Ads

এ বঞ্চনার অবসান কবে হবে ?

নূরুল ইসলাম খলিফা

হঠাৎ করেই এক ছাত্রীর ফোন পেলাম গতকাল সন্ধ্যায়। প্রথম জীবনে শিক্ষকতা করতাম আমার পাঠকদের মধ্যে কম বেশি সবাই সম্ভবত জানেন। মেয়েটি যতদূর মনে পড়ে ১৯৭৪ সালে ষষ্ঠ শেণিতে ভর্ত্তি হয়েছিল। আমার ছাত্র ছাত্রীরা আমাকে বেশ ভাল বাসতো- শ্রদ্ধা করতো যেমনটা পরবর্তীতে আমার কলিগদের কাছে পেয়েছি। পঁয়তাল্লিশ বছর আগের ছাত্র ছাত্রীদের কেউ কেউ এখনও দেশ বিদেশ থেকে ফোন করে, খোঁজ খবর নেয়। কখনও কখনও নিজেদের সুখ দু:খের কথা বলে, জীবন সমস্যা মোকাবিলায় পরামর্শ চায়। এই শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে নিজেকে হালকা করে। আমিও ৪৫ বছর আগের উচ্ছল সেই দিনগুলোর সুখস্মৃতিতে ফিরে যাই । ওরা দাদী নানি যাই হোক না কেন, আমার সামনে ভেসে ওঠে ওদের সেই কিশোর চপল চেহারাটাই । আমি মনে করি ভ্রাতৃত্বের তথা হৃদ্যতা এটি একটি মনোহর রূপ।

এই বোনটির সাথে আমার অনেকদিন হলো তেমন যোগাযোগ নেই। ওর বাবা আমার বয়সে বড় ছিলেন কিন্তু দারুন সমীহ করতেন। তিনি বাই সাইকেল চালাতেন,কিন্তু এমনটা আমার মনে পড়ে না যে , আমার সাথে রাস্তায় দেখা হলে কখনও সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়েননি। আমি বেশ বিব্রত হতাম তার এই বিনয় দেখে। তিনি সামাজিক ভাবেও বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। তখনকার প্রেক্ষাপটে বলা যায় বেশ অবস্থাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। এটি ছিল তার প্রথম সন্তান। অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে হলেও মেয়েটি বেশ প্রাণখোলা ও আন্তরিক ছিল। সহপাঠী মেয়েদের সাথে তার সম্পর্ক ভীষণ আন্তরিক ছিল। বছর দু’য়েক আগে স্কুলের এক পূনর্মিলনী প্রোগ্রামে ওর সাথে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল। দুই ছেলে এবং চার নাতি নাতনীর দাদী সে এখন।

নিজের কথা বললো, আমার খোঁজ খবর নিল বিশেষ করে আমার বেগমের খোঁজ খবর নিল বেশ সময় নিয়ে। উল্লেখ্য যে , আমার বেগম আবার ওদের বিশেষ করে ছাত্রীদের খুবই প্রিয়। নিজের কথা বলতে গিয়ে কিছু বঞ্চনার কথা বললো যা শুনে আমি তো অবাক ! বিশেষ করে ওর বাবার ব্যাপারে ভীষণ হোঁচট খেলাম। ভদ্র লোকের একটাই ছেলে,তিনটি মেয়ে।

ও বললো যে , ‘স্যার ! বাবা সব বিষয় সম্পত্তি ভাইয়ের নামে লিখে দিয়ে গেছে।’ ভাই বেশ স্বচ্ছল এবং সপরিবারে ঢাকায় থাকে। এখন ভাই আর কোনো খোঁজ খবর নেয় না। স্বামী কিছুটা অসুস্থ , ছেলে দুটো ছোট খাট চাকুরী করে। ফলে বঞ্চনার অনুভুতিটা বেশ প্রকট।

মনটা খারাপ হয়ে গেল। ইসলাম পিতা মাতার বিষয় সম্পদের উত্তরাধিকার এত বেশি সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে যে, এর চাইতে ভালো কোনো বিকল্প আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারে নি। এটি আল্লাহ তায়ালার একটি ফরজ বিধান। এখানে ভাইয়ের যেমন অধিকার আছে , ঠিক তেমনি বোনেরও আধিকার আছে। অংশে তারতম্য থাকলেও অধিকারের গুরুত্বের দিক থেকে কোনো তারতম্য নেই। পুত্র সন্তান যে অধিকারে পিতার সম্পদ ভোগ করে , কন্যাও সেই একই অধিকারে তা ভোগ করবে। কিন্তু এই বঞ্চনা যে কত !

মজার বিষয় হচ্ছে পিতার সম্পদ থেকে বোনদের বঞ্চিত করার এই কাজে আলেম ফাজেল আর মিষ্টারদের মধ্যে দারুন ঐক্য আছে। আমার জীবনে অনেক হাজী গাজীদের দেখেছি মেয়েদের বঞ্চিত করতে ; একই ভাবে তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত মিষ্টারদেরও দেখেছি এই কর্ম কান্ড করতে। ইসলাম নারীদের যে অধিকার দিয়েছে সেটা শুধু কিতাবে থাকলে তো চলবে না। বিষয়টির পূর্ন বাস্তবায়ন হওয়া দরকার। আমরা যারা ইসলামের কথা বলি , তাদের মধ্যেও এরকম বঞ্চনার কাহিনী কম নয়।

এ বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। প্রথমত: বঞ্চিত নারীদের মুখ খুলতে হবে। সমাজের আলেম ওলামাদেরকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। যারা এ ধরনের ঘৃন্য কাজ করে , আল্লাহর সুস্পষ্ট বিধানকে অগ্রাহ্য করে তাদের মেসেজ দিতে হবে যে, তাদের জানাযা পড়া হবে না এবং তাদের জন্য কোনো দোয়াও হবে না। মসজিদের মিম্বর থেকে একযোগে এই ঘৃণ্য কাজের নিন্দা জানাতে হবে। একই সাথে সমাজে যারা ইসলামকে ভালবাসেন, মানুষের অধিকারের কথা বলেন তাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। তারা এই জাতীয় মানুষগুলোকে সামাজিকভাবে বয়কট করবেন। আর রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। ইসলামী স্কলারদের মতামত নিয়ে কন্যা সন্তানদের বঞ্চিত করে কেউ এধরনের দলিল সম্পাদন করলে তা বাতিল বলে গন্য হবে এমন আইন প্রনয়ন করতে হবে।

একটা কষ্টের অনুভুতি নিয়ে ঘুমাতে গেলাম প্রিয় ছাত্রীটির এই কাহিনী শুনে। অথচ ও ছিল বলা যায় পিতার আদরের দূলালী। কেন যে মানুষ এমন হয়ে যায় ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। দু’দিনের এই দুনিয়ায় সম্পদের নেশা মানুষকে যেভাবে অমানুষ বানিয়ে দেয়, দেখে সত্যিই বেদনার্ত হয়ে যায় মনটা !

লেখকঃ কলাম লেখক ও ব্যাংকার

লেখকের প্রকাশিত অন্য লেখা-

মুর্শিদী-মারফতী কি বাঙালি সংস্কৃতি নয় ?

আরও পড়ুন