Ads

ছেলের প্রশ্ন ও আমি

শারমিন আকতার

আমার ছেলের অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি না । অথচ সে পড়ার পড় কিছু ভুলে গেলে আমি ওকে কতো গালি দেই; মাঝে মাঝে মারও পর্যন্ত দিয়ে ফেলি ।

গতকাল সে আমাকে জিজ্ঞাসা করল-

-আম্মু dogging মানে কি?

শব্দটা একটু নতুন মনে হল । এমন শব্দতো শুনিনি ।  বাচ্চার প্রশ্নের অনেক উত্তরি তো জানা থাকে না  । কখনও সঠিক, কখনও বেঠিক উত্তরতো দিয়েই থাকি ।  মেজাজ ভালো থাকায় ভাবলাম, আজকে না হয় একটু আই কিউ খাটিয়ে উত্তরটা দিয়ে ফেলি ।  একটু ভাবলাম । তারপর বললাম-

  • Dog থেকে যেহেতু dogging, হয়তো অর্থ হতে পারে “ কুত্তার মতো আচরণ করা । ”

সে আমার প্রশ্নের উত্তরটা পছন্দ করলো না । সে একটু হালকাভাবে দৌড়ে দেখাল আর বলল-

-আম্মু এরকম Dogging করা মানে কি?

– ওহ আচ্ছা ! এটা মানে ব্যায়াম করা । আর এটা Dogging না বাবা Jogging.

আমি হেসে বললাম ।

  • ওহ আচ্ছা ।

সে একটু লাজুক ভাব নিয়ে হেসে হেসে বলল ।একটা নতুন কিছু জানতে পারার আনন্দে তার চোখে মুখে খুশির আভা চিকচিক করে উঠলো ।

গতকাল Jogging  টা সে ভুল করে Dogging শুনে থাকলেও Dogging ও যে একটা কমপ্লিট অর্থবহ শব্দ আছে আমি ভুলেও ভাবিনি । এটি একটা ব্রিটিশ গালি ।

আজকে এই মুহূর্তে নেট থেকে জানলাম Dogging এর অর্থ ।  যা জানলাম তাতে বেশ লজ্জা লজ্জা লাগছে । তাই বাংলায় অর্থ করতে পারছি না  ।

ক্যামব্রিজ ডিকশনারি অনুসারে- “Sexual activity between people in a public place।“

উইকিপিডিয়া অনুসারে-

    “Dogging is a British English slang term for engaging in sexual acts in a   public or semi-public place or watching others doing so.”

অনেক সময় কিন্তু ছেলের প্রশ্নের অর্থ দেয়ার চেষ্টা থেকে আমি নতুন কিছু জানতে পারি । তার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য নেট থেকে তার অর্থ জেনে নেই । সেই প্রশ্নের উত্তর পরবর্তীতে আমার বাস্তব জীবনেও কাজে লাগে ।

একদিন ছেলে আমাকে প্রশ্ন করেছিল-

“মা পিঁপড়া, মাছি এরা চিনিতে বসে কেন? লবণও তো সাদা সেটাতে যায় না  কেন?”

বাহ চমৎকার জানার ও জ্ঞানের প্রশ্নতো ! কিন্তু আমি মূর্খ জানি না সে অর্থ । ভাগ্যিস মেজাজটা সেদিন ভালো ছিল । হাতের মোবাইলে নেটও ছিল । ঝটপট নেটে ব্রাউজ করে জানলাম যে “চিনি হচ্ছে প্রকৃতিতে প্রাপ্ত  সবচেয়ে উত্তম শক্তির উৎস (Energy Source) ।”

 

ঐ দিন প্রশ্নের উত্তর জানার পর আমার মনে হল “ওহ হাঁ চিনির রাসায়ানিক নাম তো সুক্রোজ, আর এই সুক্রজে ভেঙ্গে দুইটা গ্লুকোজ তৈরি হয় । আর এই গ্লুকোজই মানুষের শরীরে শক্তির যোগান দেয় । যেকোন খাবার হজমের মাধ্যমে ভাঙতে ভাঙতে গ্লুকোজে পরিণত হয়ে আমাদের রক্তে মিশে গিয়ে শক্তি সরবরাহ করে ।”

বোটানিতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করে চিনির রাসায়নিক নাম সুক্রোজের রাসায়নিক গঠন চৌদ্দ বার প্র্যাকটিস করার পরও কখনও আমার মাথায় এই প্রশ্নের উদয় হল না । অথচ  আমার ছেলের মাত্র পাঁচ বছর বয়স !

আসলে মনে হয় সন্তানেরা আল্লাহ প্রদত্ত মেধা নিয়েই পৃথিবীতে জন্ম নেয় । তারপর বড় হয়ে যখন আস্তে আস্তে জানার আগ্রহ তাদের বাড়ে; তখন তারা WH কোশ্চেন নিয়ে হাজির হয় বাবা-মা বা অন্য অভিভাবকদের সামনে ।  তাদের মুখে সারাক্ষণ কি? কেন? কে? কীভাবে? কখন?

অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা থাকে না । আর এই না জানা বিষয়টাকে আমরা অন্যকে জানতে না দেয়ার কালচারে বিশ্বাসী হওয়ায় নিজের অজান্তেই তখন  আমাদের ব্যর্থতা ঢাকতে, তাদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বরং ধমক দিয়ে থামিয়ে দেই । তাদের প্রশ্ন করার সাহস কেড়ে নেই । তাই হয়তো একদিন তারাও আমাদের বাবা-মাদের মতো সার্টিফিকেট সর্বস্ব বাঙালি হয়ে উঠতে পারে ।

আমার ছেলের এই চিনি বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর একদিন অফিসে আমার অনেক কাজে লেগেছিল । অফিসে মিটিং এ আমাদের ম্যানেজার স্যার কথা প্রসঙ্গে সবাইকে প্রশ্ন করলেন,

“আচ্ছা বলুনতো পিঁপড়া লবণে না গিয়ে চিনিতে যায় কেন? দুইতাই তো সাদা । কেন চিনিতেই বসলো ?”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চিটাগাং বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা বাঘা বাঘা স্যার ও ম্যাডমদেরও  এই প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না । একমাত্র আমি চট করে হাত উচিয়ে বললাম –

“ স্যার চিনি হচ্ছে এনার্জির সোর্স । ”

স্যার খুব উচ্ছসিত হয়ে বলেছিলেন, “কারেক্ট”

সেদিন গর্বে আমার বুকটা ভরে উঠেছিল । আর বাসায় ফিরে সেই কাহিনী ছেলেকে বলে বারবার তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম ।

অনেক সময় কিন্তু ছেলের প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকায় নানা কৌশলে তার থেকে  সময় নিতে হয় । তবে এই সময় নেয়ার বিষয়টাতে কিন্তু একটু ভেজাল থাকে । আমি তো আর সন্তানের মতো সরল না যে সহজভাবে বলে ফেলি “ বাবা আমি জানি না ।”  এই না বলাটাও আমার নানা কায়দায় করে থাকি –

যদি মেজাজ অনেক ভালো থাকে তখন বলি-

  • বাবা আমি তো সব জানি না । পৃথিবীতে কেউ সব জানে না ।

তুমি আমি একসাথে পড়াশুনা করে আরও শিখবো । ঠিক আছে ?

এতে সে সব চেয়ে খুশী হয় । “আমি ও সে একসাথে থেকে শিখবো” , বিষয়টা তার অনেক ভালো লাগে ।  এ র অর্থ হচ্ছে ও আমাকে সহপাঠী হিসাবে পেতে চায় কোন উস্তাদ নয় । হ্যাঁ আমিও দেখেছি যখন আমিও োর সাথে পড়াতে বসার সময় কিছু পড়ি ওর দেখি তাতে বেশী মনোযোগ থাকে ।

মেজাজ যদি একটু কম ভালো থাকে তখন বলি –

  • এখন জানি না । বাবা পরে তোমাকে জেনে জানাবো ।

মেজাজ যদি খারাপ থাকে তখন বলি-

  • খালি প্রশ্ন আর প্রশ্ন; কি? কেন? কীভাবে? কে ? খালি এগুলা নিয়েই থাকিস না । নিজে পড়াশুনা করে জানতে পারিস না ?

মেজাজ যদি আরও অনেক বেশী খারাপ থাকে তখন বলি  –

  • চুপ । খালি কে ? কেন? কীভাবে? থাপ্পড় লাগাবো । বই নিয়ে পড়তে বস যা ।

 

আবার ছেলের সর সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছি বা জানা হয়েছে তাও না । প্রায় তিন বছর আগে সে আমাকে তার শরীর নাড়তে নাড়তে প্রশ্ন করেছিল –

“আম্মু হাতের এখানে, মাথায়, শরীরের এখানে নাড়লে কাতুকুতু লাগে না, কিন্তু বগলের নিচে, প্রসাবের রাস্তার নিচে উরুর এখানে কাতুকুতু লাগে কেন?

লেখকঃ সাহিত্যিক, সম্পাদক, মহীয়সী ডটকম 

 

আরও পড়ুন