Ads

মাদ্রাসায় ভালো শিক্ষক কেন থাকে না?

।। মুন্তাজির শাহীন ।।

প্রতিষ্ঠানে ভালো ও যোগ্য শিক্ষক না থাকার অন্যতম কারণ তাদের প্রতি বিভিন্ন ধরণের অবহেলা। যথাসময়ে বেতন না দেয়া। ভালো কাজের জন্য উৎসাহ না দেয়া। তরুণরা আজ শিক্ষকতা বিমূখ হচ্ছে কিছু কিছু পরিচালকদের অসদাচরণের কারণে। শিক্ষকতাসহ কওমি অঙ্গনের পড়াশোনায় ধ্বসের জন্য এসব পরিচালকরাই দায়ী।

একজনের কথা আমি জানি যিনি হিফজ বিভাগে চাকরি করতেন, বেতন ধার্য ছিল ১০ হাজার টাকা মাত্র । মাস শেষ হলে কখনোই বেতন দিত না । উল্টো মাদ্রাসার অভাব অনটন দেখাতো। অথচ বড় হুজুরের নিজের বাসায় নিয়মিত মাছ-মাংস রান্না হতো। সাধারণ শিক্ষকদের সংসার চলত ধার দেনা করে।

একেতো বেতন খুব খুব কম, তার ওপর নিয়মিত বেতন না দেওয়া। বেতন চাইতে গেলেই শিক্ষকদের একগাদা দোষ ত্রুটি বৃহৎ বর্ণনা নিয়ে বসেন। সাধারণ শিক্ষক বেচারা কারো কাছে কিছু বলতেও পারে না, সইতেও পারে না । খাবারের কষ্ট তো আছেই। একজন তো প্রায় কেঁদে কেঁদে আমাকে বলছিল, ভাই ২৪ ঘন্টা মাদ্রাসায় থাকি, বাচ্চাদের পেছনে সময় দেই । বাচ্চারা কথা শোনে না । একটু শাসন করলে অভিভাবকরা এসে খারাপ ব্যবহার করে । মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ শাসিয়ে যায় । আবার শাসন না করলে বলে ওস্তাদ ভালো না । ভালো করে পড়াতে পারে না ইত্যাদি।

আরও পড়ুন-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেনো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো?

অভিভাবকদের খারাপ ব্যবহার, মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকদের অত্যাচার ও স্বেচ্ছাচারিতায় জর্জরিত হয়ে অনেক মাদ্রাসা শিক্ষক এখন শিক্ষকতার পেশা পরিবর্তন করে ভিন্ন পেশায় চলে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে উত্তরা থেকে বাসার কিছু মালামাল নিয়ে কিশোরগঞ্জ যাওয়ার জন্য একজন পিকআপ ড্রাইভার এর শরণাপন্ন হয়েছিলাম। পিকআপ ড্রাইভার এর মুখে সুন্নতি দাড়ি সুন্নতি লেবাস মাথায় টুপি দেখে বললাম “মাশাআল্লাহ।”

যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম, “কি ভাই? মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন তো এই লাইনে কেন?” উনি বললেন, “ভাই ব্যাপার কিছু না, আমি যাত্রাবাড়ি বড় মাদ্রাসা থেকে দাওরা পাশ করেছি। মসজিদ মাদ্রাসায় চাকরি করলে সংসার চালানো কঠিন হয়ে যায় । তাই এই পেশাকে বেছে নিয়েছি এবং আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।

তাছাড়া মাদ্রাসাগুলোর এখন যা অবস্থা এভাবে চাকরি করা যায় না । আত্মসম্মান মর্যাদা বোধ বিসর্জন দিয়ে চাকরি বা খেদমত কোনটাই আমি করতে চাই না। একটা ব্যাপার চিন্তা করে দেখেন ছাত্রদেরকে আদর্শবান মানুষ হিসেবে তৈরি করতে ওস্তাদগণ রাতদিন পরিশ্রম করেন এবং সময় দেন । দেখা যায় সাধারণ কোনো কারণেও অভিভাবকগণ খারাপ ব্যবহার করে ।

আর অভিযোগের তো কোন শেষ নেই; ছাত্র না পড়লে উস্তাদের দোষ । বাসায় গিয়ে দুষ্টুমি করলেও ওস্তাদের দোষ। তখন বলে ঠিক মতো শাসন করতে পারেন না । আবার একটু শাসন করলেও বলে, ‘পড়া পারলে পারুক না পারলে নাই, শাসন করা যাবে না ।’ এইসব অভিভাবকদের কারণে না হতে পারে ভালো হাফেজ, আলেম । না হতে পারে একজন ভালো মানুষ । এমনকি একজন ভালো সন্তান হয়ে উঠতে পারে না। এর পিছনের একমাত্র অভিভাবকদের একটা বড় অংশ দায়ী আর মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতা আর জুলুম তো আছেই ।

১২০০০ টাকা বেতন দিয়ে যেন একজন শিক্ষককে কিনে নেয় । রাত দিন ২৪ ঘন্টা ডিউটি করাতে চায়। ওদের কাছে চাকরি নেওয়া মানেই জিম্মি হয়ে যাওয়া । এসব দিক বিবেচনা করে পেশা পরিবর্তন করে এই পেশায় চলে এসেছি এবং হালাল ভাবে রুজি করছি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।”

আরও পড়ুন-বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার সামগ্রিক ভাবনা

আমার মতে উনার কথা যথার্থ এবং সঠিক। পৃথিবীতে শিক্ষকরাই একমাত্র মানুষ যিনি অন্যের সন্তানের জন্য রাত দিন পরিশ্রম করে । নিজের পরিবার পরিজনকেও সঠিকভাবে সময় দিতে পারে না। পৃথিবীতে দুই শ্রেণীর মানুষ অন্যের সফলতায় গর্ববোধ করে। প্রথম হচ্ছে বাবা মা দ্বিতীয়ত হচ্ছে শিক্ষক। পৃথিবীতে বাবা-মায়ের পরে শিক্ষকই হচ্ছে এমন একজন মানুষ যে কিনা অন্যের সন্তানের সফলতায় নিজে গর্ববোধ করে এবং অতিশয় আনন্দিত হয়।

শিক্ষকতায় প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত সফলতার সহিত সাত বছর অতিক্রম করেছি। এই দীর্ঘ পথ চলায় অনেক কিছুর সাক্ষী হয়েছি । নিজের চোখে অনেক শিক্ষককে মাজলুম হতে দেখেছি । জুলুমের শিকার হয়ে অনেক যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষককে পেশা পরিবর্তন করতে দেখেছি। আজও অনেক বন্ধুবান্ধবদের দুরাবস্থার খবর পাই।

অন্য কিছু বন্ধুবান্ধব যারা শিক্ষকতার সাথে জড়িত ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করে আর বলে, “ভাই শিক্ষকতা আর ভালো লাগে না প্রধান শিক্ষক আমাদেরকে ২৪ ঘন্টা মাদ্রাসায় আটকে রাখেন । বিকেলেও বের হতে দেন না। মাদ্রাসায় নিম্নমানের খাবার খেতে না পেরে দিনের পর দিন না খেয়ে থাকি । সকালে খেলে দুপুরে খেতে পারি না । দুপুরে খেলে রাতে খেতে পারি না । প্রধান শিক্ষক এসে একবারও খোঁজখবর নেয় না কেমন আছি কি খাচ্ছি । অথচ নিজের বাসায় সব সময় ভালো ভালো খাবার রান্না হয় । তারা সব সময় ভালো মন্দ খায়, আর মাদ্রাসায় এসে ইস্লাহি বয়ান করে খাবারের মান নিয়ে ।  আলোচনা করে খাবারের দোষ না ধরতে বলেন এবং মোটিভেশন দেয়  । অথচ নিজের ঘরে ভালো ভালো খাবার রান্না হয়। সাধারণ শিক্ষক বেচারা অপারগ । প্রধান শিক্ষকের পক্ষ হতে জারি হওয়া সকল আইন-কানুন মানতে বাধ্য । যখন কেউ কোন আদেশ অমান্য করবে পরের দিনই তার চাকরি শেষ।

আরও পড়ুন- স্কুল কি শুধু পুঁথিগত বিদ্যার জন্য ?

এক বড় ভাই বলছিল, “তার মাদ্রাসায় একজন হিফজ টিচার আছেন। দশ বছর ধরে যার সন্তানাদি হয় না। দশ বছর অপেক্ষার পর আল্লাহ তায়ালা ওনার কোলজুড়ে একজন কন্যা সন্তান দান করেছেন। কন্যা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার খবর পেয়ে উনাকে বললাম, আপনি ছুটি নিয়ে বাড়ি যান। দশ বছর পর আপনার মেয়ে হয়েছে আপনি ছুটি নিয়ে বাড়ি যান এবং আনন্দ করেন মেয়ের মুখ দেখে আসেন।’ উত্তরে ওই ওস্তাদ বলেন, ‘এখন ছুটি নিয়ে যাওয়া যাবে না । কারণ সামনে ছাত্রদের হফফাজুল কুরআন এর প্রতিযোগিতা । এখন ছুটি নিয়ে বাড়ি গেলে ছাত্রদের পড়াশোনার ক্ষতি হবে।’

কতটুকু দায়িত্ব নিয়ে কাজ করলে একজন শিক্ষক এমন হতে পারেন। এত ত্যাগের পরও এই  শিক্ষকরা মাস শেষে তাদের প্রাপ্য সম্মান এবং বেতনটা পান না। বেতন হিসেবে যে অল্প টাকা ধার্য করা থাকে, তাও মাসের পর মাস বাকি রেখে দেয় এবং ভেঙ্গে ভেঙ্গে বেতন দেয় । এমন হাজারো ঘটনার নিরব সাক্ষী হয়ে খালেছ মনে কাজ করে যাচ্ছেন অনেক মাদ্রাসা শিক্ষক। একদল শিক্ষক আরেক দল শিক্ষকের উপর এই অবিচার,অত্যাচার অনিয়ম চালাচ্ছে  যা মেনে নেয়া সত্যিই অনেক কঠিন !

লেখকঃ কবি ও মাদ্রাসা শিক্ষক

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়ন মূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিয়ে ফেসবুকে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন।প্রিয় লেখক! আপনার  পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন