Ads

বন্যায় অসহায় সিলেটবাসী আর গর্বের পদ্মা সেতু

।। আসাদ পারভেজ ।।

‘বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বে রোলমডেল, বিশেষ করে বন্যা তদারকি’—এই একটি বাক্য জীবনে কতবার পড়েছি, তার ইয়ত্তা নেই! কিন্তু বই থেকে জানা আর বাস্তবে দেখার মধ্যে ব্যবধান আকাশ-পাতাল।

মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার্থে রাষ্ট্রের তৎপর থাকাটাই স্বাভাবিক। অনেকে বলতে চান বন্যা পরিস্থিতিতো মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না। বিষয় হলো বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এমন প্রাকৃতিক সমস্যা মোকাবেলায় রাষ্ট্রের পূর্ব প্রস্তুতি থাকাটাই স্বাভাবিক নয় কি? যদি তাই হওয়ার কথা, তাহলে বন্যা মোকাবেলায় বারবার হঠাৎ বন্যা এমন কথা আসে কেন?
পুরো দেশের মধ্যে সিলেট অঞ্চল অন্যতম বিভাগীয় শহর। অথচ বন্যায় আটকে পড়া মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য সাহায্য পাচ্ছে না। একটা এলাকার এত বাজে অবস্থা হওয়ার পরও প্রশাসন পর্যায়ে দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা নেই, বন্যা সংক্লান্ত বিষয়ে মিডিয়া কাভারেজ নেই। যেন সুনামগঞ্জ, সিলেট বাংলাদেশের অংশই নয়!

বন্যা কবলিত এলাকার কয়েক সুধি মানুষের আকুতি দেখলে নিজেকে সামলে নেওয়া কষ্টকর। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার আকুতি ভেসে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। তিনি মানুষকে উদ্ধারের জন্য, পানিবন্দী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নৌকা চান; পাচ্ছেন না। তিনি লিখেছেন, ‘কোথাও ট্রলারমালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে উজান এলাকা থেকে একটা ট্রলারনৌকা কেউ ম্যানেজ করতে পারলে অতিসত্বর যোগাযোগ করুন।’ কতটা নিরুপায় পরিস্থিতিতে পড়লে এ রকম খোলা বার্তা একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দিতে পারেন।

সিলেটে গত শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় বন্যা চলছে। ষাট থেকে সত্তরোর্ধ্ব অনেকে বলছেন, তাঁরা বন্যার এত পানি এর আগে কখনও দেখেননি। কী কারণে এমন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হলো তার সঠিক কোন উত্তর সম্ভবত সরকারের জানা নেই। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সিলেটের প্রতিটি নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়েছে। হাওরে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ, রাস্তা ও স্লুইসগেট নির্মাণ করা হয়েছে। নির্বিচারে কাটা হচ্ছে পাহাড়-টিলা। মূলত, ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির জন্য মোটাদাগে এসব কারণই প্রধানত দায়ী।বিশেষ করে ভারতের উজানে পাথর উত্তোলনের ফলে মাটি আলগা হয়ে নদীতে চলে আসে। ফলে নদীর তলদেশ ভরে যায়। সেখানে নাব্যতা সংকট তৈরি হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ গবেষকদের অভিমত যে, ভবিষ্যতে বন্যা থেকে রেহাই পেতে সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারাসহ অন্যান্য নদ-নদী খনন করা জরুরি। এ ছাড়া সিলেট নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছড়াগুলো (প্রাকৃতিক) দখলমুক্ত করে খনন করে পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক পথ নিশ্চিত করা দরকার।

ভূতাত্ত্বিকভাবে সিলেট একটি বৈচিত্রময় এলাকা। পাহাড়-টিলায় জনপদটি যেমন সমৃদ্ধ; তেমনি এখানে নদী, নালা, খাল, বিল, হাওর-বাঁওড়ের কোনো কমতি নেই। তবে নদীগুলোর সব কটিরই উৎপত্তি হয়েছে ভারতে। সুরমা নদী ছাড়া বাকি নদীগুলোর অধিকাংশ এসেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল জায়গা ভারতের মেঘালয় থেকে। তাই মেঘালয়ে বৃষ্টিপাতের কারণে যে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়, এর অধিকাংশ চলে আসে সিলেটে।

সরকারের কোনোরকম পরিকল্পিত কার্যক্রম না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ি বালু-মাটি-পলি জমতে জমতে নদ-নদীগুলো প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। অন্যদিকে, অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজের কারণে নদীগুলো ক্রমে সংকোচন ও ভরাট হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে নদীশাসনের নামে নদী-বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড। যত্রতত্র স্লুইসগেট ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণেও নদীর প্রবাহপথ আরও বেশি সংকুচিত হয়েছে। এতে এবার অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে পানি জমে বন্যার সৃষ্টি করেছে।

গত মে মাসের শেষ দিকে একবার বন্যায় আক্রান্ত হয়েছিল সিলেট। এ নিয়ে সিলেট অঞ্চলে এই বছর তিনদফা বন্যা দেখা দিয়েছে। সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোয় শুরু হওয়া বন্যার পেছনে অতিবৃষ্টির বাইরে আরও কয়েকটি কারণ দেখছেন গবেষকরা।সবমিলিয়ে ৩৫ লাখের বেশি মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছে বলে কর্তৃপক্ষ বলছে।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দিয়েও কেন বন্যা ঠেকানো যাচ্ছে না এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা নেই রাষ্ট্রের কাছে। সুনামগঞ্জের সঙ্গে দেশের বাকি অংশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। নেত্রকোনার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে রেল যোগাযোগ।এর পাশাপাশি রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারীসহ দেশের আরও কয়েকটি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে।

নদী গবেষকরা বলছেন, এবারের এইরকম আকস্মিক বন্যার পেছনে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ হলেও এর বাইরে আরও কিছু উপাদান কাজ করেছে। তবে ভারত সরকার যে আক্ষরিক অর্থে বাংলাদেশের কোনরকম ভালো চায় না। তারা গ্রীষ্মে নদীপথে ব্যারিকেট দিয়ে আর বর্ষা মৌসুমে স্লুইসগেট খুলে দিয়ে অতি ক্ষরা ও বানের পানিতে আমাদের ডুবিয়ে মারে।

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি অঞ্চলে।বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্প মেঘালয়ের পাহাড়ের সাথে ধাক্কা লেগে ওপরে উঠে যায়। সেখানে ভারী হয়ে বৃষ্টি আকারে পড়তে শুরু করে।

বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে গত ২৪ ঘণ্টায় ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সেখানের অতিবৃষ্টির কারণে এবারের ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।গত তিনদিন চেরাপুঞ্জিতে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে, ২৪৮৭ মিলিমিটার এবং এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। এরকম ধারাবাহিক বৃষ্টি হয়েছে ১৯৯৫ সালে একবার, তিনদিনে ২৭৯৮ মিলিমিটার আর ১৯৭৪ সালে ২৭৬০ মিলিমিটার।

সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্ত থেকেই ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি এলাকার শুরু হয়েছে। ফলে সেখানকার পানি সরাসরি বাংলাদেশের হাওরে এসে মেশে। ভৈরব বা মেঘনা নদী হয়ে সাগরে চলে যায়।কিন্তু অতীতের বৃষ্টিপাতের প্রেক্ষাপট আর এখনকার নদীগুলোর অবস্থার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে বলে নদী গবেষকরা মনে করছেন। গবেষণায় স্পষ্ট যে, এই হঠাৎ বন্যার পেছনে চেরাপুঞ্জির এই প্রবল বৃষ্টিপাতই দায়ী।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে আবহাওয়া-জলবায়ু বা বৃষ্টির ধরন বদলে গেছে। এখন বৃষ্টি হলে অনেক বেশি গভীর বৃষ্টি হয়। প্যাসিফিকেও একটা লা নিনো আছে। সেটাও অতিবৃষ্টির পেছনে ভূমিকা রেখেছে।”

সিলেট-সুনামগঞ্জের বহু এলাকার বাসিন্দাদের জন্য চলাফেরার একমাত্র উপায় এখন নৌকা। অথচ নৌকার তেমন কোন ব্যবস্থাই নাই।

‘চেরাপুঞ্জিতে যখন বৃষ্টি হয়, সেটা ছয় থেকে আট ঘণ্টার ভেতরে তাহিরপুরে চলে আসে। কিন্তু সেখানে এসে পানি তো আর দ্রুত নামতে পারছে না। ফলে তখন সেটা আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে বন্যার তৈরি করছে’।

অতিবৃষ্টির কারণে ভারতের আসামেও বন্যা এবং ভূমিধ্বসের সৃষ্টি হয়েছে। আসামে বরাক ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গুয়াহাটিসহ অনেক এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। আসাম, মেঘালয় মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো খবর দিচ্ছে, আসামের বন্যায় অন্তত ১১ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

নদীর পানি বহনের ক্ষমতা অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। মেঘালয় বা আসাম থেকে আসা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি নদী পথে হাওর থেকে বের হয়ে মেঘনা বা যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যায়।কিন্তু এবারের বন্যার পেছনে হঠাৎ উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানি বের হতে না পারাটাও অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। দু:খের বিষয় অনেকে না জেনে এজন্যনদ-নদীর নাব্যতা কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন।

প্রতি বছর উজান থেকে পানির সাথে পলি আর পাথর নেমে আসে। সেটা এসে বাংলাদেশের অংশে নদীর তলদেশ ভরে ফেলে। নদীর পানি বহনের ক্ষমতা কমে যায়। তখন এই নদীতে বেশি পানি আসলে সেটা উপচে আশেপাশের এলাকা ভাসিয়ে ফেলে। এভাবে নদীর নাব্যতা নষ্টের জন্য ভারত অংশে অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলনকারী কতৃপক্ষ অবশ্যই দায়ী।
বন্যার পেছনে মানুষের নিজেদের তৈরি কতগুলো কারণতো অবশ্যই রয়েছে।

‘সিলেট বা সুনামগঞ্জ এলাকায় আগে ভূমি যেরকম ছিল, এতো রাস্তাঘাট ছিল না বা স্থাপনা তৈরি হয়নি। ফলে বন্যার পানি এখন নেমে যেতেও সময় লাগে। আগে হয়তো জলাভূমি, ডোবা থাকায় অনেক স্থানে বন্যার পানি থেকে যেতে পারতো। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না।’

‘হাওরে বিভিন্ন জায়গায় পকেট পকেট আমরা রোড করে ফেলেছি। ফলে পানি প্রবাহে বাধার তৈরি হচ্ছে। শহর এলাকায় বাড়িঘর তৈরির ফলে পানি আর গ্রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলে বন্যার তীব্রতা আমরা বেশি অনুভব করছি। এসব কারণে আগাম বন্যা হচ্ছে এবং অনেক তীব্র বন্যা হচ্ছে’।

বাংলাদেশে গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেকে সিলেটে অঞ্চলের বারবার বন্যার জন্য ইটনা-মিঠামইন সড়ককে দায়ী করছেন। এটা সত্য যে, অপরিকল্পিতভাবে রাস্তা তৈরির কারণে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া বন্যার অন্যতম কারণ।কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে যেভাবে ইটনা-মিঠামইন সড়ককে এই বন্যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে, বিষয়টি ততটা না। আমাদের দেশে উজান থেকে পানি নামে উত্তর থেকে দক্ষিণে। এই রাস্তাটিও কিন্তু উত্তর থেকে দক্ষিণে তৈরি। ফলে এটা হয়তো হাওরের পানি প্রবাহের কিছুটা বাধার তৈরি করছে, কিন্তু বন্যার এটাই একমাত্র কারণ নয়।

‘হাওরে যেসব রাস্তা পূর্ব-পশ্চিমে তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোই হাওরের পানি চলাচলে মূল বাধার তৈরি করছে। এরকম অনেক রাস্তা কোনরকম পরিকল্পনা ছাড়া তৈরি করা হয়েছে।হাওরে যেসব সড়ক বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হচ্ছে, তা পরিকল্পিতভাবে হয়নি। সেটা না হওয়ার কারণেই বন্যা এরকম তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে।
জানুয়ারি, ২০২২-এ জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে মাননীয় শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন যাতে হাওরে এখন থেকে এলিভেটেড বা উড়াল সড়ক করা হয়।কিন্তু শুধুমাত্র সুনামগঞ্জ জেলার হাওর এলাকায় যেসব সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে, তার বেশিরভাগই এখনো ‘অল সিজন’ বা ‘সাবমার্সিবল’ সড়ক।

তাছাড়া সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ বা নেত্রকোনা হাওর এলাকায় বেশিরভাগ জনপদে শহর রক্ষা বাঁধ নেই। ফলে কোন কারণে হাওরে বা নদীতে পানি বাড়তে শুরু করলে তা খুব দ্রুত শহরে বা আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে।হাওরের যেসব এলাকায় শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি করা হয়নি। সেটা করা না হলে বাড়িঘর উঁচু করে তৈরি করতে হবে, আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। সেটাও করা হয়নি। ফলে যখন এভাবে আকস্মিক বন্যা দেখা দিচ্ছে, সেটার ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হচ্ছে।

চীনসহ অনেক দেশে স্পঞ্জ সিটি তৈরি করা হচ্ছে। এসব শহরে বন্যা হলে সেই পানি শহরের ভেতরেই জমিয়ে রেখে কাজে লাগানোর পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে।কিন্তু এবার বাংলাদেশে যেভাবে আকস্মিকভাবে বৃষ্টির বা পানি বৃদ্ধির রেকর্ড ভেঙ্গে বন্যার তৈরি হয়েছে, এরকম পরিস্থিতিতে বন্যা ঠেকানো খুব কঠিন বলে বলছেন অধিকাংশ বিশেষজ্ঞরা।
এছাড়া বন্যার ফলে সিলেট-সুমানগঞ্জের অধিকাংশ সড়ক পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় জনজীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। ভয়াবহ বন্যার ফলে দেশের ব্যস্ততম সিলেট-ভোলাগঞ্জ বঙ্গবন্ধু মহাসড়কের অবস্থাও শোচনীয়। অপরদিকে বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পর এবার ভাঙতে শুরু করেছে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ সড়ক। পানির স্রোতে সরে যাচ্ছে সড়কের মাটি। এরই মধ্যে সিলেট-ভোলাগঞ্জ সড়কের হাবির দোকানের স্থানে রাস্তার নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। ফলে যে কোন সময় বিচ্ছিন্ন হতে পারে এ সড়কে চলাচল। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও বিঘ্ন ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী।

জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৩১ মে সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ সড়ককে জাতীয় মহাসড়কে উন্নিতকরণ প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষর হয়। পরে ৪৪১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয় ধরে ৩১ দশমিক ৭৭৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কটি ৩৪ মাস শেষে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সময়ের ব্যাবধানে বেড়েছে নির্মাণ খরচ ও সময়।
পরে চুক্তির প্রায় পাঁচ বছর পেরিয়ে মহাসড়কের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় প্রায় সাড়ে ৭শ কোটি টাকা। এছাড়া ওয়েটস্কেল স্থাপনসহ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায় সড়কের কাজ। আর নির্মাণ কাজ শেষে চুক্তি অনুযায়ী ৩ বছরের রাস্তা দেখভাল করার দায়িত্ব নেন স্প্রেক্টা ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি। তবে সে দায়িত্ব কতটা কার্যকর হচ্ছে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
মঙ্গলবার (২০ জুন) সড়কটি পরিদর্শন করেছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) সিলেটের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী উৎপল সামন্ত।তিনি বলেন, বন্যায় সড়কটির নিচ থেকে মাটি সরে গেছে। আমরা সড়কটি যথা শিগগিরই মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছি। ওখানে মাটি ভরাট করে রাস্তার পাশে বালির বস্তা দেওয়া হবে। আপাতত ভাঙন থেকে সড়কটি রক্ষায় উদ্যোগ নিচ্ছি। পানি কমলে পরবর্তীতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

একটি সরকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কিংবা অবৈধ যেভাবেই হোক রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্বে থাকলে, তারই নৈতিক দায়িত্ব যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় তড়িৎগতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া। অথচ পুরো সিলেট অঞ্চল যখন পানিতে তলিয়ে মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে, তখন কিছু সামাজিক সংগঠন ও বেশ কিছু আলেম ছাড়া কাউকেই দেখা যায়নি অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে। বিশ্ব মিড়িয়ায় যখন মৃত্যুর খবর বের হয়, আমাদের মিড়িয়া আনন্দ উৎসবের খবর নিয়ে ব্যস্ত থাকে। অবশেষে সিলেটবাসীর দুঃখ লাঘবে সরকার সেনাবাহিনী নিয়োজিত করেন। সেখানেও দেখা যাচ্ছে শায়খ আহমাদুল্লাহর নেতৃত্বে‘আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন’-এর মত প্রতিষ্ঠান গর্বিত সেনাবাহিনীর তদারকিতে সিলেটবাসীর পক্ষে জোরালো কাজ করে যাচ্ছেন যেখানে মাওলানা আব্দুল হাই মো: সাইফুল্লাহগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের ইসলামিক দলগুলোর নানা ইউনিট অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। বিশেষ করে জামায়াতের বয়োবৃদ্ধ আমির অগ্রণি ভূমিকা পালন করছেন।

আমি দেখেছি- এহছানুল কবির, সমুন, রুবেল, রেদওয়ান, রাশেদ, জেকিসহ মুফতি সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে অসহায় সিলেটবাসীর জন্য কাজ করা এক নিবেদিত গ্রুপকে। আমরা যে বীরের জাতি তা আবারও প্রমাণ করেছি। সিলেট অঞ্চলের এমন দুর্বিসহ সময়ে আলেম সমাজ ও জাতীয়তাবাদী শক্তি যে মানবিক উদ্যোগ নিয়েছে, তা জাতি দীর্ঘ সময় মনে রাখবে।
সৌদি আরব আর বাহরাইন এই দুই দেশকে স্থলপথে যোগাযোগ করানোর জন্য আরব সাগরের মাঝ দিয়ে চার লেন বিশিষ্ট ২১ কিলোমিটার লম্বা সেতু বানানো হয়েছিল ১৯৮৬ সালে যার নাম বাহরাইন সেতু। ৩৬ বছর আগে ৮০০ মিলিয়ন ডলারে নেদারল্যান্ডের বালাস্ট নিদাম কোম্পানি এটি বানিয়েছিল। সৌদি ও বাহরাইনের এমন কোন প্রবাসি এবং দেশি মানুষ ছিল না যারা এটি দেখতে যায়নি। অগণিত দর্শনার্থীদের মধ্যে কেউ কোনোদিন ব্রিজের রেলিংয়ের নাটবল্টু পরীক্ষা করতে যায়নি। এমন কোন রেকর্ড নেই যে কেউ নামাজ পড়েছে ব্রিজে, কেউ আবার প্রস্রাবও করেনি, আর কোনো মহিলা উদ্ভট ভঙ্গিতে নেচে ভিডিও করেনি।

গর্বের পদ্মা সেতু

পদ্মা সেতু নিসন্দেহে বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। এটি নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। অনেক দেশের সরকার কিংবা বিরোধী দল সকল কাজে প্রশ্ন তোলেন। আমাদের দেশ তার বাইরে নয়। না হয় গর্বিত পদ্মা সেতুর ভিত্তি কে স্থাপন করেছিল তার যথাযথ মূল্যায়ন নিয়ে সরকার জটিলতা তৈরি করবেন কেন? ইতিহাস সাক্ষী এই সেতুর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। নানা কারণে বর্তমান সরকারের জন্য এই সেতুর উদ্ভোধন এক মাইল ফলকের বিষয়। তাই বলে সিলেট অঞ্চলের বন্যা যখন কোটি মানুষকে মাজলুম হতে বাধ্য করেছে আর দেশের সকল মাধ্যমিক শিক্ষার্থীর জীবনের পথম ধাপকে আটকে দিয়েছে, তখন কি এমন উদ্ভোধন প্রয়োজন ছিল। সিলেটের দুর্বিসহ এই সময়ে কোন সরকার দলীয় চলমান কোন এমপি মাঠে ছিলেন কিনা জানি না।

পরিশেষে বলব, পদ্মা নদীর করাল গ্রাস থেকে বরিশাল অঞ্চলসহ পুরোজাতি হয়ত একদিন মুক্তি পাবে। পদ্মা সেতু এতদোঞ্চলের মানুষের জীবনকে সহজতর করবে। তাই বলে কোন এক মহিলা এই ব্রিজের উপরে দাঁড়িয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে কই খালেদা, নোবেল জয়ী ড. ইউনূস সাহেবকে কই ইউনূস বলে গালমন্দ করে ভিডিও বানাবে এমন জাতি হওয়ার তো স্বপ্ন দেখি না। অবশ্যই আমার দেশের জনৈক এমপিও জানেন না ডক্টর আর ডাক্তারের মধ্যে পার্থক্য কি?

লেখক: আসাদ পারভেজ
গবেষক ও কলামিস্ট

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়ন মূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিন।

এবং প্রিয় লেখক ! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected]

প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন