Ads

মুসলিম ইতিহাসের প্রথম বাদশাহ মুআবিয়ার বাবা

।। আরিফুল ইসলাম ।।

কুরাইশদের মধ্যে সর্বপ্রথম লেখাপড়া শিখেন হারব ইবনে উমাইয়্যা। [১] এই ঘটনা কুরাইশ ইতিহাস এবং হারব ইবনে উমাইয়্যার বংশের একটি প্যারাডাইম শিফট।

আমাদের সমাজে গ্রামের একটি কৃষক পরিবারের কেউ হাইস্কুলে পড়া তার পরিবারে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। কৃষকের ছেলে হাইস্কুলে যায়, তার ছেলে কলেজ-ভার্সিটিতে যায়। এভাবে দুই-তিন প্রজন্মের পর সেই পরিবার নতুন পরিচয় লাভ করে, তারা আর কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকে না, চাকরি-বাকরি করে।

হারব ইবনে উমাইয়্যার ক্ষেত্রেও এমন হয়। তিনি লেখাপড়া শেখার মাধ্যমে পারিবারিক লিগ্যাসী তৈরি করেন। কয়েক দশক পর সমগ্র আরবে যতো মানুষ লেখাপড়া জানতো, তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলো হারব ইবনে উমাইয়্যার বংশধর। তার একজন নাতি সবচেয়ে সম্মানজনক একটি কাজ করেন, একজন লেখাপড়া জানা লোকের কাছে এরচেয়ে সম্মানজনক কাজ আর কিছু ছিলো না। সেই দায়িত্ব হলো- ওহী লেখা। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে যা নাযিল করেছেন, তা লিপিবদ্ধ করা।

হারব ইবনে উমাইয়্যার বাবা ছিলেন উমাইয়্যা ইবনে আব্দে শামস। তার দুজন ছেলে। একজন হারব ইবনে উমাইয়্যা, আরেকজন আবুল আ’স। উমাইয়্যা ইবনে আব্দে শামসের বংশধররা প্রায় ৮৯ বছর একচ্ছত্রভাবে মুসলিম বিশ্বের শাসন ক্ষমতায় ছিলো। এই বংশের আরেকটি শাখা আন্দালুসের শাসনক্ষমতায় থাকে প্রায় ২৭৫ বছর।

কুরাইশ গোত্রের দুটো বিখ্যাত বংশধারা। একটি বনু হাশিম গোত্র, আরেকটি বনু উমাইয়্যা। বনু হাশিম গোত্রের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন আব্দুল মুত্তালিব, বনু উমাইয়্যা গোত্রের সম্মানিত ব্যক্তি উমাইয়্যা ইবনে আব্দে শামস। দুজনই ছিলেন সমসাময়িক। আব্দুল মুত্তালিবের দায়িত্ব ছিলো হজ্জ ব্যবস্থাপনা, হাজীদের আপ্যায়ন। এই কাজটি ছিলো মক্কার সবচেয়ে সম্মানজনক কাজ। অন্যদিকে, উমাইয়্যা ইবনে আব্দে শামসের দায়িত্ব ছিলো যুদ্ধ পরিচালনা। তিনি ছিলেন মক্কার সেনাপতি।

উমাইয়্যা ইবনে আব্দে শামসের পরিবার একদিকে মিলিটারি কার্যক্রমে দক্ষতা অর্জন করে, পাশাপাশি তারা শিক্ষার্জন করে। ইসলামের প্রসার লাভ করলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, গভর্নরের দায়িত্ব পালনের জন্য লোকবল প্রয়োজন হয়। একইসাথে শিক্ষিত, যোগ্য মানুষ খুঁজতে গেলে উমাইয়্যা ইবনে আব্দে শামসের পরিবারের কাউকে খুঁজতে হতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময়ে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন উমাইয়্যা বংশের দশজন ব্যক্তি। [২]

হারব ইবনে উমাইয়্যা বিয়ে করেন আরবের সুন্দরী কন্যা সাফিয়্যা বিনতে হাযনকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের পাঁচ বছর পূর্বে ৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে এই দম্পতির ঘরে একজন পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে। নবজাতকের নাম রাখা হয় সাখর, বাবার সাথে মিলিয়ে তার নাম হয় সাখর ইবনে হারব। [৩]

মক্কাবাসীর অন্যতম পেশা ছিলো ব্যবসা। ব্যবসার উদ্দেশ্যে তারা রোমান সাম্রাজ্য, পারস্য সাম্রাজ্যে যেতো। আমাদের সময়ে মা-বাবা সন্তানকে লেখাপড়া শেখান, সন্তান বড়ো হয়ে চাকরি করবে এই আশায়। তৎকালীন আরবের বাবারা সন্তানকে ব্যবসা শেখাতেন। বিজনেস ট্রিপে কাফেলার সাথে সন্তানকে পাঠাতেন যাতে তারা ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে দেখা যায় তাঁর বয়স যখন মাত্র নয় বছর, তখন তিনি তাঁর চাচা আবু তালিবের সাথে ব্যবসায়িক সফরে সিরিয়া যান। আরবরা এভাবে তাদের সন্তানদেরকে হাতে কলমে ব্যবসা শেখাতো।

লেখকের আরও লেখা পড়ুন-যিনি ছিলেন দুই খলিফার স্ত্রী

হারব ইবনে উমাইয়্যাও তার ছেলে সাখর ইবনে হারবকে ব্যবসা শেখার জন্য বাণিজ্য কাফেলার সাথে সিরিয়ায় পাঠাতেন। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ-এমবিএ কোর্সের মাধ্যমে ব্যবসা সংক্রান্ত থিওরিটিক্যাল ধারণা দেয়া হয়। ব্যবসা করতে গেলে এই থিওরিটিক্যাল ধারণা প্রয়োজন এটা অনস্বীকার্য, কিন্তু ব্যবসা করতে গেলে এভাবে প্রায় ছয় বছর পড়াশোনা করতে হবে এটার প্রয়োজনীয়তা কতোটুকু?

যার কারণে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় শিক্ষায় গ্র্যাজুয়েশন সমাপ্ত করে নব্বই ভাগের বেশি গ্র‍্যাজুয়েট ব্যবসায় না জড়িয়ে চাকরি খুঁজতে থাকে। এই ছয় বছরের পড়াশোনায় সে থিওরিটিক্যালি পড়েছে একটি ব্যবসা কিভাবে দাঁড়ায়, কোন কোন মডেল অনুসরণ করে, কিভাবে পরিকল্পনা করা হয়, কী কী পদ্ধতিতে হিশেব রাখা যায় ইত্যাদি। কিন্তু এই জ্ঞান তাকে ব্যবসা করার জন্য যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী বানায় না।

প্রাচীন মানুষ আর আধুনিক মানুষের মধ্যে পার্থক্যের জায়গা এখানে। উদাহরণটা অনেকটা এমন- প্রাচীন মানুষ পুকুরে নেমে সাঁতার শিখতেন, আধুনিক মানুষ সাঁতার শেখার জন্য কিছুদিন বই পড়বে, ইউটিউবে ভিডিও দেখবে, একজন ট্রেইনার রাখবে, অতঃপর পুকুরে নামবে।

তখনকার যুগের পনেরো বছরের কিশোররা যুদ্ধ করতে পারতো। পনেরো বছরের মধ্যে অনেকগুলো লাইফস্কিল শিখে নিতো। ঘোড়া চালানো জানতো, সাঁতার, তীর-ধনুক চালানো, ব্যবসায়িক সফরে বিদেশ যেতে পারতো। বর্তমান যুগের পনেরো বছরের ‘শিশু’ সন্ধ্যার সময় ঘরে ঢুকে এস.এস.সির প্রস্তুতি নিতে থাকে।

সাখর ইবনে হারব দ্রুততম সময়ে ব্যবসা শিখে ফেলেন। তিনি কুরাইশদের ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশোনা করতেন, বড়ো বড়ো কাফেলা নিয়ে সিরিয়ায় যেতেন। বাণিজ্য কাফেলার নেতা হিশেবে তার হাতে থাকতো ঝাণ্ডা। কুরাইশদের সবচেয়ে সম্মানিত ঝাণ্ডা ছিলো ‘আল-উকাব’। এই ঝাণ্ডাটি তারা যুদ্ধের সময় ব্যবহার করতো। তাছাড়া কুরাইশ বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব বুঝাতে এই ঝাণ্ডাটি ব্যবহৃত হতো; বর্তমান সময়ে যেমন বিভিন্ন দেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহৃত হয়। কুরাইশদের বাণিজ্যিক সফরে ‘আল-উকাব’ ঝাণ্ডাটি থাকতো সাখর ইবনে হারবের হাতে। [৪]

তৎকালীন আরবে বহুবিবাহ ছিলো খুবই সাধারণ ঘটনা। আরবের বেশিরভাগ সক্ষম পুরুষ একাধিক বিয়ে করতেন। কেউ দুটো, কেউ চারটি, কেউ আট-দশটি বিয়ে করতেন। ইসলাম এক্ষেত্রে সীমা নির্ধারণ করে দেয়। একজন পুরুষ একই সময়ে চারজনের বেশি স্ত্রী রাখতে পারবে না। কুরআনের আয়াত নাযিল হবার পর কয়েকজন সাহাবী চারজন স্ত্রী রেখে বাকিদেরকে তালাক দেন।

সাখর ইবনে হারব আরবের ঐতিহ্য অনুযায়ী একাধিক বিয়ে করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে মোট ছয়টি বিয়ে করেন। ছয় স্ত্রীর গর্ভে তার মোট ১৬ জন সন্তান জন্মগ্রহণ করে। এই ষোলো জন সন্তানের মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত হন। কেউ হন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী, কেউ হন মিলিটারি কম্যান্ডার, কেউ হন গভর্নর, কেউ হন খলিফা।

আরবদের সাধারণত দুটো নাম থাকতো। একটি পিতৃপ্রদত্ত নাম, আরেকটি পিতা হবার পরের নাম। বাবা হবার পর তারা সন্তানের নামে নিজেদের নামকরণ করতো। সন্তানের নামের আগে ‘আবু’ নামটি যুক্ত করলেই বাবার নাম হয়ে যায়। যেমন: আবু বকর, আবু যর, আবু উবাইদা, আবু আইয়ূব, আবু দারদা ইত্যাদি।

আরবের নারীরা মা হবার পর সন্তানের নামের আগে ‘উম্মু’ যোগ করে নতুন নাম রাখতো। যেমন: উম্মু সুলাইম, উম্মে হানী, উম্মে কুলসুম, উম্মে আয়মান, উম্মে রুমান ইত্যাদি।

সন্তানের নাম ছাড়াও অনেকেই নামের আগে ‘আবু’ যুক্ত করতেন। যেমন: আবু হুরাইরা, আবু হানিফা, আবু জাফর।

আরও পড়ুন- নারীদের মসজিদে নামাজ ও আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা

সাখর ইবনে হারব তার পিতৃপ্রদত্ত নামে পরিচিতি লাভ করেননি। তিনি পরিচিতি লাভ করেন তার ডাকনামে। তার ডাকনাম ছিলো আবু সুফিয়ান সাখর ইবনে হারব।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত লাভের পর থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর তিনি রাসূলুল্লাহর সাথে শত্রুতা পোষণ করেন। বদর যুদ্ধে তিনি ছিলেন মক্কার কুরাইশ বাহিনীর অন্যতম নেতা। এই যুদ্ধে মক্কার বেশিরভাগ নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা হয়। ফলে, আবু সুফিয়ান হয়ে উঠেন মক্কার একচ্ছত্র নেতা। তার নেতৃত্বে মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরবর্তী সকল যুদ্ধে মক্কাবাসী অংশ নেয়। উহুদ, খন্দক যুদ্ধে আবু সুফিয়ান একাই কুরাইশ বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। এই যুদ্ধগুলোর পূর্বে অন্তত প্রায় ৫০ বছর কুরাইশ বাহিনীর কোনো যুদ্ধে একক সেনাপতি ছিলো না। [৫]

মক্কা বিজয়ের দিন আবু সুফিয়ান সাখর ইবনে হারব ইসলাম গ্রহণ করেন। রাদিয়াল্লাহু আনহু। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মর্যাদার কথা ভেবে তাঁকে সমীহ করেন। তিনি ঘোষণা দেন- ‘যে আবু সুফিয়ানের ঘরে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ’। [৬]

ইসলাম গ্রহণের আগে যিনি মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন, ইসলাম গ্রহণের পর সেই আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসলিমদের পক্ষে যুদ্ধ করেন। এমনকি যুদ্ধে তিনি তাঁর দুটো চোখ হারান। তায়িফ অবরোধে অংশগ্রহণ করে হারান এক চোখ, ইয়ারমুক যুদ্ধে হারান অপর চোখ। [৭]

আটাশি বছর বয়সে আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু ইন্তেকাল করেন। তাঁর জানাযায় ইমামতি করেন তাঁর সুযোগ্য সন্তান মুআবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু। [৮]

যেই বয়সে তাঁর বাবা আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু সিরিয়া যেতেন ব্যবসার জন্য, সেই বয়সে মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু সিরিয়ার গভর্নর হন।

চলবে…

লেখকের ধারাবাহিক লেখা “রাজতন্ত্র” এর প্রথম পর্ব রাজতন্ত্র-০১

লেখকঃ কলাম লেখক

ফেসবুকে লেখকে পেতে এই লিংকে ক্লিক করুন – আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

 

মুসলিম ইতিহাসের প্রথম বাদশাহ মুআবিয়ার বাবা – মুসলিম ইতিহাসের প্রথম বাদশাহ মুআবিয়ার বাবা -মুসলিম ইতিহাসের প্রথম বাদশাহ মুআবিয়ার বাবা

আরও পড়ুন