Ads

ইতিহাসের আয়নায়: খৃষ্টবাদ ও সেন্ট পল

জিয়াউল হক 

সেন্ট পল। খৃষ্টধর্মের এক অত্যন্ত জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আজ আমরা খৃষ্টবাদের যে চরিত্র ও রুপ দেখতে পাই, তার মূল কারিগর হলেন এই পল। খৃষ্টবাদকে তার ভেতর থেকেই বিকৃতি করে দেবার কাজে যিনি সর্বপ্রথম পরিকল্পনা করেন এবং কাজটা শুরু করেন, তিনি হলেন এই পল।
হযরত ইসা আ: জন্মের পাঁচ বৎসর পরে বর্তমান তুরস্কের দক্ষিণে ভূমধ্যসাগরীয় উপকুল ঘেঁষে Tarsus নামক এক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ইহুদি ধর্মবলম্বী পল ছিলেন রোমান সরকারের কর্মচারী; ট্যাক্সকালেক্টর।
এক ইহুদি হযরত ইসা আ: এঁর উপরে ঈমান এনে তদানুযায়ী চলা এবং তাঁর দাওয়াত প্রচার করতেন। স্বগোত্রীয় ইহুদিদের শত বাধা সত্তেও সে কাজ হতে নিবৃত না হওয়ায় তাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করে উগ্র ইহুদিরা। লোকটার ল্যাটিন নাম ছিল; Stephen। তিনিই হলেন হযরত ইসা আ: এঁর অনুসারীদের মধ্যে প্রথম শহীদ।
হযরত ইসা আ: কর্তৃক তাওহিদের দাওয়াত উপস্থাপনের প্রথম থেকেই সেইন্ট পল কট্টরভাবে তার বিরোধিতা করেছেন। কখনই ইসা আ:কে আল্লাহর নবী বলে স্বীকার করেননি, বরং যারা হযরত ইসা আ: কে নবী বলে মেনেছে, তাদের উপরে চরম নির্যাতন চালিয়েছেন অন্যান্য ইহুদি নেতাদের সাথে মিলে। অথচ সেই তিনিই হয়ে গেলেন ইসা আ: এর এক গুরুত্বপূর্ণ শিষ্য এবং তার হাতেই বাইবেলের, তথা খৃষ্টবাদের শিক্ষা রচিত হতে থাকল, ইসা আ: এর নামেই।
Stephen’কে পাথর ছুঁড়ে হত্যার ঘটনায় প্রথমসারীতে ছিলেন পল। ইসা আ: অনুসারীদের বাড়ি থেকে ধরে এনে এনে বিচার ও কয়েদ রাখার ব্যাপারে পল ছিলেন অতি উৎসাহী ও প্রথমসারীর একজন। কিন্তু তাতে করেও ইসা আ: এর অনুসারী সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটতে থাকলে সে সময় পল এক ভিন্ন কৌশল ধরলেন। যা খৃষ্টবাদের ইতিহাসকেই পাল্টে দিয়েছে চিরদিনের মত।
এর জন্য অবশ্য তাকে এক বিরাট গল্প ফাঁদতে হয়েছে। এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে এগুতে হয়েছে। তিনি নিজে হযরত ইসা আ: এর অনুসারী হবার নাম করে খৃষ্টবাদ, তথা, হযরত ইসা আ: এর শিক্ষাকেই সুকৌশলে পাল্টে দিতে মাঠে নামলেন, ক্রমাগত চেষ্টা প্রচেষ্টা করে যেতে লাগলেন। আর তার সে উদ্দেশ্য অর্জনে তিনি অভাবিতপূর্ব এক কৌশল অবলম্বন করলেন। বলাই বাহুল্য, তার সে কৌশলটি অবশ্য কাজেও লেগেছে দারুণভাবে!
বলা হয়ে থাকে, হযরত ইসা আ: এঁর উর্ধারোহনের মাত্র কয়েকদিন পরে (খৃষ্টানদের বিশ্বাস ও বর্ণনা অনুযায়ী হযরত ইসা আ:’কে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করার কয়েকদিন পরে) পল জেরুজালেম যাচ্ছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল জেরুজালেমে যারা ইসা আ: এর উপরে ঈমান এনেছে, তাদের শায়েস্তা করা!
পথিমধ্যে হঠাৎ করেই তিনি দাবী করলেন; যিশুখৃষ্টের অনুসারীদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে তিনি সিরিয়া যাবার পথে গ্যালিলি সাগরতীরে এক সন্ধায় হঠাৎ করে গায়েবি এক আওয়াজ শুনতে পান। তিনি শুনতে পান তাকে উদ্দেশ্যে করে বলা হচ্ছে;
‘হে সওল! (খৃষ্টবাদে দীক্ষিত হবার আগে পলের আসল নাম) কেন তুমি আমাকে যাতনা দিচ্ছ?’ উক্ত আওয়াজের প্রত্যুত্তরে পল জানতে চান,
‘কে তুমি?’
উত্তরে এবারে আওয়াজ হলো;
‘আমি যিশু, তুমি যাঁকে নিপীড়ন করছ। তুমি ক্ষান্ত হও এবং শহরে প্রবেশ করো, সেখানেই তোমাকে জানানো হবে, পরবর্তি করণীয় কি?’
পলের দাবী অনুযায়ী, এ সময় উজ্জল আলোর প্রভাবে বা অন্য কোন কারণে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অন্ধ হয়ে যান।
ওদিকে সিরিয়ায় অবস্থানরত হযরত ইসা আ: এঁর আর এক শিষ্য Ananias; যিনি নিজেও একজন ইহুদি ছিলেন ও ইহুদি ধর্ম থেকে হযরত ইসা আ: এর উপরে ঈমান এনে নাসারা বা ইসা আ: এর সাহায্যকারী হয়েছিলেন, তিনিও এক স্বপ্ন দেখেন বলে দাবী করেন!
তার দাবীটি ছিল, হযরত ইসা আ: তাকে স্বপ্নে নির্দেশ দিচ্ছেন; শহরে গিয়ে পলের চোখের উপরে হাত রাখতে, যেন পল তাতে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। স্বপ্নে Ananias হযরত ইসা আ: এর উক্ত নির্দেশের উত্তরে তাকে অভিযোগের সূরে জানাচ্ছেন যে, ‘পল’তো আপনার অনুসারীদের নির্যাতন করে বেড়ায়!
উত্তরে যিশুখৃষ্ট বলছেন;
‘তা হোক, তাকে আমার বাণী প্রচারের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে, সে আমার প্রিয়পাত্রদের একজন।’
এরপরে যিশুর নির্দেশে শহরে পলকে খুঁজে বের করে Ananias। একসময় তাকে খুঁজে পেয়ে তার চোখের উপরে হাত রাখলে সাথে সাথে পল তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায় এবং সেই থেকে পল খৃষ্টের একজন নিবেদিত ভক্ত হয়ে তার বাণী প্রচার করে বেড়ান!
ইসা আ: এঁর একজন কট্টর দুশমন, তাঁর উপরে বিশ্বাস স্থাপনকারী মুসলমানদের চরমভাবে নির্যাতনে নিয়েজিত পল কর্তৃক যিশুখৃষ্টের ভক্ত বনে গিয়ে তাঁরই বাণী প্রচার করতে মাঠে নামতে দেখে ইসা আ: এর প্রকৃত অনুসরাীগণ সাংঘাতিকভাবে বিষ্মিত হয়ে তার উদ্দেশ্য নিয়েই চরম সন্দিহান হয়ে পড়ে। বিশেষ করে, তিনি যখন সিরিয়ার গির্জাতে হযরত ইসা আ:কে এই প্রথমবারের মত ‘ইশ্বরের পুত্র’ বলে উপস্থাপন করলে সকলের মাঝে এক মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হয়।
পলকে সর্বতোভাবে ইহুদিদের একটা গোষ্ঠী সহায়তা করে। তিনি হযরত ইসা আ: এর ভক্ত ও অনুসারী সেজে খৃষ্টবাদকে তার ভেতর থেকেই পাল্টে দেন। অবশ্য তার এই অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকান্ডের মূল্য গুনতে হয়েছে ৬৪ খৃষ্টাব্দে রোমে শীরচ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ডে প্রাণটা দিয়ে। তবে এটা সত্য যে খৃষ্টবাদ আর কোনদিনই তার পূর্বরুপে ফিরতে পারেনি।

লেখকঃ কলামিস্ট এবং প্রবাসী বাংলাদেশী, ইংল্যান্ড

আরও পড়ুন