Ads

ঐতিহাসিক বিদায় হজ্ব ও রাসুল ( সাঃ) এর অন্তিম যাত্রা

 ।। দিল আফরোজ রিমা ।।

ঐতিহাসিক বিদায় হজ্ব সম্পর্কে কিছু লেখার পারম্ভেই আমার দুচোখ অশ্রুসিক্ত হল। বিষয়টি স্টাডি করতে গিয়ে মনে হয়েছে আমার প্রাণের রাসুল (সাঃ) যেন নতুন করে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।

জিলহজ্জ মাসের নয় তারিখ শুক্রবার। সেদিন রাসুল (সাঃ) সমস্ত মুসলমানদের সাথে নিয়ে আরাফাতের ময়দানে সমবেত হলেন। ধারণা করা হয় এক লক্ষ পঁচিশ হাজার মুসলমান সেদিন একত্রিত হয়েছিলেন। সেই বিশাল জনসমুদ্রের সামনে রাসুল (সাঃ) তার নিজের উটের পিঠে বসে তার শেষ ভাষণ ব্যাক্ত করলেন। এই ভাষণের মধ্য দিয়েই তার জীবন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পূর্বাভাস সূচিত হয়।

রাসুল (সাঃ) বললেন – হে মুসলিমগণ এখানে তোমাদের সাথে আমার আর মিলন ঘটবে না। অতএব আমার কথাগুলো তোমরা মনযোগ সহকারে শ্রবণ কর। তারপর তিনি ভাষণ শুরু করলেন।

––” হে আল্লার বান্দাগণ, আজ হজ্বের দিন, পবিত্র জিলহজ্জ মাস। এই মক্কা নগরী যেমন পবিত্র তোমাদের পরস্পরের জান-মালও তোমাদের পরস্পরের কাছে তেমন পবিত্র। তোমাদের কাছে কারো কোন মাল গচ্ছিত থাকলে তা ফেরত দিয়ে দাও।

–হে মুসলিমগণ তোমরা একে অপরের ভাই। তোমাদের একের সম্পদ তার অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ খরচ করো না।

–হে মুসলিম পুরুষগণ, মুসলিম নারীদের প্রতি তোমাদের কর্তব্য রয়েছে। হে মুসলিম নারীগণ, মুসলিম পুরুষদের প্রতি তোমাদেরও কর্তব্য আছে। তোমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্তব্যগুলো পালন করো।

–হে মুসলিমগণ, স্ত্রীলোকদের সাথে নরম ও উদার ব্যবহার করো। ক্রীতদাসদের সাথে সদ্ব্যবহার করো। যা নিজে ভক্ষণ কর, তাদেরকেও তা খেতে দিও। নিজেরা যা পরিধান কর, তাদেরকে তাই পড়তে দিও। যদি কোন কাজে তারা ভুল করে ফেলে তবে তা ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখো।

–হে মুসলিমগণ তোমরা সত্য পথ থেকে ফিরে যেওনা। তোমরা একে অপরের প্রতি অত্যাচার করোনা। তোমরা একে অন্যকে হত্যায় লিপ্ত হয়োনা। কাল কিয়ামতে নিশ্চয়ই তোমাদের আল্লাহর দরবারে হাজির হতে হবে। সেখানে তোমার কার্যাবলীর হিসাব গ্রহণ করা হবে। হুসিয়ার থেকো। আমি তোমাদের জন্য আমার আদর্শ, এবং আল্লাহর কিতাব পবিত্র কোরআন রেখে গেলাম। যদি তোমরা কোরআনকে এবং আমার আহকামকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর,তাহলে কখনো পথ হারাবে না। যে কাজ করবে, সরল হৃদয়ে করো। মুসলমানদের কল্যাণ কামনা করো। পরস্পরে ঐক্য বজায় রেখো।

–হে উম্মতগণ, তোমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ এবং তোমরা সবাই হযরত আদম (আঃ) এর বংশধর। আল্লাহ পাক মাটি দ্বারা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তোমাদের মধ্যে সে বেশি মর্যাদাশীল যে আল্লাহকে ভয় করে। ধর্মভীরুতা ছাড়া আরব আজমের কোন ভেদাভেদ নেই। অনারবের প্রতি আরবের, আরবের প্রতি অনারবের এবং সাদার প্রতি কালোর বা কালোর প্রতি সাদার কোন প্রাধান্য বা আভিজাত্য নেই। বিশ্বের সমগ্র মুসলমান এক ভ্রাতৃ সম্পর্কে আবদ্ধ।

–হে মুসলিমগণ! তোমারা যেনে রাখো, আমিই দুনিয়ার শেষ পয়গাম্বর। আমার পরে আর কেউ পৃথিবীতে নবী হিসাবে আগমন করবে না। এখন সকলেই তোমাদের মাবূদের প্রশংসায় নিয়োজিত থাকো। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় কর। রমযানের রোযা রাখো। মালের যাকাত আদায় কর। হজ্ব পালন কর। নেতৃত্বস্থানীয়দের মান্য কর। আর এ সব কাজ দ্বারা বেহেশতে নিজেদের জায়গা করে নাও।

ভাশনের সমাপ্তিক্ষণে রাসুল ( সাঃ) উম্মতদের জিজ্ঞেস করলেন-কাল কিয়ামতে আল্লাহ আমার কর্তব্য পালন সম্পর্কে তোমাদের কাছে জানতে চাইলে তখন তোমরা কি বলবে?

উপস্থিত জনতা সবাই একসাথে বললেন-হে আল্লাহর নবী! আপনি আল্লাহর নির্দেশসমূহ প্রচার করেছেন। আপনি আপনার রেসালাতের দায়িত্ব পালন করেছেন। আপনি সৎ অসতের পার্থক্য ঘোষণা করেছেন।

রাসুল (সাঃ) পর পর তিনবার বললেন – ইয়া মাবূদ, তুমি স্বাক্ষী থেকো, ইয়া মাবূদ তুমি স্বাক্ষী থেকো, ইয়া মাবূদ তুমি স্বাক্ষী থেকো। ইয়া মাবূদ তুমি দেখ এরা সকলে স্বাক্ষী দিচ্ছে। তারপর রাসুল (সাঃ) বললেন – তোমারা যারা এখানে উপস্থিত আছো তারা অনুপস্থিত লোকদের কাছে আমার কথাগুলো পৌঁছে দিও।

রাসুল (সাঃ) এর ভাষনের পর ফেরেস্তা জিবরাইল (আঃ) এসে আল্লাহর পক্ষ থেকে ইসলামের পূর্ণতা লাভের মহা সংবাদ ঘোষণা করেন।––আজ আমি তোমার জন্য তোমার ধর্মকে সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমার প্রতি আমার নেয়ামতের সমাপ্তি ঘটল। আর ধর্ম হিসাবে ইসলামকেই আমি মনোনীত করলাম। – (আল কোরআন।)

রাসুল ( সাঃ) মিনার নিকট উপস্থিত হয়ে মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বলেন–হে মুসলিমগণ! আজকের এইদিন, এই মাস এবং এই শহর তোমাদের নিকট যেমন পবিত্র, তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এবং তোমাদের আবরু ইজ্জতও ঠিক তেমনি পরস্পরের নিকট মূল্যবান ও পবিত্র। খবরদার! আমার অবর্তমানে তোমরা বিপথগামী হয়ে পরস্পরে হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়োনা।

তোমরা মনে রেখো একদিন তোমাদেরকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে। আল্লাহ তোমাদের কাজের হিসাব গ্রহণ করবেন। যার যার অপরাধের জন্য সে নিজেই দায়ী হবে৷

––হে উম্মতগণ! শয়তান এখন এই শহরে পূজা অর্চনা সম্পর্কে ভরসা ছেড়েছে। তবে ক্ষুদ্র ব্যাপারেও তার পথের পথিক হলে নিশ্চয়ই শয়তান আনন্দিত হবে।

—- হে মুসলিমগণ! জেনে রাখো, ঈমান( কালিমা) নামাজ, রোযা, হজ্ব, যাকাত বেহেসতে প্রবেশের পাথেয়। উপস্থিত মুসলিম গণ! সত্যের আহবান তোমাদের পৌছে দিলাম। অতঃপর রাসুল( সাঃ) কোরবানির স্থানে চলে গেলেন। তিনি নিজে তেষট্রিটি উট কোরবানি করলেন। কোরবানির মাংস এবং চামড়া লোকদের মধ্যে বন্টন করে দিলেন। অতঃপর তিনি বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করে যমযম কুপের পানি পান করে আবার মিনায় ফিরে এলেন।

জিলহজ্জ এর ত্রয়োদশ তারিখে বাইতুল্লাহর শেষ তাওয়াফ বা বিদায় তাওয়াফ সমাধা করে সঙ্গিসাথি নিয়ে মদিনার পথে যাত্রা করেন।

পথিমধ্যে যমযম কুপের কাছে উপস্থিত হয়ে রাসুল( সাঃ) আবার ঘোষণা করলেন-

-হে মুসলিমগণ! আমি তোমাদেরই মত রক্ত মাংসে গড়া মানুষ মাত্র। হয়তো শীঘ্রই আল্লাহ আমাকে তার কাছে যাবার আহবান জানাবেন এবং আমাকে তোমাদের নিকট থেকে বিদায় গ্রহন করতে হবে। আমি তোমাদের কাছে দুটি জিনিস রেখে যাব। এক- আল্লাহর কোরআন উহা তোমাদেরকে সঠিক পথ দেখাবে। মজবুত করে কোরআন ধরে থেকো।

দুই- আমার হাদিস।

আমার পরিবার পরিজনের সাথে আচার ব্যবহারে আল্লাহকে ভয় করে চলবে। আমাকে যারা ভালবাসে তারা যেন আলীকেও ভালবাসে। তিনি তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন – ইয়া মাবুদ যারা আলীকে মহব্বত করে তুমি তাদেরকে মহব্বত করো। আর যারা আলীর সাথে শত্রুতা করে তুমিও তাদের দুশমন জেনো। তিনি আবার মদিনার পথে চলতে শুরু করলেন।

মদীনায় গিয়ে রাসুল ( সাঃ) গভীরভাবে আল্লাহ পাকের ধ্যান উপসনায় মগ্ন হয়ে গেলেন। সে বৎসর রমজানে তিনি বিশ দিন এতেকাফ করলেন।

রাসুল (সাঃ) তার পরিবারের উদ্দেশ্যে বললেন- হে আমার পরিজন! আল্লাহর নবী ( সাঃ) এর সাথে সম্পর্কের গৌরব যেন তোমাদের ধর্ম, কর্ম থেকে বিমূখ না করে। কন্যা এবং ফুফুদেব সম্ভোধন করে বলেন-হে নবীর কন্যা ফাতেমা! হে নবীর ফুফিরা! আল্লাহর দরবারে নিয়ে যাওয়ায় পুজি অবশ্যই যোগাড় রেখো। নতুবা আল্লাহর হাত থেকে আমি তোমাদের বাঁচাতে পাড়বো না।

তিনি সকলকে তার পরিবারের সহিত সদাচারণ প্রদর্শণ এবং তাদের স্নেহ ও প্রীতি র চোখে দেখতে বললেন। বললেন-কেউ যেন কখনো তাদের সাথে দুর্ব্যবহার না করে।

ক্রমেই তার চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলো। আর মাত্র একটি দিনের অতিথি তিনি। তাইতো তিনি সমস্ত কৃতদাসকে মুক্ত করে দিলেন। তারা ছিল চল্লিশ জন। তার গৃহে মাত্র সাতটি স্বর্ন দীনার মৌজুত ছিল। তিনি আয়েশা (রা.) কে নির্দেশ দিলেন ওগুলো গরীরদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে। আয়েশা রা. তাই করলেন। জীবনের শেষ রাতটিতে বাতি জালানোর মত তেলটুকু পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিল না।

৯ রবিউল আউয়াল দিবাগত রাতে রাসুল (সাঃ) এর অবস্থা একটু সুস্থ মনে হচ্ছিল। সেই রাতে তার ইচ্ছে অনুযায়ী তাকে ভাল করে গোসল করানো হল। ফজরের ওয়াক্তে তার নির্দেশ অনুযায়ী রাসুল ( সাঃ) এর কক্ষ মসজিদে নব্বীর মধ্যস্থিত পর্দা সরিয়ে দেওয়া হলো। মসজিদে তখন তার প্রিয় সাহাবী বৃন্দ হযরত আবু বকর (রা.) এর পিছনে জামাতে নামাজ আদায় করেছিলেন। মৃত্যু শয্যায় শায়িত রাসুল (সা.) সে দৃশ্য দু চোখ ভরে দেখে তৃপ্ত হয়েছিলেন। নামাজ শেষে তিনি ধীর ও শান্ত কন্ঠে মুসলিম গণ কে লক্ষ করে জীবনের শেষ উপদেশ দান করলেন – হে মুসলিম গণ! তোমরা সদা সর্বদা নামাজে দায়বদ্ধ থেকো। নামাজকে প্রাণ অপেক্ষা ভালবেসো। দেখ আনসারগণ! যারা ইসলামের জন্য নিজের ঘরবাড়ি পরিত্যাগ করেছে, তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করো। হে মুহাজেরীন বৃন্দ! আনসারদের সাথে সর্বদা সদাচরণ করো। তাদের মধ্যে যারা পূন্যবান তাদের সাথে উত্তম আচরণ করো। আর যারা ত্রুটি বিচ্যুতি করে তাদের ক্ষমা করো। আমার পরিবার গণের প্রতি সন্মান করো।

রাসুল( সাঃ) অবস্থার অবনতি দেখে মা ফাতেমা কান্নাকাটি শুরু করেন। স্নেহাতুর পিতা প্রাণপ্রিয় কন্যার এমন ব্যকূলতা দেখে বললেন- মা ফাতেমা ক্রন্দন করোনা। আমি তোমাদের নিকট থেকে বিদায় নিলে অধৈর্য হয়োনা। ফাতেমা ( রা.) পিতার কষ্ট দেখে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়েন।

রাসুল (সাঃ) বলেন- আমি আজ তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। কিন্তু আমার জন্য ব্যকূল হয়ো না। অতি শীঘ্রই জান্নাতে আমার সাথে তুমি মিলিত হবে।

আমাদের প্রাণের রাসুল (সাঃ), আমাদের হৃদয় উজার করা ভালবাসার ফল্গুধারা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন চিরতরে। আমরা যদি তাকে ভালবাসি, যদি কাল কিয়ামতের দিন তার শাফায়াত পেতে চাই তাহলে আসুন বেশি বেশি দরুদ পড়ি। তার দেখানো পথে চলার চেষ্টা করি। আসুন তার কথা অর্থাৎ হাদিস পড়ি এবং শিক্ষা গ্রহণ করি জীবনের জন্য। সে শিক্ষা দু’ জীবনেই কাজে লাগবে।

আমার পাঠক ভাই বোনেরা আপনারা হয়তো জানেন কিয়ামতের দিন সবাই যখন ইয়া নাফসি বলবে। নিজের চিন্তায় অস্থির থাকবে তখন আমাদের প্রাণের নবী (সাঃ) ইয়া উম্মতি উম্মতি বলে পেরেসানীর মধ্যে থাকবেন। চিন্তায় অস্থির থাকবেন তার উম্মতের কি উপায় হবে সেই ভেবে।

ইয়া আল্লাহ আজ আমি চোখের জলে আপনার কাছে দূ-হাত বাড়িয়ে কিছু চাইছি মাবূদ। ইয়া রাহমান, ইয়া রহিম আপনি আমার রাসুল (সাঃ) কে সর্বোচ্চ মর্জাদা সম্পন্ন বেহেস্ত নসীব করুন। আমিন।

লেখকঃ কবি ও সাহিত্যিক 

 

আরও পড়ুন