Ads

নোবেল শান্তি পুরস্কার কি একটি রাজনৈতিক পুরস্কার?

।। শারমিন আকতার ।।

১৮৮৬ সালে সুইডিশ ব্যবসায়ী ও রসায়নবিদ আলফ্রেড নোবেল মারা যাওয়ার সময় অনেক সম্পত্তি রেখে মারা যান । তার এই সম্পত্তির অধিকাংশ অর্জিত হয় মূলত রাশিয়ার পেট্রোলিয়াম কোম্পানি এবং ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং সাউথ আফ্রিকাতে অবস্থিত বিভিন্ন ডিনামাইট ফ্যাক্টরি থেকে ।  তিনি মারা যাওয়ার আগের বছর তার মৃত্যুর পরে তার বিশাল সম্পত্তি কি কাজে ব্যয় করা হবে তার উপর ১৮৮৫ সালে  তিনি একটা উইল করে গিয়েছিলেন । সেই উইলে এই মর্মে উল্লেখ ছিল যে ‘প্রতিবছর যারা বিশ্বে মানবতার মঙ্গলের জন্য কাজ করবেন তাদের মধ্য থেকে ৫ জনকে তার সম্পত্তি থেকে পুরস্কার দেয়া হবে ।’ কোন কোন ক্ষেত্র  (Sector) থেকে ৫ জনকে পুরস্কার দেয়া হবে তারও উল্লেখ ছিল এই উইলে। সেই ক্ষেত্রগুলো হল পদার্থ বিজ্ঞান (Physics), রসায়ন বিজ্ঞান (Chemistry),  শারীরবিদ্যা বা  চিকিৎসা বিজ্ঞান (Physiology or Medicine), সাহিত্য (Literature) এবং শান্তি  (Peace)।

আলফ্রেড নোবেলের উইল অনুসারে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হবে  “সেই ব্যাক্তিকে যিনি বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গঠনে সবচেয়ে জোরালো ও সেরা ভূমিকা রাখবেন।  যিনি স্থায়ী সেনাবাহিনীর বিলুপ্তি বা হ্রাস এবং শান্তি কংগ্রেস গঠন ও বিস্তারে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন  ।” আলফ্রেড নোবেলের উইল অনুসারে মূলত প্রতি বছর পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যিনি সবচেয়ে বেশি অবদান রাখবেন তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হবেন ।

আলফ্রেড নোবেলের উইলের প্রেক্ষিতে ১৯০১ সাল থেকে আলফ্রেড নোবেল এর উইল বাস্তবায়ন করার জন্য পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ঔষধ বা শারীরবিদ্যা, সাহিত্য এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান শুরু হয় । পরবর্তীতে ১৯৬৯ সাল থেকে আলফ্রেড নোবেল কর্তৃক নির্ধারিত পাঁচ সেক্টরের সাথে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের মাধ্যমে মোট ছয় বিষয়ে নোবেল দেয়া অব্যাহত থাকে ।

১০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে  পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, শারীরবিদ্যা বা  চিকিৎসা বিজ্ঞান,সাহিত্য এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হচ্ছে । এই ১০০ বছরের মধ্যে অন্যান্য নোবেল পুরস্কার নিয়ে তেমন কথা না হলেও প্রায়ই নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানকে কেন্দ্র করে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটিকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় । যাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হচ্ছে আদৌ তিনি শান্তিতে অবদান রেখেছেন কি না সে বিষয়ে সরব হয়ে উঠেন সমালোচক ও বিশেষজ্ঞরা ।

বিভিন্ন সময়ে সমালোচিত নোবেল শান্তি পুরস্কারের মধ্যে সবচেয়ে সমালোচিত ছিল ১৯৭৩ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এবং প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড সরকারদ্বয়ের  মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে দেয়া নোবেল শান্তি পুরস্কার । অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমেরিকান রাজনৈতিক স্বার্থ সামনে রেখে সাধারণত নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয় বলে সমালোচক এবং বিশেষজ্ঞদের অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করে থাকেন।

১৯৭৩ সালে হেনরি কিসিঞ্জার ও লে ডাক থো যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন ।  ঐ সময় উত্তর ভিয়েতনাম ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার যুদ্ধ বিরতি এবং সেখান থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের প্রেক্ষাপটে তাদেরকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। কিন্তু লে ডাক থো এই পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান; কারণ তখনো যুদ্ধ চলছিল।  তাদেরকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের ফলে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি ঐ সময় ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল। নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির দুইজন সদস্য সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করেন। সমালোচকদের অনেকের অভিমত, “কিসিঞ্জার শান্তি প্রণেতা ছিলেন না; বরং যুদ্ধের ব্যাপক প্রসারে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছিলেন।”

এরপরে সমালোচিত হয় ১৯৯১ সালে অং সান সু চিকে দেয়া নোবেল শান্তি পুরস্কার । তারপর ১৯৯৪ সালে যৌথভাবে ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট ইতজাক রাবিন, তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন পেরেজ এবং ফিলিস্থিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতের নোবেল শান্তি পুরস্কারও বেশ সমালোচিত হয়েছিল । ২০০৯ সালে বারাক ওবামার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিও কম সমালোচিত হয়নি ।

পরবর্তীতে ২০০৩ সালে ইরানের নারীবাদী আইনজীবী শিরিন এবাদির পাওয়া  নোবেল শান্তি পুরস্কার এবং ২০১৪ সালে পাকিস্তানের কিশোরী মালালা ইউসুফজাইর অর্জন করা নোবেল শান্তি পুরস্কার পাশ্চাত্যে সাদরে সমাদৃত হলেও মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোতে বেশ সমালোচিত হয়েছে । অনেকের মনে প্রশ্ন তারা কি আদৌ নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ?  এতো ছোট অবদানের জন্য এতো বড় পুরস্কার ! আলফ্রেড নোবেল এর উইল অনুসারে নোবেল শান্তি পুরস্কার মূলত তাকেই দেয়ার কথা যিনি নির্দিষ্ট বছরে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বেশি অবদান রাখবেন । সারা পৃথিবীর প্রায় ৮ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় শিরিন এবাদি এবং মালালা ইউসুফজাইয়ের অবদান কি আসলেই সবচেয়ে বেশি ছিল? নাকি কোন একটা ধর্মীয় আদর্শ বা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাদের জোরালো অবস্থানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদেরকে এই নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছে?

নার্গেস মোহাম্মাদী

 

গত ৬ অক্টোবর ২০২৩ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয় । এইবার  নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়েছে ইরানের ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক ও অ্যাকটিভিস্ট নার্গেস মোহাম্মাদীকে । তাকে দেয়া নোবেল শান্তি পুরস্কার পাশ্চাত্যে সাদরে সমাদৃত হলেও প্রাচ্যের ইসলাম মনা সাধারণ মানুষের কাছে আদৌ কি তা পছন্দনীয় পুরস্কার ? মাঝে মাঝে নোবেল শান্তি পুরস্কারটা উলু বনে মুক্তো ছড়ানোর মতো হয়ে যায় । নার্গেস মোহাম্মদীকে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি  কর্তৃক নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছেন স্বয়ং ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির বর্তমান মহিলা চেয়ারম্যান বেরিট রেইস-অ্যান্ডারসেন নোবেল শান্তি পুরস্কার-২০২৩ এর জন্য ইরানের নারীবাদী অ্যাকটিভিস্ট নার্গেস মোহাম্মদীর  নাম ঘোষণার  করার পরপরই বলেন, “She is the symbol of what it means to be a freedom fighter in Iran.” নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির মতে নার্গেস মোহাম্মদীকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে ইরানে নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরব ভূমিকা পালন করা । নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান তাদের অফিসিয়াল বিবৃতিতে বলে ‘নার্গেস মোহাম্মদীকে ইরানে নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা; সকলের জন্য মানবাধিকার ও স্বাধীনতার অধিকার আদায়ের সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।’

লেখকের আরও লেখা পড়ুন-নারীর সত্যিকারের স্বাধীনতা আসে যেভাবে

নোবেল প্রাইজের অফিসিয়াল ওয়েব সাইটে নার্গেস মোহাম্মদীকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়ার  Prize motivation হিসাবে উল্লেখ আছে – “For her fight against the oppression of women in Iran and her fight to promote human rights and freedom for all”

৮.১ বিলিয়ন মানুষের এই ধরিত্রীতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার-২০২৩ পাওয়া ইরানের নাগরিক নার্গেস মোহাম্মদী আসলে কে? তার আদর্শিক চিন্তাধারা, কার্যক্রম আসলে কেমন? আসুন তা জানার চেষ্টা করি ।

নার্গেস মোহাম্মদী হচ্ছেন একজন ইরানের নারীবাদী মানবাধিকার কর্মী । ১৯৭২ সালে তিনি ইরানের জানজানে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি ইমাম খোমেনি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় (একে  কাজভিন আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ও বলা হয়ে থাকে) থেকে পদার্থ বিদ্যায় পড়াশোনা শেষ করে একজন প্রোফেশনাল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে পেশা শুরু করেন ।  নার্গেস মোহাম্মদী মূলত ২০০৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া ইরানের আরেক নারীবাদী আইনজীবী শিরিন এবাদির একজন একনিষ্ঠ ভক্ত এবং অনুসারী ।  তিনি নারীবাদী আন্দোলনকে বেগবান করতে এবং তাদের চিন্তাধারার আদলে তথাকথিত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আগ্রহ নিয়ে শিরিন এবাদির  প্রতিষ্ঠান “ডিফেন্ডারস অফ হিউম্যান রাইটস সেন্টার (DHRC) এ যোগ দেন এবং পরবর্তীতে এর ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

নার্গেস মোহাম্মদী ইরানের নারীদের হিজাবপ্রথার বিরুদ্ধে বর্তমানে সবচেয়ে সোচ্চার একজন নারীবাদী কর্মী । ইরানের সরকারী আইনের আলোকে নয় বছর বা তার বেশি বয়সী সকল নারীকে ইসলামী ড্রেস কোড মেনে চলতে হয় । এই ড্রেস কোডের অংশ হিসাবে নারীদের মাথার চুল ঢেকে রাখতে অবশ্যই হিজাব বা ওড়না পরে থাকতে হয় । আর এই ইসলামী ড্রেস কোডের বিরুদ্ধে যারা ইরানে সোচ্চার নার্গেস মোহাম্মদী মূলত তাদেরই একজন প্রতিনিধি এবং তাদের জন্য জন সমর্থন আদায়ের জোরালো ভূমিকা রাখতে অগ্র সেনানী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন  ।

নার্গেস মোহাম্মদী তার এক বক্তব্যে বলেন-“চূড়ান্ত সমাধান হল একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠন । কিন্তু আপাতত বিকল্প সমাধান  হচ্ছে আমাদের প্রথমত সুশীল সমাজ গড়ে তোলার জন্য জোরালো পদক্ষেপ নেয়া এবং নিজেদের শক্ত অবস্থান ধরে রাখা  ।  আমাদের নারীদের মেসেজ হল আমরা নীরব থাকব না এবং আমরা  আইন অমান্য করব ।”

হিজাব প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের পাশাপাশি তিনি ইরানে  জঘন্য অপরাধমূলক কার্যক্রম যেমন খুন, ধর্ষণ, যেনা, সমকামিতাসহ নানা ধরণের  অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত আসামীর জন্য যে মৃত্যুদণ্ডের আইন আছে নার্গেস মোহাম্মদী তার বিরুদ্ধেও আওয়াজ উঠান । এসব অপরাধের বিরুদ্ধে দেয়া ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট নাকি ইরানী সরকারের আরোপ করা মানবাধিকার লঙ্ঘন ! পরোক্ষভাবে এর অর্থ হচ্ছে তিনি  ইসলামী শাসনব্যবস্থাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসাবে আখ্যায়িত করছেন ।

তিনি ইরানের জাতীয় নিরাপত্তার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ আছে । ইরানের সরকার নিয়ে সমালোচনার জন্য ১৯৯৮ সালে প্রথম তিনি কারাগারে যান এবং সেই সময় প্রায় এক বছর কারা বরণ করেন  । পরবর্তীতে মোহাম্মদী আরও ১২ বার গ্রেপ্তার হয়েছেন ।  শিরিন এবাদির নারীবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান  “DHRC”-এর সদস্যপদ লাভ এবং দেশের শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অপপ্রচারের জন্যও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল । তিনি মূলত ইরানের ইসলামী সরকার কর্তৃক কারাদণ্ড প্রাপ্ত একজন নারীবাদী অ্যাকটিভিস্ট । তাকে বিভিন্ন অপরাধের সাজা হিসাবে বেশ কয়েক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে । বর্তমানে তিনি ইরানের Tehran’s Evin Prison  এ বন্দী অবস্থায় রয়েছেন ।

তথাকথিত নারীবাদী আন্দোলনের সাথে জড়িত থেকে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মিডিয়ার সহায়তা পাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ইরানের বিভিন্ন সংস্কারপন্থী পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবেও কাজ করেছেন । ইরানের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে প্রবন্ধমূলক বই রচনা করেছেন । তার  সেই বইয়ের নাম হচ্ছে The reforms, the Strategy and the Tactics

নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণার পর  “Peace Research Institute Oslo” এর পরিচালক Henrik Urdal বলেন-“We hope today’s prize will send a clear message to world leaders including the United States that international pressure is needed to improve the lives of girls and women in Iran. ” অর্থাৎ “আমরা আশা করি আজকের পুরস্কারটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে একটি সুস্পষ্ট বার্তা পাঠাবে যে ইরানে মেয়েদের ও মহিলাদের জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োজন।”

লেখকের আরও লেখা পড়ুন-সফল দাম্পত্য জীবন গঠনে কুফু আইনের ভূমিকা

তাহলে কি ইরানের উপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে নার্গেস মোহাম্মদীকে দেয়া সম্মানজনক এই  নোবেল শান্তি পুরস্কার মূলত একটি রাজনৈতিক পুরস্কার? নিজস্ব ধর্মীয় স্বকীয়তা এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাড়িয়ে শিরিন এবাদির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নার্গেস মোহাম্মদীর যে নারীবাদী আন্দোলন; তা কি আদৌ ইরানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখছে? নার্গেস মোহাম্মদীকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান মূলত ইরানের চিরশত্রু আমেরিকার রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের অপপ্রয়াস কি না? ইরানী সরকারের বিরুদ্ধে নারী অধিকার (Women Rights) লঙ্ঘনের কালিমা লেপন করে ইরান সরকারকে কাবু করার জন্য এটি আমেরিকান একটি কূটকৌশল কি না তা ভাবে দেখার বিষয় !

ইরানের একজন সিনিয়র সরকারী ব্যক্তিত্ব বলেন- “এই পুরস্কারটি মূলত ইরানী শাসন প্রক্রিয়া এবং মূল্যবোধের বিরুদ্ধে একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নমুনা  । আর ইহা প্রায়ই ইরানী  তথাকথিত সুশীল নারীদের ইরানি শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানকে উস্কে দিতে ভূমিকা রাখে ।”

গত ৬ অক্টোবর ইরানের জনপ্রিয় ইংরেজি পত্রিকা তেহরান টাইমস এর লেখক ফারামর্জ কুহপায়েহ এর একটি আর্টিকেল প্রকাশ হয় “On the Politicized Prize” শিরোনামে ।  ফারামর্জ কুহপায়েহ তার এই আর্টিকেলে বলেন- “নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের বাছাই করার প্রক্রিয়াটি অস্পষ্ট এবং অস্বচ্ছ বলে সমালোচকরা সমালোচনা করে থাকেন। আল-জাজিরার বিবৃতি অনুসারে নোবেল পুরস্কার কেউ অর্জন করার পর পরবর্তী ৫০ বছরের মধ্যে সেই নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন প্রক্রিয়া  এবং এই  পুরস্কার কাকে দেয়া হবে সে বিষয়ে আলোচনা প্রক্রিয়া নিয়ে তথ্য প্রকাশ করা নোবেল ফাউন্ডেশন  নিষিদ্ধ থাকে ।”

তিনি আরও বলেন- “নোবেল শান্তি পুরস্কারটি মূলত সমালোচিত হয় শান্তি নিয়ে  অপরিণত এবং ত্রুটিপূর্ণ উপলব্ধির জন্য বা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত  হওয়ার জন্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে কিছু নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী পরবর্তীতে মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে; এমন কাজ করার জন্য সমালোচিত হয়েছেন।

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি এই পুরস্কারকে “রাজনৈতিক কাজ” এবং ইহাকে ইরানের প্রতি কিছু ইউরোপীয় রাষ্ট্রের “হস্তক্ষেপবাদী নীতির” অংশ হিসেবে নিন্দা করেছেন।

সাধারণত মুসলিম দেশের সেসব মুসলিম নারীরাই নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হচ্ছেন যারা তথাকথিত নারীবাদী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী । ইসলামী মূল্যবোধ ও মুসলিম সমাজের চিরায়ত সাংস্কৃতিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে যাদের জোরালো অবস্থান । উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ২০০৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া ইরানের ইরানের শিরিন এবাদি, ২০১৪ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া পাকিস্তানের কিশোরী মালা ইউসুফজাই  এবং এই বছর ২০২৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া ইরানের আরেক নারীবাদী নার্গেস মোহাম্মদী। ইরানে যারা মুসলিম নারীদের ইসলামী সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য এবং স্বকীয়তার বিরুদ্ধে কথা বলেন; শান্তির আহবানের আড়ালে যারা মুসলিম সমাজে অশান্তির সুচনা ঘটাচ্ছেন তারাই মূলত পাচ্ছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার !

আরও পড়ুন-নোবেল শান্তি পুরস্কারের ‘রাজনৈতিক ব্যবহার’

আমেরিকার মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় এর পলিটিক্যাল সাইন্স এর অধ্যাপক রোনাল্ড ক্রেবস  Vice Media তে দেয়া তার এক সাক্ষাৎকারে নোবেল শান্তি পুরস্কারের ব্যাপারে সমালোচনা করে বলেন – “The award increasingly has been given to candidates who are thought to exemplify certain ideals rather than in recognition of a particular achievement or a lifetime of achievements. This can lead to some buyer’s remorse years later. Likewise, sometimes awards are given to people with spotted records for one peacemaking event (or attempt)….”

অর্থাৎ “এই পুরস্কারটি ক্রমবর্ধমানভাবে সেইসব প্রার্থীদের দেওয়া হয়েছে যারা একটি নির্দিষ্ট আদর্শের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কোন সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কৃতিত্ব বা সারাজীবনের কোন অর্জনের স্বীকৃতি হিসাবে দেয়া হচ্ছে না । এইভাবে মনোনীত করার বিষয়টি বছরের পর বছর ধরে প্রবল আক্ষেপের কারণ হতে পারে । শান্তি স্থাপনের ইভেন্টের পুরস্কারগুলি কখনও কখনও এমন ব্যক্তিদের দেওয়া হচ্ছে যাদের কালিমাযুক্ত অতিত রেকর্ড রয়েছে…।”

সমালোচকদের  অনেকেই সন্দেহ করছেন যে এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কার মূলত ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকান স্বার্থ উদ্ধারের জন্য একটি রাজনৈতিক পুরস্কার?

পরিশেষে ইরানের জনপ্রিয় ইংরেজি সংবাদপত্র তেহরান টাইমসের ইরানী প্রবন্ধকার ফারামর্জ কুহপায়েহ এর ভাষায় বলতে চাই – “Nobel Peace Prize is a highly politicized award with a history of being used to advance Western political agenda against governments opposing the Western hegemony.” অর্থাৎ “নোবেল শান্তি পুরস্কার সম্পূর্ণভাবে একটি রাজনৈতিক পুরস্কার; যা পশ্চিমা আধিপত্যের বিরোধিতাকারী সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিমা রাজনৈতিক এজেন্ডাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হওয়ার ইতিহাস।”

রেফারেন্সঃ

১। “On the Politicized Prize” by Faramarz Kuhpayeh, Tehran times

২। “What Narges Mohammadi’s Nobel Means for Iran” by Alexandra Sharp, Foreign policy

৩। Financial Times

৪। উইকিপিডিয়া

৫। https://www.nobelpeaceprize.org/

৬। https://bigthink.com/the-past/worst-nobel-peace-prizes/

লেখকঃ শারমিন আকতার, CSAA (Certified Shari’ah Advisor and Auditor), একটি ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং মহীয়সী অনলাইন পোর্টালের সম্পাদক

মহীয়সী প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিন।

প্রিয় লেখক ! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected] এবং [email protected] 

প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন