Ads

কুরআন পাঠে আমার বাবার একাগ্রতা ।। দ্বিতীয় পর্ব

।। মূল: শায়েখ ওয়ালীদ বাসাইউনি ।।

।। অনুবাদ: ফাহমিনা হাসানাত ।।

গত পর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম কুরআন পাঠে আমার বন্ধুর বাবার একাগ্রতাকে কেন্দ্র করে কুরআন পাঠের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে। আল-কুরআনের নামের মাঝেই রয়েছে এর বর্ণনা। কুরআনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা উপলব্ধি করার জন্য  এর কিছু প্রতিশব্দ এখানে উল্লেখ করা হলো –

* নির্দেশনা,

* অনুস্মারক,

* নিরাময়,

* করুণা

কুরআনকে আত্মা হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে । কারণ কুরআন আমাদের আত্মাকে জীবিত রাখে। এছাড়া কুরআনকে জীবনদানকারী হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে । কারণ জীবনের প্রকৃত অর্থ কুরআনেই অন্তর্নিহিত এবং কুরআন অধ্যায়নের মাঝেই তা উপলব্ধি করা যায়। মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন –

يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ قَدۡ جَآءَتۡكُم مَّوۡعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمۡ وَشِفَآءٌ لِّمَا فِى ٱلصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحۡمَةٌ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ

হে মানুষ, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত। (সূরা ইউনুস-[১০]:আয়াত-৫৭)

আল-কুরআন একটি সম্মানিত কিতাব এবং যে কেউ তা পড়বেন এবং অনুসরণ করবেন তিনি কেবল এই জীবনেই নয়, পরবর্তী জীবনেও সম্মানিত হবেন ইন শা আল্লাহ । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন – তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই, যে নিজে কুরআন শেখে এবং অন্যকে তা শেখায়। [সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০২৭]

অন্য আরেকটি হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন – ‘কুরআনের শিক্ষা লাভকারীকে বলা হবে, পড়, আরোহণ কর আর দুনিয়াতে যেভাবে ধীরে ধীরে পাঠ করতে সেভাবে ধীরে ধীরে পাঠ করে যাও। অতএব যে আয়াতে তোমার পাঠ শেষ হবে সেখানে হবে তোমার মনযিল।'[তিরমিজি:২৯১৪]

আপনি কি জানেন যে ইমাম ইবনে আল-সালাহ বলেছেন যে ফেরেশতারা মানুষের কুরআন তেলাওয়াত শোনার জন্য জড়ো হয় কারণ কুরআন পড়তে পারার ক্ষমতা দিয়ে আল্লাহ আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছেন কিন্তু ফেরেশতাদের নয়।আমি বিশ্বাস করি যে আল্লাহ আমাদের জন্য কুরআনের সাথে সংযোগ স্থাপন করা সহজ করেছেন, তবে সমস্যাটি কুরআনের নয়, সমস্যা আমাদের অন্তরের। আমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন- কোরআন অধ্যয়ন ও অনুশীলনের গুরুত্ব

আমরা অনেকেই কুরআনের গুরুত্ব বুঝি এবং এর শিক্ষা এবং তেলাওয়াতের ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি । তারপরও আমরা পুরোপুরিভাবে কুরআনের সাথে সম্পৃক্ত হতে বা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পারি না। “আমি জানি না….আমি এতবার ব্যর্থ হয়েছি যে আমার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়! আমার আগ্রহ আছে কিন্তু দৃঢ় সংকল্প ও ইচ্ছাশক্তি নেই”…. কথাগুলো খুব পরিচিত শোনাচ্ছে, তাই না?

আল্লাহ কি বলেছেন শুনুন –

يُؤۡفَكُ عَنۡهُ مَنۡ أُفِكَ

যে পথভ্রষ্ট হয়েছে তাকেই তা (কুরআন) থেকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে।[সূরা আয-যারিয়াত-৫১: আয়াত-৯]

অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার কামনা-বাসনায় ভ্রান্ত হয়ে খারাপ কাজে ব্যস্ত সে কুরআন থেকে প্রতারিত হয়। ইবনে মাসউদ বলেছেন: “যদি আপনার অন্তর পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ হয়, তবে আপনি কখনো অনুভব করবে না যে আপনার জীবনে আপনার প্রভুর বাণীর প্রয়োজন নেই।”

একজন ব্যক্তি আল হাসান আল বাসরির কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি রাতে নামাজ পড়তে এবং কুরআন তেলাওয়াত করতে চাই, কিন্তু প্রতিরাতেই এমন হয় যে আমি ঘুম থেকে উঠতে পারিনা, এমনকি যদি আমি তাড়াতাড়িও ঘুমাতে যাই। আপনি কি বলতে পারেন আমি কেন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছি?” উত্তরে হাসান বাসরি বলেছিলেন, “আপনার দিনের বেলার পাপ আপনাকে বাধা দিচ্ছে।”

আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন-

وَمَآ أَصَٰبَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتۡ أَيۡدِيكُمۡ وَيَعۡفُواْ عَن كَثِيرٍ

আর তোমাদের প্রতি যে মুসীবত আপতিত হয়, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল। আর অনেক কিছুই তিনি ক্ষমা করে দেন।[সূরা আশ-শুরা-৪২: আয়াত-৩০]

মানুষের জীবনে কুরআনকে ভুলে যাওয়ার চেয়ে বড় বিপর্যয় আর কি হতে পারে?

سَأَصۡرِفُ عَنۡ ءَايَٰتِىَ ٱلَّذِينَ يَتَكَبَّرُونَ فِى ٱلۡأَرۡضِ بِغَيۡرِ ٱلۡحَقِّ وَإِن يَرَوۡاْ كُلَّ ءَايَةٍ لَّا يُؤۡمِنُواْ بِهَا وَإِن يَرَوۡاْ سَبِيلَ ٱلرُّشۡدِ لَا يَتَّخِذُوهُ سَبِيلًا وَإِن يَرَوۡاْ سَبِيلَ ٱلۡغَىِّ يَتَّخِذُوهُ سَبِيلًاۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ كَذَّبُواْ بِئَايَٰتِنَا وَكَانُواْ عَنۡهَا غَٰفِلِينَ

যারা অন্যায়ভাবে যমীনে অহঙ্কার করে, আমার আয়াতসমূহ থেকে তাদেরকে আমি অবশ্যই ফিরিয়ে রাখব। আর তারা সকল আয়াত দেখলেও তাতে ঈমান আনবে না এবং তারা সঠিক পথ দেখলেও তাকে পথ হিসাবে গ্রহণ করবে না। আর তারা ভ্রান্ত পথ দেখলে তা পথ হিসাবে গ্রহণ করবে। এটা এ জন্য যে, তারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে এবং সে সম্পর্কে তারা ছিল গাফেল।[সূরা আল-আরাফ-৭: আয়াত-১৪৬]

ইবনে মাসউদ বলেছেন: “আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, একজন বিশ্বাসীর হৃদয়ে আল-কুরআনের প্রতি ভালোবাসা, এবং গান বাজনার প্রতি ভালোবাসা একসাথে থাকতে পারে না। এদের একটি অন্যটিকে কবর দিয়ে দেয়।”

এটা সত্যিই খুব ভীতিকর! আমাদের পাপ কীভাবে আমাদেরকে আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারে এবং ফলস্বরূপ এটি আমাদেরকে তাঁর হেদায়েত থেকে থেকে বঞ্চিত করতে পারে।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন: “তিনটি জায়গায় আপনার হৃদয়ের সন্ধান করুন: যখন আপনি কুরআন শুনেন, যখন (আল্লাহর) জ্ঞান অন্বেষণ করেন, এবং যখন আপনি একান্তে থাকেন। আপনি যদি এই জায়গাগুলিতে এটি খুঁজে না পান, তবে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন যেন তিনি আপনাকে একটি হৃদয় দিয়ে আশীর্বাদ করেন, কারণ আপনার হৃদয় নেই।”

এই গল্পটি সম্পর্কে আরো কিছু চিন্তা ভাবনা তুলে ধরবো পরবর্তী পর্বে।

আগের পর্ব –কুরআন পাঠে আমার বাবার একাগ্রতা ।। প্রথম পর্ব

চলবে ইন শা আল্লাহ।

রেফারেন্স:

[১] সূরা ইউনুস-১০:আয়াত-৫৭

[২] সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০২৭

[৩] তিরমিজি:২৯১৪

[৪] সূরা আয-যারিয়াত-৫১: আয়াত-৯

[৫] সূরা আশ-শুরা-৪২: আয়াত-৩০

[৬] সূরা আল-আরাফ-৭: আয়াত-১৪৬

সিরিজঃ যে গল্প মন ছুয়ে যায়

 

আরও পড়ুন