Ads

বিশ্ব ভালোবাসা দিবসঃ অপসংস্কৃতির উদাহরণ

।। আলী ওসমান শেফায়েত ।।

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই তরুণ-তরুণীদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের সমারোহ। কতসব বিচিত্র আয়োজন হবে আজ এই দিনকেই ঘিরে। দিন-রাত চলবে আয়োজনের ঝলকানী। বিশ্বায়নের সূত্রে পাওয়া এ পশ্চিমা সংস্কৃতি আমাদের জন্য কতটা মানানসই একবারও কি তা ভেবে দেখেছি? বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের আছে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। অথচ আমরা আমাদের সংস্কৃতির খোঁজ-খবর তেমনভাবে রাখি না। বাঙালিদের ৩৬৫ দিন ভালোবাসার। অথচ একটি বিশেষ দিনকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে বাকিদিনগুলোক ভালোবাসাহীন করে চালাতে চাইছি।

সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে যে ভালোবাসা চিরন্তনভাবে চলে আসছে মাঝপথে এসে সে ভালোবাসায় বাধার সৃষ্টি করে ভালোবাসাকেও করে ফেলছি সংকীর্ণ। ভালোবাসা দিবসের সময় আসলে আমরা হিতাহীত জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকি উন্মাদের মত। অথচ একবারও গভীরভাবে খোঁজ নিয়ে জানতে চাই না ভালোবাসা দিবস উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস। মনে প্রশ্ন জাগে না, কোন্ কারণে আমরা বিশেষ একটি দিনের খাঁচায় বন্দি করে ফেলছি মুক্ত ভালাবাসাকে। শুধুমাত্র নিষিদ্ধ যৌবন কামনার তাড়নায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে আমাদের বিবেককে। ভালোবাসা দিবস বলতেই তরুণ-তরুণীরা হুঁশ হারিয়ে উম্মাদনায় মাতছে। যেসব দেশ থেকে ভালোবাসা একেবারেই পরবাসী হয়েছে সেসব দেশের মানুষ ভালোবাসা দিবস পালন করে কিছুটা লাভবান হলেও বাংলাদেশের মত একটি আদর্শিক ইসলামিক দেশে ভালোবাসা দিবস পালনের নামে যা হয় তা আদৌ কাম্য নয়, নয় গ্রহণযোগ্যও। যে দেশের মানুষের জীবনের সকল পরতে-পরতে ভালোবাসায় ভরপুর তারা নির্দিষ্ট একটি দিন কেন্দ্রিক ভালোবাসাকে পুঁঞ্জিভূত করে ফেলবে, এটা কখনো হওয়ার নয়, মানারও নয়। বিশেষত আমরা যে ইতিহাসগুলোকে স্মরণ করার মানসে ভালোবাসা দিবসকে পালন করি সেসব ঘটনাগুলোতে প্রকৃত ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও ছিল কিনা তা নিয়ে আছে গুরুতর প্রশ্ন।

ভালোবাসা দিবস কী:

পশ্চিমা দেশগুলোতে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ বলা হয়। বছরের ৩৬৫ থেকে মাত্র একটি দিন ও রাত প্রেম সরোবরে ডুব দেওয়া, সাঁতার কাটা, চরিত্রের নৈতিক ভূষণ খুলে প্রেম সরোবরের সলিলে হারিয়ে যাওয়ার দিবস হচ্ছে, ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ বা ‘ভালোবাসা দিবস’। এ দিনটিকে ‘লাভ ডে’ অথবা ‘লাভার্স ফেস্টিভ্যাল’ বলা হয় না। অথচ আমাদের দেশে ‘সেন্ট ভালেন্টাইন্স ডে’র অনুবাদ করে বলা হচ্ছে ‘ভালোবাসা দিবস’। এরূপ অনুবাদের কারণে এদেশের সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। ভালোবাসা অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি শব্দ। মূল শব্দের অনুবাদ বিকৃত করে ‘ভালোবাস দিবস’ বলায় এটা যে ভিন্ন দেশ ও ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে এসেছে সেটা সহজে বুঝা যাচ্ছে না। বাংলাদেশের মত অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ তার নিজ নামের পরিবর্তে অনুবাদের ছদ্মবরণে প্রবেশ করছে। ফলে এ দিবসের প্রকৃত অর্থ, উৎপত্তির কারণ ও ইতিহাস অনেকের কাছেই অজানা থেকে যাচ্ছে। অনেকটা হুজুগের বশবর্তী হয়ে বিজাতীয় ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতি-নীতিতে লালিত ও পরিপুষ্ট একটি ধর্মীয় উৎসবের দিনকে এ দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী বিশেষকরে তরুণ-তরুণীরা নিজেদের একটি অন্যতম উৎসবের দিন হিসেবে গ্রহণ করছে।

‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র আসল পরিচয়:

‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ (Saint Valentine’s Day) এর প্রথম শব্দটিই এ দিনটির আসল পরিচয় বলে দিচ্ছে। Advanced Oxford Learners Dictionary তে Saint শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে: a person declared to be holy by the Christian Church because of her/his qualities or good works অর্থাৎ– এমন ব্যক্তি, খ্রিস্টান গীর্জা কর্তৃক যাকে তার গুণাবলী বা ভালো কাজের জন্য পবিত্র সত্তা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আর Valentine শব্দের অর্থ ভালবাসা নয়। Valentine মূলত একজন ব্যক্তির নাম। খ্রিস্ট ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করার কারণে যাকে গীর্জা কর্তৃক Saint (পবিত্র সত্তা) ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং সহজেই বুঝা যায়, গীর্জা কর্তৃক ‘পবিত্র সত্তা’ হিসেবে ঘোষিত একজন ধর্ম যাজকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এ দিনটি উদযাপনের মূল কারণ।‘

‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’-এর ইতিহাস:

বিভিন্ন Encyclopedia অধ্যয়ন করলে সহজেই Saint Valentine এর ইতিহাস সম্পর্কে জানা যাবে। আরো জানা যাবে Saint Valentine’s Day এর উৎপত্তির কারণ। ২৭০ খ্রিস্টাব্দের কথা। তখন রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস নারী-পুরুষের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। তার ধারণা ছিল, বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে যুদ্ধের প্রতি পুরুষদের অনীহা সৃষ্টি হয়। সে সময় রোমের খ্রিস্টান গীর্জার পুরোহিত ‘ভ্যালেন্টাইন’ রাজার নির্দেশ অগ্রাহ্য করে গোপনে নারী-পুরুষের বিবাহ বন্ধনের কাজ সম্পন্ন করতেন। এ ঘটনা উদঘাটিত হওয়ার পর তাকে রাজার কাছে ধরে নিয়ে আসা হয়। ভ্যালেন্টাইন রাজাকে জানালেন, খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসের কারণে তিনি কাউকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বারণ করতে পারেননা। রাজা তখন তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় রাজা তাকে খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে প্রাচীন রোমান পৌত্তলিক ধর্মে ফিরে আসার প্রস্তাব দেন এবং বিনিময়ে তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার কথা বলেন।

আরও পড়ুন- ভ্যালেন্টাইন্স ডেঃ লাল গোলাপের আড়ালে অভিশপ্ত আঁধার

উল্লেখ্য, রাজা দ্বিতীয় ক্লডিয়াস প্রাচীন রোমান পৌত্তলিক ধর্মে বিশ্বাস করতেন এবং তৎকালীন রোমান সাম্রাজ্যে এ ধর্মের প্রাধান্য ছিল। যাহোক, পুরোহিত ভ্যালেন্টাইন রাজার প্রস্তাব মানতে অস্বীকৃতি জানালেন এবং খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি অনুগত থাকার কথা পুনর্ব্যক্ত করলেন। তখন রাজা তাকে মৃত্যুদন্ডের নির্দেশ দেন। অতঃপর রাজার নির্দেশে ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি অনুগত থেকে ধর্মকে বিসর্জন না দিয়ে আত্মাহুতি দেওয়ার জন্য ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ ঘোষণা করা হয়।

পরবর্তীতে রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টান ধর্মের প্রাধান্য সৃষ্টি হলে খ্রিস্টান গীর্জা ভ্যালেন্টাইনকে ‘Saint’ (পবিত্র সত্তা) হিসেবে ঘোষণা করে। কেননা খ্রিস্ট ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করলে গীর্জা কর্তৃক তাকে Saint (পবিত্র সত্তা) বলা হয়। ৩৫০ সালে রোমের যে স্থানে ’ভ্যালেন্টাইন’ কে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল সেখানে তার স্মরণে একটি গীর্জা নির্মাণ করা হয়। অবশেষে ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে খিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু পোপ গ্লডিয়াস ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ (Saint Valentine Day) হিসেবে ঘোষণা করেন। এ দিনে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে গীর্জায় খ্রিস্টান ধর্মমতে পবিত্র সত্তা (Saint) নিবার্চনের জন্য একটি লটারির আয়োজন করা হতো। লটারীতে যার নাম আসত সে সংশ্লিষ্ট বছর থেকে গীর্জা ও খ্রিস্টান ধর্মের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করত ।

সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’ এর প্রেম প্রসঙ্গ:

কথিত আছে, ভ্যালেন্টাইন কারাগারে থাকাকালে কারারক্ষীর যুবতী মেয়ের প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়েন। ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রয়ারি তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার দিন সে কারারক্ষীর যুবতী মেয়েকে একটি চিরকুট লিখে যায় যার শেষে লিখা ছিল, “From Your Valentine” অর্থাৎ ‘তোমার ভ্যালেন্টাইনের পক্ষ থেকে’।

ভ্যালেন্টাইনের প্রেম সম্পর্কে এর চেয়ে বেশী কিছু জানা যায় না। তবে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ ঘোষণার কয়েকটি ইতিহাস বা কারণের এটিও একটি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কারারক্ষীর যুবতী মেয়ের প্রেমে ভ্যালেন্টাইনের কথিত ভালবাসার কারণে কি খ্রিস্টান পোপ গ্ল্যাসিয়াস ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ ঘোষণা করেছিলেন? নিশ্চয়ই না। কারণ, খ্রিস্ট ধর্মে পুরোহিতদের জন্য বিয়ে করা বৈধ নয়। পুরোহিত হয়ে কারো যুবতী মেয়ের প্রেমে আসক্তি খ্রিস্ট ধর্ম মতেও অনৈতিক কাজ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, ভালবাসার কারণে ভ্যালেন্টাইন কে কারাগারে যেতে হয়নি। কারণ, সে কারারক্ষীর যুবতী মেয়ের প্রেমে আসক্ত হয়েছিল কারাগারে যাওয়ার পর। সুতরাং, ভ্যালেন্টাইন কে কারাগারে নিক্ষেপও মৃত্যুদন্ডদান এর সাথে ভালবাসার কোন সম্পর্ক ছিলনা।

তাই ভ্যালেন্টাইনের কথিত ভালবাসা ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ এর মূল বিষয় ছিল না। বরং খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি গভীর ভালবাসাই ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদন্ডের কারণ ছিল। কারণ নারী-পুরুষের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে রাজার নিষেধাজ্ঞার বিপরীতে তিনি গোপনে নারী-পুরুষের বিবাহ বন্ধনের কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে তার ধর্মীয় বিধান পালন করেছিলেন এবং অবশেষে তাকে জীবন দিতে হয়েছিল। আর খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি তার এহেন গভীর ভালবাসার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেই মূলত তার মৃত্যুদন্ডের দিনটিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।

শেষ কথা: ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ সম্পর্কিত এসব অজানা তথ্য জানার পরও ইসলাম ধর্মের অনুসারী বাংলাদেশী ঐতিহ্যে লালিত কোন নারী কিংবা পুরুষ কি এইদিনে তার প্রিয়জন থেকে কোন চিরকুট, প্রেমপত্র, লাল গোলাপ, ভ্যালেন্টাইন্স ডে কার্ড বা কোন উপহার পাওয়ার অপেক্ষায় থাকবে? কিংবা এ দিনে তথাকথিত ভালবাসা বিনিময়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবে? দেশের বিভিন্ন নগরীর হোটেল গুলো মেতে উঠবে অবৈধ সম্পর্কের যৌনতা ও শরীর বিনিময়ের মহা উৎসবে। এদিন বহু কুমারী মেয়ে হারাবে তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ “সতীত্ব”। রাস্তায় রাস্তায় কপত কপতীর জোড়া। পার্কের চিপায় বসে অশালীন কামনার প্রকাশ। কখনো বা রিক্সার হুডের নিচে। এসব কিছুই আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধের সাথে মানান সই নয়। এতে হচ্ছে ব্যভিচারের মত মহা পাপ। তবে তা জেনে শুনে নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক মূল্যবোধ ও নিজ দেশের মাটি ও মানুষের সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে আত্ম-বিস্মৃতির চরম দেউলিয়াপনা ছাড়া আর কি হতে পারে? তাই সকল পিতা মাতার উচিত সন্তানের উপর খেয়াল রাখা। তাদের কে সঠিক ভাবে বোঝানো। মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন।

লেখকঃ কলাম লেখক ও সাহিত্যিক

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন এবং সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হইন । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিযি

আরও পড়ুন