Ads

প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে ধূমপান আর নয়

ডা. ফাহমিদা শিরীন নীলা

বছরখানেক আগের কথা, রোজার মাস, আড়ং এর উপরে রেস্টুরেন্টে ইফতার শেষে কফির অর্ডার দিয়ে বসে ছিলাম।এমনিতে কফি আমার খুব একটা পছন্দের নয়, কিন্তু রোজা ,সারাদিন অফিসের কাজ, শপিং, আগের দিনের জার্নি সব মিলিয়ে খুব ক্লান্ত লাগছিল শরীরটা। কফির মগ হাতে নিয়ে বাইরের রাস্তার যানজট লাগার দৃশ্য দেখছি ,ইফতারের পরে সংসদ ভবনের সামনে ধীরে ধীরে জমতে শুরু করছিল গাড়ীর বহর । কফির মগে চুমুক দিতে যাব, এ সময় দুটো অল্প বয়সী ছেলেমেয়ে এসে বসল রাস্তার গাঁ ঘেঁষে ছোলানো ব্যালকনিতে । মানুষকে খুঁটিয়ে দেখার অভ্যাস আমার নিতান্তই কম।তবুও ওরা দুজনেই আমার দৃষ্টি কাড়ল দুটো কারণে। প্রথম কারণ হল, ওরা বসেছিল আমার দৃষ্টিসীমানার মধ্যেই, রাস্তার ধারের ব্যালকনিতে রাখা ছোট্ট টেবিলের দু’পাশে। আর দ্বিতীয়টি হল, ওদের টেবিলের উপরে রাখা সিগারেটের প্যাকেট , যেটা থেকে সিগারেট বের করে দুজনেই একসাথে ঠোঁটে ধরল। ম্যাচ খুঁজে পাচ্ছিল না বোধ হয়, ছেলেটা উঠে এসে হোটেলবয়ের কাছে থেকে ম্যাচ নিয়ে গিয়ে দুজনের সিগারেট ধরাল এবং সুখটান দেয়া শুরু করল। আমি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলাম। সিগারেট টানা এবং ধোঁয়া ছাড়ার স্টাইল দেখে বোঝাই যাচ্ছে, এটা তাদের নিত্যকার অভ্যেস। আমি মফস্বলের মানুষ, উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে সন্ধ্যার পর একসাথে বসে সিগারেট ফুঁকছে এ দৃশ্য দেখা তো দূরে থাক, কোনদিন দু:স্বপ্নেও ভাবিনি। ছেলেটির সাথে সাথে মেয়েটিও একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছে, উপরের দিকে মুখ করে কুণ্ডলীর আকারের ধোঁয়া ছাড়ছে,নাক-মুখ দিয়ে সমান তালে ধোঁয়া বের করছে। ওদের বয়স খুব বেশী হলে ১৮/১৯ হবে। মেয়েটির দিকে এবার ভালভাবে তাকালাম। খুব মায়াকাড়া তীক্ষ্ণ চেহারা, লম্বা চুল পিছনে বেণী করে বাঁধা, পোষাক-আশাকও উগ্র নয়। সাধারণ সালেয়ার-কামিজের উপরে ওড়নাটাও বেশ পরিপাটি করে নেয়া। মেয়েটির চলাফেরার মধ্যেও কোন উগ্রতা নয়, বরং বেশ কনফিডেন্স দেখলাম যেন। হিসাব মিলাতে পারলাম না কিছুতেই। এই বয়সের একটা মেয়ে সন্ধ্যার পর একা ঘরের বাইরে আছে, ওর মা খুব টেনশন করছে নিশ্চয় ! আচ্ছা, ওর মা কি জানে,ওনার মেয়ে সিগারেট খায় ? আর মেয়েটা সিগারেটের গন্ধ লুকায় কিভাবে?

আমি নিতান্তই সেকেলে, তাই কেবল ছেলে-মেয়েগুলোর আচরণ দেখেই বিস্মিত হয়ে বসে রইলাম শপিং ফেলে। ছেলেটার বয়সও তো বেশী নয়। একসময় দেখতাম, ছেলেরা বিকেলে বাইরে ঘুরতে বেরুলেও সন্ধ্যা নামার আগেই ঘরে ফিরতো। এখন কি মধ্যবিত্ত ঘরের এই চাল উঠে গেছে? আহা ! ছেলেটার মা হয়তো চা-নাস্তা নিয়ে ছেলের অপেক্ষায় বসে আছে। আর এদিকে ছেলে বসে বসে ধোঁয়া খাচ্ছে । ওরা যেভাবে চেইন স্মোকারদের মত একটার পর একটা সিগারেট শেষ করছে তাতে সিগারেটের বাক্স শেষ হতে বেশী সময় লাগবেনা, এত সিগারেট কেনার টাকা পায় কোথায় ওরা? আর একটা কথা,ওরা যে এভাবে সিগারেট খাচ্ছে একের পর এক, ওরা কি জানে নিজেদের কত বড় ক্ষতি করছে তারা? ওরা হয়তো দুজনে বন্ধু, কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকা। সম্পর্ক যাই হোক, ওরা নিজেদের ভাল না বাসলেও একে অপরকে ভালবাসে নিশ্চয়, তারপরেও ওরা নিজেদের সর্বনাশে একে অপরকে সাহায্য করছে কিভাবে?

নানান প্রশ্ন মাথায় নিয়ে ফিরে এলাম। কলেজ লাইফে দেখেছি, অনেক বান্ধবী সিগারেটকে পৌরুষ্যের প্রতীক মনে করতো। আশ্চর্য হলেও সত্যি, তারা কিন্তু পরে কোন সিগারেটখোরকে বিয়ে করেনি। এতদিন ডাক্তাররা চিন্তা করতো স্বামী সিগারেট খেলে পরোক্ষ ধূমপায়ী( passive smoker) হিসেবে নারী এবং তার ভবিষ্যত সন্তানের কতটুকু ক্ষতি হবে। দু:খের বিষয় হলেও সত্য যে, এখন বাংলাদেশেও বোধ হয় অবস্ট্রেটিসিয়ানদের একজন গর্ভবতীকে প্রশ্ন করার সময় এসে যাচ্ছে,’আপনি কি সিগারেট পান করেন?’

এখন স্বভাবত:ই একজন নারী প্রশ্ন করতে পারে, পুরুষ যদি সিগারেট খেতে পারে, নারী নয় কেন? পুরুষের কি ক্ষতি হয়না?
হ্যাঁ হয়, অবশ্যই ক্ষতি হয়। সিগারেট কখনোই কারো জন্য সুফল নিয়ে আসতে পারেনা। একটা সিগারেটে থাকে ১০ মিলিগ্রাম নিকোটিন, যার অন্তত: ১-২ গ্রাম আপনি টেনে নেন । সিগারেট থেকে নিকোটিন টানার মাত্র ১০ সেকেন্ডের মধ্যে এটি আপনার ব্রেনকে উত্তেজিত করতে পারে। এটি আপনার শরীর থেকে ডোপামিন নামক একটি হরমোন নি:শরণ করে, যা আপনাকে আরও বেশী সিগারেট টানতে উৎসাহিত করবে। আপনি টানতে থাকবেন, আপনার অ্যাড্রেনাল গ্ল্যান্ড আরও বেশী এপিনেফ্রিন(অ্যাড্রেনালিন) নি:শরন করবে যা আপনার শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়াবে,বাড়াবে রক্তচাপ,হৃদস্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি। অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নি:শরন বাঁধাগ্রস্ত হবে, ফলে আপনার রক্ত আরও সুমিষ্ট(hyperglycaemic) হবে, ফলে বাড়বে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি।আপনার হার্ট এ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়াবে দুই থেকে চার গুন ,আপনার ষ্ট্রোক হবার সম্ভাবনাও বাড়বে দুই থেকে চার গুন । আপনার রক্তনালীর বিভিন্ন সমস্যা (vascular disease ) দেখা দিতে পারে, কিডনীর সমস্যা দেখা দিতে পারে। পৃথিবীতে যতগুলো ক্যান্সার হয়, তার এক তৃতীয়াংশই হতে পারে সিগারেট থেকে, এর মধ্যে শুধুমাত্র ফুসফুসের ক্যানসারের সম্ভাবনাই সাধারনদের তুলনায় ২৫ গুন বা তারও বেশী। এছাড়াও শরীরের যেকোন অঙ্গে ক্যানসার সৃষ্টির গুণ আছে সিগারেটের মধ্যে ।কমে যেতে পারে প্রজনন ক্ষমতা,বাড়বে বাতের সমস্যা। এতক্ষণ যা যা বললাম তা সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য, নারী বা পুরুষ বলে এর কোন ভেদাভেদ নেই। সুতরাং, আজ যেসব পুরুষ, নারীর সিগারেট খাওয়ার মধ্যে নিজেদের ইগো প্রবলেম খুঁজে পাচ্ছেন, তারা বরং এইভেবে দু:খিত হতে পারেন যে, নারী সিগারেট খাওয়ার মধ্যে দিয়ে নিজেদের সেইসব রাজকীয় রোগ আহ্বান করে আনছে যা এতকাল পুরুষদের মধ্যেই প্রকট ছিল।

এখন দেখা যাক, অবস্ট্রেটিসিয়ানদের এত মাথাব্যথা কেন নারী ধূমপায়ীদের নিয়ে। এরা কি নারী পুরুষের সমতা চায়না? নাকি এরা নারী স্বাধীনতার অন্তরায়? নারী, আপনি জানেন না, ধূমপান শুধু আপনার জন্য নয়, আপনার অনাগত সন্তানের জন্যও অনেক মূল্যবান উপহার নিয়ে আসবে যার মূল্য দিতে হবে আপনাকে সারাজীবন ধরে। গর্ভাবস্থায় সিগারেট খেলে আপনি জন্ম দিতে পারেন একটা বিকলাঙ্গ (Congenital anomalies), অপুষ্ট শিশু(Intrauterine growth retardation/Low birth weight), সময়ের আগেই হয়ে যেতে পারে আপনার বাচ্চা(premature baby),নষ্ট হয়ে যেতে পারে গর্ভস্থ ভ্রুণ(missed abortion), গর্ভেই মারা যেতে পারে আপনার সন্তান(Intrauterine death) কিংবা আপনি নির্দিষ্ট সময়ে জন্ম দিতে পারেন একটা মৃত বাচ্চা(still birth)।এছাড়াও অন্যান্য নারীর তুলনায় ধূমপায়ী নারীদের হাড়ের ক্ষয় হবে দ্রুত, দাঁত পড়ে যাবে তাড়াতাড়ি।

একটু দাঁড়ান, আরও আছে। এখানেই শেষ নয়। আপনার সিগারেট খাওয়ার জন্য আপনার পাশে থাকা আপনার প্রিয়জনটিও পড়বে স্বাস্থ্যাঝুঁকিতে যার মধ্যে হার্টের অসুখ, ক্যানসার, শ্বাসজনিত সমস্যা অন্যতম। এমনকি আপনার সিগারেট খাওয়ার জন্য আপনার সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটি হুট করে কোন কারণ ছাড়াই মারা যেতে পারে(sudden infant death syndrome) । পুরুষ এতদিন প্রিয়জনের মূল্যায়ন না করে নিজের নেশাকে প্রাধান্য দিয়েছে বলে, নারী আপনিও কি তাই করবেন?
পুরুষ, আপনাদের বলি,সিগারেট টানার সাথে ইগোর কোন সম্পর্ক নেই, এমনকি আপনি যে সংস্কৃতির দোহাই দিচ্ছেন তারও কোন সম্পর্ক ছিলনা কোনকালে। সিগারেট আমাদের দেশীয় কোন সংস্কৃতি নয়, বরং ইংরেজরা যতগুলো খারাপ গুণ দান করে গেছেন আমাদের, তার মধ্যে সিগারেট অন্যতম। সুতরাং, পুরুষ টানুক কিংবা নারী উভয়েই শুধুমাত্র নিজের এবং আশেপাশের মানুষের ক্ষতি বই অন্যকিছু করছেন না। সিগারেটের সাথে না আছে ইগোর সম্পর্ক, না জেন্ডারের,না বাঙালীয়ানার, এর সাথে সম্পর্ক শুধু এবং শুধুমাত্র স্বাস্থ্য ঝুঁকির।

খুব সম্প্রতি একটি ভিডিও নিয়ে দারুন হৈ চৈ। যদিও ভিডিওটা দেখার সৌভাগ্য কিংবা দূর্ভাগ্য কোনটাই হয়নি। তবে সেটা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি দেখে বিষয়টা অবগত হলাম। যিনি বানিয়েছেন ভিডিওটি তিনি এটা দিয়ে আসলে কি বোঝাতে চেয়েছেন সেটা কোনভাবেই বোধগম্য হল না । হতে পারে, উনি নারীদের সিগারেট খাওয়া নিয়ে খুবই চিন্তিত। কিন্তু তাহলে মেয়েদের সিগারেট খাওয়ার ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে উনি ভিডিও করে নেটে প্রকাশ করতে পারতেন, উনার চিন্তা-চেতনার নিদর্শন দেখে নারীসমাজ প্রীত হতো। কিংবা,উনি হয়তো নারীকে ছোট করতে চেয়েছেন সামাজিকভাবে। কিন্তু তিনি যদি পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে বলতেন, প্রকাশে্য ধূমপানের সাথে নারীর ছোট হওয়ার কি সম্পর্ক, তাহলে নারী সমাজ কৃতার্থ হতেন। তিনি হয়তো জানেন না, যিনি প্রকাশে্য ধূমপান করেন তিনি এই ঘুনে ধরা সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোর সাহস রাখেন। আসলে তেনাদের ইগোতে লেগেছে মনে হয়। তা ভাইজান, আপনের ভাইয়েরা কেন জনসম্মুখে সিগারেট খাবে আর খেলে কেন ভিডিও করে নেটে ছাড়া হবেনা সেটা যদি একটিবার বলতেন, তাহলে বুঝতাম আপনি আসলেই নারী সমাজ নিয়ে অধিক চিন্তিত। কিংবা, সিগারেটের উপকারিতা নিয়ে আপনার হয়তো চিন্তার অন্ত নেই। সিগারেটের প্যাকেটে কিন্তু লেখা নেই,ধূমপান কেবল মাত্র নারীর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সিগারেট আপনি খেলে আপনার ক্ষতি হবে, আপনার পাশের নারী-পুরুষের ক্ষতি হবে, আপনার কাছে থাকা বাচ্চার ক্ষতি হবে। তবে কেন শুধুমাত্র নারীর প্রকাশ্য ধূমপান নিয়ে উদ্বিগ্ন আপনি? সিগারেট নারী না খেলেও এতকাল হাটে-মাঠে, বাজারে, পাবলিক বাসে, পাবলিক প্লেসে, ঘরে-বাইরে সর্বত্র নারীরা পরোক্ষ ধূমপায়ী (Passive Smoker) হয়ে ঝুঁকিতে থেকেছে। কই তখন তো কোন ভাইজানরে দেখিনি এ নিয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করতে । আপনার মা-বোন-স্ত্রী-কন্যা ক্ষতির সম্মুখীন হবে ভেবে ক’জন সিগারেট ছেড়ে ছিলেন আপনারা? আজ নারী প্রকাশ্যে ধূমপান করলে নারী নিজের বা সমাজের কতখানি ক্ষতি করছে সেটার হিসাব কষার আগে আপনারা পুরুষরা এতকাল ধরে নারী এবং সমাজের কতখানি ক্ষতি করেছেন তার হিসেবটা প্রকাশের প্রয়াশ করুন একবার। হিসেবের অংকটা এতটাই বড় হবে যে তা প্রকাশ তো দূরে থাকুক নিকাশও করতে পারবেন না। বাংলাদেশের ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ এর ৪(১) ধারার বিধান অনুযায়ী, ‘কোন ব্যক্তি কোন পাবলিক পরিবহন বা পাবলিক প্লেসে ধূমপান করিতে পারিবেন না’। এই আইনের কোথাও কিন্ত নারী বা পুরুষের উল্লেখ নেই। সুতরাং, অযথা জেন্ডারকে ইস্যু না করে স্বাস্থ্য ইস্যুর কথা ভাবুন, সিগারেট নিজে ত্যাগ করুন, অন্যকেও উৎসাহিত করুন।

আর হ্যাঁ নারী, যারা নিজেদের স্বাধীন, আধুনিক কিংবা পুরুষের সমকক্ষ করতে পুরুষের মুখের সিগারেট এনে নিজের ঠোঁটে টানছেন, তাদের বলি, পুরুষ কেয়ামত অবধি মাথা ঠুকে মরলেও নারীর সমকক্ষ হতে পারবেনা। নারীকে বিধাতা এমনই নেয়ামত দিয়ে পাঠিয়েছেন। নারীদেহ আছে বলেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসে, সমৃদ্ধ হয় পৃথিবী। সুতরাং, স্রষ্টার দেয়া এই অমূল্য রত্নের যত্ন করতে শিখুন। নিজে সুস্থ থাকুন, সুস্থ প্রজন্মের জন্ম দিন।

লেখকঃ

গাইনী বিশেষজ্ঞ
এমবিবিএস ; এফসিপিএস (গাইনী এন্ড অবস)
ফিগো ফেলো(ইটালী)
বগুড়া

 

আরও পড়ুন