Ads

ইমরানের সাথে স্ত্রীকেও ১৪ বছরের জেল! কোন পথে পাকিস্তান?

।। মাসুম খলিলী ।।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তার স্ত্রী বুশরা বিবিকে রাষ্ট্রীয় উপহার বেআইনিভাবে বিক্রির দায়ে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁস সংক্রান্ত একটি মামলায় খানকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার একদিন পরে এই সাজা দেওয়া হয়।

পাকিস্তানের জনপ্রিয় রাজনীতিকের বিরুদ্ধে দ্বৈত সাজা দেওয়া হয় ৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের প্রায় এক সপ্তাহ আগে। নির্বাচনের ১ সপ্তাহ আগে এই দণ্ডে বোঝা যাচ্ছে এস্টাবলিশমেন্টের সামনে এতকিছু করার পরওআশংকা রয়ে গেছে জনগণ পিটিআইকে জয়ী করে ফেলে কিনা।

দেশটিতে প্রাক নির্বাচন কারসাজির উদাহরণ অনেক থাকলেও ভোট গ্রহণ ও ফল প্রকাশে কারসাজি হয় না বলে বিশ্বাস করা হতো। এবার সেই বিশ্বাসও ভেঙে পড়তে পারে। রাষ্ট্রের গভীর ক্ষমতা বলয় সম্ভবত, গণতন্ত্র ও জনমতকে দেশের নিরাপত্তার সাথে সাংঘর্ষিক হিসাবে বিবেচনা করছে।

ইমরান খান ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে কারাগারে রয়েছেন। তিনি, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা প্রকাশ করা এবং তার সমর্থকদের দ্বারা সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ সহ শতাধিক অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন। সব অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন। তবে তার দলের অনেক নেতা চাপের মুখে পিটিআই ছেড়েছেন। খান নিজে সহ পিটিআই-এর একাধিক নির্বাচনী মনোনীত প্রার্থী পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) দ্বারা তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাখ্যাত হতে দেখেছেন।

কারাগারে থাকার কারণে খান গত মাসে তার দলের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। অপেক্ষাকৃত অপরিচিত আইনজীবী গোহর আলী খানকে নতুন প্রধান হিসেবে নাম দেওয়া হয়েছে, যিনি তিন বছরেরও কম সময় আগে দলে যোগ দিয়েছিলেন। অনেকে ধারণা করেছিলেন ইমরানের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী দলের নেতুত্ব দিতে পারেন। ইমরানের সাথে অন্তরালে থাকা তার স্ত্রীকেও ১৪ বছরের দন্ড দেয়ায় তাকেও ক্ষমতাধররা এলাউ না করার বিষয়টি স্পষ্ট হলো।

জরিপে কি আসছে?

গ্যালাপ পাকিস্তান এবারের সাধারণ নির্বাচনের ১ মাস আগে ডিসেম্বরের এক জরিপে জরিপকৃত ভোটারদের ৩৪ শতাংশ পিটিআই এবং ৩২ শতাংশ বলেছেন যে তারা পিএমএল-এনকে ভোট দেবেন। পিএমএল-এন ও পিটিআই-এর মধ্যে ব্যবধান গত ৮ মাসের মধ্যে ধীরে ধীরে কিন্তু ধারাবাহিকভাবে সংকুচিত হচ্ছে।

আরও পড়ুন- শেষ হতে পারে গাজায় গণহত্যা

২০২৩ সালের মার্চ মাসে, পাঞ্জাবে পিএমএল-এন ্এর সাথে ২১ শতাংশ ব্যবধানে পিটিআই এগিয়ে ছিল। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের সমীক্ষায় এই ব্যবধান এখন ২ শতাংশ। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৩০ দিনের মধ্যে, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে বা বিপরীত হয় কিনা তা দেখা গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই সময়ের মধ্যেই পিটিআইয়ের নির্বাচনী প্রতীক চূড়ান্তভাবে কেড়ে নেয়া হয়েছে।

জরীপ অনুসারে দেশটির বৃহত্তম প্রদেশ পাঞ্জাবে নির্বাচনের এক মাস আগে নির্বাচন প্রতিযোগীতামূলক বলে মনে হচ্ছে এবং জনপ্রিয় ভোটের অভিপ্রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ নির্বাচন ২০১৮ পরিস্থিতির কাছাকাছি। এই প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দুটি প্রধান দলের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সমর্থন দেখা যায়। পিটিআই উত্তর পাঞ্জাবে পিএমএল-এন-এর চেয়ে যুক্তিসঙ্গত ব্যবধানে এগিয়ে থাকলেও পশ্চিম ও মধ্য পাঞ্জাবে ঘাড়ের সাথে গলা মিলিয়েছে। দক্ষিণ পাঞ্জাবে পিএমএল-এন এগিয়ে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে এবং পিপিপি-রও এখানে যুক্তিসঙ্গত সমর্থন রয়েছে। মধ্য পাঞ্জাবে, টিএলপির একটি স্পয়লার ভোট রয়েছে। যেহেতু উত্তর পাঞ্জাব পাঞ্জাবের মোট আসনের ১০ শতাংশ, তাই এটা বলা নিরাপদ যে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা বেশ প্রতিযোগিতামূলক হবে।

সিন্ধুতে, পিপিপি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল, যেখানে পিটিআই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। তবে, গ্রামীণ সিন্ধুর বিপরীতে করাচি ও হায়দারাবাদ অঞ্চলে পিপিপির সমর্থন কম। খায়বার পাখতুন খোয়ায় পিটিআই এগিয়ে রয়েছে কিন্তু জোটের উত্থানের কারণে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে খায়বার পাখতুন খোয়ায় জরিপ করা ৪৫ শতাংশ ভোটার দাবি করেছেন যে তারা পিটিআইকে ভোট দিতে চান। ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে, পিটিআই-এর ভোট শেয়ার ছিল ৩৭ শতাংশ। ফলে স্পষ্টতই পিটিআইয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে, যদিও খুব বেশি উল্লেখযোগ্য নয়।

পিটিআই ব্যতীত অন্য দলগুলির ভোট বিভিন্ন নির্বাচনী অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত যা কেপিতে ব্যাপক জনপ্রিয় ভোটের দিক থেকে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও তাদের আসন জিততে সাহায্য করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, দক্ষিণ কেপিতে জামিয়তে উলামায়ে ইসলামে-ফজলুর উল্লেখযোগ্য ভোট শেয়ার রয়েছে আর মুসলিম লীগ নওয়াজের উল্লেখযোগ্য ভোট শেয়ার রয়েছে হাজারায়। হাজারা ও দক্ষিণ কেপিতে জাতীয় পরিষদের প্রায় অর্ধেক আসন রয়েছে।

নেতাদের অনুমোদনের রেটিং এর ক্ষেত্রে, ইমরান খান নওয়াজ শরীফের সাথে জাতীয় স্তরে সামান্য এগিয়ে রয়েছেন। ক্ষমতায় থাকাকালীন পিটিআই-এর জটিল শাসনের রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও, ডিসেম্বরের একটি গ্যালাপ জনমত জরিপে দেখা যায় যে কারাবন্দী খানের অনুমোদনের রেটিং ৫৭ শতাংশ দাঁড়িয়েছে, যেখানে শরীফের জন্য ৫২ শতাংশ। পাঞ্জাবে ইমরান খানের চেয়ে এগিয়ে নওয়াজ শরিফ। জুন ২০২৩ এবং ডিসেম্বর ২০২৩ এর মধ্যে, অনুমোদনের রেটিং এর ক্ষেত্রে ইমরান খান এবং নওয়াজ শরীফের মধ্যে ব্যবধান যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। এ সময়ে ইমরান জেলে অন্তরীণ রয়েছেন আর তার দলের ওপর ব্যাপক নিপীড়ন চালানো হয়েছে।

গ্যালপের জরিপ অনুসারে, জাতীয় পর্যায়ে নেতাদের মধ্যে খান ও শরীফের পর এবার পিপিপির বিলাওয়াল ভুট্টো ও জামায়াতের আমীর সিরাজুল হকের অবস্থান। এই চার জনের অনুমোদন হার যথাক্রমে ৫৭, ৫২, ৩৫ ও ৩৪ শতাংশ। এবারের নির্বাচনে জামায়াতের ইসলামীর মতো দলের আসন সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে।

ইমরানের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ

পাকিস্তানে ইমরান খানের জন্য বেশ খারাপ সময় যাচ্ছে। ২০২২ সালের এপ্রিলে একটি অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার পদচ্যুত হওয়ার পর থেকে, বিভিন্ন সময় এই ক্রিকেটার-রাজনীতিবিদকে গুলি করা হয়েছে, দাঙ্গা থেকে শুরু করে সন্ত্রাসবাদ পর্যন্ত ১৮০ টিরও বেশি অভিযোগে মামলা করা হয়েছে এবং পরবর্তীতে নয়-বাই-১১-ফুটের একটি নির্জন জেল সেলে পাঠানো হয়েছে। ৮ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানে নতুন নির্বাচনের কাছাকাছি আসার সাথে সাথে, ব্যাপক জনসমর্থন বজায় থাকা সত্ত্বেও ৭১ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা কম বলে মনে হচ্ছে।

এটা কোন গোপন বিষয় নয় যে পাকিস্তানের সামরিক কিংমেকাররা শরীফের পিছনে তাদের সমর্থন ছুড়ে দিয়েছে, যার শেষ পর্যন্ত অর্থ হল তিনি ক্ষমতায় ফেরার জন্য অপেক্ষায় আছেন। তবে খানের স্থায়ী জনপ্রিয়তা মানে আরও ভারী এবং বেপরোয়া কৌশলের প্রয়োজন হবে।

একটি বড় প্রশ্ন হল কেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ধরনের নির্লজ্জ অনিয়মের মুখে এতটা নিঃশব্দ হয়ে গেছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যে দেশটি জো বাইডেন প্রশাসনের অধীনে গণতন্ত্রের প্রচারকে একটি প্রধান বৈদেশিক নীতির অগ্রাধিকার বলে দাবি করেছে। এই ভূমিকার ঝুঁকিও বেশ উচ্চ থরনের বাজি, কারণ পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান ১৪০ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি ঋণে ডুবে যাচ্ছে। আর সাধারণ মানুষ এশিয়ার সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করছে, খাদ্যের দাম বছরে ৩৮.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সত্যটি হল যুক্তরাষ্ট্রের উপেক্ষার মুখে রাশিয়া ও চীনের সাথে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেওয়ার পর পশ্চিমে ইমরান খানের খুব কম বন্ধু রয়েছে। ওয়াশিংটন ডিসি-র উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান টাইম ম্যাগজিনকে বলেছেন, ‘ওয়াশিংটনের দৃষ্টিকোণ থেকে, এখন যে কেউই খানের চেয়ে ভালো হতে পারে। এর বিপরীতে শরীফকে ব্যবসা-বান্ধব এবং আমেরিকাপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন প্রত্যাহারের পর, ওয়াশিংটনের বৈদেশিক নীতির অগ্রাধিকার চীন, ইউক্রেন এবং এখন গাজায় স্থানান্তরিত হয়েছে। তবুও ইসলামাবাদে একজন বিশ্বস্ত অংশীদারের গুরুত্ব রয়েছে তাদের কাছে।’ সব মিলিয়ে এবারের নির্বাচনে ইমরান খানের দলের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা খুবই কম। আর নির্বাচনে তার সমর্থকরা জয়ী হলেও তাদের অনেককে হর্স ট্রেডিংয়ে দল পাল্টিয়ে সামরিক প্রতিষ্ঠানের পছন্দের দলকে দিয়ে সরকার গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে খায়বার পাখতুন খোয়াসহ একধিক প্রদেশে সরকার গঠনের মতো অবস্থায় পৌছা পিটিআইয়ের পক্ষে অসম্ভব নয়।

ইমরানকে রাজনৈতিক আবহাওয়া পাল্টানোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তিনি এতদিন এস্টাবলিশমেন্টের সাথে আপোষরফা করতে রাজি হনসি। সম্প্রতি তিনি আলোচনা করার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। সে যাই হোক এবারের বাস্তবতা হলো ইমরানকে নতুন মেয়াদে ক্ষমতার বাইরে থাকতে হবে আর অপেক্ষা করতে হবে বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন আর নওয়াজের সাথে সামরিক নেতাদের নতুন কোন সংঘাত দেখা দেয় কিনা তার দিকে।

দেশটির অর্থনীতি এখন যে অবস্থায় রয়েছে তাতে সরকারের পক্ষে জনমত জয় করা খুব সহজ নয়। তবে সততা ও জাতীয় স্বার্থের তোয়াক্কা না করলে নানা পক্ষের সাথে মানিয়ে নেয়া কঠিন হয় না। যেটি ইমরান খান আসলেই পারেননি। এ জন্য সৎ ইমরানকে স্ত্রী সহ জেল দেয়া হচ্ছে আর অসৎ রাজনীতিবিদরা হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী।

ই-মেইলঃ [email protected]

লেখকঃ কলাম লেখক ও দৈনিক নয়া দিগন্তের সাবেক সহযোগী সম্পাদক

…………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়ন মূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিয়ে ফেসবুকে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন।প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন