Ads

ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে সুদ গ্রহনের অভিযোগ ও তার জবাব প্রসংগে

।। মু. শামসুজ্জামান ।।

সাম্প্রতিক সময়ে একটি খবর নিয়ে বেশ লেখালেখি হচ্ছে যে ইসলামী ব্যাংক সোনালী ব্যাংক থেকে ১০০০ কোটি টাকা সুদের বিনিময়ে ঋণ নিয়েছে তার নগদ তারল্যের সংকট দূর করতে। এর বিপরীতে ইসলামী ব্যাংকও একটি জবাবে ব্যাখ্যা বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করেছে। এ প্রসংগে আরো বিস্তারিত ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক, সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা তার ফেসবুক পেজে দিয়েছেন। আমার কাছে এ ব্যাখ্যাটিই উপযুক্ত মনে হওয়ায় আমি হুবহু তার লিখাটি উপস্থাপন করলাম।
-কোট-
ইসলামী ব্যাংক: সুদি ঋণ গ্রহণের অভিযোগ ও জবাবের শরঈ প্রেক্ষিত

অভিযোগ:

১. কনভেনশনাল ব্যাংকের সাথে লেনদেন

২. সুদের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ করা

ইসলামী ব্যাংকের জবাব

১. মুদারাবা স্পেশাল নোটিশ ডিপোজিট (মুদারাবা এসএনডি)

২. ডিপোজিট এট প্রভিশনাল রেট এডজাস্টাবল আফ্টার ফাইনালাইজেশন অব একাউন্ট (প্রাক্কলিত হারে চূড়ান্ত হওয়ার পর সমন্বয়)

ইসলামী ব্যাংক নিয়ে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত প্রতিবেদনের একাংশ

১ম অভিযোগ ও জবাব: শরীঈ বিশ্লেষণ

ক্লাসিক্যাল ফিকহ: ঐতিহ্যবাহী ফিকহ ইসলামীতে “মুদারাবা গাইরুল মুসলিম”/ অমুসলিমের সাথে মুদারাবা শিরোনামে অভিজ্ঞ আলিমগণ এ বিষয়ে বিশ্লেষণ করেছেন।

হানাফি ও হাম্বলী মত: সামষ্টিকভাবে অমুসলিম ‘সাহিবুল মাল’/ক্যাপিটাল প্রোভাইডার/মূলধন যোগানদাতা অথবা ‘মুদারিব’/ম্যানাজার/উদ্যোক্তা হওয়া বৈধ।

ইমাম আল-কাসানী (রঃ) বলেন, মুদারাবার ক্ষেত্রে এটা শর্ত নয় যে অর্থের মালিক বা উদ্যোক্তা কোনো পক্ষ মুসলিম হতে হবে। তাই মুসলিম এবং জিম্মি (দেশীয় অমুসলিম নাগরিক) অথবা দেশীয় অমুসলিম এবং নিরাপত্তাকামী বিদেশী অমুসলিম নাগরিক’ (’আল-হারবী আল-আল-মুস্তামিন’)-এর মাঝে মুদারাবা বৈধ। যদি ইসলামী রাষ্ট্রে কোনো নিরাপত্তাকামী অমুসলিম প্রবেশ করে এবং মুসলিম নাগরিকের সাথে মুদারাবা করে অথবা কোনো মুসলিম এমন কোনো নিরাপত্তাকামী বিদেশী নাগরিককে মুদারাবার ভিত্তিতে সম্পদ বিনিয়োগ করে তা বৈধ হবে। কেননা, দেশীয় অমুসলিম নাগরিকের সাথে মুদারাবা বৈধ; সুতরাং সমভাবে অমুসলিম বিদেশী নাগরিকের সাথেও মুদারাবা বৈধ।

فذهب الحنفيّة والحنابلة إلى جواز مضاربة غير المسلم في الجملة‏.‏

قال الكاساني‏:‏ ولا يشترط إسلام ربّ المال أو المضارب‏,‏ فتصح المضاربة بين أهل الذّمّة وبين المسلم والذّمّيّ والحربيّ المستأمن‏,‏ حتّى لو دخل حربي دار الإسلام بأمان‏,‏ فدفع ماله إلى مسلمٍ مضاربةً‏,‏ أو دفع إليه مسلم ماله مضاربةً فهو جائز‏,‏ لأنّ المستأمن في دارنا بمنزلة الذّمّيّ‏,‏ والمضاربة مع الذّمّيّ جائزة فكذلك مع الحربيّ المستأمن‏.‏

শাফিঈ ও মালিকী মতামত:

অমুসলিমদের সাথে মুদারাবা অংশগ্রহণ মাকরূহ বা অপছন্দনীয়। মালিকী মাযহাবের একটি মতানুযায়ী অমুসলিম দেশীয় নাগরিকের সাথে মুদারাবা হারাম বা নিষিদ্ধ। ইমাম মালিক বলেন, কেবলমাত্র হালাল-হারাম সম্পর্কে অবহিত লোক ছাড়া অন্য কারো সাথে মুদারাবা করা আমি পছন্দ করি না; যদি কোনো মুসলিম কোনো হারামকে হালাল মনে করে তার সাথেও মুদারাবার ক্ষেত্রে একই কথা।

وأمّا الشّافعيّة والمالكيّة في المذهب فذهبوا إلى أنّ مضاربة غير المسلم أو مشاركته مكروهة‏,‏ وعند المالكيّة قول بحرمة مضاربة المسلم للذّمّيّ‏.‏

وقال مالك‏:‏ لا أحب للرّجل أن يقارض رجلاً إلا رجلاً يعرف الحرام والحلال‏,‏ وإن كان رجلاً مسلماً فلا أحب له أن يقارض من يستحل شيئاً من الحرام‏.‏

অনুসিদ্ধান্ত: উপরিউক্ত মতামতের আলোকে হানাফি ফিকহের দৃষ্টিকোণ থেকে কনভেশনাল ব্যাংকের সাথে মুদারাবা চুক্তির ভিত্তিতে লেনদেন বৈধ। ইসলামী ব্যাংক ক্যাপিটাল প্রোভাইডার হোক বা মুদারিব দু‘টির যে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে। কনভেনশনাল ব্যাংকও মুদারাবার যাবতীয় বিধি-বিধান অনুসরণ করে ইসলামী ব্যাংক থেকে ক্যাপিটাল/মূলধন নিতে পারে। অন্তত থিউরিটিক্যাল কোন সমস্যা নেই, যদি অপারেশনাল প্রব্লেম সলভ করতে পারে।

 

২য় অভিযোগ ও জবাব: শরীঈ বিশ্লেষণ

১. সুদি ঋণ ও মুদারাবা ডিপোজিট: সুদ হচ্ছে, ক্যাপিটাল ওনার কর্তৃক কোনো রিক্স ছাড়া গ্রহিতা থেকে নির্দিষ্ট সময়ান্তে পূর্ব নির্ধারত হারে অর্থ লাভ করা। প্রচলিত ব্যাংকের এমন অর্থলগ্নিকরণ প্রক্রিয়া লোন বা ঋণ এবং সময়ান্তে আরনিংকে সুদ বলা হয়। মুদরাবা হচ্ছে, ক্যাপিটাল ওনারের মূলধন এবং উদ্যোক্তার লেভার/শ্রম দিয়ে যদি প্রত্যাশিত মুনাফা অর্জিত হয়, তবে তা পূর্ব নির্ধারিত হারাহারে উভয় পক্ষের মাঝে বন্টনের চুক্তি করা। একইসাথে মুনাফা অর্জিত না হয়ে পুঁজির ক্ষতি হলে ক্যাপিটাল ওনার মূলধন এবং লেভার তার শ্রমের ক্ষতি মেনে নেয়া। ইসলামে সুদ হারাম এবং মুদারাবা হালাল বা বৈধ।

২. মুদারাবা এসএনডি: সাধারণত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তারল্য সংকট হলে ‘কলমানি‘ বা মানি মার্কেট ইন্সট্রুমেন্টের মাধ্যমে সংকট পূরণ করে। প্রচলিত ব্যাংকগুলো এ কাজ সুদের ভিত্তিতে করে থাকে। ইসলামী আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাধারণত ব্যক্তি বা কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক থেকে ব্যাংক স্বল্প সময়ের অর্থের প্রয়োজন পূরণে ‘মুদারাবা এসএনডি‘ একাউন্ট ওপেন করে থাকে। মুদারাবার ভিত্তিতে ডিসাইন করা অনেকগুলো ইন্সট্রুমেন্টের মাঝে ‘মুদারাবা স্পেশাল নোটিশ ডিপোজিট‘ ইসলামী ব্যাংকের একটি শরীআ অনুমোদিত প্রোডাক্ট। কোন কোন ব্যাংক ‘মুদারাবা শর্ট নোটিশ ডিপোজিট‘ নামে তা পরিচালনা করে।

ডেইলি স্টারে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিবাদে ইসলামী ব্যাংকের বক্তব্য

৩. প্রভিশনাল রেট এডজাস্টাবল আফ্টার ফাইনালাইজেশন: মুদারাবা চুক্তির দু‘পক্ষ প্রথমে একটি প্রাক্কলিত হার ঘোষণা করে যাতে শরীআর দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই। তবে হিসাব চূড়ান্ত হওয়ার পর তা অবশ্যই সমন্বয় করতে হবে এবং সমন্বিত হিসাব অনুযায়ী দু‘পক্ষ তাদের মুনাফা এডজাস্ট করবে। ইসলামী ব্যাংকগুলো ‘মুদারাবা এসএনডি‘ একাউন্ট শরীআর বিধি মেনে মুনাফা সমন্বয় করে থাকে।

অনুসিদ্ধান্ত: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির অবশ্য-ই মুদারাবার যাবতীয় বিধি অনুসরণ করে ‘মুদারাবা স্পেশাল নোটিশ ডিপোজিট‘ পরিচালনা করে। তা অবশ্য-ই সুদী ইনুস্ট্রুমেন্ট নয়।

বি.দ্র: বিভ্রান্ত হওয়ার পূর্বে অভিযোগকারীর পরিচয় জানা ইসলামে আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা বলেন,

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنۡ جَآءَکُمۡ فَاسِقٌۢ بِنَبَاٍ فَتَبَیَّنُوۡۤا اَنۡ تُصِیۡبُوۡا قَوۡمًۢا بِجَهَالَۃٍ فَتُصۡبِحُوۡا عَلٰی مَا فَعَلۡتُمۡ نٰدِمِیۡنَ

“হে বিশ্বাসীগণ! যদি কোন পাপাচারী তোমাদের নিকট কোন বার্তা আনয়ন করে, তাহলে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে; যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোন সম্প্রদায়কে আঘাত না কর এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।“ [আল-কুরআন, ৪৯:৬]

(ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক, সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা)

-আনকোট-

দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ত্রুটি, ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের অভাব,মেয়াদ উত্তীর্ণ লোনের উর্ধ্বগতি, ডলার সংকট এবং ক্রমাগত নেতিবাচক লেখালেখির কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ডিপোজিটর ব্যাংকে ডিপোজিট রাখার বিষয়ে কিছুটা আস্থার অভাব আছে,একথা স্বীকার করতেই হবে। ফলে কমবেশী সকল ব্যাংকেই নগদ অর্থের প্রবাহ সংকুচিত হয়ে আসছে। তার বিপরীতে বিনিয়োগ বা এডভানস কমিটমেন্ট কিন্ত চলমান। অন্যদিকে আদায় পরিস্থিতিও ভালো নয়।ইসলামী ব্যাংক এসব সমস্যার উর্ধ্বে নয় বা তার ব্যতিক্রম নয়।

আমরা আশা করবো, এসব সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে আলোচনা সমালোচনার পূর্বে সমস্যার কারণ ভালোভাবে জানা দরকার। আরো উল্লেখ্য যে ইদানিং যে কোন ছোটখাটো বিষয়ও জনসমক্ষে প্রকাশ করে আতংক ও অস্থিতিশীলতা তৈরী করা কোন কোন মিডিয়ার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। একটি সুদবিহীন ও সুদভিত্তিক প্যারালাল অর্থনীতির দেশে কিভাবে ইসলামী ব্যাংকের লেনদেন হবে তার সমাধান বহু আগেই ফিকাহ আমাদের দিয়েছে।

লেখকঃ  মু. শামসুজ্জামান, সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়ন মূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিয়ে ফেসবুকে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন।প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন