Ads

ইসলামী ব্যাংকিং পেশায় তিন যুগ (১৯৮৪-২০১৯)।। পর্ব-৩

।। মু. শামসুজ্জামান ।।

বর্তমান প্রজন্মের জানা থাকা দরকার যে কনসেপ্ট হিসাবে ইসলামী ব্যাংকিং কোন অদ্ভুত বিষয় নয় যেমনটি ক্রিটিকরা বলে থাকে। তাদের সহস্র সমালোচনার একটি কমন আসপেক্ট হলো ‘ইসলামী ব্যাংক সুদকে ঘুরিয়ে খায়।’  আমি এক কথায় এর জবাব দেয়া যথেষ্ট মনে করি না।এক কথায় সন্তষ্ট করা গেলে সেই দেড় হাজার বছর আগেই এটি নিষ্পন্ন হয়ে যেতো।কিন্ত হয়নি এবং হবার আশাও তিরোহিত। আর সে কারণে বিষয়টি আল্লাহর গোচররীভূত হয়েছে, তিনি কুরআনে উদ্ধৃত করে দিয়েছেন- الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا ۗ وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا ۚ فَمَن جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّهِ فَانتَهَىٰ فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ ۖ وَمَنْ عَادَ فَأُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতে দন্ডায়মান হবে, যেভাবে দন্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তি, যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলজথেস ক্রয়-বিক্রয় ও তো  সুদ নেয়ারই মত ! (অর্থাৎ ক্রয় বিক্রয় ও সুদ একইরকম) অথচ আল্লাহ তাআলা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপার আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় সুদ নেয়, তারাই দোযখে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে। (সূরা বাকারাঃ২৭৫)

দুনিয়ায় তাবৎ অর্থনীতির বুনিয়াদ হলো ক্রয় বিক্রয়। ব্যবসা বা ক্রয়-বিক্রয় এই যে, বিক্রেতা কোন জিনিসকে বিক্রয় করার জন্য পেশ করে। বিক্রেতা ও ক্রেতার মাঝে সেই জিনিসের দাম কত তা নির্দিষ্ট ও নিষ্পত্তি হয়। অতঃপর সেই দাম বা মূল্যের বিনিময়ে ক্রেতা সেই জিনিসটাকে বিক্রেতার নিকট থেকে গ্রহণ করে।

আরও পড়ুন- পেশা হিসাবে ব্যাংকিং কতটা নির্ভরযোগ্য ?

পক্ষান্তরে সুদ এই যে, কোন ব্যক্তি তার মূলধন কোন অপর এক ব্যক্তিকে ধার দেয় এবং এই শর্ত আরোপ করে যে, ‘এতো সময়ের মধ্যে আসলের উপর এতো টাকা বেশী নেব।’ আসল টাকা ছাড়া এ বাড়তি টাকার নামই হল সুদ। যা কোন জিনিসের মূল্য নয় বরং তা হল কেবল (ঋণ গ্রহীতাকে তার ঋণ পরিশোধে) কিছু সময় ও অবকাশ দেওয়ার বিনিময়।

অতএব ব্যবসা এবং সুদ এই উভয় প্রকার লেন-দেন নিয়ে একটু চিন্তা-ভাবনা করলে এই পার্থক্যগুলো পরিদৃষ্ট হয়ঃ-

১- ব্যবসায় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েরই মুনাফা বিনিময় সমানভাবে হয়ে থাকে; কারণ ক্রেতা এ ক্রীত বস্তু বিক্রেতার নিকট থেকে ক্রয় করে তার দ্বারা উপকৃত হয়। এবং বিক্রেতাও তার সেই শ্রম, বুদ্ধি এবং সময়ের মূল্য গ্রহণ করে; যা সে ক্রেতার জন্য এ জিনিস প্রস্তুত ও সরবরাহ করার পথে ব্যয় করেছে। পক্ষান্তরে সুদী কারবারে দুই পক্ষের মুনাফা বিনিময় সমানভাবে হয় না। সুদগ্রহীতা তো এক নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ নিয়ে নেয়; ফলে সে নিশ্চিতরূপে উপকৃত হয়। কিন্তু সুদদাতার জন্য কেবল (ঋণ পরিশোধে) অবকাশ মিলে; যাতে সে উপকৃত হয় কি না তা অনিশ্চিত। কারণ ঋণ গ্রহীতা যদি ব্যক্তিগত প্রয়োজন বা অভাব মিটাবার উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করে থাকে তবে নিঃসন্দেহে এ অবকাশ অপকারী। আর যদি সে ব্যবসা করার জন্য নিয়ে থাকে, তাহলে অবকাশে যেমন তার উপকার বা লাভ হওয়ার সম্ভাবনা আছে তেমনি আছে অপকার বা ক্ষতি হওয়ারও আশঙ্কা। কিন্তু ঋণদাতা সর্বাবস্থায় তার মুনাফার (সুদের) একটা নির্দিষ্ট অংশ গ্রহণ করে থাকে; তাতে ঋণগ্রহীতার কারবারে লাভ হোক চাই না হোক। সুতরাং এ কথা স্পষ্ট হল যে, সুদী কারবার কেবল একপক্ষের লাভ এবং অপর পক্ষের ক্ষতি, অথবা একপক্ষের নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট লাভ এবং অপর পক্ষের অনিশ্চিত ও অনির্দিষ্ট লাভের মাধ্যমেই হয়ে থাকে।

২- ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসার ক্ষেত্রে বিক্রেতা ক্রেতার নিকট থেকে যত পরিমাণেই লাভ গ্রহণ করুক না কেন, গ্রহণ করে সে মাত্র একবার। পক্ষান্তরে সুদী কারবারে অর্থ লগ্নিকারী তার অর্থের উপর ধারাবাহিকভাবে বারংবার মুনাফা বা সূদ গ্রহণ করতে থাকে এবং সময়ের গতি (লমবা হয়ে) বাড়ার সাথে সাথে তার সুদের অঙ্কও বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। ঋণগ্রহীতা এ অর্থ দ্বারা যতই উপকৃত হোক না কেন, তার এ উপকার এক নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কিন্তু এর বিপরীত পক্ষে ঋণদাতা যে উপকার ও লাভ অর্জন করে থাকে, তার কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই।

৩- ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসায় পণ্য-দ্রব্য ও তার মূল্য বিনিময় হওয়ার সাথে সাথেই আদান-প্রদানের ব্যাপার শেষ হয়ে যায়। এর পরে ক্রেতা স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করে এবং বিক্রেতাকে কোন জিনিস ফেরৎ দিতে (বা নতুন ভাবে দিতে) হয় না। পক্ষান্তরে সুদী কারবারে ঋণগ্রহীতা টাকা নিয়ে খরচ করে ফেলে। অতঃপর সেই খরচ-করা টাকা যোগাড় করে বাড়তি সুদ-সহ ফেরৎ দিতে হয়।

৪- ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে মানুষ নিজের মেহনত ও বুদ্ধি ব্যয় করে এবং তারই পারিশ্রমিক গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে সুদী কারবারে সুদখোর কেবলমাত্র তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাল দিয়ে বিনা মেহনত ও কষ্টে অপরের কামাই ও উপার্জনে অংশীদার হয়ে বসে।

এছাড়া সুদ মানুষের মাঝে কার্পণ্য, স্বার্থপরতা, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, নির্দয়তা, অর্থলোলুপতা ও ধনপূজার মত প্রভৃতি গুণ সৃষ্টি করে। দুই জাতির মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ আনয়ন করে। জাতির ব্যক্তিবর্গের মাঝে সহানুভূতি ও পরস্পরকে সহায়তা করার নৈতিক সম্পর্ক নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। সমাজের ধন-দৌলতের স্বাধীন আবর্তনকে ব্যাহত করে, বরং এ ধন-সম্পদের গতিমুখ নির্ধনদের নিকট থেকে ধনপতিদের দিকে ফিরিয়ে দেয়। যার ফলশ্রুতিতে জনসাধারণের মালধন গুটিয়ে কেবল একশ্রেণীর নিকট গিয়ে একত্রিত ও স্ত্তপীকৃত হতে থাকে। পরিশেষে তা পুরো সমাজেরই ধ্বংস ও বরবাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এসব তিক্ত-অভিজ্ঞতার কথা জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতি বিষয়ে দূরদর্শীদের নিকট অবশ্যই অবিদিত নয়। সুদের এ সকল মন্দ প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই অনস্বীকার্য।

আমাদের দৈনন্দিন কাজে প্রতিদিন পারিবারিক ও গৃহাস্থলির কাজে যে বাজার সওদা করি সেটা যদি বিনা বিতর্কে ইয়াব কবুল অর্থাৎ পণ্যমূল্য প্রস্তাব যা মুখে বলে বা পণ্যের গায়ে লিখা থাকে এবং গ্রাহক দরদাম করে বা সেই মূল্যে রাজী হয়ে ক্রয় করে তাহলে ইসলামী পদ্ধতিতে আপত্তি কেনো ?

ইসলামী ব্যাংক এই ক্রয় বিক্রয়ের কাজটিই করে থাকে।তবে এটাই সব নয়।এখানে এই ম্যাকানিজমটি “বাই” নামে পরিচিত। অংশীদার হয়ে কোন বিনিয়োগ কারীর সাথে লাভ ও লোকসান ভাগাভাগি হলে সেটা “শিরকাত” এবং কোন সম্পদ নিজে কিনে বা ক্রয়ে পার্টনার হয়ে ভাড়ায় খাটালে সেটার নাম হয় “ইজারা”।

ইসলামী ফিকাহবিদগণ এরকম বহু হালাল পদ্ধতির কথা বলেছেন যা ইসলামী ব্যাংকগুলো প্রাকটিচ করে থাকে।

চলবে- আগের পর্ব- ইসলামী ব্যাংকিং পেশায় তিন যুগ (১৯৮৪-২০১৯)।। দ্বিতীয় পর্ব

লেখকঃ  মু. শামসুজ্জামান, সাবেক এডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়ন মূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিয়ে ফেসবুকে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন।প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন