইজানি জাতীয়তাবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠেছে। আর্মেনীয়দের প্রতি আজারবাইজানিদের ঘৃণা কতটা তীব্র সেটি একটি ঘটনা থেকে বোঝা যায়। ২০০৪ সালে হাঙ্গেরিতে ন্যাটোর একটি বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য একদল আজারবাইজানি ও আর্মেনীয় সামরিক কর্মকর্তাকে প্রেরণ করা হয়েছিল। সেখানে লেফটেন্যান্ট রামিল সাফারভ নামক একজন আজারবাইজানি কর্মকর্তা আর্মেনীয় লেফটেন্যান্ট গুর্গেন মার্কারিয়ানকে ঘুমন্ত অবস্থায় খুন করে। হাঙ্গেরিতে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। ২০১২ সালে তাকে আজারবাইজানের নিকট হস্তান্তর করা হয়। আজারবাইজানি সরকার তাকে শাস্তি দেবে বলে হাঙ্গেরিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে সাফারভকে পুরস্কৃত করা হয়। সাফারভ আজারবাইজানে মেজর পদে পদোন্নতি লাভ করে। অত:পর ৮ বছরের বকেয়া সমস্ত বেতন লাভ করে এবং আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ তাকে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে অভিহিত করেন।

আর্মেনীয়দের মধ্যেও আজারবাইজানিদের প্রতি ঘৃণা ও ভয়। আর্মেনিয়া সরকার নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত বলেই প্রতিটি সরকারই জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে তীব্র আজারবাইজানিবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে। আর্মেনিয়ায় অবস্থিত কয়েকটি আজারবাইজানি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে। আর্মেনিয়ার ইতিহাস থেকে আজারবাইজানিদের মুছে ফেলতে আজারবাইজানি নির্মিত স্থাপত্যগুলোকে ইরানিনির্মিত হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।

 

লেখকঃ  আসাদ পারভেজ, গবেষক ও রাষ্ট্রচিন্তক

ফেসবুকে লেখককে খুঁজে পেতে নিচের লিংকে যান

Asad Parvez

 

আরও পড়ুন