আবদুল্লাহ আরমান
নব্বইয়ের দশকে আমাদের শৈশব ও বাল্যকাল কেটেছে,কেটেছে কৈশোরও। সে সময়ের কিছু দৃশ্য আজও মনের কোণে উঁকি দেয়। চোখ লাল না হওয়া পর্যন্ত পুকুরে সাঁতার কাটা,গাছে চড়ে পাকা পেয়ারা কিংবা আম পাড়া,বর্ষাকালে ছিপ,জাল বা ডুব দিয়ে মাছ ধরা,ভাই-বোনরা মিলে বউছি খেলা, বিকেল হতেই ব্যাট-বল কিংবা ফুটবল নিয়ে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাঠে খেলতে যাওয়া,কখনোবা প্রিয় বন্ধুদের সাথে ঝগড়া করে মন খারাপ করে বাড়ি ফেরা ইত্যাদি আজও স্মৃতির পাতায় জ্বলজ্বল করছে! মায়ের চোখ রাঙানী কিংবা বকুনী কিছুতেই কৈশোরের সে দুরন্তপনাকে দমিয়ে রাখতে পারতোনা। আবার বাধ্য ছেলের মতো ফজর পর আরবী কায়দা বা আমপারা বুকে জড়িয়ে মক্তবে যেতাম আর সন্ধ্যার পর হারিকেন কিংবা কুপি জ্বালিয়ে উঁচু আওয়াজে পড়ে বড় ভাইবোনদের পড়ায় ডিস্টার্ব করতাম! এসব নিয়ে তাদের সাথে ঝগড়া- খুনসুটি তো লেগেই থাকতো!
কোথায় যেন হারিয়ে গেলো সেই দিনগুলো। গ্রামটাও যেন আর আগের মতো নেই। খেলার মাঠে চাঞ্চল্য ও কিশোরদের দুরন্তপনা আর চোখে পড়েনা। তাদের বন্ধু গুলোও আজ ভার্চুয়াল, ভাইবোন সবাই নিজ নিজ ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত,তাই খুনসুটি করার মতো সময় তাদের আজ নেই! তবে কি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা প্রযুক্তির ছদ্মবেশে এসে কৈশোরের সোনালী দিনগুলো বদলে দিয়েছে !
অপরদিকে আধুনিক জীবনে প্রযুক্তির অবদান ও প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। প্রযুক্তি তার জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় আমাদের জীবনকে করেছে সহজ ও আরামদায়ক। একসময় যা কল্পনাতীত ছিলো আজ তা বাস্তব হয়ে আমাদের হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েছে। পুরো বিশ্বকে একটি গ্লোবাল ভিলেজে রূপান্তর করার একক কৃতিত্ব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিরই।উপকারের পাশাপাশি এর কিছু নেতিবাচক দিকও আছে যেগুলো স্লো পয়জনিংয়ের মতো নীরব ঘাতক হয়ে তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামী করছে। স্ক্রিন আসক্তি এরমধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে। ফেসবুক, ইউটিউব, পর্ণগ্রাফির পাশাপাশি ভিডিও গেইম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সারা বিশ্বের শিশু,কিশোর- কিশোরী,যুবক-যুবতীদের মধ্যে ভিডিও গেইমের নেতিবাচক প্রভাব এতটাই বেশী যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং দীর্ঘদিন জরিপ ও গবেষণার পর ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ ১১তম সংশোধিত সংস্করণে (আইসিডি-১১), ‘গেমিং অ্যাডিকশন’ হিসেবে একে মনোস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছে ২০১৮ সালের জুন মাসে! বিশ্বজুড়ে এই বিষয়ে প্রকাশিত ১৬টি গবেষণাপত্রের মেটা অ্যানালাইসিস করে দেখা গেছে কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ ইন্টারনেট গেমিংয়ে আসক্তিতে ভুগছে। যাদের মধ্যে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হচ্ছে কিশোর আর ১ দশমিক ৩ শতাংশ কিশোরী।
বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন—বিটিআরসির তথ্যমতে, এপ্রিল ২০১৯–এ বাংলাদেশে প্রায় ৯ কোটি ৩৭ লাখ মানুষ ইন্টারনেটের গ্রাহক, আর এদের মধ্যে ৮ কোটি ৭৯ লাখ ব্যবহারকারী মুঠোফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়। ২০১৬ সালের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৩৫ শতাংশ হচ্ছে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর–কিশোরী। এরাই কিন্তু গেমিং আসক্তি হওয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। (প্রথম আলো-24 july,2019)।
চীনে ৯০৭.৫ মিলিয়ন,US ২৮৩ মিলিয়ন, জাপান ১০১.৫ মিলিয়ন, জার্মানি ৭৫.৫ মিলিয়ন মানুষ গেইম খেলতে অভ্যস্ত। যাদের মধ্যে ২২% গেমার মোট ৬১-৮০% সময় গেইম খেলায় ব্যয় করে।
আমাদের দেশে এ বিষয়ে এখনো ব্যাপকভাবে কোনো স্টাডি না হওয়ায় মোট সংখ্যা জানা না গেলেও Newsagebd.com এর একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ঢাকার কল্যানপুর এলাকার ৫০%,ধানমন্ডির ২৪%,মিরপুরের ২১%, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকার ১৮% শিশুরা গেইম খেলায় অভস্ত্য। সুতরাং আমাদের দেশেও এর কুপ্রভাব সহজেই অনুমেয়।
গেইম আসক্তির লক্ষ্মণসমূহঃ
গেইম খেললেই তা আসক্তি নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য গবেষণা দলের মতে, গেমিং আসক্তির লক্ষণগুলো ১২ মাস ধরে থাকতে হবে। তবে লক্ষণ যদি গুরুতর ধরনের হয় তবে সেগুলো অল্প দিন ধরে লক্ষণ দেখা দিলে সেটাকেও গেমিং ডিজঅর্ডার বলা যাবে। বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী গেইম আসক্তির উল্লেখযোগ্য লক্ষণগুলো নিচে তুলে ধরছি।
★অধিকাংশ সময় গেইম বিষয়ে চিন্তা করা।
★গেইম খেলতে না পারলে অস্বস্তি বোধ হওয়া।
★আরো বেশী সময় ধরে গেইম খেলার প্রয়োজনবোধ করা।
★ অন্যান্য সাধারণ কাজ এমনকি পছন্দের কাজও করতে না চাওয়া।
★গেইমের কারণে কাজে ও স্কুলে নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হওয়া।
★“কতক্ষণ গেইম খেলো” এই প্রশ্নের জবাবে গেইমের প্রতি দুর্বলতা ঢাকতে আপনজনের কাছে মিথ্যা বলা।
★দিন দিন ইন্টারনেটে গেম খেলার সময় বাড়তে থাকা।
★ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়া। দিনে ঘুমানো আর রাতে জাগা।
★খাবার গ্রহণে অনিয়মিত হওয়া। বাসায় সবার সঙ্গে টেবিলে বসে না খেয়ে নিজের ঘরে একা বসে খেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা।
★সামাজিকতা কমে যাবে। কারও সঙ্গে মিশতে না চাওয়ার প্রবণতা বাড়বে।
★খেলার সময় কেউ ডাকলে বা মোবাইলে কল দিলে রেগে যাওয়া,ইত্যাদি।
আসক্তির ফলাফলঃ
গেইম আসক্তির পরিনাম বেশ ভয়াবহ। মূলত ইন্টারনেট গেম আসক্তি অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্যের আসক্তির মতোই। পার্থক্য হচ্ছে এটি আচরণগত আসক্তি, আর অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্যের আসক্তি, রাসায়নিক আসক্তি।
মস্তিষ্কের যে অংশে (রিওয়ার্ড সেন্টার) ইয়াবা বা গাঁজার মতো বস্তুর প্রতি আসক্তি জন্ম নেয় ঠিক সেই অংশেই ইন্টারনেট বা গেমের প্রতি আসক্তি জন্মায়। তাই একে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। শিশুদের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিকর দিকগুলো হলো-
★ দৃষ্টিশক্তিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
★ রুচিহীনতা তৈরী হয় ও খাদ্যাভ্যাসে প্রভাব ফেলে।
★রাগ ও আক্রমনাত্মক আচরণ বৃদ্ধি পায়।
★ আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্নমর্যাদা হ্রাস পায়।
★ স্কুলে অনুপস্থিতির হার এবং খারাপ রেজাল্টের হার বৃদ্ধি পায়।
★মা-বাবা ও অন্যান্য নন-গেমার বন্ধুদের সাথে দূরত্ব তৈরী হয়।
★মস্তিষ্কের মনোযোগ নিয়ন্ত্রণকারী অংশে নেতিবাচক পরিবর্তন হয় ফলে পড়াশুনা সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে মনোযোগ হ্রাস পায়।
★গেইমের জন্য টাকা চুরির প্রবণতা বাড়ে।
★অটিজম শিশুদের ক্ষেত্রে জটিলতা আরও বৃদ্ধি পায়।
বড়দের ক্ষেত্রে আরও অন্যান্য সমস্যা যেমনঃ শারীরিক ক্লান্তি,মাথা ব্যাথা ও মাইগ্রেন,দাম্পত্য কলহ বৃদ্ধি,ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা হ্রাস প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়।
অভিভাবকদের করণীয়ঃ
★ডিভাইস ব্যবহারের ক্ষেত্রে সন্তান কি ব্যবহার করবে এবং কতটুকু সময় ব্যবহার করবে তা আপনি নিজে নির্ধারণ করুন এবং সেক্ষেত্রে যাবতীয় হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করার শর্ত জুড়ে দিন।
★সন্তানের সামনে অপ্রয়োজনে ডিভাইস ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। আপনার সন্তানের কাছে যেমনটি আশা করেন নিজেও তা অনুশীলন করুন কারণ শিশুরা অনুকরণপ্রিয়।
★সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দিন। পিতা-মাতার সাথে সম্পর্কের দূরত্ব সন্তানের বিপথগামী হওয়ার অন্যতম কারণ।
★ পারিবারিক পাঠাগার গড়ে তুলুন। সন্তানকে তার বয়সের উপযোগী বই উপহার দিন। একাধিক সন্তান থাকলে বই পাঠের প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করুন।
★ সন্তানকে ধর্মচর্চা ও নৈতিকতা শিক্ষাদানের পাশাপাশি ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা যুগ শ্রেষ্ঠ মনিষীদের জীবনযাপন ও সময়নিষ্ঠতা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দিন।
ইলেকট্রনিক গেমস বিষয়ে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিঃ
একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা। এটিও তার ব্যতীক্রম নয়। একজন মানুষের স্বাভাবিক বিকাশের স্বার্থে খেলাধুলা বা চিত্তবিনোদনকে ইসলাম নিষেধ করেনা। তবে এক্ষেত্রে কিছু শর্ত ও মূলনীতি রয়েছে। প্রসিদ্ধ প্রথিতযশা বিদ্বান সলেহ আল মুনাজ্জিদ হাফিঃ তাঁর বিশ্ববিখ্যাত ওয়েবসাইট islamqa.info তে গেমস খেলার বিধান বিষয়ক এক প্রশ্নোত্তরে বলেন,গেমস বা খেলাধূলাকে দু ভাগে ভাগ করা হয়…
প্রথমতঃ যেসব খেলার মাধ্যমে শরীরচর্চা হয় ইসলামে তা বৈধ,প্রয়োজন সাপেক্ষে উত্তমও বটে।যেমনঃ দৌড়,সাঁতার,ঘোড়া দৌড়, ফুটবল,ক্রিকেট ইত্যাদি। তবে সেক্ষেত্রে সতর খোলা,অার্থিক চ্যালেঞ্জ,বাজি ধরা ইত্যাদী নিষিদ্ধ কর্ম পরিহার করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ যেসব খেলায় শারীরিক পরিশ্রম নেই তার বিধান আপেক্ষিক। মিউজিক,প্রাণী বা শত্রুকে আক্রমণ কিংবা হত্যা করতে গুলি বা বোমা হামলা,নগ্নতা,বিশেষ ধর্মানুভূতি ও তার সিম্বলে আঘাত,ফাইটারের বারংবার মৃত্যু ও পুনঃ জীবন লাভ,লাইফ বৃদ্ধি,যাদু,লুডু,কার্ড,পাশা বা জুয়া, সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার,পৃথিবী ও ভিন্ন গ্রহের প্রাণীর ছবি, গুপ্তহত্যা,উগ্রতা, অস্ত্র চালানো,সাধারণ বা ধর্মীয় মূর্তিকে সম্মানের মাধ্যমে বিশেষ ক্ষমতা লাভ ইত্যাদি নিষিদ্ধ কর্ম বিশিষ্ট গেমস খেলা হারাম। এসব নিষেধাজ্ঞার আওতা মুক্ত গেমস বৈধ তবে তা যেন শারীরিক বা মানসিক ক্ষতির কারণ না হয় এবং ধর্মীয় আবশ্যক বিধিবিধান পালনে বাধা সৃষ্টি না করে তা নিশ্চিত করতে হবে। আল্লাহ বলেনঃ “যারা তাদের দ্বীনকে খেলা-তামাশা বানিয়ে নিয়েছিল আর দুনিয়ার জীবন যাদেরকে প্রতারিত করেছিল। কাজেই আজকের দিনে তাদেরকে আমি ভুলে যাব যেভাবে তারা এ দিনের সাক্ষাৎকে ভুলে গিয়েছিল….”(সূরা আরাফঃ৫১)
বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ
1.https://islamqa.info/en/answers/2898/electronic-games
2.https://islamqa.info/en/answers/2898/electronic-gam
3. https://islamqa.info/en/answers/22305/games-between-what-is-lawful-and-what-is-prohibited
পরিশেষে বর্তমান প্রজন্মের গেমস আসক্তিকে পুঁজি করে এর নির্মাতারা কি পরিমাণ ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে তার ছোট্ট একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করতে চাই। PUBG গেমস থেকে শুধুমাত্র ২০১৮ সালে মোট আয় ৯২০ মিলিয়ন ডলার তন্মধ্যে মুনাফা প্রায় ৩১০ মিলিয়ন ডলার যার ৫৩% এসেছে এশিয়া থেকে! অথচ ২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বলিউড ইতিহাসের একটি টপ ব্লকবাস্টার মুভি এ পর্যন্ত গ্লোবালী আয় করেছে মাত্র ৩০০ মিলিয়ন ডলার! তরুণদের ক্রমবর্ধমান আসক্তির ফলে তাদের বাৎসরিক আয় উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।আসক্তির এ ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে একটি অসুস্থ প্রজন্ম দেখার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। তাই সন্তানের হাতে ডিভাইস তুলে দিয়ে তাদের সুপ্ত আগ্নেয়গিরিতে নিক্ষেপ করছেন কিনা তা ভেবে দেখার এখনই সময়!