Ads

মুর্শিদী-মারফতী কি বাঙালি সংস্কৃতি নয় ?

 নূরুল ইসলাম খলিফা

বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে মহল বিশেষের মতলবী প্রচারণা ও উদ্ভট লম্ফ-ঝম্ফ আমরা মাঝে মধ্যেই দেখি। এ মহলটির মুখপাত্র হিসেবে কিছু মিডিয়া এ বিষয়ে বিভিন্ন দিবস, পর্ব কিংবা ঊপলক্ষ্য সামনে পেলেই তাদের মতলবী প্রচারণার ঢোল বাজাতে শুরু করে । দেশের আম জনতা যদিও তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ধ্বজাধারী এই মহলটিকে খুব ভাল করেই জানে এবং তাদের মগজ কোন জায়গায় বন্ধক দেয়া আছে তাও জানে। তার পরেও তাদের মতলবী প্রচারণায় মানুষ বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম যাতে বিভ্রান্ত না হয়, সে জন্য মাঝে মধ্যে এদের স্বরূপ উন্মোচন করে দু’য়েক কলাম লিখা প্রয়োজন বলে মনে করি।

এই মহলটি সাধারণত: রমনার বটমূলে বাংলা বর্ষ বরণ, রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকি পালন কিংবা বিশ্ব ভারতী থেকে ডক্টরেট করে আসা ইত্যাদিকেই বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান উপকরণ হিসেবে প্রচার করতে চেষ্টা করে ।আর এ কাজে লিপ্ত বা পারদর্শী ব্যক্তি বিশেষরা তাদের দৃষ্টিতে হয়ে উঠেন বাঙালি সংস্কৃতির বিরল সাধক। আঠারো কোটি মানুষের এই জনপদের আর কিছু তাদের চোখে পড়ে না , সে সব নিয়ে তারা ভীষন নির্লিপ্ত। বাংলা বর্ষ বরণ, রবীন্দ্র নাথ ইত্যাদি এর কোনোটাকেই আমরা খাটো করে দেখছি না। কিন্তু আমাদের কথা হলো আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গনে কি আর কিছু নেই ? আমাদের জীবনাচারের বাকি অসংখ্য বিষয় তাহলে কাদের সংস্কৃতি ?

আসলে সংস্কৃতি বলতে কি বুঝায় ? আমরা যারা সাধারণ মানুষ , খুব বেশি বিদ্যা বুদ্ধি নেই তারা সংস্কৃতি বলতে বুঝি একটি জনপদ বা দেশ কিংবা জাতি রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের গোটা জীবনাচার যার মধ্যে তাদের বোধ-বিশ্বাস, ধর্ম-কর্ম ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।

উইকিপিডিয়া, বাংলা পিডিয়া, ক্যামব্রীজ ইংলিশ ডিকশনারী, নিউ ওয়ার্লড এনসাইক্লোপিডিয়া- সব জায়গায় প্রায় একই সুরে বলা হয়েছে , ‘সংস্কৃতি হলো মানুষের জ্ঞান, আচার-আচারণ,বিশ্বাস, রীতি-নীতি, নীতিবোধ ইত্যাদি। ক্যামব্রীজ ইংলিশ ডিকশনারী বলেছে যে , সংস্কৃতি হচ্ছে

“জীবন যাপনের পন্থা বিশেষ করে নির্দিষ্ট একটি সময়ে নির্দিষ্ট একটি দলের মানুষদের সাধারণ প্রথাসমুহ ও বিশ্বাসগুলো। ” ( the way of life , especially the general customs & beliefs of a particular group of people at a particular time )

উইকিপিডিয়া সংস্কৃতির সঙ্গা দিয়েছে , “কোনো স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায় , সঙ্গীত , নৃত্য, সাহিত্য,নাট্যশালা , সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয় তাই সংস্কৃতি।” New world Encyclopedia বলছে

“ Culture has been called ‘the way of life for an entire society .’ As such it includes codes of manners , dress , language , religion, rituals, norms of behavior such as law and morality and systems of belief .”

এখানে ভাষার কথা যেমন আছে , পোশাক পরিচ্ছদের কথাও আছে তেমনি ধর্ম বা বিশ্বাসের কথাও আছে। অর্থাৎ সংস্কৃতি মানে একটি জাতি বা গোষ্ঠির সামগ্রিক জীবনাচারণ।

উদ্ধৃতি আর দীর্ঘ করলাম না। প্রশ্ন হলো রমনা বটমূলে নববর্ষ বরণ কিংবা রবীন্দ্র চর্চাই কি কেবল বাঙালি সংস্কৃতি? বাংলাদেশের প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষের জীবনাচারের বাকি রীতি-পদ্ধতিগুলো কি বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয় ? রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চা বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হলে ভাটিয়ালী , মুর্শিদী এবং মারফতী কেন বাঙালি সংস্কৃতি নয় ? ফররুখ আল মাহমুদরা কেন বাঙালি সংস্কৃতির বিরল সাধক হবেন না ? তাদের নিয়ে এই মহলটির মুখে কেন কুলুপ আটা থাকে ? নজরুলের ‘উমর ফারুক’ পাঠ্য তালিকায় দিলে তথাকথিত প্রগতিশীল বাঙালিদের গাত্রদাহ কেন হয় ? উমর ফারুক লিখে নজরুল যদি বাঙালি সংস্কৃতির বিপক্ষে গিয়ে থাকেন , তাহলে শিবাজী বন্দনা করে রবীন্দ্র নাথ কোন বাঙালির পরিচয় দিলেন ? তাহলে কি নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত আর কীর্তন বাঙালি সাহিত্য আর ইসলামী গান , হামদ-নাত পরিত্যাজ্য ? আমরা তো মনে করি রবীন্দ্র নাথ যেমন বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ , তেমনি নজরুল , ফররুখ , আল মাহমুদরাও বাঙালি সংস্কৃতির অবিভাজ্য অংশ।

কপালে টিপ দেয়া যদি বাঙালি সংস্কৃতি হয় , ওড়না-হিজাব কেন বাঙালি সংস্কৃতি হবে না ? এদেশের কত শতাংশ নারী কপালে টিপ পরেন ? কেউ প্রশ্ন করতে পারেন- হিজাব এবং ওড়না আরব কিংবা তুর্কীরা এদেশে নিয়ে এসেছে। আমরা বলবো টিপ দেয়ার প্রথা তো আর্যদের আমদানী। আর্যরাও কিন্তু বহিরাগত। তারা এ মাটির আদি বাসিন্দা নয়। বিশ্ব সভ্যতা এভাবেই গ্রহন বর্জনের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়েছে এটাই পৃথিবির ইতিহাস। বর্ষ বরণ যদি বাঙালি সংস্কৃতি হয় তবে রোযা-ঈদ কেন বাঙালি সংস্কৃতি হবে না ? তাহলে এই মহলটি কি বৈদিক সংস্কৃতিকেই বাঙালি সংস্কৃতি বানাতে চান ? তারা কি তাহলে শ্রীকান্তের ‘মাঠে বাঙালি ও মুসলমানদের মধ্যে খেলা হবে ’- সেই দর্শনের আমদানী করতে চান ? এদেশের নব্বই ভাগ

মানুষের বোধ বিশ্বাস ও জীবনাচারকে বাঙালির খাতা থেকে খারিজ করে দিতে চান ?
বর্ণবাদ , ব্রাহ্মন্যবাদ , মারাঠা বর্গী ,পাঞ্জাবী লুটেরাদের শোষণ-নিপিড়নের বিরুদ্ধে লড়াকু এই বাংলার সহজ সরল মানুষগুলো কিন্তু মতলববাজদের চিনতে ভুল করে না। সময় মতই তারা জবাব দিয়ে দেয়।

লেখকঃ কলাম লেখক ও ব্যাংকার

এই লেখা সংশ্লিষ্ট প্রকাশিত অন্য লেখা

বোরখা পরা নিষেধ !

আরও পড়ুন