Ads

যৌন হয়রানির প্রতিরোধ কোন পথে?

।। শহীদ সিরাজী ।।

যৌন হয়রানি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। একসময় দেশের সোনার ছেলেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বাবিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি করে যেভাবে তা উদযাপন করেছিল তার ধারাবাহিকতায় দেশে এখন চলছে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির মহোৎসব। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজর মত প্রতিষ্ঠানও এমন মহৎ কর্মের বাইরে নয়। সারা দেশের সব বিখ্যাত বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এহেন ঘটনার উদাহরণ রয়েছে ভুরিভুরি।

আমাদের মনে আছে নিকট অতিতে দেশে এমন বর্বর কয়েকটি ঘটনার কথা-

– সিলেটে এমসি কলেজে স্বামীকে বেঁধে রেখে তরুণী স্ত্রীকে ধর্ষণ।

– কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় তরুণী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণ।

– ফেনীর আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে ধর্ষণ। বিচার চাওয়ায় আগুনে পুড়িয়ে মারার মত ঘটনা।

এসব ঘটনা এখন ইতিহাস। আর বিচারের বাণী কেবল নীরবে কাঁদছে।

এমন বর্বর ঘটনা নিয়ে সমাজকর্মী, বুদ্ধিজীবি শাসকবর্গের আলোচনা পর্যালোচনা সমালোচনা, জনগণের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর রাষ্ট্রযন্ত্রের চেষ্টা- তদবিরের পরেও কী থেমেছে এ জঘন্য অপরাধ ? বরং সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তা বেড়েই চলেছে। বহমান সময় যে কয়েকটি ঘটনা সমাজে আবার চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে এবং টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিনত করেছে তা হলো –

এক) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে আবাসিক হলে আটকে স্ত্রীকে ধর্ষণ।

দুই) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ এনেছেন ওই বিভাগেরই এক শিক্ষার্থী। সে যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ করেছে।

তিন) ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ। অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির আজিমপুর শাখার (দিবা) জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মোহাম্মদ মুরাদ হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে। বাসায় প্রাইভেট পড়ানোর নামে একাধিক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করেছেন বলে লিখিত অভিযোগও জমা পড়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।

চার) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনে মামলা করেছেন তাঁর এক নারী সহকর্মী। ওই নারী অন্য একটি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।

পাঁচ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ছাত্রীর। প্রাথমিকভাবে যৌন হয়রানির অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় শিক্ষককে অ্যাকাডেমিক সব কার্যক্রম থেকে বরখাস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ( দ্যা ডেইলী স্টার বাংলা)

একবার ভাবুন! শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের এমন অনৈতিকতা ও তাদের কেমন বিকৃতি! যা সকলকে ভয়ানক চিন্তায় ফেলেছে ও বিচলিত করছে। উদ্বেগের সাথে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আজকের এবং আগামি প্রজন্মকে রক্ষার দায়িত্ব যাদের হাতে রয়েছে তারা কী করছে? যারা মানুষ গড়ার আঙিনাকে করছে অনৈতিকতার অাস্তানা। আর যারা মানুষ গড়ার কারিগর তারা মানুষ তৈরি না করে অমানুষ তৈরী করছে।

এর প্রতিবাদে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে প্রতিবাদ। মিছিল হচ্ছে। দবি করা হচ্ছে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির। টিভি টকশো, প্রিন্টিং মিডিয়াতে চলছে ভয়ানক প্রতিবাদ। আসলে সকলেই চাচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বন্ধ হোক কিন্তু হচ্ছে না কেন ? এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। ভুক্তভোগিরা এর কারণ উল্লেখ করেছেন যেমন –

– যৌন হয়রানি হলেও অনেক ক্ষেত্রে ভিকটিম কোন অভিযোগ করে না।

– সামাজিক ভাবে হেনস্থা হওয়া বা মানসম্মানের ভয়েও অনেকে অভিযোগ করে না।

– বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা থেকেও অনেকে অভিযোগ করতে এগিয়ে আসে না।

– আইন আছে তবে বাস্তবতা হচ্ছে আইনের আশ্রয় নিলেও ঠিকমত বিচার হয় না,

অনেক সময় অভিযোগই নেওয়া হয় না। এ কারণে অনেকের মধ্যে অনাস্থা রয়ে গেছে ।  সমাজ ও তার বাস্তবতার বীক্ষণে অনেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক বা পরিচালনা কমিটিকে অভিযুক্ত করেন। বলেন –

– অনেক প্রতিষ্ঠানেের যৌন হয়রানির কোন

প্রতিরোধ সেল নাই।

– স্থানীয় আইনশৃঙ্খলায় সস্পৃক্ত বাহিনীর

রয়েছে সদিচ্ছার অভাব

– স্কুল কর্তৃপক্ষের রয়েছে মনোযোগের অভাবে

– কোন কোন শিক্ষকের সস্পৃক্ততা থাকে

– ঘটনায় শিক্ষকরা জড়িয়ে যান

– ছেলে শিক্ষার্থীরা ইভটিজিং করে

– প্রতিরোধ কমিটি থাকলেও যথাযথ তারা দায়িত্ব

পালন করে না।

– ম্যানেজমেন্ট কমিটির কোন কোন সদস্য

নিজেরা এ গর্হিত কাজে জড়িত হয়ে পড়ছে।

সমাজবিজ্ঞানিদের মতে যৌন হয়রানি বন্ধ না হওয়ার কারণ –

– বিচারে দীর্ঘসুত্রিতার কারণে বন্ধ হচ্ছে না যৌন

হয়রানি।

– ক্ষমতার প্রভাব বিচারকে প্রভাবিত করছে

– সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় অন্যতম কারণ

– ইন্টারনেটের অপব্যবহার

– সামাজিক যোগাযোগে মাধ্যমের অপ ব্যবহার

– শিক্ষক শিক্ণার্থীর মধ্যের দুরত্ব কমে যাওয়া

– শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এখন মেধা ও

নৈতিকতার পরিবর্তে প্রভাব-প্রতিপত্তি দলীয়

পরিচয় প্রাধান্য দেয়া ইত্যাদি।

যৌন হয়রানি নিয়ে মানবাধিকার কর্মীরাও আতঙ্কিত। তারা দেখছে দেশে ধর্ষণ, যৌন হয়রানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। ধর্ষণের সাথে বাড়ছে নৃশংসতাও। তাদের মতে, ‘ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই’।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর বক্তব্য –

ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বলছে,

দেশে ধর্ষণের মহোৎসব চলছে। আইন ও বিচার দিয়ে এ রাষ্ট্রে ধর্ষণ ঠেকানো যাচ্ছে না। নারী ধর্ষণ বা নির্যাতনের ঘটনায় বিচার না হয়ে উল্টো ভিকটিমের দোষ খোঁজা হয়, এটা নারীর বিচার পাওয়ায় বাঁধা দেয়ার সামিল। তাদের দাবি ধর্ষণ মামলায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে৷ ফলে ধর্ষণ বাড়ছে।

ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি নিয়ে নানা পর্যবেক্ষণ ও মতামত দেখে বোঝা যাচ্ছে দেশের মানুষ কতটা চিন্তিত কতটা অাতঙ্কিত। যৌন নিপীড়ন বেড়েই চলেছে অথচ তার যথাযথ বিচার হচ্ছে না। এ ভয়ানক অবস্থা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সকলেই খুঁজছে পথ। বাস্তবে এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসা তো দূরের কথা তা থামাতেই পারছে না। উল্টো মহামারির মত ছড়িয়ে পড়ছে। এর কারণ কি? আসলে এর কারণ ভাবতে হবে নির্মোহ ভাবে। এর সমাধান নানাজন নানাভাবে পথ বাতলে দিচ্ছেন। কেউ বলছেন সকল প্রতিষ্ঠানে প্রতিরোধ কমিটি (সেল) থাকতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে প্রতিরোধ কমিটি থাকলেই কি তা বন্ধ হবে। আর এ কমিটির সদস্যরা নিজেরা এমন গর্হিত কাজ করবে না তার গ্যারান্টি কে দেবে ? এমন ঘটনা কি দেশে নেই? ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হয়েও ছাত্রীকে বিয়ে করার রেকর্ড আমাদের এ সমাজেই তো রয়েছে। রক্ষক যদি ভক্ষক হয় তবে এমন কমিটি কিভাবে তা প্রতিরোধ করবে। তাছাড়া যৌন হয়রানির মত ঘটনা শুধু কি প্রতিষ্ঠানেই ঘটছে? পথে বা বাসাতেও ঘটছে না। তখন প্রতিরোধ সেল কি ভাবে প্রতিরোধ করবে?

২০২১ সালের ৭ জানুয়ারিতে এমন একট ঘটনা ঘটেছিল। আমরা কি মনে রেখেছি? ঢাকায় দিনদুপুরে ধর্ষণের শিকার হয় কিশোরী আনুশকাহ নূর আমিন (১৮)। সেদিন দুপুরে কলাবাগানের ডলফিন গলিতে দিহানের বাসায় এই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। পরে অসুস্থ হয়ে পড়লে দিহানসহ চার বন্ধু আনুশকাহকে ধানমন্ডির মডার্ণ আনোয়ার খান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। বিকালে হাসপাতালে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ‘ও লেভেলের ছাত্রী। এমন ঘটনা আরও ঘটলে প্রতিরোধ কমিটি কী প্রতিরোধ করতে পারবে?

কেউ কেউ পরিচালনা কমিটির সদিচ্ছার অভাবের কথা বলছেন। কথা ঠিক। অনেক সময় দেখা গেছে ধর্ষক কমিটির কোন সদস্যের ছেলে বা অন্য কেউ। তখন তো তাদের ইচ্ছার অভাব দেখা দেবেই। আর প্রভাবশালী বা নেতার ছেলে হলে তো তার সাতখুন মাফ। কেউ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকার কথা বলছেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকার কথা কে না জানে?

অনেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও সচেতনতা সৃষ্টির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। খুব ভালো কথা! তবে প্রশ্ন হচ্ছে কিসের সচেতনতা ? যৌবনপ্রাপ্ত ছেলে-মেয়ে তো ঘি ও আগুনের মত। পাশাপাশি থাকলে বা রাখলে তারা নিজেদের পোড়াবে। যদি নৈতিকতা বা আল্লাহর ভয় না থাকে তো কি ভাবে বা কোন মন্ত্রে তাদের সচেতন করবেন? বিড়ালকে দুধের পাহারায় বসিয়ে যতই সতর্ক করুন বিড়াল কি শুনবে? দেশে এখন যা ঘটছে এভাবে কী যৌন হয়রানি বন্ধ হবে? আসলে সমাধানের জন্য সকলে অন্ধকারে ঢিল ছুড়ছেন। কিন্তু আসল জায়গায় কেউ হাত দিচ্ছেন না।

এরজন্য যেতে হবে সমস্যার মূলে। ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির মূলে রয়েছে নারী বা পুরুষের পরস্পর আকর্ষণ প্রকারান্তরে যৌন ক্ষুধা। এ ব্যাপারে বিজ্ঞান কি বলে তা আমরা জানতে পারি। আপনি যদি বিজ্ঞানমনস্ক হন তাহলে বিজ্ঞান দিয়ে বোঝা আপনার জন্য সহজ হবে।

এ বিষয়ে মেডিক্যাল সায়েন্সের প্রমাণকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নাই। আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রিসার্চ জার্নাল “Evolution & Human Bahavior। এতে প্রকাশিত হয়েছে একটা বৈজ্ঞানিক স্টাডি। তাতে বলা হয়েছে,

“ছেলেরা যখন মেয়েদের সংস্পর্শে আসে তখন ছেলেদের মধ্যে Hormonal Response টা তীব্র হয়ে ওঠে। অর্থাৎ ছেলেদের মেয়েদের প্রতি যে Testoterone(ছেলেদের সেক্স হরমোন) আপিল করবে বা আকর্ষণ করবে। এ আকর্ষণে যদি নিয়ন্ত্রণ না থাকে তাহলে যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটে।

এ বৈজ্ঞানিক স্টাডির চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছে ইসলাম। সেখানে বলা হয়েছে,

“যখন দুটি ছেলে মেয়ে নির্জনে কথা বলে তখন সেখানে তৃতীয় একজন উপস্থিত থাকে আর সে হলো শয়তান।”(আল হাদীস)

এজন্য ইসলাম পর্দা এক গুরুত্বপূর্ণ বিধান।

এ কথা বলার সাথে সাথে অনেকে বলবেন, এসব মৌলবাদি চিন্তা বা পশ্চাদমুখীতা। সভ্য সমাজে এ সব চলতে পারে না। পাশ্চাত্যে সভ্যতার মুকুট যাদের মাথায় তাদের কি জানা নাই সেসব দেশে নারী নিগ্রহের পরিসংখ্যান তাদের ভয়াবহ।

‘দেখা গেছে ব্রিটেনে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক চার নারীর একজন ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। কেবল ২০২২ সালের মার্চ মাসেই ধর্ষণের ৭০ হাজার ৩৩০টি ঘটনার তথ্য এসেছে পুলিশের কাছে। ওয়েলস ও ইংল্যান্ডে প্রতি বছর ৮৫ হাজার নারী ধর্ষণসহ নানা ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার হন।

প্রতি বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও গড়ে চার লাখ ৬৩ হাজার ৬৩৪ জন নারী ধর্ষণ ও যৌন হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতি ৫ জন মার্কিন নারীর একজন যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়াও প্রতি বছর হাজার হাজার নিরপরাধ নারী মার্কিন পুলিশের হামলায় হতাহত হচ্ছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি খামারগুলোতে কাজ করছে ত্রিশ লাখেরও বেশি নারী। এদের মধ্যে প্রায় ৬৩ হাজার অভিবাসী ও অনেকেই অবৈধভাবে সেদেশে এসেছেন। এই নারীরা অন্তত একবার তাদের মালিক বা নিয়োগ-কর্তাদের হাতে যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মস্থলে নারীরা যেসব নির্যাতনের শিকার হন সেসবের মধ্যে রয়েছে মারধোর, যৌন-নির্যাতন এবং এমনকি হত্যাকাণ্ড!’

এমন পরিসংখ্যান নিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার যারা প্রবক্তা তাদের বলবো কবি রবীদ্রনাথের জুতা আবিষ্কারের কবিতা পড়তে। হয়তো অনেকে জানেন তবুও গল্পটা আর একবার স্মরণ করিয়ে দেই।

গল্পটা এক রাজার। পথে চলতে ফিরতে রাজার পা ধুলামলিন হয়। কিভাবে ধুলাবালি মুক্ত রাখা যায়? রাজা মন্ত্রীদের হুকুম দিলেন রাজ্য থেকে ধুলাবালি দূর করতে। সমস্যার সমাধান করতে সকলে হলো গলদঘর্ম। ভাবতে ভাবতে মন্ত্রী ও পণ্ডিতদের খাওয়া-দাওয়া, ঘুম হারাম হয়ে গেল । পরিবারে কান্নাকাটির রােল পড়ে গেল। আদেশ মত রাজা কাজ চাই। রাজ্যের জ্ঞানী-গুণীদের পরামর্শে সাড়ে সতেরাে লক্ষ ঝাঁটা ঝাড় দিতেই রাজ্য ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। লোকজনের সর্দি-কাশিতে মরার উপক্রম হলাে।

এরপর ধুলা দূর করার পালা। ভিস্তি ভিস্তি পানি ঢালার ফলে পুকুর, নদী শুকিয়ে গেল আর সর্দি-জ্বরে উজাড় হলাে দেশটা ।

আবার বসল পরামর্শ সভা। রাজ্যময় মাদুর দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো। রাজা ঘরের মধ্যে আটকা পড়লেন। রাজা তাতে ক্ষেপে উঠলেন। শেষে আবার পরামর্শ সভা বসলো। যোগ্য লোক খুঁজতে লােকজন ছােটাছুটি শুরু করল।

শেষে এক বুড়ো মুচি এসে রাজার চরণ দুটি চামড়া দিয়ে ঢাকার পরামর্শ দিলেন। রাজার নির্দেশে সে রাজার পা দুটো চামড়া দিয়ে ঢেকে দিলেন। ধুলাবালি থেকে রাজা মুক্ত হলাে। এভাবেই জুতার আবিষ্কার হলাে।

ধর্ষণ বা যৌন হয়রানি রোধের উপায় বের করতে হলে জুতা আবিষ্কারের মত সমস্যার মূলে যেতে হবে। অনেক পরীক্ষা-নীরিক্ষা তো হয়েছে এবার সঠিক চিকিৎসা দিতে হবে।

আগেই বলা হয়েছে ‘ছেলেরা যখন মেয়েদের সংস্পর্শে আসে তখন ছেলেদের মধ্যে Hormonal Response টা তীব্র হয়ে ওঠে। অর্থাৎ ছেলেদের মেয়েদের প্রতি যে Testoterone(ছেলেদের সেক্স হরমোন) আপিল করবে বা আকর্ষণ করবে। এ আকর্ষণে যদি নিয়ন্ত্রণ না থাকে তাহলে যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটে।

সুতরাং সমস্যা হলো শিক্ষার্থী ছেলে-মেয়ে পরস্পরের সংস্পর্শে আসা। নিজেদের গোপনীয় সৌন্দর্য প্রকাশ করে সেক্স হরমোন নিঃসরণ করা বা যৌন উত্তেজনা ছড়ানো। শেষে ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের মত ঘটনা ঘটানো।

সোজা বিষয়; এর প্রতিরোধ করতে হলে তাদের পরস্পর সংস্পর্শে আসা রোধ করতে হবে। এমন কথায় প্রগতিবাদীরা বা মুক্তমনা বা ভোগবাদী বলে যারা পরিচিত তারা আঁতকে উঠবে। প্রতিরোধ করে বলবে এতো পশ্চাদপদতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ। সভ্য সমাজে এটা চলতেই পারে না।

কিন্তু যারা নিজেদের সভ্য সমাজের বলে দাবি করছে তেমন সমাজে এখন কি হচ্ছে? সে সমাজেই তো শত শত ধর্ষণ, যৌন হয়রানি হচ্ছে। তা কি বন্ধ করা যাচ্ছে? তাহলে এটা কেমন সভ্য সমাজ? আইন থেকেও বা আইন প্রয়োগ করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না। উপরে যে পরিসংখ্যার দেয়া হয়েছে তা দেখেও কি তারা সত্য মানবে না? ইসলামের সমালোচনা করবে?

এমতাবস্থায় কি করবেন? শুধু মুখে মুখে বাদ-প্রতিবাদ, শ্লোগান, দাবি-দাওয়া নিয়ে স্মারকলিপি পেশ করে কিংবা বিচার দাবি করে; কী যৌন হয়রানি দুর করা যাবে? না-কি রাজার রাজ্যে ধূুলা দুর করার মত এটা ঝেটিয়ে দুর করবেন? তাতে যৌন হয়রানি ধুলার মত আরও ছড়িয়ে পড়বে সমাজে।

তবে কি পানি ঢেলে ময়লা ধোয়ার মত ধুয়ে ফেলবেন? তাতেও হবে না। কারণ পিরিতি তো কাঠালের আঁঠা, লাগলে আর ছুটবে না। বরং আরও লেপ্টে গিয়ে মহামারি রূপ নেবে।

অবস্থা যে দিকে গড়াচ্ছে তা সমাজে ক্যান্সারে রূপ নিতে চলেছে। সমাজের যারা নিয়ন্ত্রক তদেরকে বুঝেসুঝে একে ক্যান্সার মনে করে তার চিকিৎসা করাতে হবে। কোন কোন ভোগবাদী প্রকারান্তরে নারীলোভীর কথায গ্রাম্য চিকিৎসকের মত চিকিৎসা দিলে রোগ দূর হবে না।

পরিমল জয়ধরদের ঘটনা, ফেনীর সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রীর যৌন হয়রানি ও পুড়িয়ে মারার ঘটনা, সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনা, জাহাঙ্গীর নগর, ঢাকা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালের মত দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা কেন ঘটছে তা এখন পরিস্কার।

এসব জায়গা নারী নিপীড়নের এখন উর্বর ক্ষেত্র। সেখানে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশার চারণভূমি। যৌন নিপীড়নের অভয়ারণ্য। এসব বন্ধ না করতে পারলে যৌন হয়রানি বন্ধ করা যাবে না।

শেষমেশ সমাধান পেতে সেই মুচির ফর্মুলাতে যেতে হবে। ছেলে-মেয়েদের বিশেষ করে মেয়েদের যেসব অঙ্গের মাধমে যৌনতা ছড়ায় তা ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ছেলে থেকে মেয়েদের দূরে রাখতে হবে। আর কেবল মাত্র বিয়ের মাধ্যমে যৌন চাহিদা পূরণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। আইন থাকতে হবে তার যথাযথ প্রয়োগও করতে হবে। এর আর কোন বিকল্প নেই।

প্রকৃত অর্থে এ সমস্যা সমাধানের জন্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মানতে হবে, কুরআনিক সমাধান গ্রহন করতে হবে। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার কথা আগে বলা হয়েছে। এখন কুরআনিক সমাধান আমাদের জানতে হবে এবং মানতে হবে।

বিজ্ঞানের গবেষণার কথা বলা হয়েছে –

‘ছেলেরা যখন মেয়েদের সংস্পর্শে আসে তখন ছেলেদের মধ্যে Hormonal Response টা তীব্র হয়ে ওঠে। অর্থাৎ ছেলেদের মেয়েদের প্রতি যে Testoterone(ছেলেদের সেক্স হরমোন) আপিল করবে বা আকর্ষণ করবে।’

এ গবেষণা আমাদের মানতে হবে নইলে যৌন আকর্ষণ ছেলেমেয়েরা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে সমাজে যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটাতে থাকবে। যা এখন হচ্ছে এবং তা মহামারির দিকে গড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে তা বন্ধ করা বড় চ্যালেঞ্জ হঢে দাঁড়াচ্ছে।

কুরাআনিক সমাধান

কুরআনিক সমাধান আপনি মানতে বাধ্য কারণ তা পরীক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত। ইতিহাসেও তা প্রমান রয়েছে।

আমরা ভালভাবেই জানি ইসলাম আসার পূর্বে অারবে নারীদের অবস্থা কেমন ছিল। নারীরা তখন পণ্যের মত ব্যবহৃত হতো। সমাজে তাদের ছিল না কোন সম্মান। মর্যাদা তো ছিলোই না; এসব নিয়ে চিন্তা করার তাদের সময়ও ছিলো না। নারীরা দাসী ও ভোগের সামগ্রী ছাড়া কিছু ছিল না। ছিল না জীবনের ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তা। এ কারণে মানসম্মান রক্ষার জন্য কন্যাশিশুর জন্মের পর বাবা-মা তাদের আদরের মেয়েকে পর্যন্ত মাটির গর্তে জীবন্ত পুঁতে ফেলতো।

এমন বর্বর সমাজকে নবিজি বদলে দিয়েছিলেন। নারীরা পেয়েছিল পূর্ণ মর্যাদা ও সম্মান। পেয়েছিল ইজ্জত-আবরুর নিরাপত্তা। রাস্ট্রব্যবস্থা তাদের এমন নিরাপত্তা দিয়েছিল যে, একাকি এক নারী সুদূর সানা থেকে হাজরামাউত ভ্রমণ করেছিলো, কোন যৌন হৃযরানির মত ঘটনা তখন ঘটেনি ; এমকি কোন পুরুষ চোখ তুলে তার দিকে চেয়েও দেখেনি। নারীদের জন্য এমন নিরাপত্তা আর কোন সমাজ বা সভ্যতা উপহার দিতে পারবে?

শেষ কথা –

বিশ্বে সমাজ গঠনের নামে নানা ধরনের মডেল চালু আছে। এর মধ্য দুটোই প্রধান-

– ভোগবাদী পাশ্চাত্য মডেল

– ইসলামী মডেল

সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন মডেল আমরা গ্রহন করবো?

আগের আলোচনায় আমরা দেখেছি ইসলামের আগমনে বদলে গিয়েছিল সব। বর্বর মানুষ নৈতিক মানে উন্নিত হয়েছিল। সমাজ থেকে সম্পূর্ণ দূর হয়েছিল ব্যভিচার, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন।

অন্যদিকে সভ্যতার যুগে বিভিন্ন দেশে এখন কি হচ্ছে তাও দেখেছি। যারা সভ্যতার দাবিদার তাদের দেখা উচিৎ উন্নত-সভ্যজাতি ইউরোপ, আমেরিকার নারীরা কি পরিমাণে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে! তার পরিসংখ্যানের তুলনায় মুসলিম বিশ্বে সে হার অনেক কম। কিছুটা হলেও এসব মুসলিম দেশে শাসন মেনে চলা হচ্ছে বলে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি কম হচ্ছে। তাই ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র যদি ইসলামী বিধান মেনে চলে তাহলে এ সমস্যার সমাধান হবে।

এজন্যই আমাদের সমাজ বিনির্মাণে নবিজির দেয়া ইসলামী মডেলকে গ্রহণ করতে হবে। নবিজির নীতিমালার শীলন করতে হবে। পরিবার, জাতি, দেশকে রক্ষার জন্য নতুন প্রজন্মকে যথাযথ নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে। যে সব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে তাহলো-

১. সহশিক্ষা নয় আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করতে হবে। সেখানে নারীদের প্রতিষ্ঠানে কর্মচারি থেকে উর্ধতন সকলে মহিলা হবে।

২. মেয়েদের কর্মক্ষেত্র আলাদা করতে হবে। সেখানে সর্বোপর্যায়ে তত্ত্বাবধায়ক নারী হবে।

৩. নারীদের জন্য আলাদা যানবাহন হতে হবে, ড্রাইভার, কন্ট্রাক্টর, হেলপার সকলেই নারী হবে। তাতে নারীদের কর্মসংস্থানও বাড়বে। তারা পুুরুষ সংস্রব থেকে দূরে থাকতে পারবে। ইসলাম এটা পারমিট করবে। এমন পরিবেশ নারীরাও বেশ খুশি হবে ও যৌন হয়রানির শিকার হবে না।

৪. নারীরা শালীন পোশাক পরবে। পর্দা মেনে বাইরে বের হবে। পর্দা না করে অশালীন পোশাক নারীরা বাইরে বের হলে তা যৌন হয়রানিকে উসকে দেয়। এজন্য নিজেদের নিরাপত্তার জন্য শালীন পোশাক পরে তাদের বের হওয়া দরকার।

৫. বিয়ে ছাড়া যৌন সম্পর্ক ও অশ্লীলতা নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ আল্লাহ বলেন,

তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না, নিশ্চয় তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ’ (বনি ইসরাইল-৩২)

তিনি আরো বলেন,

‘লজ্জাহীনতার যত পন্থা আছে, এর নিকটেও যেও না, তা প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে হোক’। ( আনআম-১৫১)

৬. ব্যভিচার, ধর্ষণ রোধে ইসলামের শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকতে হবে। এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

৭. প্রজন্মকে নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে। জেনা-ব্যভিচার মহাপাপ, মৃত্যুর পর রয়েছে তার কঠিন শাস্তি । এ সম্পর্কিত কুরআন ও হাদিসের শিক্ষা প্রচার করতে হবে। শিক্ষক, ইমাম ও মিডিয়া ভূমিকা রাখবে।

৮ . মেলামেশা থেকে যৌন কামনার সৃষ্টি হয়। এ জন্য নারী-পুরুষ উভয়কে দৃষ্টি সংযত রাখার শিক্ষা দিতে হবে। পরিবারকে এজন্য যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে।

এ ব্যাপারে নবিজি বলেছেন,

‘নির্জনে কোনো নারী-পুরুষ একত্রিত হলে তাদের মধ্যে তৃতীয় জন হয় শয়তান’। (তিরমিজি) এর মানে শয়তান তাদেরকে পাপের দিকে উৎসাহিত করে। এ ব্যাপারে সকলের নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতে হবে।

এসব সত্য যত তাড়াতাড়ি বোধগম্য হবে তত তাড়াতাড়ি সমস্যার সমাধান হবে। চোখ বন্ধ করে রাত ভাবলে দিনের আগমন বন্ধ হবে না। একজন অশিক্ষিত মুচি যেমন চামড়া দিয়ে পা ঢেকে রাজার ধুলা সমস্যা সমাধান করেছিল তেমন ভাবতে হবে। শিক্ষা ও সভ্যতার অহমিকা নিয়ে নবিজির প্রতিষ্টিত ইসলামী মডেলের অনুশীলন ছাড়া ধর্ষণ, যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়ন বন্ধ করা সম্ভব হবে না।

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন । আসুন সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

আরও পড়ুন