Ads

উপমহাদেশের বিস্মৃত স্বাধীনতা সংগ্রামী ফজলে হক খয়রাবাদী

।। আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ।।

ফজলে হক খয়রাবাদী (১৭৯৭-১৮৬১) উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম সারির এক যোদ্ধা, যিনি ব্রিটিশের হাতে নির্যাতিত ঔপনিবেশিক আমলে মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে দ্বীপান্তরিত অবস্থায় আন্দামানের কারাগারে শাহাদত বরণ করেন। ১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে এক মহান প্রবাদপুরুষ ছিলেন। এই মহান ব্যক্তিত্ব ১৭৯৭ সালে বর্তমান উত্তর প্রদেশের সীতাপুর জিলার খয়রাবাদের এক আলোকিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল মাওলানা ফজলে ইমাম, যিনি ধর্মীয় বিষয়ে মোগলদের উপদেষ্টা ছিলেন এবং তার খেতাব ছিল সদর-উস-সুদুর।

ফজলে হক খয়রাবাদী পাঁচ মাসের কম সময়ে কোরআন হিফজ করেন এবং পিতার অধীনে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর শিক্ষা গ্রহণ শেষে ১৩ বছর শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ব্রিটিশ সরকার ১৮১৬ সালে উনিশ বছর বয়সে তাকে দিল্লিতে ‘সর রিশতাদার’ বা দেওয়ানি আদালতের প্রধান নিয়োগ করে। ১৮৩১ সালে তিনি ব্রিটিশের চাকুরি ত্যাগ করে তাদের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সংগঠিত করা ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর, মির্জা আসাদুল্লাহ গালিব, সদরুদ্দিন আজুরদাসহ ওই সময়ের বিদ্বজনদের সাহচর্যে কাটাতে শুরু করেন। মির্জা গালিবের অনুরোধে তিনি তার প্রথম ‘দিওয়ান’ বা কবিতা সংকলন সম্পাদনা করেন। তিনি উর্দু, আরবি ও ফারসি সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন এবং নিজেও কবিতা লিখতেন। আরবিতে তিনি চার হাজারের অধিক কবিতা ছাড়াও সিপাহি বিদ্রোহের ওপর তিনটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ‘আল্লামা’ নামে অভিহিত হন। পরবর্তী জীবনে তিনি মহান সুফি হিসেবে শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন।

ব্রিটিশের চাকুরি ত্যাগ করার পর তিনি ঝাজ্জারের নওয়াবের দরবারে সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন। ১৮৪০ সালে ঝাজ্জারের নওয়াবের মৃত্যুর পর তিনি ১৮৪৭ সালে অযোধ্যায় নওয়াব ওয়াজিদ আলী শাহের অধীনে ‘সদর-উস-সুদুর’ ও ‘মুহতামিম-ই-হুজুর-ই-তেহশিল’ (তহশিলদার) হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে তিনি আলওয়ারের রাজা ও রামপুরের নওয়াবের দরবারে কিছুকাল বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৫৬ সালে ব্রিটিশ সরকার অযোধ্যাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করলে তিনি আলওয়ারের রাজার আমন্ত্রণে সেখানে যান এবং দেড় বছর বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করার পর দিল্লিতে চলে আসেন সিপাহি বিদ্রোহে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে।

আরও পড়ুন- ভারতের বিস্মৃত স্বাধীনতা সংগ্রামী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ

একজন ইসলামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জিহাদের ফতোয়া জারি করা ছাড়াও ব্রিটিশ মুক্ত স্বাধীন ভারতের জন্যে গণতান্ত্রিক নীতিমালার ভিত্তিতে সংবিধানের একটি খসড়াও তৈরি করেছিলেন বলে জানা যায়। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করার জন্যে তিনি ভারতবাসীর প্রতি আহবান জানান এবং সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পরও তিনি অযোধ্যার বিদ্রোহী নেত্রী বেগম হযরত মহলের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিদ্রোহ চালিয়ে গেছেন।

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের শাসকগণ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নেতৃত্বে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের পর্যায়ে ফজলে হক খয়রাবাদী লখনউ এ অযোধ্যার নওয়াবের দরবারে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি সেখান থেকে বেশ কয়েকবার দিল্লিতে আসেন মোগল সম্রাটের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হওয়ার জন্যে। ১৮৫৭ সালের ২৬ জুন জেনারেল বখত খান ১৪ হাজার দেশীয় সৈন্য নিয়ে বেরেলি থেকে দিল্লিতে পৌছেন। লাল কিল্লায় ব্রিটিশের গুপ্তচর মুনশি জীবন রামের দিনপঞ্জীর বর্ণনা অনুসারে ফজলে হক খয়রাবাদী মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতেন এবং তাকে পরামর্শ দিতেন।

আল্লামা ফজলে হক খয়রাবাদী

ফজলে হক খয়রাবাদী ১৮৫৭ সালের আগস্ট মাসে আলওয়ার থেকে দিল্লিতে আসেন। তার দিল্লি পৌছার এক মাস আগে তার পরামর্শে ও বখত খানের তাগিদে জুলাই মাসের ২৭ তারিখে জুমার জামাতের জেনারেল বখত খানসহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের এক বৈঠকে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জিহাদের আবশ্যকতার ওপর আলোচনার পর একটি ফতোয়া জারির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ফতোয়ায় ৩৫ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির স্বাক্ষর ছিল, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সদরুদ্দিন আজুরদা, আবদুল কাদির, ফয়জুল্লাহ দেহলভি, ফৈজ আহমেদ বদাউনী, ওয়াজির খান ও সাইয়িদ মুবারক শাহ রামপুরী। এই ফতোয়া ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জোরদার করতে দিল্লিবাসীকে বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করে।ফতোয়ায় উল্লেখ করা হয়েছিল যে,

“চলমান পরিস্থিতিতে জিহাদ অবশ্য পালনীয় কর্তব্য এবং নগরীর অধিবাসীদের জন্য জিহাদে অংশগ্রহণ করা জরুরী। এই কর্তব্য পালনের স্বার্থে এই নগরীর বাসিন্দাদের উচিত ব্রিটিশের মোকাবিলায় জিহাদে অবতীর্ণ হওয়া। বিপুল সংখ্যক মুজাদেহীন ও অস্ত্রশস্ত্রের সমাবেশ ঘাঁয় নগরবাসী ও দূরদূরান্তের জনগণের জন্য জিহাদ সন্দেহাতীতভাবে ‘ফরজে আইনে’ পরিণত হয়েছে। নগরবাসী যদি ব্রিটিশকে মোকাবিলা করা থেকে দূরে থাকে বা অলসতা প্রদর্শন করে, তাহলেও তাদের জন্য জিহাদ অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। এমনকি ইসলামী আইন অনুযায়ী একই পরিস্থিতিতে নিপতিত পৃথিবীর সকল অধিবাসীর ওপর জিহাদ করা ফরজ। যেসব স্থান হত্যা ও লুণ্ঠনের সমূহ হুমকির মধ্যে রয়েছে, সেসব স্থানে যদি জনগোষ্ঠীর ক্ষমতা ও শক্তি থাকে, তাহলেও তাদের জন্য জিহাদ অবশ্য পালনীয় কর্তব্য।”

আরও পড়ুন- মুসলমানের রক্তে লেখা ভারতের স্বাধীনতা

খয়রাবাদী দিল্লিতে পৌছার পর বখত খানের পরামর্শে আরেকটি ফতোয়া জারি করেন বলে বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায় এবং ওই সময়ে দিল্লি থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র ‘সাদিুকুল আখবার’ এ তা প্রকাশিত হয়েছে। তার ফতোয়ায় উল্লেখ করা হয়েছিল যে,

“মুসলামানদের জন্য জিহাদ করা ফরজ। কারণ বিধর্মীরা যদি জয়লাভ করে তাহলে তারা মুসলিম নারীপুরুষ ও শিশুদের হত্যা করবে। তারা শুধু তৈমুরের বংশধরদের হত্যা করবে তা নয়, সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করবে।”

১৮৫৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ বাহিনী দিল্লি পুনরাধিকার করলে তারা বিপুল সংখ্যক দিল্লিবাসী, বিশেষ করে মুসলিম বাসিন্দাদের হত্যা করে। অধিকাংশ মুসলিম তাদের সর্বস্ব ত্যাগ করে নগরী ছেড়ে যায়। ফজলে হক খয়রাবাদী ২৪ সেপ্টেম্বর তার পরিবার পরিজন নিয়ে আলওয়ারে যান এবং সেখানে পরিবারকে রেখে দুই মাসের কষ্টকর সফরে ১৮৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসে খয়রাবাদ পৌছেন। সেখান থেকে তিনি অযোধ্যার বিদ্রোহী বেগম হযরত মহলের সঙ্গে যোগ দেন। ডিসেম্বরের ৩০ তারিখে তাকে সীতাপুর থেকে গ্রেফতার করে ১৮৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে লখনউ পাঠানো হয়। সেখানে তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়, সেগুলো হচ্ছে:

১) তিনি ১৮৫৭-৫৮ সালের বিপ্লবী সরকারের নেতা ছিলেন এবং দিল্লি, অযোধ্যা এবং অন্যান্য এলাকার লোকজনকে বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডে প্ররোচিত করেছেন;

২) ১৮৫৮ সালের মে মাসে তিনি বুন্দির বিপ্লবী নেতা মাম্মু খানের সঙ্গে বৈঠকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং হত্যাকাণ্ড পরিচালনার উদ্দেশ্যে তিনি ধর্মীয় ফতোয়া জারি করেন;

৩) ১৮৫৮ সালের মে মাসে তিনি আবদুল হাকিম নামে এক সরকারি কর্মকর্তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বুন্দির লোকজনকে প্ররোচিত করেন।

ফজলে হক তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। আদালত তাকে বিশ্বাসঘাতক ঘোষণা করে তাকে আন্দামানে ‘কালাপানি’র দণ্ডে দণ্ডিত করে। তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আদেশও দান করে। ‘ফায়ার কুইন’ নামে এক জাহাজযোগে তাকে ১৮৫৯ সালের ৮ অক্টোবর আন্দামানের কারাগারে পৌছানো হয় এবং ১৮৬১ সালে ১২ আগস্ট মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সেখানেই অন্তরীণ ছিলেন।

ফজলে হক খয়রাবাদী আন্দামানের কারাগারে অবস্থানকালে আরবি ভাষায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন: “আল সুরাতুল হিন্দিয়া,” “আল ফিতনাতুল হিন্দিয়া” ও “কাসিদা দালিয়া।” ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের কারণ ও পরিণতি এবং দ্বীপান্তরিত বন্দীদের অবস্থা সম্পর্কে জানার উৎস হিসেবে তিনটি গ্রন্থই অত্যন্ত তথ্যবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ।

খয়রাবাদীর পুত্র শামস উল হক ব্রিটিশের উচ্চ আদালতে তার পিতার মুক্তির আদেশ লাভে সফল হন এবং তিনি আদেশনামা নিয়ে ১৮৬১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আন্দামান দ্বীপের পোর্ট ব্লেয়ার পৌছেন। জাহাজ থেকে অবতরণ করে কুখ্যাত সেলুলার দ্বীপের দিকে যাওয়ার সময় তিনি একটি শব মিছিল দেখতে পান। মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের জিজ্ঞাসা করে তিনি জানতে পারেন যে এটি তার মহান পিতার শবমিছিল, যিনি গতকাল (১২ ফেব্রুয়ারি ১৮৬১) ইন্তেকাল করেছেন। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, প্রজ্ঞাবান এই মহান ব্যক্তি শুধু ব্রিটিশের কারাগার থেকে নয়, যন্ত্রণাদায়ক পার্থিব বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করেছেন।

স্বাধীনতা সংগ্রামী আল্লামা ফজলে হক খয়রাবাদীকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের পোর্ট ব্লেয়ারের সাউথ পয়েন্টে কবরস্থ করা হয়েছে। এখনো সেখানে বহু লোক তার মাজার জিয়ারত করতে যান।

আল্লামা ফজলে হক খয়রাবাদীর মাজার

(তথ্যসূত্র: ভারত সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’ ওয়েবসাইট, উইকিপিডিয়া, গোল্ডেন রিসার্চ থটস, মহারাষ্ট্র)

লেখকঃ  লেখক , অনুবাদক এবং ইউ এস এ প্রবাসী বাংলাদেশী সাংবাদিক 

 

 

আরও পড়ুন